কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালী। বাংলার নদী, নালা, খাল, বিলে অফুরন্ত মাছের সম্ভার এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পিছনে দায়ী। কিন্তু অতিলোভ যখন ধ্বংস করতে বসে সেই প্রাকৃতিক আবাস, হারাতে থাকে প্রকৃতির অমূল্য দান! সেই কথাই এবার সৌম্য সরকারের কলমে।
তখন কর্মসূত্রে বহরমপুরে ভাড়া থাকি । আজ থেকে বছর এগারো আগেকার কথা হলেও, জাঁকজমক,হৈ-চৈ আর জনকোলাহলে বহরমপুর তখনই কলকাতার যে কোনো জমজমাট পাড়ার সাথে টক্কর দিতে পারে! তবে সুখের বিষয়ও এই কাজের সূত্রেই শহরের ভিড়ভাট্টার থেকে বেশি সময় কাটাতে হত আশেপাশের কয়েকটা জলাভূমিতে ।এখন যদিও খবর পাই সেসব জায়গাকেও শহুরে সংস্কৃতি গ্রাস করেছে! যাক সেকথা ।
একটা ছিমছাম সুন্দর দোতলা বাড়ির গোটা নিচের তলাটা আমাদের দখলে। বাড়ির ঠিক পেছনেই বিষ্টুপুর বিল। কোনো এক সময় ভাগীরথীর সঙ্গে এঁকেবেঁকে জুড়েছিল। মাত্র বছর ষাট-সত্তর আগেও নদী থেকে ঘড়িয়াল ভেসে চলে আসত এরকম গল্পও কান পাতলে শোনা যায়। এখন সময়ের খেলায় সেই যোগসূত্রের আর খোঁজ মেলেনা। শহরের মাঝে বাঁকাচাঁদের আকারের বিষ্টুপুর বিল অবহেলিতর মত পড়ে আছে। যে বিষ্টুপুর বিলকে ওয়েস্টওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানের আওতায় এনে শহরকে পরিষ্কার রাখার কথা ভাবা হয়েছিল, সেই প্ল্যান সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ মানুষেরই অদূরদর্শীতায়। এখন শহরের বিশাল অংশের ময়লা এসে পড়ে বিষ্টুপুরে, এখান থেকে জল বেরিয়ে ভাগীরথীতে পড়ার নালা বিপুল পরিমান প্লাস্টিকজাত ময়লায় সম্পূর্ণভাবে আটকানো। যদিও বহরমপুর পুরসভা এলাকায় তখনই ক্যারিব্যাগ জাতীয় প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিন্তু বিষ্টুপুরের গর্বের ইতিহাস যে ততদিনে কালের গর্ভে বিলীন তা বোধহয় নিশ্চিত করে বলা যায়।
বিলের জল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, ওপরে তেলের মত পরত ভেসে থাকে। জলে হাত ডোবাতে মোটে ইচ্ছা করেনা। বিকেলের দিকে মাঝেমধ্যেই বদগন্ধে আশপাশ ভুরভুর করে। বর্ষায় জল উঠে সংলগ্ন রাস্তাঘাট ভেসে যায়। আর জলের সাথে ভেসে আসা আরো চোদ্দ-রকমের ময়লায় সে এক বিচ্ছিরি কান্ড। যদিও আসপাশের অনেকেই ওই বিলের জলেই সারা বছর স্নান-ধান এবং বাড়ির যাবতীয় কাজ সারেন। তবে বিলে যেটা ভালো হয় তা হল মাছের চাষ। একটা কো-অপরেটিভ থেকে নিয়মিত পোনার চারা ছাড়া হয়।বিলের ময়লা খেয়ে তারা ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং প্রায় প্রতিদিনই সকালের দিকে কো-অপরেটিভ অন্তর্ভুক্ত জেলেরা নৌকা নিয়ে জাল ফেলে সেই মাছ ধরা এবং বিক্রির বন্দোবস্ত করে।
এই বিলেরই এক পাহারাদার নৃপেনদাদুর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছিল। লম্বা কালো চেহারা, সারা দেহের চামড়া কুঁচকে ঝুলে গেছে, কিন্তু এখনো বেশ কর্মক্ষম আছেন।তবে সকাল-বিকাল-সন্ধ্যে সবসময়ই দাদু কিঞ্চিত জলপান করে থাকেন।মাঝেমধ্যে আনুসাঙ্গিক ছোলা-বাদাম কি চানাচুর সাপ্লাই দিলে দাদুর মেজাজটা একটু বেশিই খুশি হয়ে যায়। তখন নানারকম পুরোনো গল্প, বিলের ইতিহাস ভূগোল সব গড়গড় করে বের হয় দাদুর মুখ থেকে। আমার লোভ সেইটাতেই! তারপর যখন সে গল্প ভূতে এসে ঠেকে, তখন বুঝে যাই এবার ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।
সেদিনও বিকেলবেলা দাদুর সাথে দেখা করতে গেছি, পকেটে সদ্য কেনা বিড়ির প্যাকেট। গল্পের ঘুষ আর কি। গিয়ে দেখি, দাদু বিলের ধারে উবু হয়ে বসে জলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। মাঝেমাঝে হাতে একটা শুকনো ঘাসের শীষ নিয়ে জলের ওপর বোলাচ্ছে। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু তখনো দাদুর দৃষ্টি সেই জলের দিকে। আমি বোঝার চেষ্টা করছি কি ঘটছে। হঠাৎ জলের ওপর ছোট্ট একটা ঘাই আর সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসি। বুঝলাম আজকের ডোসিংটা একটু বেশিই হয়েছে। ততক্ষণে আমার দিকে প্রশ্ন ধেয়ে এসেছে,
- “কি? কেমন দেখলা?”
