top of page
  • ..

জলবিদ্যুৎ হিমাচল প্রদেশে কোন পরিবেশ-বান্ধব সমাধান নয়: গবেষণায় উঠে এল তথ্য।

কিন্নর। সম্প্রতি বারবার খবরে আসছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্যে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাড়বাড়ন্তের জন্য এখানকার জীববৈচিত্র বিপন্ন হচ্ছে, স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।পরিপূরক বনসৃজনের করুণ অবস্থাও উঠে এসেছে গবেষণায়। গবেষকরা দাবি করছেন হিমালয়ের প্রকৃতির ওপর এইসব প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে বিশদ চর্চা হোক ও ততদিন এইসব প্রকল্পের বৃদ্ধি বন্ধ থাক। লিখলেন ময়ঙ্ক আগরওয়াল




করছাম-ওয়াংতু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, কিন্নর। ছবি: Wikimedia Commons


জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ঝুঁঝবার জন্য ভারত নবীকরণ যোগ্য শক্তি ব্যবহারে জোর দিচ্ছে যার মধ্যে জলবিদ্যুৎ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় উঠে এল হিমালয় অঞ্চলে এই সব প্রকল্প পরিবেশের পক্ষে বেশ ক্ষতিকর সাব্যস্ত হচ্ছে। এই গবেষণায় মূলত অরণ্য অঞ্চল যা এই সব প্রকল্পের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার পর্যালোচনা করা হয়েছে এবং এতে দেখা যাচ্ছে যে এর ফলে শুধু বর্তমান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জীববৈচিত্রের ক্ষতি হওয়া বা বনভূমি খন্ড বিখন্ড হয়ে যাওয়া ছাড়াও ক্ষতিপূরণ হিসাবে যে বনসৃজন করা হয়েছে তাও যথাযথ হয়নি।

গত বছর অর্থাৎ, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘Land Use Policy’ নামক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত এই রচনায় যেমন সরকারি তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনি ক্ষেত্র-সমীক্ষাও করা হয়েছে মূলত: জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য যে বনভূমির জমির চরিত্র পরিবর্তন করা হয়েছে তার বিস্তৃতি ও প্রভাব খতিয়ে দেখার জন্য পশ্চিম হিমালয়ের পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল কিন্নর অঞ্চলে। এই গবেষণায় পাশাপাশি উঠে এসেছে এইসব কর্মকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ হিসাবে বিকল্প বনসৃজনের সমীক্ষাও।

১৯৮০ সালের বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী জলবিদ্যুৎ বা এই জাতীয় কোন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করলে বিকল্প বনসৃজনের ব্যবস্থা করতে হবে বলে বলা হয়েছে ক্ষতিপূরণ হিসাবে। এই গবেষণায় দেখা গেল যে, গবেষণায় যে সব জমিতে সমীক্ষা হয়েছে তার মাত্র ১২ শতাংশ জমিতে এই বনসৃজন হয়েছে এবং এইটুকু মাত্র জমিতেও চারার বেঁচে থাকার হার মাত্র ১০ শতাংশ। এসব ক্ষেত্রে বলা হয় যে, এই ধরনের বিকল্প বনসৃজন আসলে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অঞ্চলে কৃত্রিম হস্তক্ষেপ বিশেষ,যার দীর্ঘকালীন পরিবেশগত ফলাফল এখনও গবেষণার বিষয়বস্তু।

মানসী আশের ও প্রকাশ ভাণ্ডারী ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই গবেষণাটি চালান। এনারা Himdhara Environment Research and Action Collective এর সাথে যুক্ত যাদের কাজ মূলত পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য প্রয়াস চালানো এবং হিমালয় অঞ্চলে অরণ্যের অধিকার আইনের যথোপযোগী প্রয়োগের ওপর জোর দেওয়া।

গবেষণার অঞ্চল কিন্নরের উত্তর-পূর্ব দিকে তিব্বতের আন্তর্জাতিক সীমানা এবং এর সম্পূর্ণ এলাকা হল ৬,৪০১ বর্গ কিলোমিটার। শতদ্রু হল এখানকার মূল হিমবাহ-জাত নদী আর এর রয়েছে বসপা ও স্পিতির মত উপনদী। জাস্কর, গ্রেটার হিমালয় ও পিরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণীগুলি এখানে সমান্তরালে অবস্থান করছে যাদের উচ্চতা ২,৩২০ থেকে ৬,৮১৬ মিটার অবধি। এর স্বাভাবিক উদ্ভিজ সম্পদ বৈচিত্র্যপূর্ণ যার মধ্যে রয়েছে উপক্রান্তীয় পাইন বন থেকে শুষ্ক-শীতল নাতিশীতোষ্ণ অরণ্য, বার্চ গাছের অরণ্য থেকে অত্যুচ্চ বুগিয়াল, শুষ্ক অঞ্চলে মরুজাতীয় উদ্ভিদের সাথে ঘাস ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ।

