রাইমোনা, যমদুয়ার এইসব অরণ্যের নাম বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে নতুন নয়। বুদ্ধদেব গুহ'র বনজঙ্গল সংক্রান্ত লেখায়, উপন্যাসে উঠে এসেছে জীববৈচিত্রে ভরা সেইসব বনের কথা। ২০২১ এর জুনে অসম সরকার এই এলাকায় রাজ্যের ষষ্ঠ ন্যাশানাল পার্কটির ঘোষনা করল বোড়োল্যান্ড স্বয়ংশাসিত অঞ্চলের অন্তর্গত কোকরাঝাড় জেলায়। হাতির দলের জন্য বিখ্যাত এই অরণ্যে বাস আরো সব দুর্লভ প্রাণী ও নানারকম প্রজাপতির। লিখলেন বিকাশ কুমার ভট্টাচার্য্য ও জ্যোতির্ময় সাহারিয়া।
নিজের লেখা শিকার কাহিনী Thirty-Seven Years of Big Game Shooting এ কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর লিখেছেন ১৯০০ সালে মাত্র কযেক দিনের শিকার অভিযানে তার শিকার বাহিনী ১১টি বাঘ, ১১টি লেপার্ড, একটি গণ্ডার, তিনটি ওয়াটার বাফেলো(জংলি মহিষ), একটি গাউর,দুটি সম্বর হরিণ, তিনটি হগ ডিয়ার ও তিনটি বরাহ শিকার করেছিল ভুটান পাহাড়ের পাদদেশে সরলভাঙ্গা নদীর পাড়ের জঙ্গলে।
জীববৈচিত্রে ভরা এই অরণ্য এখন অসমের রাইমোনা ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত। একদা বিজনি রাজ্যের রাজধানী রাইমোনার নামে এই ন্যাশনাল পার্কের ঘোষণা হয়েছে ২০২১ সালের জুন মাসে। টানা ৪২২ বর্গকিলোমিটার অরণ্যকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার মধ্যে রিপু সংরক্ষিত বনাঞ্চলের উত্তরভাগ পড়েছে। এই বনাঞ্চল জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ উত্তর-পূর্ব ভারতের মানস টাইগার রিজার্ভের পশ্চিমাঞ্চলের বাফার এলাকা আসলে।
হাতিদের বাসভূমি হিসাবে সুপরিচিত এই এলাকায় ২০০৩ সালে অসম সরকার ২৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে চিরাং-রিপু এলিফেন্ট রিজার্ভের ঘোষণা করেছিল। এই নতুন ঘোষিত জাতীয় উদ্যান, মানস জাতীয় উদ্যানের সাথে মিলে হাতিদের চলাচলের এক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পশ্চিমবঙ্গ, ভুটান ও অরুণাচল প্রদেশের সীমানার এপার-ওপারে।
রাইমোনার প্রবাদপ্রতিম হাতির দল
১৯৮১ সালে অসম সরকারের হাতিসুমারিতে রাইমোনার বনাঞ্চল সহ মানস টাইগার রিজার্ভের ২৮৩৭ বর্গ কিমি এলাকায় ১২০০ হাতি মিলেছিল।
এই এলাকার হাতিদের নিয়ে কম কিংবদন্তি নেই। এমনকি জনপ্রিয় সাহিত্যের পাতাতেও তা জায়গা পেয়েছে।স্হানীয় উপকথায় একজন সাদা শাড়ি পড়া নারীর কথা জানা যায় যিনি এই এলাকার সবথেকে বড় হাতির দলকে পরিচালনা করতেন। বনকর্মী ও স্হানীয় মানুষদের কাছে এই 'পাগলি সাহান' কে দেখতে পাওয়ার কথা শোনা যায়। ব্রিটিশ লেখক গর্ডন ক্যাসারি তাঁর উপন্যাস The Elephant God ও The Jungle Girl-এ এইসব উপকথার অনেক কিছু ব্যবহার করেছেন। লেখক গনেশ দাস তাঁর বই 'মানস, মানুলা আরু ত্রিমূর্তি" তে সেইসব বনকর্মীদের কথা লিখেছেন যারা এই 'পাগলি সাহান' কে দেখেছেন বলে দাবি করেন। এই জনশ্রুতিকে ভিত্তি করে ২০১৯ সালে একটি উপন্যাস প্রকাশ পেয়েছে যার নাম The Elephant Girl।
এই কিংবদন্তীতুল্য হাতিরা আজ বিপদের মুখে তাদের বাসস্হান নষ্ট হয়ে যাওয়ায়। স্হানীয় সংস্হা আরণ্যকের ২০১১ সালে করা একটি গবেষণা পত্রে দেখা গেছে মানুষের বিবিধ কর্মকান্ডের জন্য হাতিদের বাসস্হান ভাগ হয়ে গেছে। গবেষণাটির অন্যতম লেখক জ্যোতি পি দাসের মতে," রাইমোনা ন্যাশনাল পার্কের ঘোষণা একটি সাধু উদ্যোগ। এতে হাতিদের বাসস্হান ধ্বংস হওয়া বন্ধ হবে।"
