ভারত-নেপাল সীমান্তে উত্তরপ্রদেশের তরাই অঞ্চলে বিস্তৃত দুধওয়া টাইগার রিজার্ভ। সেই অরণ্যে ভ্রমণের স্মৃতিকথা এবার উপমন্যু রায়ের লেখায় ও ছবিতে।
১লা জুন , ২০১৮ , ওয়াজেদ আলী শাহের শহরের থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছি ভারত নেপাল সীমান্তবর্তী অঞ্চলের , উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেরি জেলার পালিয়া নগরে । এলাকা মূলত কৃষি প্রধান এবং আখ ও সরিষা এখানকার প্রধান ফসল। উপরন্তু দেশীয় বিদেশী পুঁজির সহায়তায় মূলত বনজ সম্পদ এবং কৃষিজাত পণ্যকে মাধ্যম করে এখানে গড়ে উঠেছে ভারী শিল্পাঞ্চল, সাইরেনের ভোঁ-ভোঁ শব্দ কানে আসে মাঝেমাঝে। থারু আদিবাসীরা প্রথম এই অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করলেও, উপার্জনের সুযোগে এলাকায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস। কালক্রমে শিখ , হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মিলনে বেড়ে ওঠে এই ছোট্ট জনপদ পালিয়া। আক্ষরিক অর্থেই যা মানবজাতির মহামিলন ক্ষেত্র।
আমরা কলকাতার কয়েকজন যুবক প্রায় ১৭০০ কিমি পথ অতিক্রম করে এসে পৌঁছাই পালিয়ার ২৫ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামীন জনপদ ভিড়ায় । রবির কিরণ যখন আমার শহরকে স্পর্শ করেনি , তখন ছাড়ে লখনৌগামী বিমান। ঘন্টা দেড়েকের বিমান যাত্রার শেষে এসে পৌঁছাই আওয়াধ পুরীতে। ভুলভুলাইয়ার গোলকধাঁধা কাটিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে পাড়ি দিয়ে ভিড়া এসে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে ৪ ঘন্টা। যাত্রাপথ মসৃণ এবং প্রসস্থ , কয়েক জায়গায় অবশ্য নির্মাণকার্য চলছে। যাত্রাপথে জলখাবারে জুটেছিল হাইওয়ের ধারের এক দোকানের কচুরি ও আলুর তরকারি, সঙ্গে চা, জিলিপি। গোটা রাস্তা জুড়েই অধিকাংশ এলাকায় গড়ে উঠেছে এরম অসংখ্য ফ্যামিলি মোটেল যেখানে স্বল্প ব্যয়ে সুস্বাদু আহার মেলে।
আমাদের এই দীর্ঘ পথযাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল তরাই অঞ্চলের চিরহরিৎ বনভূমির স্পর্শ অনুভব ও বন্যপ্রাণ প্রতক্ষ্য করা। ভিড়ায় আমাদের ঠিকানা হয় এক বেসরকারি পর্যটক আবাস।
যোজন বিস্তৃত আখের খেত , সরিষার খেত এবং ডানপাশে কিষাণপুর অভয়ারণ্যকে রেখে প্রকৃতির কোলে গড়ে উঠেছে পর্যটক আবাসটি । আশেপাশে মনুষ্য বসতি খুবই কম এবং সন্ধ্যের পর যে এলাকায় মাংসাশী পশুর আগমন ঘটে তার কিছু প্রমাণ মেলে তাদের পদচিহ্নে। কর্ণধার ও বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ ফজলুর রহমান ভাই , সন্ধ্যের পর আমাদের চিহ্নিত ঘেরাটোপের বাইরে বেরোতে নিষেধ করেছিলেন ।
