শহরের পর শহর জুড়ে বেড়ে চলেছে ঝাঁ-চকচকে বহুতল। সেজে উঠছে চকমকে কাঁচের সজ্জায়। কিন্তু পাখিদের জন্য ঘাতক হয়ে উঠছে এইসব কাঁচের জানালা-দরজা ওয়ালা বাড়ি। কিভাবে? সমাধানই বা কী? আলোচনায় স্হাপত্য বিশেষজ্ঞ রণিত মাইতি।
ই এম বাইপাস বা সেক্টর ফাইভে ঝকঝকে কাঁচের বাড়ি গুলো দেখলে একটা ভালো লাগা তৈরী হয় না ?নিজেদের একটা আন্তর্জাতিক মানের শহরের বাসিন্দা হিসেবে ভাবতে পারার মধ্যে একটা অন্য রকমের গর্ব অনুভব করা যায়। বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকেই কাঁচের দেয়াল ওয়ালা বহুতল বা সাধারণ নির্মাণ, সেটা অফিস ,শপিং মল, হাসপাতাল বা যাই হোক না কেন সারা বিশ্বেই ভীষণ জনপ্রিয়।গভীর ভাবে ভেবে দেখলে বেশ কিছু আপাত সুবিধে এই জনপ্ৰিয়তার মূল কারণ। চট জলদি ঝাঁ চকচকে বলতে আমরা যা বোঝাই,সেটা কাঁচের নির্মাণ দিয়ে সহজেই বোঝানো যায়,কিন্তু কাঁচের নির্মাণের সবচেয়ে সুবিধে হলো প্রাকৃতিক আলো (সূর্যের আলো) খুব সহজেই নির্মাণের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ,একই সাথে যারা নির্মাণের অভ্যন্তরে থাকে ,তাদের জন্যে বাইরের চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ । সূর্যের আলোর সাথে অনেকটা সূর্যের তাপ ও ঢুকে পড়ে।
পশ্চিমী ঠান্ডার দেশে ,এটা বড় সুবিধে। কিন্তু গ্রীষ্ম প্রধান জায়গায়, আধুনিক কাঁচের নির্মাণ এ সাধারণত এই তাপ বেরোনোর কোনো উপায় বা ব্যবস্থা থাকেনা।তাই গ্রীন হাউস তৈরী হয় । এই গ্রীন হাউস থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র।
১৯৪৭, ভারত যখন স্বাধীনতা পাচ্ছে,তখন আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সূচনা হলো.১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ র মধ্যে শেষ হলো নিউ ইয়র্ক দ্য ইউনাইটেড নেশনস সেক্রেটারিয়েট।একটা পুরো কাঁচের নির্মাণ সম্পূর্ণ ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করে ফেলার প্রথম উদাহরণ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি দরজা খুলে দিলো।কাঁচের বহুতল আর গরম থাকবেনা।হু হু করে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো এরকম নির্মাণ।গ্রীষ্ম প্রধান দেশ বা শহর যেমন দুবাই,সিডনি বা ভারতের বিভিন্ন শহরেও ছড়িয়ে পড়লো কাঁচের নির্মাণ!শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের কল্যানে।
এই কাঁচের নির্মাণের অনেক সুবিধে অসুবিধের মধ্যে আমরা আলোচনা করবো এমন একটা বিষয় নিয়ে যেটা বেশ আশ্চর্যজনক এবং আগে পর্যন্ত কল্পনাও করেনি কেউ ।
এই কাঁচের বহুতল মারাত্মক ভাবে ক্ষতি করলো পাখিদের।
উদ্বেগের কারণ
সংখ্যায় না বললে এই ক্ষতি বোঝানো যাবেনা।স্মিথসোনিয়ান গবেষনা করে বের করেন আমেরিকায় কাঁচের দেয়াল বা জানালায় ধাক্কা খেয়ে গড়ে ৫৯৯ মিলিয়ান পাখির মৃত্যু হয়। হ্যাঁ, সংখ্যাটা এতটাই ভয়াবহ। এবং এই পরিসংখ্যান ২০১৪ সাল এর । আজকের দিনে এই সংখ্যা নিশ্চিৎ ভাবে ১ বিলিয়ান ছুঁয়েছে। সারা পৃথিবীর সংখ্যা কোথায় গেছে ভাবলেও ভয় লাগে।
স্বাভাবিক ভাবেই ভারতবর্ষে খুব বেশি গবেষণা হয়নি এই বিষয় নিয়ে। স্টেট্ অফ বার্ডস ২০২০ বলছে, শিকারি পাখি (raptors), উপকূলে বিচরণকারী পরিযায়ী পাখি (migratory shorebirds) এবং পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় পাখিদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। সহেলি (Small Minivet), গোত্রা (Common Greenshank) কিংবা ঝুঁটিভরত (Oriental Skylark)-দের মতো পরিচিত পাখিদের সংখ্যাও রীতিমতো কমের দিকে।(এই সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অতি দ্রুত বেড়ে ওঠা কাঁচের দেওয়ালের বাড়ির কতখানি সম্পর্ক সেটা নিয়ে গবেষণার আশু প্রয়োজন।)
এখন প্রশ্ন হলো কাঁচের নির্মাণ পাখিদের প্রাণ কেন নিচ্ছে?
