বাঘ হল খাদ্যশৃঙ্খলে শীর্ষে থাকা প্রাণী। একটা বাস্তুতন্ত্র কতটা সুস্হ ও সতেজ তা বোঝা যায় সেখানে বাঘের মত প্রাণীর অস্তিত্ব দিয়ে। কিন্তু শুধু আবেগ দিয়ে, কিছু অরণ্য তাদের জন্য ছেড়ে রাখলেই টিকবে না বাঘেরা।দরকার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও দৃষ্টিভঙ্গী। দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার পর সেই নিয়ে আলোচনায় বিশিষ্ট বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ ও Wildlife Conservation Trust (WCT) এর প্রেসিডেন্ট অনীশ আন্ধেরিয়া।বাঘ সংরক্ষণে এই করিডরের গুরত্ব নিয়ে আলোচনায় আজ দ্বিতীয় পর্ব।
গুরুত্বপূর্ণ বাঘ সংরক্ষণের কেন্দ্রবিন্দুরা ও করিডর
সোজাসাপ্টা কথা হল জাতীয় উদ্যানগুলির মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী পার্কগুলোর মধ্যে যোগাযোগের করিডরগুলি রক্ষা না করলে ভবিষ্যতে এইসব জাতীয় উদ্যানে বাঘ বাঁচানো সম্ভব হবে না।
যেমন কানহার সাথে দক্ষিণে মহারাষ্ট্রের নভেগাঁও-নাগজিরার সংযোগ রয়েছে বালাঘাটের অরণ্য অঞ্চলের মাধ্যমে। এরপর আরও যোগাযোগ চলে গেলে তাড়োবা-আন্ধেরি টাইগার রিজার্ভ অবধি মাঝের আদিয়ালের আঞ্চলিক অরণ্যগুলির মাধ্যমে এবং উমরেদ-পোনি-কারান্ডালা অভয়ারণ্যের মাধ্যমে। কানহার যোগাযোগ রয়েছে ছত্তিশগড়ের আচানাকমার টাইগার রিজার্ভের সাথে ফেন অভয়ারণ্যের মাধ্যমে।
পেঞ্চের যোগাযোগ রয়েছে মেলঘাটের সাথে মহেন্দ্রির বনাঞ্চলের মাধ্যমে যা ওয়ারুদের বনাঞ্চলের সাথেই আরও বিস্তৃত হয়েছে তালেগাঁও বনাঞ্চলে যা আরো যোগাযোগ রক্ষা করছে বোর টাইগার রিজার্ভের সাথে।
আমি এইসব জায়গা শুধু ঘুরে ঘুরেই দেখিনি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপগ্রহ চিত্রে নজর রেখে দেখেছি মহারাষ্ট্রের পেঞ্চের বাঘ বন কিভাবে নভেগাঁও-নাগজিরার সাথে সংযুক্ত হয়েছে মোগারাকসা, পানি, লান্দেজারি এবং নাকাডোংরির বনাঞ্চল দিয়ে।
বাঘেদের জন্য মানুষের তৈরি করে দেওয়া সীমানা অর্থহীন, কিন্তু মানুষের অনধিকার প্রবেশ ও চলাচলে বাধা সৃষ্টির অনেক ফল হতে পারে, এমনকি মৃত্যু।
এমনকি শখের বন্যপ্রাণী গবেষক যিনি গুগল আর্থের ব্যবহার জানেন(যেটা খুব সহজ), সহজেই বুঝতে পারবেন কিভাবে কুনো-পালপুর অভয়ারণ্য উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে রনথোম্ভরের সাথে নিশ্চিতভাবে সংযুক্ত। এবং সাতপুরা দক্ষিণ-পশ্চিমে মেলঘাটের সাথে যুক্ত। একইভাবে সঞ্জয়-ডুবরি যুক্ত গুরু ঘাসিদাস টাইগার রিজার্ভের সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে।
বন হল কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ বিষয়। তাই পরিকল্পনাকারীরা যখন সব শেষে নদী ও বনের মধ্যে নাড়ির টান বুঝতে পারেন, তখন তাদের কাছে 'করিডর' যাদের কথা এই রচনায় বলা হচ্ছে, তাদের দাম বাঘের মত একটা অনন্যসাধারণ জানোয়ারকে বাঁচানোর থেকেও অনেক বেশি হয়ে দাঁড়ায়। তার কারণ জলের যোগানের জন্য এইসব অরণ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশে। এবং এই কারণেই মধ্যপ্রদেশ শুধু মধ্যভারত নয়, এর দক্ষিণে গোটা ভারতীয় উপদ্বীপের অস্তিত্বের জন্যই জরুরি বলে পরিগণিত হচ্ছে।
বাঘেরা বাধার মুখে
