top of page
..

আন্ডারডগদের কথা: ঢোল-কাহিনী

ভারতের বনে ছড়িয়ে রয়েছে বাঘ, লেপার্ড, সিংহ, হাতি ছাড়াও আরও বিবিধ রকমের বন্যপ্রাণী। বাঘ-সিংহের লাইম লাইটে তারা আসতে পারে না। তবু বাস্তুতন্ত্রে, জীববৈচিত্রের ভারসাম্যে তারা কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনই একটি প্রাণী ঢোল।অসম্ভব হিংস্র, যূথবদ্ধ শিকারী ঢোলেদের সম্পর্কে জানা-অজানা খবর নিয়ে কলম ধরলেন সুমন্ত ভট্টাচার্য্য



জঙ্গলি লাল কুকুর ঢোল ছবি: Davidvraju, CC BY-SA 4.0



পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্কের সবুজে তখন এক নভেম্বরের কুয়াশা-মাখা সকালের আমেজ ভেদ করে এসে পড়ছে সোনালি রোদ।আমাদের জিপসিটা হালকা করে সবুজ বনপথের একটা মোড়ে দাড় করিয়ে গাইড কান পাতলেন জঙ্গলের ভেতরে। সবাই এখন একটু 'রিল্যাক্সড' হয়ে আছে সকাল সকাল জঙ্গল সাফারিতে বাঘ মামার দর্শন পেয়ে যাবার পর।আমরাও এদিক ওদিক হালকা চালে চলেছি আরো কিছু উপরি পাওনার আশায়।বন মানে তো শুধু বাঘ নয়। একটা টাইগার রিজার্ভ আরও হাজার রকম পশু, পাখি ও পতঙ্গের আশ্রয় স্থল। হঠাৎদাড়িয়ে পড়ে গাইড জঙ্গলেরএকদিকে আঙ্গুল নির্দেশ করলেন- "দেখিয়ে স্যার জি, ঢোল কা ঝুন্ড"! তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলাম। ঢোল!! যাদের দেখার আকর্ষণ আমার কাছে বাঘ দেখার থেকে কোন অংশে কম না! মধ্য ভারতের জঙ্গলে এসে ঢোল না দেখে চলে যাওয়া তো এক বিরাট অপ্রাপ্তি। এই সেই ঢোল! যাদের হিংস্রতার কথা কিপলিং এর 'দ্য জঙ্গল বুক' থেকে কেনেথ অ্যান্ডারসনের শিকার কাহিনীতে মিথের পর্যায়ে চলে গেছে।সেই জঙ্গলি কুকুরদের আবাস তো এখন এসে ঠেকেছে এই মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের জঙ্গলেই শুধু। ওই তো এক দল ঢোল সবুজ জঙ্গলের মধ্যে সকালের রোদে আয়েশ করছে।হাঁটছে, হালকা চালে কেউ দৌড়চ্ছে, কেউ বা শুয়ে আদর করছে দলের অন্য সদস্যকে। না জানা থাকলে কুকুর বা শিয়াল বলেও ভুলকরে ফেলতে পারে কেউ।


জঙ্গলের গভীরে ঢোলের দল। ছবি: লেখক।

ঢোল হল স্তন্যপায়ীগোত্রের কুকুরেরই নিকটাত্মীয়। বিজ্ঞানসম্মতনাম Cuon alpinus। এই Wild canid গোত্রের প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে গোল্ডেন জ্যাকল বা শেয়ালের বিভিন্ন প্রজাতি যেমন- গোল্ডেন জ্যাকল, ডেসার্ট ফক্স, ইন্ডিয়ান ফক্স, রেড ফক্স, টিবেটান ফক্স আবার নেকড়ে প্রজাতির ইন্ডিয়ান গ্রে উলফ্ আর টিবেটান উলফ্। এই গোত্রের প্রাণীরা সারা দেশেই পাহাড় থেকে সমতলে বা অরণ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও, সংরক্ষণ ও বন্যজীব চর্চায় তারা যেন অনেকটাই পিছনে পড়ে আছে বাঘ বা লেপার্ডদের তুলনায়। অথচ এরাও আমাদের দেশের অসাধারণ জীববৈচিত্রের সম্ভারে প্রকৃতির অবিস্মরণীয় দান। এদের মধ্যে ঢোলের বাসস্হান সাধারণত: বনের অন্তরালে। একটা সময়ে এই বুনো কুকুরদের পাওয়া যেত গোটা এশিয়া, ইওরোপ আর উত্তর আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে। কালের বিবর্তনে ১২ থেকে ১৮হাজার বছর আগেই তারা বাকি সব জায়গা থেকে লুপ্ত হয়ে শুধু এশিয়ার কিছু কিছু জায়গায় টিকে রয়েছে।তাই ঢোলের অন্য নাম Asiatic Wild Dog। আমাদের দেশ ভারত এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি সংখ্যক ঢোলের আবাসভূমি।