একটি বিপন্ন স্তন্যপায়ী, দুর্লভ প্রজাপতির দল ও স্থানীয় জীববৈচিত্র্য
হাতিই এখানকার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী নয়।রাইমোনা ন্যাশনাল পার্ক গোল্ডেন লাঙ্গুর(Trachypithecus geei) এর বাসস্হানও বটে। এই প্রাণী পৃথিবীর স্তন্যপায়ী জীবদের বিপন্নতার তালিকার একদম উপরের দিকে যাদের অসম ও ভুটানের জঙ্গলে পাওয়া যায়। ১৯৫৩ সালে প্রকৃতিবিদ E. P. Gee যমদুয়ারের প্রায়-চিরহরিৎ বনে এই প্রাণীদের প্রথম দেখেন। গোল্ডেন লাঙ্গুর বা সোনালি বাঁদরের ৮০ শতাংশই সুরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে বিভিন্ন অভয়ারণ্য ও সামাজিক বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। তাই ন্যাশনাল পার্কের ঘোষণা তাদের কিছুটা সুরক্ষা দেবে এইসব অরণ্যর কিছু কিছু অংশে।
কুশলবাবু ও তাঁর সহকর্মীদের ২০০৯ সালের একটি গবেষণাপত্রে তাঁরা ৮১টি প্রজাতির ৭৪৩১টি প্রজাপতির মৃত্যু নথিভুক্ত করেন এই স্হানে ২০০৭ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে মাত্র একটি বছরে। এই বনাঞ্চল এখন রাইমোনা ন্যাশনাল পার্কের অংশ হওয়ায় এখানে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ হলে প্রজাপতির মৃত্যুর ঘটনা কমবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
উল্টাপানি ও রিপু চিরাং অভয়ারণ্য যা এখন এই ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত, সেখানে কিছু দুর্লভ প্রজাপতির দেখা মেলে। কোকরাঝাড় বিজ্ঞান কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও প্রাণীবিদ কুশল চৌধুরী যিনি এই অঞ্চলের প্রজাপতি নিয়ে অনেকদিন কাজ করছেন, ২০১০ সালে দুটি দুর্লভ প্রজাপতিকে নথিভুক্ত করেছেন এই এলাকা থেকে। " একটি দুর্লভ প্রজাপতি প্রজাতি yellow-crested spangle (Papilio elephenor Doubleday) এর দেখা মেলে ২০০৯ সালে রিপু-চিরাং অভয়ারণ্যে একশ বছর পরে। এই অরণ্যে আমরা Lycaenidae বর্গভুক্ত অতি দুর্লভ একটি প্রজাপতি Moore’s Cupid Shijimia moorei কে পাই যা সাধারণত: চীন ও জাপানে দেখা যায়", চৌধুরী বলেন। ২০১০ সালে এদের খুঁজে পাওয়া নিয়ে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন তিনি।
এই প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ আরো জানান যে, রিপু-চিরাং বনের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তা কোকরাঝাড় থেকে সরলপাড়া গেছে তা প্রজাপতিদের মৃত্যু-উপত্যকা আসলে। কুশলবাবু ও তাঁর সহকর্মীদের ২০০৯ সালের একটি গবেষণাপত্রে তাঁরা ৮১টি প্রজাতির ৭৪৩১টি প্রজাপতির মৃত্যু নথিভুক্ত করেন এই স্হানে ২০০৭ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে মাত্র একটি বছরে। এই বনাঞ্চল এখন রাইমোনা ন্যাশনাল পার্কের অংশ হওয়ায় এখানে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ হলে প্রজাপতির মৃত্যুর ঘটনা কমবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
