top of page
..

কৃত্রিম পরিপূরক বনসৃজন কার্বনের আধার হিসাবে পুরানো অরণ্যের বিকল্প হতে পারে না

প্রাচীন সব অরণ্য কেটে ফেলা হচ্ছে পরিকাঠামো ও শিল্পোন্নায়নের জন্য। তার বিকল্প হিসাবে করা হচ্ছে পরিপূরক কৃত্রিম বনসৃজন। এদিকে ভারত রাষ্ট্রসংঘে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ২.৫-৩ গিগাটনের কার্বন ধারন করার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। তাই পরিপূরক বনসৃজন দরকার হয়ে পড়েছে ও তাতে জোর দিচ্ছে সরকার। কিন্তু তা কি সত্যিই কার্বন ধারন করার জন্য পুরানো পরিপূর্ণ অরণ্যের মত উপযোগী? কতটা সক্ষম তা জীববৈচিত্রের পক্ষে বা পরিবেশের অন্যান্য দাবি মেটাতে। আলোচনা করলেন সুপ্রিয়া ভোরা







সাম্প্রতিক কালে মুক্তি পাওয়া 'শেরনি' ছায়াছবিতে মধ্যপ্রদেশে বাঘের বাসস্থান এমন একটি অরণ্যের একটি জটিল পরিস্হিতি দেখানো হয়েছে, যেখানে ডি এফ ও বিদ্যা ভিনসেন্ট তাঁর ঊর্ধ্বতন পদাধিকারী বংশীলাল বনসালের মুখোমুখি হন এই সমস্যা নিয়ে যে, গ্রামবাসীদের সংরক্ষিত অরণ্যে তাদের গবাদি পশু চড়াতে যেতে হয়, কারণ তারা আগে যে জমিতে পশু চড়াত তা এখন বন দপ্তর সেগুনের বৃক্ষরোপণের জন্য অধিকার করে নিয়েছে। এতে বংশীলাল উত্তর দেন, "তো? আমরা প্রতি বছর অর্থ পেয়ে তাকি গাছ লাগানোর জন্য। সেগুলো আমাদের কোথাও তো লাগাতে হবে, আর এই জমিটাই এখানে সব থেকে উর্বর।" যখন বিদ্যা জিজ্ঞাসা করেন যে, গ্রামবাসীরা তাহলে কোথায় যাবেন, তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ওঠেন, "যেখানে পারে যাক। ওরা আমাদের মাথাব্যথা নয়।" সিনেমার ঘটনাটি নিছক কাহিনী হলেও, এই সব ঘটনা আসলে ভারতের অরণ্যের বাস্তব চিত্রটাকেই তুলে ধরেছে। এই 'বৃক্ষরোপণের জন্য অর্থ' হল সেই বস্তু যা ভারতীয় আইন অনুযায়ী Compensatory Afforestation Fund Management And Planning Authority (CAMPA) এর আওতায় আসে। সাধারণ জমিকে বৃক্ষরোপণের কাজে ব্যবহার করা নিয়ে এই কর্তৃপক্ষের সাথে মতবিরোধ এখন একটি জ্বলন্ত সমস্যা

বনসৃজনের সংজ্ঞা হল এমন কোন স্হানে বন তৈরি করা যেখানে এর আগে তা ছিল না। সার পৃথিবীতেই জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে লড়তে একে একটা পছন্দসই পন্হা হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। গাছ বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেয়, আর কোন বন যদি তার নির্গমন করা কার্বনের থেকে বেশি কার্বন শোষণ করে নেয় তবে তাকে কার্বনের আধার বা carbon sink বলে অভিহিত করা যেতে পারে।

বন-সৃজন দু'রকম হতে পারে। এক হল প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হওয়া বন যা গবেষণায় দেখা গেছে কার্বন শুষে নিতে বেশি কার্যকরী। আর এক হল রোপণ করা অরণ্য- যা সাধারণত এক রকমের ও একই বয়সের গাছ নিয়ে তৈরি। Global Forest Resource Assessment 2020 এর তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর ৩% অরণ্য বৃক্ষরোপণের ফলে তৈরি।