লাল শরীরে সাদা বুক, পেট ,গলা। কালো, ফোলা ল্যাজের বাহার। ছবি: লেখক।

গোল্ডেন জ্যাকল। এদের আবাস মূলত: ঝোপঝাড়, তৃণভূমি। ছবি: লেখক।
এদের দেখতে এত একরকম হয় যে , কোন এলাকায় তাদের সঠিক সংখ্যা গণনা করা শক্ত। এমনকি পুরুষ ও মহিলা আলাদা করাও সহজ নয় ক্যামেরা ট্র্যাপের ছবিতে।

ইন্ডিয়ান গ্রে উলফ। খোলা প্রান্তর এদের পছন্দ। ছবি: লেখক।

Wild Canid গোষ্ঠীর অন্যান্য প্রাণীদের মত ঢোলেরাও গন্ধশুঁকে শিকারের সন্ধান করে, সঙ্গীদের খোঁজে, বিপদের আঁচ করে। দেখতে শিয়ালের মত হলেও তারা আকারে মাঝারি কুকুরের মত। ওজনে এরা ১২-১৮ কেজি হয়ে থাকে। লম্বায় প্রায় ৯০ সেন্টিমিটার।লালচে-খয়েরি লোমশ চামড়ায় ঢাকা ঢোলেদের গলা বা বুকের কাছটা হয় সাদা।আর তাদের ফোলানো, লোমশ, কালচে ল্যাজটি যেন তাদের সৌন্দর্যের আসল রহস্য। এদের দেখতে এত একরকম হয় যে , কোন এলাকায় তাদের সঠিক সংখ্যা গণনা করা শক্ত। এমনকি পুরুষ ও মহিলা আলাদা করাও সহজ নয় ক্যামেরা ট্র্যাপের ছবিতে। ঢোলেরা দলবদ্ধ শিকারি।তাদের এক একটা দলে ২-৩০ টি ঢোল থাকতে পারে। আমি নিজে যেমন ঢোলের বড় দল দেখেছি অরণ্যে, তেমনি দু'টো ঢোল- পুরুষও নারীর দলও দেখেছি। ঢোলেদের দলে একটি করে পুরুষ ও নারী থাকে যাদের আলফা বলে চিহ্নিত করা হয়, এদের কাজ মূলত বাচ্চার জন্ম দিয়ে দল বাড়ানো। দলের বাকিরা এদের ঘিরে রাখে, শিকার করে, বাচ্চাদের দেখভালও করে। ঢোলেদের দলের মধ্যে অদ্ভুত দৃঢ় সামাজিক বন্ধন দেখা যায়।অবসরে তারা নিজেরা খেলা করে, পরস্পরকে আদর করে, বাচ্চাদের যত্ন নেয়।অক্টোবর থেকে জানুয়ারি হল ওদের প্রজনন ঋতু। তবে ঢোলের দলে কোন বাচ্চা বড় হলে স্বেচ্ছায় অন্য কোন দলে চলে যেতে পারে। ক্যানিড গোষ্ঠীর অন্য প্রাণীদের মতএক্ষেত্রে বিরোধ-লড়াইয়ের কোন ঘটনা ঘটে না।একটি ঢোলের জঙ্গলে স্বাভাবিক আয়ু প্রায় ১০ বছর। ঘন্টায় প্রায় ৪৫ মাইল বেগে এরা দৌড়াতে পারে।ঢোলের দল বনের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত চলাচল করে।খাদ্যের চাহিদা ও বাঘের মত বড় জন্তুর কারণে তাদের ঘন ঘন জায়গা পাল্টাতে হয়। ক্রান্তীয়(tropical) বা নাতিশীতোষ্ণ(temperate) বনগুলি এদের আবাসস্থল। মূলত: ঘন বন বা ঘনঝোপ-জঙ্গলে এরা থাকতে পছন্দ করে, পাহাড়ে বা সমতলে।ঘাসবনের মত উন্মুক্ত প্রান্তর বা লোকালয়ের নৈকট্য অবশ্য তাদের পছন্দের জায়গা নয়। এছাড়াও দেখা গেছে, মূলত দক্ষিণ ভারতে চাষাবাদের জন্য যে কফির বাণিজ্যিক বনাঞ্চল গড়ে উঠেছে, সেগুলোও এদের সাময়িক আশ্রয় হিসাবে কাজ করে।


