top of page
  • ..

ঋজুদার সঙ্গে আচানকমারে

তিনিই বাঙালীর কাছে আসল ঋজুদা। কখনও তিনিই লালসাহেব, সুকুমার, পৃথু ঘোষ, চারণ চ্যটার্জী বা অনন্য। তাদের সাথে সাথে এযুগের বাঙালী পাঠকের নতুন করে চেনা বনজোৎস্নার সৌন্দর্যকে। বা টোটাবাবু। হ্যাঁ, আচানকমারের সেই টোটাবাবু। যার হাত ধরে ছত্তিশগড় (সাবেক মধ্যপ্রদেশ)-এর এই আশ্চর্য মায়াবী অরণ্যের পরিচয় হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের। সেই বনেই লেখকের সাথে ভ্রমণের সুখস্মৃতি তাঁর দীর্ঘদিনের সফরসঙ্গী কৌশিক লাহিড়ী'র কলমে বনেপাহাড়ে'র পাতায়।


আচানকমারে একদিন: অমরকন্টকে বুদ্ধদেব গুহ।

বছর পঁচিশ আগের কথা।

আমরা সেবার গিয়েছি মধ্যপ্রদেশে।

আমরা মানে আমি, বিখ্যাত লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক সানি টাওয়ার্সের জয়ন্ত চ্যাটার্জি, আর ঋজুদা স্বয়ং!

মানে, বুদ্ধদেব গুহ।


আচানকমারের সেই পুরানো বনবাংলোর গেটের সামনে আমরা

নদীটার নাম মাট্টিনালা। লমনি বাংলোর পিছন দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। মাট্টিনালা পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কেঁওচি এগারো কিলোমিটার।

সেখান থেকে রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে সুহাগপুরে, SECL-এর কোলিয়ারিতে। আর কেঁওচির মোড় থেকে বাঁ দিকে একুশ কিলোমিটার দূরে অমরকণ্টক।

পথ গেছে কেঁওচির দিকে। ছবি: বনেপাহাড়ে।

মোড়ে কয়েকটি জেনারেটরের আলোয় উদ্ভাসিত ধাবা। পানের দোকান। মণিহারি দোকান। সাইকেল সারানোর দোকান। গাড়ির গ্যারেজ।

মিশ্র গন্ধ জায়গাটাতে। সবেচেয়ে বড় ধাবাটার নাম ‘হোটেল ধরমু’। তার বাইরে একটা সাইনবোর্ড কেঁওচি থেকে বিভিন্ন জায়গার দূরত্ব লেখা। অসমের নগাঁওতে, মনে পড়ল, ঠিক এরকম একটা সাইনবোর্ড দেখেছিলাম একটা হোটেলের বাইরে।

এখান থেকে বিলাসপুর ঠিক একশো কিলোমিটার।

দুর্‌গ দু’শো আটচল্লিশ কিলোমিটার। লাহিড়ীদের জ‌ন্য বিখ্যাত সেই চিরিমিরি একশো কুড়ি। লম্বা লিস্টির মধ্যে একাট নামে চোখ আটকে গেল। ‘মইহার’। সেই বাবা আলাউদ্দিন খানের মইহার। এখান থেকে তিনশো পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে।

গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে এলাম মাট্টিনালার ব্রিজটার উপর। একাদশীর কিশোরী চাঁদ ততক্ষণে সেখানে ‌নদীর জলে, সাদা বালিতে, পাথরে, জঙ্গলে, পাহাড়ে মেশাতে শুরু করেছে তুষ-জ্যোৎস্না।

নদী থেকে ছোট কটকটে ব্যাঙ ডাকছে। আকাশ বাতাস মথিত করে ডাকছে পিউ-কাঁহা।

দাদা গলা খুললেন।

একের পর এক গান।

সঙ্গের ফ্লাস্কে কফি ছিল। ধোঁয়া-ওঠা কফি খেতে খেতে সম্মিলিত গল্প, গান, হাসি।

লমনি বাংলোর সামনে কয়েকটি চিরপাইনের গাছ। তার তলায় একটা ছাউনি মতো করা—চবুতরা।

আমাদের ভারী পছন্দের জায়গা।


লামনিতে প্রাতঃরাশে আমরা

সেখানে চেয়ার পেতে বসে, টেবিলে পা তুলে আবার পিউ-কাঁহার আর্তি শোনা। সঙ্গে এসে মিশল গ্রামের দিক থেকে ভেসে আসা ধামসা আর গানের শব্দ।

চবুতারার ছাদের একটা ফুটো দিয়ে চাঁদ এসে পড়ল আমার মুখে। চুমু খেল কপালে। সরেও গেল একটু পরে।

মুহূর্তটা শুধু থেকে গেল চিরস্থায়ী হয়ে।

এর ঠিক পরেই দামা‌ল দরিয়ায় ভেসে যাওয়ার মুখড়া!

তার বিস্তার।

এই বাংলোতেই উঠেছি আমরা।


লামনি বনবাংলো তখন


চওড়া বারান্দা বাংলোটার তিনদিক ঘিরে। তার উপর চেয়ার পেতে শুরু হল গল্প, গান। শুধু আমরা তিনজনই। জয়ন্তদা, আমি আর দাদা স্বয়ং।

‘‘এটা শুনেছ? শোনো। ‘বসো মেরে ‌নয়না‌নো মে নন্দলালা’...’’

আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ওঁর ‘অনুমতির জন্যে’ উপন্যাসে পড়েছি, সেই অন্ধ-গায়ক সজ্জনবাবুর গান।

‘‘নবমী নিশি গো তুমি আজ যেন পোহায়ো না...’’