পর্যটক আবাসের প্রতিটি ঘরে একসঙ্গে দু'জন থাকতে পারে। প্রতিটি ঘরের সঙ্গে লাগোয়া পশ্চিমী ধাঁচের শৌচালয় এবং রয়েছে শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। যদিও এই প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা থাকায় তা অধিকাংশ সময়েই বিকল । আড়ম্বরে ভারী না হলেও, পরিবেশ বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন এবং প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকার সৌভাগ্য মেলে। আবাসের চৌহদ্দির মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য নাম না জানা গাছ , সেখানে বাসা বেঁধেছে ওয়াটার হেনরা। সকাল হলেই এসে ডাকাডাকি শুরু করে সানবার্ড , ওরিয়েন্টাল হোয়াইট আই , ওরিয়েল , কোকিল, ঘুঘু পাখি , টিয়া ,প্যারাডাইজ ফ্লাইক্যাচের , স্টোনচ্যাট , লং টেইলেড শ্রাইক এবং আরো অনেকে। জংলী এবং মেছো বেড়ালেরা যে আশেপাশে ভালোই ঘুড়ে বেড়ায় তা তাদের পায়ের ছাপেই প্রমান মেলে।
ভিড়াতে যে ২ দিন আমরা ছিলাম সেদিন আমরা মিলিয়ে মিশিয়ে মুরগির মাংস , ভাত, লুচি , পোলাও , তড়কা , রুটি , মাখন ,পাউরুটি , আলুর পরোটা , পকোড়া খেয়ে দিন কাটিয়েছি। প্রতিটি খাবারই ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু এবং সযত্নে পরিবেশন করা।
কিষাণপুর ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি , দুধয়া ন্যাশনাল পার্ক এবং কাটেরনিয়াঘাট ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি নিয়ে গড়ে উঠেছে দুধয়া টাইগার রিসার্ভের সংরক্ষিত বনাঞ্চল । প্ৰধান মুখ্য বনপাল (লখনৌ ) , ফিল্ড ডিরেক্টর দুধয়া টাইগার রিসার্ভ এবং ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার (পালিয়া ) অনুমতি নিয়ে আসতে হয় দুধয়া ভ্রমণে । ১৯৮৭ সালে গড়ে ওঠা এই বনাঞ্চল আয়তনে প্রায় ৪৫০ বর্গমাইল। স্যাংচুয়ারি এলাকাসমূহ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হয় ,২০০০ সাল নাগাদ। লখিমপুর খেরি ও বাহরাইচ এই দুই জেলায় অরণ্য বিস্তৃত হলেও, দুধয়ার মূল প্রবেশ দ্বার হল পালিয়া।
প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক এখানে ডোরাকাটা বাঘ , হাতি, গন্ডার , বিভিন্ন পাখি, প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে আসেন। এখানে জঙ্গলে ভ্রমণের জন্যে মূলত জিপসি ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি জিপসিতে ৬ জনপূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি একেকবারে ভ্রমণের সুবিধা নিতে পারেন। জঙ্গল সাফারি মূলত সকালবেলা ও বিকেলবেলা দিনে দু'বার বনবিভাগের তত্বাবধানে পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি জিপসি বনবিভাগের সঙ্গে যুক্ত এবং প্রতিবার জঙ্গলে ভ্রমণের সময় আপনাকে সঙ্গে নিতে হবে নেচার গাইডকে , যে আপনাকে গহীন অরণ্যে পথ চেনাবে। এভাবেই পরিচয় হয় দুই বন্ধু , পালিয়া নিবাসী লীলাধর-পেশায় গাইড এবং অমিত কুমার- পেশায় জিপসি চালক এর সঙ্গে । এই দু'জনের তত্বাবধানে আমরা জঙ্গলের বিভিন্ন প্রান্তে চষে বেড়াই আমাদের ভ্রমণকালে।