এমনকি লেপার্ডকেও ঢোলের দলের হাতে আক্রান্ত হতে বা ঢোলের দলের ভয়ে নিজের শিকার করা জন্তু ফেলে পালাতে দেখা গেছে।

আদর। ঢোল পরিবার। ছবি: Kandukuru Nagarjun CC BY 2.0

ঢোলেদের শিকার করার ধরনের বিষয়ে কিছু বলতেই হয়। ঢোলেরা দলবদ্ধ ভাবে শিকার করে।মূলত: দিনের বেলায়। একদল শিকারকে পিছন থেকে তাড়া করে। কেউ কেউ সমান্তরালে এগিয়ে গিয়ে তার গতি রোধ করে।শিষ দেবার মত বা আর্তনাদ করে কান্নার মত চিৎকার করে জঙ্গলে এগিয়ে চলে তারা। মাঝারি কুকুরের আকারের প্রাণীরা অল্পসময়েই ধরাশায়ী করে ফেলতে পারে সম্বার হরিণ, চিতল, গাউড় বা বাইসন, মিথুনের মত বড় প্রাণীদের।প্রিয় খাবার তাদের সম্বার ওচিতল হরিণ। এছাড়াও বুনো শুয়োর, বুনো মোষ, নীলগাই, খরগোশ, হিমালয়ের মেঠোইঁদুর, বাঁদর- এরাও তার খাদ্য তালিকায় থাকে। এমনকি লেপার্ডকেও ঢোলের দলের হাতে আক্রান্ত হতে বা ঢোলের দলের ভয়ে নিজের শিকার করা জন্তু ফেলে পালাতে দেখা গেছে। ঢোলেরা চেষ্টা করে শিকারকে জলে বা কাদায় নিয়ে গিয়ে তার পালানোর পথ বন্ধ করে দিতে। বাঘ বা লেপার্ডের মত গলায় কামড়ে ধরে তারা শিকার করেনা। বরং সবাই মিলে জীবন্ত শিকারকে কামড়ে খেয়ে নিতে থাকে। কখনও শিকারের চোখে কামড়ে ধরে তাকে অন্ধও করে দেয়। তাদের এই স্বভাবের কারণ আসলে তাদের ছোট চোয়াল, যার ফলে কামড় দিয়ে তারা কোন বড় জন্তুকে মেরে ফেলতে অক্ষম। ঢোলেদের বলা হয় hypercarnivour, যেহেতু ওদের খাদ্যের প্রায় সবটাই মাংস।চার সেকেন্ডে এক কিলো মাংস খেয়ে নিতে পারে।কোন বনাঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে শিকার থাকার দরকার তাদের টিকে থাকার জন্য। তাই কোন জায়গায় ঢোলের দলের অস্তিত্ব সেই বনের খাদ্য-শৃঙ্খলের প্রাচুর্য প্রমাণ করে।