ধুর কি আর দেখলাম! কি একটা মাছ এসে বুড়োর হাতের কাছেই ঘাই করেছে।আর কি দেখার আছে! দাদুকে জানালাম সেকথা।
- “কি কও! ফলি মাছে বাসা করসে এইখানে, ডিম দিসে গাছের গায়, মদ্দাটা পাহারা দিতেসে এখন। সুমুন্দির বড্ড রাগ! দেখলানা?”
ফলি মাছ মানে তো আমরা যাকে ফলুই বলি। মুর্শিদাবাদের আঞ্চলিক নামগুলোর সাথে ততদিনে ভালোই পরিচয় হয়ে গেছে।তো সেই ফলুই মাছ বাসা বানায় নাকি! গাছের গায়ে ডিম দেয়! এসব কথাতো কোনোদিন শুনিনি।
- “তা'লে আর বলছি কি! অয় যে গাছের গোড়া জলে ডুবে আছে, অর গায়েই ডিম দেয়।এখন হপ্তা ভোর মদ্দাটা অয়খানে বসে থাকবে। ডিম ফুটলে তারপর তার ছুটি!”
ফোকলা গাল থেকে সদ্য ধরানো বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে শুনিয়েছে বহরমপুরের এক অখ্যাত অশিক্ষিত বুড়ো।
পরের ঘটনা আট বছর পরের। আবার কয়েকজনের কাছে শুনেছি প্রায় একই রকম গল্প। ২৫°-২৮° সেলসিয়াস উষ্ণতায় দিনের বেলায় ফলুই দম্পতি ব্রিডিং ডান্স শুরু করে। মা ফলুই জলে ডোবা কোনো গাছের গায়ে কিংবা গাছের অভাবে কোনো সুবিধা মতো জায়গায় ৩.৮ - ৪ মিমি সাইজের আঠালো ডিমগুলোকে আটকে দেয়। এরপর ডিম পাহারার দায়িত্ব পড়ে বাবা ফলুইয়ের ওপর। পরবর্তী ১৬৮ - ২০৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা না বেরোনো পর্যন্ত দায়িত্বশীল বাবা ফলুই ডিমের দেখভাল করে থাকে। কিন্তু এবার যে আর অবজ্ঞা করার উপায় নেই। কারণ যারা বলছেন একথা তারা তো জার্মানির হামবোল্ড ইউনিভার্সিটির মৎস্যগবেষক! Honesty Yanwirsal এবং তার দুই সহকর্মী। যদিও ফলুইয়ের যে অপত্যস্নেহ আছে এবং পুরুষটি যে ডিম পাহারা দেয় সেকথা আগেই অনেকে বলেছেন। কিন্তু হাতে কলমে প্রমাণ এত ভালো করে এর আগে পাওয়া যায়নি!