কানহা ও পেঞ্চের মাঝে যে করিডর তা অনেকটা প্রশস্ত হলেও এখন রাস্তা, রেলপথ ও খালের কারণে বিপর্যস্ত। সব করিডরই আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে মানুষের লাগানো আগুনে,জ্বালানির কাঠ সংগ্রহের জন্য, গবাদি পশুচারণ ও চোরাগোপ্তা শিকারের ফলে। স্হানীয় মানুষজনের এইসব কাজ আসলে তাদেরই পরিবেশের ক্ষতি করছে দীর্ঘমেয়াদে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রক এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের মধ্যে যদি সামঞ্জস্য সাধন করা যায় ঠিক মত, তবে বন দপ্তরের অধীন যেসব সম্পদ রয়েছে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করে পরিকাঠামো উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা করা যাবে।
পড়ুন প্রথম পর্ব: 'টাইগার করিডর' ও বাঘ সংরক্ষণ
ভারতে যেভাবে দেশজুড়ে সড়ক, রেলপথ ও সেচখালের মত পরিকাঠামোর বিকাশ হচ্ছে দ্রুত গতিতে তাতে ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত অরণ্যগুলির বাস্তুতন্ত্রের ওপর আরও প্রভাব পড়ছে।
WCT র সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় মধ্যভারতের ভূ-ভাগ জুড়ে থাকা আটটি রাজ্যের এলাকার মধ্যে পড়া সড়ক, রেলওয়ে লাইন ও সেচের খালগুলি কিভাবে এই করিডরকে ভাগ করে দিচ্ছে বা ভাগ হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি করছে তা দেখা হয়েছে। সরকারি ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা ১৭০০টি প্রস্তাবের মধ্যে ৩৯৯টি বাঘেদের করিডরকে বিভক্ত করে দিচ্ছে। তার মধ্যে ৯৬টি মধ্যপ্রদেশে। এটা হচ্ছে মূলত: এই কারণেই যে করিডরগুলি বিস্তারিতভাবে চিহ্নিত নয় ও পরিকল্পনাকারীরা অনেক দূরে বসে শুধুমাত্র সরলরেখার টান মেরেই এক একটা প্রকল্পের চিন্তা করছেন, যেখানে সামান্য কিছু পরিবর্তনই অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ করিডরকে বাঁচাতে পারে। আসলে সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল বিকল্পটাকেই বাছা হচ্ছে এভাবে, করিডরগুলিকে বাঁচাতে একাধিক অন্য বিকল্প থাকলেও।
মধ্যপ্রদেশ এমন একটি রাজ্য যেখানে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত পর্যটন জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এই সব তথ্য পরিকল্পনাকার ও জনগণের কাছে থাকা দরকার। বিশেষত: ন্যাশানাল পার্কের পরিচালকবর্গ ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্য বন্যপ্রাণী পরিষদের সদস্যরা যেন সময়মত তা জানতে পারেন, যাতে পরিকল্পনাগুলির প্রয়োজনীয় পুনর্যোজনার ব্যবস্হা নেওয়া যায় সময় ও অর্থের অপচয় না করে।
সমস্যা নিরসনে আন্ডার-পাস বা ওভার ব্রিজের মত ব্যয়বহুল ব্যবস্হার ওপর যখন নজর পড়ছে বন্যপ্রাণীর যাতায়াতের জন্য, তখন এটুকু অন্তত মনে করা দরকার ইতিমধ্যে যেসব পরিকাঠামো রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও এমন বিনিয়োগের দরকার আছে। সেটা করতে হলে এইসব কাজে যুক্ত সকলকে এটা ভাবতে হবে যে, অরণ্য নিজেই একটা বিপুল অর্থনৈতিক পরিকাঠামো (যদি পর্যটন, জল সঞ্চয় , কার্বন ধারণের বিষয় মাথায় রাখি) এবং এক ধরনের পরিকাঠামো বানানোর জন্য অন্য ধরনের পরিকাঠামোকে নষ্ট করে দেওয়া কখনই দেশের পক্ষে উপযোগী নয়। পরিকাঠামো পরিকল্পনা করার সময়ে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের সমস্যা সমাধানের ভাবনা যদি একসাথে করা হয়, তবে পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশ বা জনমতের চাপে পড়ে তার জন্য বিরাট খরচ করার দরকার পড়ে না। পরিকাঠামো উদ্ভূত সমস্যা প্রশমনের (mitigation) জন্য ব্যয় বরাদ্দের কথা মাটি খোঁড়ার আগেই ভাবা উচিত যাতে তা ভবিষ্যতে খরচ বাড়িয়ে না দেয় এবং সময় নষ্ট না করে।