বন্দীপুরে সম্বর শিকার। ছবি:Yathin S Krishnappa, CC BY-SA 3.0

ঢোলের শিকার করা ও খাওয়ার এই ধরনই হয়ত প্রাচীন কাল থেকে ওদের সম্পর্কে ভীতির সৃষ্টি করেছে। রুডিয়ার্ড কিপলিং এর জঙ্গল বুকে সিওনীর অরণ্যে নেকড়ে থেকে হাতির দল, মোগলি থেকে শের খান সবাই ভয় পেয়ে চলত এই 'লাল কুকুর' দে'র। জন্ম নিয়েছে মিথের যে- ঢোল যে পথে চলে, বাঘও এড়িয়ে চলে। কেনেথ আন্ডারসনের বইতে এমন এক ঘটনার উল্লেখও রয়েছে।

১৮০৭ সালে আঁকা তৈলচিত্রে ঢোলের দল কর্তৃক বাঘকে আক্রমণ

তাই এক সময়ে যথেচ্ছ মারা হয়েছে এই প্রাণীদের। এমনকি ব্রিটিশ সরকারের শিকারি ও মাংশাহারী প্রাণী সংহারের যে নীতি ছিল তার থেকে ঢোলেরাও বাদ পড়েনি।তারা মনে করতেন, ঢোলেদের কারণে বনে শিকার করার মত জন্তু কমে যাচ্ছে। একটা পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এইভাবে ঢোলেরা দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাদের পুরানো বাসস্থানের ৬০% এলাকা থেকেই হারিয়ে গেছে( Karanath et al. 2010)। এক সময়ে নির্বিচার হত্যায় যদিও রাশ পড়েছে ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণী আইন লাগু হবার পরে, কিন্তু ব্যাপক হারে বনভূমির হারিয়ে যাওয়া তাদের বাসস্থান ও এক বন থেকে অন্য বনে যাতায়াতের করিডর এলাকায় ব্যাপক সংকোচন ঘটিয়েছে।প্রতিহিংসাবশত: হত্যার ঘটনাও কিছু ঘটে, যদিও মধ্য বা দক্ষিণ ভারতে তা খুব একটা শোনা যায় না। এর কারণ ঢোলেরা সেখানে যথেষ্ট বন্যপ্রাণীকে খাবার হিসাবে পায়, তাই লোকালয়ে এসে গবাদি পশুহত্যার ঘটনা খুব কম। ঢোলেদের এখন মূলত: মধ্য, দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অরণ্যেই পাওয়া যায়।উত্তর-পূর্ব ভারতেও ঢোলেরা আছে কম সংখ্যায় , কিন্তু গবাদি পশু বাঁচাতে সেখানকার বাসিন্দারা ঢোলেদের বড় একটা অংশ কে মেরে ফেলেছে (Gopi et al. 2012, Lyngdoh et al. 2014)। আসলে এখানকার বনাঞ্চলগুলি, বিশেষত: অরুণাচল বা মেঘালয়ের মত এলাকায়- নির্বিচার শিকারের ফলে প্রায় বন্যপ্রাণীশূন্য। তাই ঢোলেদের খাবারের জন্য মিথুন নামক গবাদি পশুকে শিকার করতে হয়। এছাড়াও হিমালয়ের উচ্চ ভূমিতে সিকিম ও লাদাখে সম্প্রতি কিছু গবেষণা ঢোলেদের সন্ধান দিয়েছে( Bashir et al. 2014)। তাদের কিছু সংখ্যক উপস্থিতি আছে দুধওয়ার মত তরাই বনাঞ্চলেও।

ভারতে বর্তমানে ঢোলের বাসভূমি। গ্রাফিক্স: লেখক

ভারত ছাড়াও এশিয়াতে ঢোলের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে নেপাল, ভুটান, চীন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, লাওস, মায়ানমারের মত কিছু দেশে। এমনকি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাতেও ক্যামেরা ট্র্যাপে ঢোলের আনাগোনার ছবি ধরা পড়েছে।

ভারতে বর্তমানে বাঘ সংরক্ষণের সাফল্যের কারণে যেসব বনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে, সেখানে তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় ঢোলেরা পেরে উঠতে না পেরে যথেষ্ট সংখ্যায় টিকে থাকতে পারছে না।