তাহলে মুর্শিদাবাদের সেই অশিক্ষিত মাতাল বুড়োর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে অবজ্ঞা করি কেমন করে! আমাদের বন্যপ্রাণ নিয়ে এরকম কত মূল্যবান তথ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমরা যাদের প্রথম দর্শনেই অশিক্ষিত ভাবি সেই লোকগুলোর কাছে ।যদি জীবকার টানে মাঠেঘাটে ঘোরা এই সমস্ত লোকেদের থেকে কোনো ভাবে এই তথ্যরাশি সংগ্রহ করে নথিবদ্ধ করা যায় তবে তা ভবিষ্যতের জন্য এক অমূল্য তথ্যভাণ্ডার হয়ে থাকবে। হয়তো প্রাণীটির সংরক্ষণেও বিশাল ভূমিকা নেবে এরকমই কোনো মেঠো তথ্য।
কিন্তু যাকে নিয়ে কথা সেই ফলুই মাছ সম্পর্কে তো আর কিছু জানা হল না। সে কথায় আসি তবে। ফলুইয়ের লাতিন নাম Notopterus notopterus, ইংরাজি নাম Asian Bronze Featherback বা Asian Knife fish। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এদের দেখতে একদম খাপখোলা ছুরির মতো। চকচকে রুপালি দেহের রঙ, তাতে অনেক সময় কালচে নীল কি তামাটে সবুজ আভা। ছোটবেলায় আড়াআড়ি কালচে দাগের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। পিঠপাখনাটা খুব ছোট। শ্রোণিপাখনা প্রায় চোখে না পড়ার মতো। কিন্তু পায়ুপাখনা লেজের সাথে মিশে একটা সুন্দর ঝালর তৈরি করেছে। এই ঝালরের মত পাখনা দুলিয়েই এরা মাথা না ঘুরিয়েই ব্যাক গিয়ার মেরে পিছিয়ে আসতে পারে। সারা দেহের আঁশগুলো খুব ছোট, কানকোর আঁশ অন্যান্য আঁশের তুলনায় বড়। সাইজে দু'ফুট পর্যন্ত বড় হতে পারে বলে খবর কিন্তু একফুটের বড় এখন বেশ দুর্লভ।
আমাদের গ্রামবাংলার বেশ পরিচিত মাছ কিন্তু এরা। অন্তত কিছুদিন আগে পর্যন্ত তো তাই ছিল। গ্রামের পুকুর, ডোবা, খালে যথেষ্ট সংখ্যায় দেখা মিলতো। বর্ষার জলে ডোবা বিল,জলার অত্যন্ত পরিচিত মাছ ফলুই। নদী থেকে ঈষৎ নোনাজলের খাঁড়িতেও এদের অবাধ বিচরণ। ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ছাড়াও প্রায় পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ছড়ানো এর আবাস ভূমি। আমাদের দেশে শহুরে সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত মানুষজনের গরিষ্ঠ অংশ না-পসন্দ করলেও, খাদ্যরসিকের কাছে যথেষ্টই কদর আছে এদের। কিন্তু বর্তমানে সংখ্যাটা চোখে পড়ার মতো কমেছে। এর একটা বড় কারণ গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ পুকুরঝিলেই এখন শুধুই পোনা মাছ চাষ হচ্ছে। শাল শোল চাঁদা ফলুইয়ের মতো মাছেরা চাষীদের কাছে শুধুই কদরবিহীন "আমাছা"। আগাছার মত এদেরও চাষের জমি থেকে উপড়ে ফেলাকেই তারা কর্তব্য বলে মনে করেন। আর একটা কারণ চাষের জমিতে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক! সব মিলিয়ে আর পাঁচটা দেশি মাছের সঙ্গে ফলুইয়ের সংখ্যাটাও পড়তির দিকে। প্রত্যেক অঞ্চলের অন্তত কিছু জলাভূমিকে প্রাকৃতিক না রাখতে পারলে এই অবক্ষয় রোখা বড় মুশকিল।
তাহলে আজ এই পর্যন্ত থাক। সুযোগ পেলে আবার কোনো এক সময় বনে-পাহাড়েতে ফিরে আসবো অন্য কোনো মাছের গল্প নিয়ে।
তথ্যঋণ :Yanwirsal. H, P. Bartsch, F. Kirschbaum (2017) Zoosystematics and Evolution 93(2): 299-324
লেখক পরিচিতি: সৌম্য সরকারের পেশা অধ্যাপনা। গবেষণার কাজ মূলত দক্ষিণবঙ্গে হলেও, গত বারো বছর বন্যপ্রাণের খোঁজ খবরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাংলার পাহাড় থেকে সমতল। লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদ থেকে প্রকাশিত মেঠোবই “বাংলার সাপ”। ভালোবাসেন বিভিন্ন দেশি মাছকে নিজস্ব পরিবেশে রেখে তাদের আচার-আচরণ সম্বন্ধে জানতে।
Comments