যেহেতু সময়টা গ্রীষ্মকাল এবং অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় প্রায় ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁইছুঁই তদুপরি লু বইবার সম্ভাবনা আছে , তাই যখন ভ্রমণসূচি পরিকল্পনা হয়েছিল তখন ঠিক হয়েছিল এবারে আমরা শুধুমাত্র কিষাণপুর অভয়রণ্য এবং দুধওয়া জাতীয় উদ্যানেই ঘুরব। এই স্থানদ্বয়ের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। কাটারনিয়াঘাট, পালিয়া থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং মূলত নদীমাত্রিক অঞ্চল হওয়ায় , তাই সেখানে জলজ বন্যপ্রাণের উপস্থিতি যে শীতকালেই ভালো টের পাওয়া যাবে তা আমরা পূর্বেই ঠাউর করে ভ্রমণসূচির বাইরে রাখি।
কিষাণপুর অভয়ারণ্য মূলত গড়ে উঠেছে 'ঝাদিতাল' নামক এক জলাভূমিকে কেন্দ্র করে। এই জলাভূমিতে বাস করে মাগার প্রজাতির কুমির , অসংখ্য পক্ষী এবং পানীয় জলের সন্ধানে এখানে ডোরাকাটা বাঘ মাঝেমাঝেই উপস্থিত হয়। ঝাঁকে ঝাঁকে হরিনের পাল দৌড়ে চলে, শিউরে উঠতে হয় ময়ূরের ডাকে।কাঠঠোকরা সারাদিন ঠুকরে চলেছে গাছের ডাল , বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস সারাদিন ডেকে চলেছে প্যাঁকপ্যাঁক শব্দে, সারস প্রজাতির পাখির উড়ে চলে কোনো এক অজানার উদ্দেশ্যে , কোথাও বা উঁচু মগডালে শিকারের অপেক্ষায় বসে আছে কোনো এক ঈগল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যখন সকালের প্রথম সূর্যকিরণ শরীরকে স্পর্শ করে তখন তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন । দু'দিন ব্যাপী কিষাণপুর ভ্রমণে আমরা দর্শন পাই বাঘিনীর। খাঁচার বাইরে , খোলা গাড়িতে চেপে বাঘের ছবি তোলার শখ আমার অনেকদিনের। যতবারই দেখি ছিন্নমস্তার বাহনের রূপ ততবারই মুগ্ধ হই। এবার তার অন্যথা হয়নি , পূর্ণবয়স্ক বাঘিনী আমাদের সঙ্গে প্রায় ১০মিনিট সময় কাটায়।
কিষাণপুরের পালা সঙ্গে করে , বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে রওয়ানা হই দুধওয়ার পথে , বিদায় জানাই ফজলুর ভাই ও তাদের সহকর্মীদের অনন্য সহযোগিতাকে। দুধয়ার পথে পরখ করি মুরাদাবাদী বিরিয়ানী। পোলাওয়ের চালের মধ্যে সিদ্ধ মুরগির মাংস বিভিন্ন মশলায় সহযোগে পরিবেশন করা হয় , স্বাদে ও গন্ধে যা অতুলনীয় । দুধওয়ায় আমাদের সুযোগ হয় বনবিভাগের বিশ্রাম গৃহে থাকার। আক্ষরিক অর্থেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত এই বিশ্রাম গৃহ। ঘরের বারান্দা থেকে দেখা যায় , নীলগাই, হাতির পাল, গণ্ডার , হরিণের পাল ,বুনো শুয়োর এবং আরো অনেককে ।
বিলি আরজান সিং এর সংরক্ষণ নীতির ওপর ভর করে , ১৯৭৬ সাল থেকে এই অঞ্চল পরিণত হয় বাঘেদের রাজত্বে। ২০১১ সালের ব্যাঘ্রশুমারী অনুযায়ী দুধয়া ও পিলিভিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রায় ৮০-১১০ টি বাঘের বসবাসের প্রমান মিলেছে। প্রসঙ্গত দুধয়ার জঙ্গল কিষাণপুরের থেকে অনেক বেশি গভীর। কিছু কিছু জায়গায় যেমন,গুলরিঘাট অঞ্চলে সূর্যের আলো প্রায় প্রবেশ করে না। কোথাও আবার রয়েছে সাথিয়ানার মত উন্মুক্ত তৃণভূমি, কোথাও বা সারদা নদীর ধারা কুলকুল শব্দে বয়ে চলে।
মাটির রং কোথাও লাল তো কোথাও ধবধবে সাদা।গাছের শাখা প্রশাখা রাস্তার ওপর নুইয়ে পড়ে সৃষ্টি করে এক প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গপথ। ঘুড়তে ঘুড়তে আপনার চোখে পড়বে প্রাচীন কোনো এক রানীর সমাধি অথবা আপনার দিকে চোখ গোলগোল করে তাকাবে কোনো এক পেঁচা , কোথাও আবার জলে গা ডুবিয়ে শুয়ে আছে কেউটে সাপ ।