যদিও সর্বত্রই ব্যাপক হারে বনভূমির ধ্বংস ও শিকার, হত্যার কারণে তাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে। এছাড়াও সাধারণ কুকুরের থেকেও তাদের মধ্যে রেবিস, ক্যানাইন ডিস্টেম্পার, পারভো ভাইরাস বা মাঙ্গের মত অসুখ ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু এরা দলবদ্ধ ভাবে থাকে, ফলত: তা দ্রুত একটা দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে একটি এলাকা থেকে তাদের সংখ্যা হঠাৎই অনেক কমে যেতে পারে। বিশিষ্ট সংরক্ষণবিদ ও ওয়াইল্ড-লাইফবায়োলজিস্ট, NTCA সদস্য ড: অনীশ অন্ধেরিয়ার সাথে কথাবার্তায় আর একটা দিক উঠে এল আমাদের কাছে। ভারতে বর্তমানে বাঘ সংরক্ষণের সাফল্যের কারণে যেসব বনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে, সেখানে তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় ঢোলেরা পেরে উঠতে না পেরে যথেষ্ট সংখ্যায় টিকে থাকতে পারছে না। এই কারণে তিনি যেসব টাইগার রিজার্ভে বাঘ সংরক্ষণ এখনও ততটা সাফল্যের মুখ দেখেনি , সেখানে ঢোলেদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখার মত জানালেন। এই প্রসঙ্গে সাতকোশিয়ার মত টাইগার রিজার্ভের উদাহরণ দেন তিনি।তবে এর সাথে এও জানান, যেখানে ঢোল থাকবে সেখানকার এলাকা বেশ বড়হতে হবে ও তারপ্রিয় খাদ্য সম্বার বা চিতলের যথেষ্ট উপস্হিতি থাকাদরকার। এমনটাই একটি গবেষণায় উঠে আসে (Bhandari A et al.) এই বছরে, যেখানে নাগারহোল ও তাড়োবা টাইগার রিজার্ভে তুলনামূলক পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে যে নাগারহোল- যেখানে বাঘের সংখ্যাও ঘনত্ব তুলনায় কম- সেখানে ঢোলেরা বড় দল করে রয়েছে। অপরপক্ষে বাঘের জন্য বিখ্যাত তাড়োবায় ঢোলেদের দলের সংখ্যা ছোট। এর জন্য গবেষকরা বাঘের উপস্হিতি বা অনুপস্হিতিতে খাদ্যের সুলভতা এবং বাঘের দ্বারা ঢোলেদের হত্যাকে কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন।

দলবদ্ধ ভোজন শিকার করা চিতল হরিণের। ছবি: Yathin S Krishnappa, CC BY-SA 3.0
IUCN এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এশিয়াতে ঢোলের সংখ্যা ৪,৫০০ থেকে ১০,৫০০'র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তার মধ্যে প্রজননে সক্ষম পরিণত ঢোলের সংখ্যা ৯৪৯ থেকে ২,২১৫ টি মাত্র।

IUCN (International Union for Conservation of Nature) ঢোলেদের ‘endangered’ বা বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। দেখতে একই রকম হওয়ায় ও জঙ্গলের এক অংশ থেকে অন্যত্র দ্রুত যাতায়াতের কারণে ঢোলেদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা দুরহ।কোন কোন এলাকায় তাদের সংখ্যা অসুখ বা অন্য কারণে হঠাৎ করে কমে যায়। ড: অন্ধেরিয়া জানান, "একসাথে দশটা বাচ্চা হলে ওদের সংখ্যা হঠাৎবেড়ে যায়। আবার অসুখে বা বাঘের আক্রমণে তাদের মৃত্যু হলে সংখ্যা হঠাৎ কমে যেতে পারে।" একমাত্র ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কিছু অংশে ড:অর্জুন শ্রীবৎসদের মত গবেষকরা ব্যাপক হারে পর্যবেক্ষণ করে ঢোলেদের সংখ্যা নিরূপণ করার কাজটি করেছেন। তাই IUCN এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এশিয়াতে ঢোলের সংখ্যা ৪,৫০০ থেকে ১০,৫০০'র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তার মধ্যে প্রজননে সক্ষম পরিণত ঢোলের সংখ্যা ৯৪৯ থেকে ২,২১৫ টি মাত্র। ২,৫০০ এর কম বলেই তা IUCN এর নিয়ম অনুযায়ী স্বভাবতই বিপন্ন তালিকায় চলে এসেছে। এবং এদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে বই বাড়ছে না।