এই গবেষকরা তথ্যের জন্য আরও অন্যান্য গবেষণাপত্রে চোখ রাখেন এবং বৃক্ষচ্ছেদন ও পরিপূরক বনসৃজনের তথ্য সংগ্রহ করেন। কতটা অরণ্য কাটা হয়েছে, কোন কোন প্রজাতির গাছ কাটা হয়েছে, বনসৃজন কেমন হয়েছে( সংখ্যায়, প্রজাতি হিসাবে ও খরচ কত হয়েছে) সমস্ত কার্যকর ও নির্মীয়মাণ প্রকল্পগুলোর জন্য তা দেখা হয়।প্রকল্পগুলির forest clearance proposals ও environmental impact assessment report খতিয়ে দেখেন তারা। পরিপূরক বনসৃজনের জন্য তারা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র-সমীক্ষাও করেন।

এইসব বিচার বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করে গবেষণাটি এই সিদ্ধান্তে আসে যে, হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র যা বৈচিত্র্যময় ও ভঙ্গুর, তা আধুনিক উন্নয়নের জন্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন বিপর্যয় যেমন ভূমিধ্বস, বন্যা, দাবানল পর্বত ও তার বনভূমিকে আরও বিপন্ন করে তুলেছে।

তবে, বর্তমানে যে অভূতপূর্ব রূপে হিমালয়ের ভূ-ভাগের চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটে চলেছে তার মূল দায় অবশ্যই বেড়ে চলা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির। এরা এইসব অঞ্চলে নতুন নতুন বিপদের সৃষ্টি করেছে বিগত দুইটি দশকে যেমন, ব্যাপক হারে অরণ্য নিধন, বনভূমির ভাগ হয়ে যাওয়া, ভূমি-ক্ষয় ও বনভূমির জীববৈচিত্রের ক্ষতিসাধন। স্থানীয় জন-সম্প্রদায়ের জন্য এ এক সমস্যার কারণ, যাদের জীবন ও জীবিকা এইসব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে সংকটে পড়েছে।

এই গবেষণাপত্রের একজন লেখিকা মানসী আশের জানাচ্ছেন যে, যে সমস্ত সরকারি সংস্থা পরিবেশগত নিয়মাবলী ও বনসম্পদ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে তারা চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে এই সমস্ত প্রকল্পের স্থানীয় বনভূমির ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের চরিত্র ও মাত্রা অনুধাবন করতে। তিনি জানান, তাদের গবেষণায় এটাই উঠে এসেছে যে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও তার সহানে পরিপূরক বনসৃজন পাহাড়ের ভূমির চরিত্রগত পরিবর্তন করেছে ও বনভূমির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।


জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে হিমাচল প্রদেশ অতি গুরুত্বপূর্ণ


ভারতের মোটের ওপর ১,৪৫,৩২০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা আছে বলে ধরা হয়, যার মধ্যে ১,১২,০০০ মেগাওয়াটই হিমালয়ের রাজ্যগুলিতে(৭৮%)। বর্তমানে দেশের এই ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৪৫,৬৯৯ মেগাওয়াট। ২০১৯ সালে সরকার ঘোষণা করে বিরাট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিকে সবুজ শক্তি হিসাবে গণ্য করা হবে যদিও স্থানীয় ক্ষেত্রে পরিবেশের ওপর এদের ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য বরাবরই বিতর্ক রয়েছে।

গবেষণা আরও বলছে সমস্ত হিমালয় রাজ্যগুলির মধ্যে হিমাচল প্রদেশে এই সব প্রকল্পের কাজের গতি ও ব্যাপকতা সবথেকে বেশি।হিমাচলের পাঁচটি সর্বোচ্চ সম্ভাবনাময় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার নদী উপত্যকার মধ্যে শতদ্রু উপত্যকার সহান সবার উপরে। এখানে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নদীগুলির ২২ শতাংশ এলাকায় বাঁধ হয়ে যাবে ও ৭২ শতাংশ সুড়ঙ্গে চলে যাবে!