বৃষ্টির শব্দ, পাশের বৃষ্টি ভেজা কোটা-কেঁওচি রোড বেয়ে চলা ট্রাকের টায়ারের শব্দ, গান সব মিলে এক অসাধারণ পরিবেশ!

লামনিতে

‘‘... তখন কলকাতায় বোমা পড়েছে, বুঝলে, বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বাবা আমাদের রংপুরে পাঠিয়ে দিলেন... তা সেই তখন পোড়াদহ বলে একটা স্টেশন ছিল উত্তরবঙ্গে... গভীর রাতে ট্রেনের জানলার ধারে বসে আছি... তখন কতই বা বয়স— একটা পাগলা একটা গান গেয়েছিল আজও ম‌নে আছে, ‘পাগলা মনা, পাগলা মনা’..। সুর ভুলে গেছি, বাকি কথা ভুলে গেছি... তা, পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, না?

‘‘প্রাণ, তুমি প্রেম সিন্ধু হয়ে বিন্দুদানে কৃপণ হলে...’’

আশ্চর্য স্মৃতিকথায় পেয়েছে দাদাকে। তার আলাপের চলনই জানান দিচ্ছে, ঝড় উঠল বলে!

‘‘বড়ে গোলাম আলি যেই ‘সা’ বললেন, ব্যস, আমার বুকের মধ্যে যেন ছোরা বসে গেল...তা, এই হচ্ছে গান।

‘‘...সংস্কৃত, ঊর্দু, আরবি, ফারসি সব... আমাদের সমস্ত কালচারটা নষ্ট করে দিল সাহেবরা।

‘‘...জর্জদা, ওঃ! জর্জদার কোনও তুলনা হয় না।... ‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না...’

‘‘এই গানটা শুনেছ জয়ন্ত, ‘জানালার পাশে বসে আছি?’’

জয়ন্তদা এতক্ষণে কথা বললেন, ‘‘হ্যাঁ।’’

‘‘গাও।’’

‘‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি...’’

‘‘বাহ্‌, জয়ন্তর গলায় সুর তো চমৎকার...

‘‘গানের আসল ব্যাপার ‘ইনোভেশন’ বুঝলে, আর ‘ডিভোশন’

‘‘হোয়েন ঋতু সিংগস্‌, শি ইজ আ ডিফারেন্ট পার্সন, শি ইজ এলিভেটেড টু আ ডিফারেন্ট পেডেস্টাল ইনস্ট্যানটেনিয়সলি— যেন ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলে তখন...

‘‘এরা পরকে আপন করে...’’

গান তো নয়, এক একটা সুরে ভেজা শব্দ যেন এক একটা মুক্তোর দানা হয়ে ঝকঝক করে ভেসে উঠছে আকাশের গায়ে।

আয়েশি আলাপে লামনির বারান্দায়

‘‘আর, বাচ্চুদি (নীলিমা সেন), সেই ‘বন্ধু রহো রহো সাথে...’... এ আর হবে না, জানো...

‘‘চিরসখা হে... কিছুই তো হল ‌না... আহা! রাজেশ্বরী দত্ত, মনে আছে তো? ‘পিপাসা, হায় নাহি মিটিল...’’

ততক্ষণে ধাঁধাঁ লেগে গিয়েছে!

হাত-পায়ে সাড় কেড়ে নিয়েছে আশপাশে ছড়িয়ে পড়া এক আশ্চর্য মায়াজাল!

‘‘আচ্ছা, বলো তো, ‘মালকোষ’-এর ওপর ক’টা রবীন্দ্রসঙ্গীত জানো? এটা শুনেছ? ‘স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাব উড়িয়ে’।’’

স্তব্ধ হয়ে বসে আমরা। কথা শুকিয়ে গিয়েছে ভেতর থেকে।

‘‘শোনোনি? চিরকুমার সভা! সুরটা লক্ষ করো, ‘...আনন্দধারা বহিছে ভুবনে...’

গোলক-দ্যুলোক বিস্তৃত এক ইন্দ্রজাল! কোত্থেকে উদয় হল সে! এত নিথর, অবশ, অচঞ্চল করে দেওয়ার তার সীমাহীন ক্ষমতা!

টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলো চিরন্তন হয়ে গেল।

ছবি: বনেপাহাড়ে।

এখন অনেক রাত। ঘরে আস্তে করে চালিয়ে রেখেছি আমির খান। ‘যোগ’। এরপর ‘দরবারি’।

বিছানায় শুয়ে চুপ করে শুনছেন জয়ন্তদা। আর আপশোস করছেন, ‘ক্যাসেট’ আনেননি বলে।

জানলা দিয়ে দেখলাম, বাইরে আশ্চর্য মায়াবী নিশীথ। মেঘের ফাঁক চিরে চাঁদ বেরিয়ে আসছে একেকবার।

চারদিকটা কেমন যেন ছোটবেলার রূপকথার দেশ হয়ে যাচ্ছে...


সেই বারান্দা। ছবি: বনেপাহাড়ে।


লেখক পরিচিতি: লেখক কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক। একাধারে সাহিত্যকর্মী ও বাচিকশিল্পী।


বুদ্ধেদব গুহ ও লামনির পুরানো ছবি: লেখক।

লামনি ও আচানকমারের সাম্প্রতিক ছবি বনেপাহাড়ের সংগ্রহ থেকে।






551 views1 comment

1 Comment


Mousumi Banerjee
Mousumi Banerjee
Dec 05, 2021

অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বড় মায়াময় লেখা।

Like
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page