ভারতে বনসৃজনের একটা বড় পন্থা হল 'পরিপূরক বনসৃজন' যা আসলে Forest Conservation Act (1980) অনুযায়ী কোন বনভূমিকে অন্য কাজে ব্যবহার করার পরিবর্তে অন্যত্র বনসৃজন করা।

ভারতে ক্রমাগত প্রাকৃতিক বনভূমি হারিয়ে যাচ্ছে পরিকাঠামো ও শিল্পায়নের স্বার্থে। এদিকে রাষ্ট্রসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বানানো ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ২.৫-৩ বিলিয়ন টনের কারবন ডাই অক্সাইড ধারণ ক্ষমতা যুক্ত কার্বন আধার বা কার্বন সিঙ্ক বানাতে অঙ্গীকারবদ্ধ আরও বনসৃজন ও বৃক্ষরোপণ করে।

পরিপূরক বনসৃজন নীতি অনুযায়ী, যখন কোন বনভূমিকে কেটে ফেলা হয় কোন অন্য কাজের জন্য, তখন যারা সেটা করছে তাদের উপযুক্ত অর্থ দিতে হয় রাজ্যের বনদপ্তরকে অন্য কোন জমিতে সমান আয়তনের বনভূমি তৈরি করার জন্য অথবা কোন নষ্ট হয়ে যাওয়া দ্বিগুণ মাপের বনভূমিকে পরিপূর্ণ বনভূমিতে রূপান্তরিত করার জন্য। এই জমা হওয়া ক্ষতিপূরণ রাশির যথাযথ ব্যবহারের জন্য প্রতি রাজ্যেই CAMPA তৈরি করা হয়েছে যাতে পরিপূরক বনসৃজন যথাযথ ভাবে হয় তা পর্যবেক্ষণের জন্য। রাজ্যস্তরের CAMPA কে নজরে রাখে কেন্দ্রের National CAMPA Advisory Council।

CAMPA র অধীনে সময়ের সাথে সাথে জমা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার তহবিল। ২০১৬ সালে সরকার পরিপূরক বনসৃজন তহবিল ব্যবস্হাপনা নিয়ে Compensatory Afforestation Fund Management Bill পাশ করায়। এই নতুন নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্র সরকার এই তহবিল থেকে অর্থ রাজ্যগুলিকে প্রদান করবে তাদের রাজ্যে বনসৃজনের জন্য। এই বিল ও তার নানা ধারা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে।


পরিপূরক বনসৃজন কি আদৌ ভারতের কার্বন সিঙ্ক বাড়াচ্ছে?


২০১৯ সালের ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের ২৪.৫৬% এলাকা বনাঞ্চল। National Mission for Green India র পরিকল্পনা অনুযায়ী এই এলাকা বাড়িয়ে ৩৩ শতাংশ করার কথা ২০৩০ সালের মধ্যে। National Mission for Green India হল National Action Plan on Climate Change (NAPCC) এর অন্তর্ভুক্ত আটটি কার্যক্রমের একটি যেখানে বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ৫ মিলিয়ন হেক্টর চিহ্নিত অরণ্য ও চিহ্নিত করা অরণ্য বহিভূর্ত এলাকায়। এছাড়াও আরও ৫ মিলিয়ান হেক্টার জমিতে গাছের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে।

কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হবে যদি ক্রমাগত বনভূমিকে অন্য কাজের জন্য ধ্বংস করা হতে থাকে?

" আমরা একটা পুরানো অরণ্যকে কেটে ফেলব, এবং তারপরে বলব এই ঘন অরণ্যের অভাব অন্যত্র কিছু চারাগাছ রোপণ করে মিটিয়ে ফেলব," বললেন মানান ভান যিনি অরণ্য বিষয়ক গবেষক এবং ভিয়েনার University of Natural Resources and Life Sciences এ গবেষণা করছেন সোশাল ইকোলজি নিয়ে। "এই নতুন লাগানো গাছেরা কার্বনের আধার রূপে এবং অন্য বাস্তুতান্ত্রিক চাহিদা মেটাতে পুরানো স্বয়ংসম্পূর্ণ অরণ্যের অভাব পূরণ করতে অক্ষম," তিনি ব্যাখ্যা করলেন।