শতদ্রু উপত্যকার উচ্চ অংশে অবস্থিত কিন্নর হল রাজ্যের জলবিদ্যুৎ রাজধানী। এখানে ৫৩ টি এমন প্রকল্পের প্রস্তাব আছে যার মধ্যে ১৭টিই বৃহৎ (২৫ মেগাওয়াটের ওপর)। বিভিন্ন ক্ষমতার ১৫টি প্রকল্প এখনই কাজ করছে ও ৩,০৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, যা এই রাজ্যের সব জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ।

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে প্রকল্পের জমিতে ১১,৫৯৮ টি ২১ প্রজাতির বৃহৎ বৃক্ষ ছিল- এদের সবই কেটে ফেলা হয় প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য এবং বেশিরভাগই সিডার ও চিলগোজা পাইন জাতীয়। অন্যান্য প্রজাতির গাছ, ভেষজ উদ্ভিদ ও গুল্মের কোন কথাই উল্লেখ করা হয়নি বলে গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, যদিও তাদের গুরুত্ব কম নয়। যে চিলগোজা পাইন জাতীয় বৃক্ষ এই প্রকল্পে হারিয়ে গেছে তারা বিপন্ন তালিকাভুক্ত চিরহরিৎ বৃক্ষ। এদের পশ্চিম হিমালয়েই পাওয়া যায় ও এদের ফল খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে এই ঘটনা স্থানীয় এলাকার জন্য মোটেই সুখবর নয়। যদিও আপেল ও মরশুমি সবজির চাষই এখন এখানে রোজগারের মূল উৎস, তবুও যে সব এলাকায় যথেষ্ট চিলগোজা পাইন আছে, সেখানে তা স্থানীয় মানুষের রুজি রুটির জন্য সহায়ক বড় পরিমাণে।


বড় বাঁধের বিরুদ্ধে হিমালয় অঞ্চলে প্রতিবাদ। ছবি: Lingaraj G.J./Flickr(Creative Commons)


পরিপূরক বনসৃজনের ব্যর্থতা


গবেষকরা ২২টি বনসৃজনের জন্য চিহ্নিত এলাকায় ক্ষেত্র সমীক্ষা চালান। ৩১শে মার্চ, ২০১৪ অবধি যে ৯৮৪ একর জমিতে বিদ্যুৎ প্রকল্প, রাস্তা ও পরিবাহী তারের জন্য অরণ্য নিধন করা হয়েছে, তার বদলে ১,৯৩০ হেক্টর জমিতে বনসৃজনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। গবেষণায় প্রকাশ ২০০২ থকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৪৪টি সহানে ২৪১.৬৭ একর জমিতে এই বনসৃজন হয়েছে (মোট জমির ১২%)। Compensatory Afforestation ও Catchment Area Treatment Plan এর অধীন যত বৃক্ষরোপণের কথা বলা হয়েছে তার মাত্র ১০% ওই সব জমিতে পাওয়া গেছে একেবারেই কম।

"২২টির মধ্যে ৩টি জমিতে কোন চারাই দেখা যায়নি। মানতির চিহ্নিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শুধুমাত্র জংধরা তারের বেড়াই কোন এক বনসৃজন প্রকল্পের সাক্ষ্য বহন করছে। ভালভাবে খতিয়ে দেখে সেখানে কোন চারাগাছ বা জমি খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন পাওয়া যায়নি।" গবেষণাটি জানাচ্ছে।

উচ্চ ও মধ্য কিন্নরে বনসৃজন প্রকল্পের অধীন ৪টি জমিতে (৩.৬%), রোপিত চারার বেঁচে থাকার হার খুবই করুণ, যেহেতু ওইসব জমি একেবারেই শুষ্ক এলাকায় ও সেচের কোন ব্যবস্থা নেই সেখানে- যে অবস্থার কথা বনবিভাগ ভালই জানে এবং ব্যর্থতার কারণ হিসাবে ডেসার্ট ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টে এটাই দেখানো হয়েছে।

গবেষণাটি আরও বলছে, অন্য এক স্হানে বনরক্ষীরা গবেষকদের জানান যে, আগুনে পুরো বনসৃজন প্রকল্পটি শেষ হয়ে গেছে সেখানে। "এইসব সমীক্ষায় দেখা হয়েছে খতিয়ে। বসপা, লানদার,থং সং থিকরু ও হুবরার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ভূমিধ্বস অথবা হিম-ধ্বসে প্রকল্পগুলি ধ্বংস হয়েছে। প্লিংছা এলাকার জমি পুরোপুরি পাথরে ভর্তি, চারা রোপণের জন্য স্হানই নেই। আবার কিছু চিহ্নিত জমি খাড়া ঢালে, বৃক্ষরোপনের করাই সেখানে সম্ভব নয়। ৫০% এর ওপর বনসৃজনের জমিই এমন সব।"