১৫০ এর ওপর প্রজাপতির প্রজাতি, বাঘ, ক্লাউডেড লেপার্ড, গাউর, চিতল হরিণ ছাড়াও রাইমোনা পাখিদের জীববৈচিত্রের দিক থেকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্হান BirdLife International এর ঘোষণা অনুযায়ী।
একটি আন্ত:সীমান্ত প্রাকৃতিক অঞ্চল
এই প্রাকৃতিক ভূভাগকে জীবজগতের যাতায়াতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বলে চিহ্নিত করে অসম বন বিভাগ একটি বিবৃতিতে জানায় যে, রাইমোনা অরণ্য প্রাণীজগতের হিমালয়, ইন্দো-চীনা ও ইন্দো-মালয় অঞ্চল থেকে পশ্চিমের দিকে যেতে এবং ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে পূর্বের দিকে যেতে যে যাতায়াতের পথ তার অংশ স্বরূপ। এই নতুন ঘোষণা হওয়া জাতীয় উদ্যান ২৪০০ বর্গ কিমি আন্ত:সীমান্ত সংরক্ষিত ভূভাগের অংশ যা বিস্তৃত হয়েছে ভুটানের ফিবসু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও জিগমে সিংগে ওয়াংচুক জাতীয় উদ্যানে।
মানস জাতীয় উদ্যানে ২০১৮ সালে করা ক্যামেরা ট্র্যাপ পর্যবেক্ষণে এটা দেখা গেছে বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণে আন্ত:সীমান্ত ব্যবস্হাপনা খুবই কার্যকরী মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘাত ও অন্যান্য সমস্যার সমাধানে। অসম ও ভুটানে বনবিভাগ মানস জাতীয় উদ্যান ও রয়াল মানস জাতীয় উদ্যান মিলিয়ে আন্ত:সীমান্ত বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য "আন্ত:সীমান্ত মানস সংরক্ষিত এলাকা" গড়ে তুলেছে। বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে রাইমোনা ন্যাশনাল পার্কের ঘোষণা এই ব্যবস্হাকেই আরো সংগঠিত করবে। Wildlife Trust of India (WTI) এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক বিবেক মেননের মতে," যেহেতু রাইমোনা ভুটানের ফিবসো ও নামগিয়াল ওয়াংচুক জাতীয় উদ্যানের সাথে যুক্ত, তাই আন্ত:সীমান্ত একটি উদ্যানের সম্ভাবনা আছে এখানে"।
ইকোট্যুরিজমের সম্ভাবনা
অসমের এই ষষ্ঠ জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠা পশ্চিম অসমে পর্যটন সম্ভাবনা বৃদ্ধির পক্ষে আশাপ্রদ, যেখানে পর্যটক তুলনামূলক কম আসে। কুশল চৌধুরীর মতে, প্রজাপতির বিপুল বৈচিত্র্য এই এলাকায় পর্যটক আকর্ষণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।যদিও পর্যটনের জন্য এই জীববৈচিত্রের ওপর কোন খারাপ প্রভাব না পড়ে সেদিকেও নজর রাখতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বনের সীমানায় বাস করা স্হানীয় মানুষজন বনের ওপর নির্ভর করে খাদ্য, জ্বালানি, পশুপালন, ভেষজ ঔষধ, বাড়ি তৈরির নির্মাণ সামগ্রীর জন্য। স্হানীয় কিছু লোক মনে করছেন রাইমোনাকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা তাদের বনে যাতায়াতের অধিকারে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। তবে সরলপাড়া এলাকার স্হানীয় নেতৃস্হানীয় খামপা বসুমাতারি, যিনি একজন প্রাক্তন বোড়ো জঙ্গিও বটে, তাঁর মতে- জাতীয় উদ্যানের প্রতিষ্ঠা এখানে স্হানীয় মানুষজন ও ব্যবসায়ীদের জন্য ইকো টুরিজমের দিক থেকে কাজের সুযোগসুবিধা বাড়াবে।
মূল প্রবন্ধটি Mongabay পত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2021/11/the-birth-of-raimona-assams-sixth-national-park/
Comments