পাখিরা সাধারণত ৩০-৫০ কিমি প্রতি ঘন্টা বেগে ওড়ে,পরিযায়ী পাখিরা দিনে প্রায় ৫থেকে ৬ ঘন্টা উড়তে পারে,১৫০ মিটার উঁচুতে। কখনো বেশি। আর সমস্যা টা সেখানেই। সারা বিশ্বে বহুতল গুলো ১৫০ মিটার এর অনেক বেশি। ভারতের মতো দেশ পিছিয়ে থাকলেও দ্রুত এই আরো উঁচুর দৌড়ে নাম লিখিয়েছে। সমস্যা আরও বেড়েছে শহর জোড়া গ্লাস এর জঙ্গলে ছাদ বাগানের সবুজ। উড়ন্ত পাখিরা এই সবুজ ,আর কাঁচের দেয়ালে আকাশের প্রতিবিম্বে ধাক্কা খায়।
পাখিরা কাঁচের মধ্যে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ বুঝতে পারেনা। পাখিদের চোখ মানুষের মতো নয়. কাঁচ যদি স্বচ্ছ হয়, তাহলে পাখিরা কাঁচের পরে নির্মাণের অভ্যন্তর টিই বুঝতে পারে।কাঁচ নয়।
আর রাত্তিরে অভ্যন্তরের আলো পাখিদের আকৃষ্ট করে,কাঁচের দেয়াল যেন শুধু হত্যার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয় এই ক্ষেত্রে।ফলত: সংঘর্ষ এবং মৃত্যু।
সুপারিশ
কিন্তু পরিবেশবিদ এবং স্থপতিরা সমস্যাটা বুঝলেন।সব ক্ষেত্রে না হলেও পদক্ষেপ নেয়া শুরু হলো। কাঁচ এর সামনে স্ক্রিন ,গ্রিল,শাটার ,বারান্দার ব্যবহার শুরু হয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে।যেন পাখিরা বুঝতে পারে। ওপেক বা স্বচ্ছ নয় এরম কাঁচের ব্যবহার ও শুরু হয়েছে।
পাখিরা অতি বেগুনি রশ্মি দেখতে বা বুঝতে পারে।কিছু কাঁচের মধ্যে অতি বেগুনি রশ্মির ডিসাইন ঢুকিয়ে রাখা হচ্ছে,পাখিরা সতর্ক হবে,অথচ মানুষের চোখে পড়বেনা। বহুবিধ উপায় নিয়ে গবেষণা চলছে।ইউনিভার্সিটি অফ কুইন্সল্যান্ড "জেন্ কার্টেন " উদ্ভাবন করেছে।এটা দড়ির পর্দা র মতন.হাওয়ায় দোলে আর কাঁচের দেয়ালের ওপর আলোছায়ার নকশা তৈরী করে এই নকশা পাখিদের অপছন্দ। পাখিরা এই সব দেয়াল এড়িয়ে চলে।
আশাব্যঞ্জক খবর
চড়াই (House Sparrow) কিংবা ময়ূর (Indian Peafowl)-দের মতো বেশ কিছু পরিচিত পাখির পরিস্থিতি ভালোর দিকে।
আন্তর্জাতিক বিপদ তালিকার অর্ন্তভুক্ত কিছু পাখি, যেমন কাস্তেচরা (Black-headed Ibis), গয়ার (Oriental Darter)-দের অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল। আর এগুলো সম্ভব হয়েছে পক্ষী প্রেমী বা প্রকৃতি প্রেমী সাধারণ মানুষের জন্যে।সরকার বা নীতি নির্ধারক দের অবিলম্বে এগিয়ে আস্তে হবে। সাথে স্থপতি এবং বিল্ডারদের হতে হবে আর একটু অনুূভূতিশীল।
পাখিরা একটা শহর কে সুন্দর করে। শহর শুধু মানুষের কিন্তু নয়,আমাদের একটা দায়িত্ব আছে প্রকৃতির দেয়া পাখিদের ওড়ার জন্যে মুক্ত আকাশ টা মুক্তই রাখা ।
ছবি ঋণ : Yankech gary/ flicker.
unsplash.com
Austin Marshall/ flickr.
Piotr Panek/wikimedia.
লেখক পরিচিতি: লেখক কলকাতার একজন স্হাপত্যবিদ। স্কোয়ার কনসালটেন্সি সার্ভিসের পরিচালক।
Comments