একটি রোগাক্রান্ত ঢোল। ছবি: লেখক।


১৯৭২ সালের ওয়াইল্ড-লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট ভারতে ঢোলেদের আইনি সুরক্ষা দিয়েছে। তারা শিডিউল ২ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তাদের নিয়ে কোন বাণিজ্যিক কারবার নিষিদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনে।

বস্তুত:পক্ষে উত্তর-পূর্ব ভারতের ঢোলেরা, ভারতের ঢোলেদের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঢোলেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তাই ওই অংশে আরও বেশি করে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা প্রয়োজন বলে মত সব গবেষকদেরই।

ঢোলেরা পছন্দ করে ঘন বনে থাকতে। ক্যানিড গোত্রের অন্য প্রাণী যেমন শিয়াল বা নেকড়ের মত লোকালয়ের সান্নিধ্য তাদের পছন্দ নয়। তাই যেখানে সুরক্ষিত বন রয়েছে, রয়েছেযথেষ্ট খাবার মত শাকাহারী প্রাণী- সেখানে ঢোলেদের সংখ্যা কিছুটা বেশি। এমনকি উত্তর-পূর্ব ভারতে মিজোরামের ডাম্পা টাইগার রিজার্ভে প্রিয়া সিং, অর্জুন শ্রীবৎস ও ডি. ম্যাকডোনাল্ডের করা গবেষণায় দেখা গেছে সুরক্ষিত বন-সীমানা, যথেষ্ট খাদ্য ও বনরক্ষীর উপস্হিতি একটা বাসস্হান বা হ্যাবিটেটকে ঢোলের জন্য উপযোগী করে তোলে। বস্তুত:পক্ষে উত্তর-পূর্ব ভারতের ঢোলেরা, ভারতের ঢোলেদের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঢোলেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তাই ওই অংশে আরও বেশি করে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা প্রয়োজন বলে মত সব গবেষকদেরই। বর্তমানে গবেষণায় ঢোলেদের বিষ্ঠা'র থেকেডি এন এ নমুনা সংগ্রহ করে তাদের বিষয়ে জানার নতুন দিক খুলে গেছে। তাই আরও বেশি বনাঞ্চলে তাদের নিয়ে কাজের যেমন দরকার, তেমনি দরকার বনাঞ্চল বাঁচানোর। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মত দেশে তথাকথিত উন্নয়নমূলক কাজ ও শিল্পোদ্যোগের জন্য ব্যাপক বনভূমির সংকোচনের ফলে অন্যান্য বন্যজীবের সাথে ঢোলেদের সংখ্যায় ব্যাপক হ্রাস হয়েছে।ভারতেও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, হাইওয়ে, রেলপথের বিস্তারের সাথে সাথে বনগুলির সঙ্কোচন তো ঘটছেই, তারা একে অপরের থেকে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।তাই বাঘের মত এইসব জন্তুদেরও বাঁচতে হলে উন্নয়নের এই ধারনাকে অন্যভাবে হিসাবে রাখা দরকার।

দুজনের দল। বনপথ ওদের পছন্দের যাতায়াতের জন্য। ছবি: লেখক।

ঢোলের মত প্রাণীরা বাস্তুতন্ত্রে গভীর প্রভাব রাখে।মানুষের মধ্যে তাই সচেতনতার প্রসার দরকার সেই নিয়ে। আশির দশকে ভুটানে ঢোলের সংখ্যা ব্যাপক ভাবে কমে যায় মানুষের হাতে তাদের নির্বিচারহ ত্যার জন্য। এরপরে দেখা যায় সেখানে বুনোশূকরের উপদ্রব বেড়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।সেখানকার বাসিন্দারা ভুল বুঝতে পারেন। ঢোলেরহত্যা কমে। বাড়ে তাদের সংখ্যা। বুনোশূকরের চাষের ক্ষেতে হানা দেওয়াও কমে যায় তাদের সংখ্যা ঢোলেদের কারণে নিয়ন্ত্রণে আসায়।অপরদিকে গবাদি পশুর শিকারের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়াটাও যে ঢোলের মত প্রাণীদের হত্যা নিবারণে সাহায্য করে তার উদাহরণ নেপালের কাঞ্চনজঙ্ঘা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এখানে এই ব্যবস্থা নেওয়ায় ঢোলের হত্যা অনেক কমেছে স্থানীয় মানুষের হাতে।