আশের বলেন, "বৈশ্বিক সবুজায়ন অভিযান এই সব প্রকল্প চালাতে আরও ইন্ধন দিচ্ছে পরিপূরক ক্ষতিপূরণের নামে, যা স্থানীয় সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র ও স্থানীয় মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক। আমরা এই পরিপূরক বনসৃজনের উদ্দেশ্যকেই প্রশ্ন করছি যা বলে এক জায়গার পরিবেশের ক্ষতি অন্য জায়গায় কিছু করে শোধরানো যায়"।

কিছু স্থানে তো গাছ লাগানো হচ্ছে তৃণভূমিতে যা স্থানীয় মানুষ ঘাস কাটার জন্য ও গবাদি পশু চড়াতে ব্যবহার করেন। বনবিভাগ গাছ লাগিয়ে যাবার পর তারা তাই এগুলো উপড়ে ফেলছে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, সম্পূর্ণ আলাদা প্রকারের গাছ লাগানো হচ্ছে কেটে ফেলা গাছের বদলে। " যেসব গাছ কেটে ফেলছে তা হল স্থানীয় প্রজাতির, কিন্তু তার বদলে লাগানো হচ্ছে বহিরাগত প্রজাতির মহানিম বা রুবিনিয়া জাতীয় গাছ। এর পিছনে কারণ হচ্ছ এদের টিকে যাবার ক্ষমতা। মহানিম বা Ailanthus এর স্থানীয় প্রজাতির গাছের তুলনায় বেঁচে যাবার হার বেশি। আমরা দেখেছি সব বনসৃজন এলাকাতেই এই জাতীয় গাছরাই বাঁচছে ও বাড়ছে বেশি করে।"

বনের উদ্ভিদের এমন প্রকৃতি পরিবর্তন স্থানীয় জীববৈচিত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক, বহিরাগত প্রজাতি যেমন রুবিনিয়ার বাড়বৃদ্ধিতে তাদর অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। স্থানীয় অনেক কৃষকই তাদের জমিতে এই গাছের ছড়িয়ে পড়া নিয়ে বলছেন।

বাস্তুতন্ত্রে জলের ভূমিকা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ও ব্যক্তিদের যৌথ মঞ্চ South Asia Network on Dams, Rivers and People (SANDRP) এর আহ্বায়ক হিমাংশু ঠক্কর এই গবেষণাটিকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন যে, "কিন্নরে যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তা হয়ত বাকি দেশের জন্যও সত্যি।"

"বেশিরভাগ ক্ষতিপূরণের প্রকল্পই দুর্নীতি-পূর্ণ,তা সে পরিপূরক বনসৃজন হোক,ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, পরিবেশগত উন্নয়ন হোক, অববাহিকা অঞ্চলের উন্নয়ন হোক, কাদামাটির যথাযোগ্য ব্যবস্থা বা মৎস্য-চাষ প্রকল্প হোক। এর কারণ হল এসবে সরকারি সংস্থা ও নির্মাণকারী সংস্থা কেউই উৎসাহিত নয়। এগুলো দেখার বা ব্যবস্থা নেবার কেউ নেই যখন এই সব প্রকল্প সঠিকভাবে রূপায়িত হয় না। যতক্ষণ না আমরা এমন কোন স্বাধীন, নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা তৈরি করতে পারছি যারা এইসব ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা নিতে পারবে প্রয়োজনীয় কাজ না হলে, ততদিন ভাল কিছুর আশা কম।"ঠক্কর জানান।

সারা ভারত বন আন্দোলনে সংগঠনের সৌমিত্র ঘোষ বলেন যে, " এটা শুধু হিমাচলের ব্যাপার নয়, হিমালয়ের সব রাজ্যগুলির বনের জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত, জনসমাজ এর দ্বারা প্রভাবিত এবং পরিবেশগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি ধ্বংসের মুখে এইসব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য।"