বন কেটে চাষাবাদের জন্য কৃত্রিম বনসৃজন। মহারাষ্ট্র। ছবি: Rohit N/ Wikimedia Commons

তিনি আরও বলেন, প্রতিটি রাজ্যেই নির্দিষ্ট কিছু গাছ লাগানোর সুপারাশি থাকে। উদাহরণ-স্বরূপ, উত্তরাখন্ড রাজ্য ২০১৯-২০ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী দেওদার,ওক, বাঁশ ও মালবেরি গাছের বৃক্ষরোপণ করেছে।প্রতি রাজ্যেরই এমন নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড আছে।বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত: সেগুন, বাঁশ ও ইউক্যালিপটাস হল পছন্দের গাছ।

" এর কিছু সমস্যা রয়েছে। কোন এলাকায় নতুন কোন বৃক্ষরোপণ পরিকল্পনায় যেসব গাছ বাছা হয় যখন তখন পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে এর বৃহত্তর প্রভাবের কথা ভাবা হয় না।" ভান জানালেন। একটি রিসার্চ পেপারে পরিপূরক বনসৃজন বিলের আলোচনায় তিনি বলেন, " কোন বন কেটে পরিপূরক হিসাবে অন্যত্র কৃত্রিমভাবে সেই এলাকার স্বাভাবিক উদ্ভিদ নয় এমন কোন গাছ লাগিয়ে বন ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয় এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য তা ক্ষতিকর"।

শরৎচন্দ্র লেলে একজন অরণ্য প্রশাসন নিয়ে গবেষক এবং অশোকা ট্রাস্ট ফর রিসার্চ এন্ড ইকোলজির Environmental Policy and Governance কমিটির বিশিষ্ট সদস্য। তাঁর মতে, সামাজিক ও বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্যের বিষয়গুলো জানাই আছে। "বিজ্ঞান বলে যে দ্রুত বাড়তে থাকা নতুন গাছ বেশি কার্বন ছাড়ে পরিবেশে। আর এরা অরণ্যের জল-ভারসাম্য ও জীববৈচিত্রের জন্যও অনেকসময় ক্ষতিকারক। গবেষণা এটাই বলে যে একধরনের গাছ দিয়ে বনসৃজন (monoculture plantation) কখনই একটা অরণ্যের জটিল জীববৈচিত্রের জন্য বিকল্প ব্যবস্হা হতে পারে না। সবকিছুকেই এই "অরণ্য" নামক একটা শব্দবন্ধ দিয়ে সূচিত করাটা সমস্যার, কারণ এই শব্দ এইসব ভারসাম্যের কথাকে প্রকাশ করার বদলে গোপন করতে সাহায্য করে," তিনি জানান।

ভান আরও জানান, "২০১৯ সালের ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের বনজ কার্বন আধার বৃদ্ধি পেয়েছে বলা হচ্ছে, যা দাঁড়িয়েছে এখন ৭১২৪ মেগাটন, সেখানে এই ব্যাপারটাই খতিয়ে দেখার সুযোগ কম যে এই বৃদ্ধি নতুন লাগানো বৃক্ষ থেকে হয়েছে না পুরানো অরণ্যের জন্য। তাছাড়া তাদের হিসাবই বলছে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যের থেকে পিছিয়ে আছি। এই বিষয়গুলিই উদ্বেগের"।

ভারতীয় সংসদের শেষ বাদল অধিবেশনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী শ্রী ভূপিন্দার যাদব রাজ্যসভাকে জানান যে "বন" নামক শব্দটির সংজ্ঞা এখনও সরকার নির্ধারণ করেনি। " 'বন' শব্দটি কোন কেন্দ্রীয় বন আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয় নি, যেমন ভারতীয় বন আইন (১৯২৭) বা বন সংরক্ষণ আইন (১৯৮০)। কেন্দ্র সরকার বন'কে সংজ্ঞায়িত করতে কোন মানদন্ড এখনও বানায়নি।"


বন তৈরি করার জমি কোথায়?