দল। ছবি: Mike Prince from Bangalore, India, CC BY 2.0
ক্যানিড পরিবারের কোন প্রাণীকে ২০১৫ সালের থেকে আপনি যে কোন স্হানে দেখে থাকলে https://www.wildcanids.net ওয়েবসাইটে গিয়ে সেই তথ্য জানিয়ে এই গবেষণাকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।

ঢোল সহ ক্যানিড পরিবারের বন্যজীবদের সংরক্ষণে সার্বিক করুণ অবস্হার কথা মাথায় রেখে পাঁচজন গবেষক ২০১৮ সালে wildcanid india কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এঁরা হলেন অর্জুন শ্রীবৎস, ইরাবতী মাজগাঁওকার, সুষমা শর্মা, গিরিশ পাঞ্জাবি এবং প্রিয়া সিং। নিজেদের গবেষণা ছাড়াও এরা সচেতন নাগরিকদের দেওয়া তথ্যের ওপরেও ভরসা রাখছেন। ক্যানিড পরিবারের কোন প্রাণীকে ২০১৫ সালের থেকে আপনি যে কোন স্হানে দেখে থাকলে https://www.wildcanids.net ওয়েবসাইটে গিয়ে সেই তথ্য জানিয়ে এই গবেষণাকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। ঢোলের মত প্রাণীরা যেমন বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে জরুরি, তেমনি তাদের উপস্হিতি বনকে করে তোলে রঙিন ,বৈচিত্র্যময়। বাঘ বা লেপার্ড বা সিংহের পাশাপাশি তাদের সর্বোচ্চ সংখ্যায় উপস্হিতি ভারতের পক্ষে নিশ্চই গর্বের কারণ। সরকারও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণপন্হী সংগঠনগুলি এ বিষয়ে আরও সময় ও অর্থ ব্যয় করবে, সচেষ্ট হবে এটাই গবেষকদের আশা। আশায় বুক বেঁধে লেখা হল এই ছোট নিবন্ধটিও।



ছবি: লেখক।


তথ্যঋণ:


Srivathsa Arjun, Puri Mahi, Karanth Krithi K., Patel Imran and Kumar N. Samba 2019Examining human–carnivore interactions using a socio-ecological framework: sympatric wild canids in India as a case studyR. Soc. open sci.6182008182008.


Karanth KK, Nichols JD, Karanth KU, Hines JE, Christensen NL (2010) The shrinking ark: patterns of large mammal extinctions in India. Proc Biol Sci 277:1971–1979.


Srivathsa, A., Karanth, K.U., Kumar, N.S. et al. Insights from distribution dynamics inform strategies to conserve a dhole Cuon alpinus metapopulation in India. Sci Rep 9, 3081 (2019).


Srivathsa A, Karanth KK, Jathanna D, Kumar NS, Karanth KU (2014) On a Dhole Trail: Examining Ecological andAnthropogenic Correlates of Dhole Habitat Occupancy in the Western Ghats of India. PLoS ONE 9(6):e98803.


Singh, P., Srivathsa, A., & Macdonald, D. (2020). Conservation status of the dhole Cuon alpinus in north-east India, with a focus on Dampa Tiger Reserve, Mizoram. Oryx, 54(6), 873-877. doi:10.1017/S0030605319000255


Bhandari, A, Ghaskadbi, P, Nigam, P, Habib, B. Dhole pack size variation: Assessing the effect of Prey availability and Apex predator. Ecol Evol. 2021; 11: 4774– 4785.



লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।



















Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page