" এইসব যথেচ্ছভাবে হচ্ছে গোটা হিমালয় জুড়ে। যেমন এইসব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ভূমিকা একইরকম উত্তরাখণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম বা উত্তরবঙ্গের কিছু অংশে। এরা শুধু বন্যপ্রাণীদের বাসস্থানকে খন্ডিতই করছে না, তাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে।তারা ওখানকার আদি বাসিন্দাদেরও বিপদে ফেলছে।সরকারি সংস্থাদের অগ্রাধিকারে তো কখনই জীববৈচিত্র, স্থানীয় মানুষ বা বন্যপ্রাণীদের বাসস্থান থাকে না।"ঘোষ জানালেন।

পরিপূরক বনসৃজনের বিষয়ে সৌমিত্রবাবু মন্তব্য করেন, " এই ধরনের বনসৃজন কোন উদ্দেশ্য সাধন করে না.... কোন ক্ষতিপূরণই হয় না শুধুমাত্র বনবিভাগের কর্তাদের ছাড়া। আমরা এমন অনেক উদাহরণ দেখেছি ভারত জুড়ে...অনেক জায়গায় শুধু ভুতুড়ে বৃক্ষরোপণ হয় ( অর্থাৎ কাগজে-কলমে হয়, বাস্তবে নয়)।"


জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি ভূ-ভাগকে খন্ডিত করে


গবেষণাটি দেখিয়েছে ১৩ টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পই রূপি-ভাবা অভয়ারণ্যের বাফার এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে পড়ছে। অন্যদিকে পাঁচটি প্রকল্প আছে লিপ্পা-আরসাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের এলাকায়, আর একটি আছে রকছাম-ছিটকুল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ৬.৫ কিলোমিটারের মধ্যে।

"সবকটি অভয়ারণ্যই উচ্চ হিমালয়ে অবস্থিত যেখানে শীতকাল খুব প্রবল ও তুষারপাত হয় ব্যাপক আকারে। শীতের সময় বন্যজীবেরা নীচের দিকে চলে আসে খাবার ও জলের সন্ধানে। এই সব নীচু এলাকাতেই এই প্রকল্পগুলি গজিয়ে উঠেছে।" গবেষণাটির বক্তব্য।

প্রকল্পের বিভিন্ন এলাকা যেমন সুড়ঙ্গ, কাদামাটি জমা করার স্হান, স্টোন ক্রাশার ইউনিট, ডি-সিল্টিং চেম্বার, স্টোরহাউস,পাওয়ারহাউস, কলোনি এলাকা- এসব জায়গার মধ্যে যোগাযোগ রাখতে সংযোগকারী রাস্তাঘাটের একটা বড় জাল তৈরি হয় এসব স্হানে। বনভূমির জমি বিদ্যুৎ পরিবাহী তারের টাওয়ারের জন্যও নেওয়া হয় গ্রাম থেকে গ্রাম হয়ে পাহাড়ের ওপর দিয়ে যেতে। এর ফলে বন ও বনের বাসিন্দাদের বাসস্থান আরও খণ্ডিত হয়ে যায়, যোগাযোগের পথগুলো রুদ্ধ হয়ে যায়, বন্যজীবেরা ছড়িয়ে যায়। এর ফলে বনভূমির দ্রুত অবক্ষয়ের অন্যান্য দিক খুলে যায়।

গবেষণাটির মূল নেতৃত্বদানকারী প্রকাশ ভাণ্ডারীর মতে, এইসব প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন বিভাগের সম্মিলিতভাবে, বিশদে, স্বাধীনভাবে সমীক্ষা করা উচিত যে হিমালয়ে এরা কেমন প্রভাব ফেলছে এবং ততদিন এইসব প্রকল্পের বৃদ্ধির কাজ বন্ধ রাখা দরকার। "পরিকল্পনা ও পরিবেশগত নীতিনির্ধারণের সময় স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ও বাসিন্দাদের ওপর প্রভাবের কথা মাথায় রাখা উচিত। গ্রামসভার অংশগ্রহণ ও ২০০৬ সালের বনাধিকার আইন অনুযায়ী অনুমতি গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।" তিনি বলেন।


তথ্যঋণ: Asher, M., & Bhandari, P. Mitigation or Myth? Impacts of Hydropower Development and Compensatory Afforestation on forest ecosystems in the high Himalayas. Land Use Policy, 100, 105041.


মূল প্রবন্ধটি Mongabay পত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2020/09/hydropower-not-a-very-green-solution-in-himachal-pradesh-finds-study/?fbclid=IwAR2vzVNj2HLusB2XiuOl9d2SRhTTEp3NsfiH1HPKLUCLV4yH0qegBlkUBpU


অনুবাদ: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।


Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page