গোয়াতে বনভূমিকে অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য তার চরিত্র বদলানোর পর, পরিপূরক বনসৃজণ হচ্ছে অন্য রাজ্যে, যেমন কর্ণাটক বা মধ্যপ্রদেশে। পরিবেশ কর্মীরা তাই প্রতিবাদ করে প্রশ্ন তুলেছেন, এক জায়গায় বন কেটে ফেলে তার ক্ষতিপূরণ কি অন্যত্র বৃক্ষরোপণ করে করা যেতে পারে!

পরিপূরক বনসৃজণের জন্য জমিদখলের ঘটনাও সামনে আসে। আদিবাসী সম্প্রদায় ও বনবাসীরা বনাধিকার আইন, ২০০৬ অনুযায়ী সম্প্রদায়গত বনের সম্পদের দাবিদার। গবেষক ও বনাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ সংঘমিত্রা দুবে'র মতে," বনে বসবাস করা আদিবাসী ও অন্যান্য অধিবাসীদের বনের ওপর অধিকার আছে যারা তাদের জীবনধারনের জন্য, বাসস্হানের জন্য ও অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল"।

এই আইন অনুযায়ী স্হানীয় গ্রামসভা নীতিনির্ধারণে একটা বিশেষ জায়গা অধিকার করে এইসব এলাকায় এমন সব পরিকল্পনায় যা তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে। "এই পরিপূরক বনসৃজন আইন কোনভাবেই এই গ্রামসভার ভূমিকা স্বীকার করে না। তারা আসলে নীচের থেকে নীতিনির্ধারণের বদলে ওপর থেকে চাপিয়ে দেবার নীতিতে বিশ্বাস করে"।

"সরকারের জমির অভাব এবং বনবাসী সমাজের জমি তার দখল করছে। বনসৃজনের কাজে এটা এখন একটা বড় প্রশ্ন।", বললেন শ্রী লেলে। "বনাধিকারের প্রশ্নটায় একটা সিদ্ধান্তে না এলে পরিপূরক বনসৃজন নিয়ে সমস্যা মিটবে না। গ্রাম-সভার এসব জমির ব্যবস্হাপনায় থাকা দরকার, এবং ওই জমিতে বনসৃজনের অর্থ তাদের কাছে আসা দরকার"।


মূল্যায়ন ও নজরদারি


সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে শীর্ষস্হানীয় পদাধিকারী, ইনস্পেক্টার জেনারেল অব ফরেস্টের বক্তব্য অনুযায়ী, বনসৃজন নিয়ে যে তথ্য পাওয়া যায় তার ৭০% শতাংশই অসম্পূর্ণ ও ভুলে ভরা। গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য নেই পরিবেশ মন্ত্রকের অনলাইন পোর্টালে, পরিসংখ্যানও অসম্পূর্ণ। Mongabay-India নাম না বলার শর্তে একজন অবসরপ্রাপ্ত বনবিভাগের অফিসার জানান, নজরদারি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ যা ঠিকমত পালন হয় না। "দশ বছর পর পর মূল্যায়ন করা দরকার, যা কখনও হয়না"।

"অনেক কিছুই আছে যা বনসৃজনের সময় ঠিক না হতে পারে," ভান বলেন। "উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, চারাদের বাঁচার হার অসম। কিন্তু রেকর্ডে যা দেখানো হয় তা শুধু যত চারা লাগানো হয়েছে তার হিসাব। বছর বছর হিসাব রাখাটা প্রয়োজন। এটা কখনই ১০০ শতাংশ সফল নয় যা দেখানো হয়।"



লেখক পরিচিতি: সুপ্রিয়া ভোরা একজন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক। থাকেন গোয়ায়।



মূল প্রবন্ধটি Mongabay পত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2021/08/compensatory-afforestation-unlikely-to-make-up-for-the-loss-of-carbon-stocks/







1 Comment


Manisha Deb Sarkar
Manisha Deb Sarkar
Dec 11, 2021

Atyonto samayopojogi ekti bastab chitro.. shudhu statistics diye sab kichhu r satyi i mulyayan hoyna. Jibboichitro o manush-prokriti samporko atyonto gurutwopurno ekti bishoy.

Like
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page