বন্যপ্রাণের খুব বেশি তারতম্য কিষাণপুরের থেকে তুলনায় এখানে নেই। তবে দুধয়ায় দর্শন মেলে গজরাজের। কপাল ভালো থাকলে বনের রাজা বাঘ ও একশৃঙ্গ গন্ডারের। সংযোজন হিসেবে এখানে রয়েছে হাতির পিঠে চেপে ভ্রমণের সুবিধা।
৪ দিন জঙ্গলের আনাচে কানাচে ঘুড়ে দুধওয়ার ফরেস্ট ক্যান্টিনে দুপুরের আহার সাঙ্গ করে এসে অপেক্ষা করছি পালিয়াতে , লখনৌ যাওয়ার বাসের উদেশ্যে। জঙ্গলের ভিতরে কোনোপ্রকার আমিষ খাদ্য (ডিম ছাড়া) নিয়ে যাওয়া এবং প্লাষ্টিক নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। সমস্ত জঞ্জাল যা আমরা থাকার সময় তৈরী করি , তা জঙ্গলের বাইরে নিয়ে আসতে হয় ভ্রমণ শেষে। জঙ্গলের কোনো বনজ সম্পদের ক্ষতি সাধন করলে বা বন্যপ্রাণকে বিরক্ত করলে এবং বনজ সম্পদ জঙ্গলের বাইরে আনা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এসব ভাবতে ভাবতেই লখনৌ যাওয়ার বাসের ডাক পড়ল , বিদায় জানানোর পালা বন্ধু লীলাধর ও অমিতকে। আর কয়েক ঘন্টার যাত্রায় পৌঁছে যাব নবাবের রাজধানী লখনৌতে। সেখান থেকে উড়ে যাব সিটি অফ জয়ের পথে , সঙ্গে থাকবে স্মৃতিরা এবং ভবিষ্যৎ ভ্রমণের পিপাসা।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য -
কিভাবে যাবেন - কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বিমানে লখনৌ , সেখানে থেকে বাসে বা ভাড়ার গাড়িতে পালিয়া।
কোথায় থাকবেন - দুধওয়াতে বনবিভাগের আবাস গৃহ এবং কিষাণপুরে বেসরকারি পরিচালনায় চালিত অসংখ্য পর্যটক আবাস।
কখন যাবেন - নভেম্বর থেকে জুন মাস প্রতি বছর।
কি খাবেন - খাওয়া দাওয়া মূলত উত্তর ভারতীয় প্রকৃতির , ওখানকার লোকাল খাবার খাওয়াই ভাল। আলুর পরোটা , ভাত , ডাল ,রুটি,সবজি ,তড়কা ,মুরগির মাংস ,সালাদ, মুরাদাবাদী বিরিয়ানি, ডিম।
তাপমাত্রা - শীতকালে সর্বনিম্ন ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস , গরমকালে সর্বোচ্চ - ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস , বৃষ্টিপাত - ১১০ সেন্টিমিটার বাৎসরিক।
সঙ্গে রাখবেন - সচিত্র সরকার স্বীকৃত পরিচয়পত্র , ছাতা/টুপি , ক্যামেরা,টর্চ ,বাইনোকুলার, বিনব্যাগ , পোশাক যা পরিবেশের সঙ্গে মানানসই , ফার্স্ট এইড কিট ,প্রয়োজনীয় অর্থ , প্রয়োজনী ওষুধ , ঋতুভেদে গরম জামাকাপড় এবং বর্ষাতি।
যা করবেন - জঙ্গল ভ্রমণের সময় অবশ্যই , নেচার গাইডের নির্দেশ পালন এবং বনবিভাগের আইনসমূহ পালন।
যা করবেন না - জঙ্গলের বন্যপ্রাণ কে বিরক্ত , প্লাস্টিকের ব্যবহার , যত্রতত্র নোংরা করা এবং অন্ধকারে জঙ্গলে যাবেন না।
যোগাযোগ - . Director, Dudhwa Tiger Reserve
Phone:05872-252106
Email : dirdudhwa@yahoo.com
Divisional forest officer Katrania Ghat Wild Life Sanctuary
Phone:05252-232498
Email: dfo.katerniaghat@gmail.com
ছবি: লেখক
লেখক পরিচিতি: লেখক কলকাতা নিবাসী। অরণ্যে ভ্রমণ ও বন্যপ্রাণীর ছবি তোলা নেশা।
Comments