যদি সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হত এবং দীর্ঘমেয়াদি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালানো হত, তবে ৭ নং জাতীয় সড়ক যা গুরুত্বপূর্ণ কানহা-পেঞ্চ-নভেগাঁও-নাগজিরার সংযোগরক্ষাকারী করিডরকে বিভক্ত করেছে, তার সমস্যা প্রশমনে করা খরচ অনেক কম হত, নির্মাণেও সময় কম যেত। Detailed Project Report (DPR) পেশ করার আগে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও সংরক্ষণ বিজ্ঞানের ব্যবহার এবং সড়ক নির্মাণের এলাকার বিষয়ে স্বচ্ছতা- উন্নয়ন ও বাস্তুতন্ত্র দুজনের পক্ষেই স্বস্তির কারণ হয়।
এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আগামী বছরগুলিতে বিভিন্ন দেশকে বাস্ততন্ত্র ও পরিবেশ বাঁচাতে বিপুল খরচ করতে হবে, কারণ তার ওপরেই অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর টিকে থাকা নির্ভর করবে।
বর্তমানে প্রযুক্তির যুগে জাতীয় পরিকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনার সময় আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে কাজ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। 'কিভাবে বন্যপ্রাণী বাঁচানো যাবে'- র ওপরে বিষয়টি থেমে নেই।বরং ভারতীয় উপমহাদেশের বহুশ্রুত জীববৈচিত্রের জন্য কী কী সুবিধা আমরা পাচ্ছি ও কেন আমাদের জীববৈচিত্র বাঁচানো দরকার এটাই এখন মূল প্রতিপাদ্য।
বর্তমানে, মধ্যপ্রদেশের সেই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আছে যাতে তারা গোটা দেশকে পথ দেখাতে পারে কিভাবে পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্রের উন্নয়ন সম্ভব, এমনকি তার উপর ভিত্তি করে মানুষের জীবন ধারণের মানোন্নয়ন সম্ভব। খুব হালকা ভাবে মধ্যপ্রদেশের অরণ্যগুলির বাফার এলাকাগুলির পরিচালনার খোঁজ খবর নিলেই বুঝতে সুবিধা হবে যে, যদি প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও পুঁজি হাতে থাকে তবে বনদপ্তরই কত ভাল ভাবে জীববৈচিত্র রক্ষা ও সেই জীববৈচিত্রের কেন্দ্রগুলির আশেপাশে থাকা মানুষজনের স্বার্থ সুরক্ষার কাজটি কত ভাল ভাবে একসাথে সামঞ্জস্য রেখে করতে পারে।
করিডরের সংজ্ঞা:
'করিডর' শব্দটির অনেক রকম ব্যবহার রয়েছে:
বনভূমি, যা যাতায়াতে সাহায্য করতেও পারে নাও পারে
সংযোগরক্ষাকারী ভূ-ভাগ
বিক্ষিপ্ত কিছু বসবাস উপযোগী আশ্রয়স্হল
হাইওয়ের তলায় বানানো আন্ডারপাস
সংকীর্ণ ভূ-ভাগ যা বড় বনভূমির মধ্যে সংযোগ রক্ষায় সাহায্য করে, যেমন নদীর তীর বরাবর ছোট অরণ্যভূমি
করিডরের উপযোগিতা:
নতুন কোন এলাকায় বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করা
পুরানো এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয় গেলে অন্য জায়গায় যেতে সাহায্য করা
নতুন কোন এলাকায় জনসংখ্যা পুন:স্হাপিত করা যেখানে পূর্বে বাঘের সংখ্যা শেষ হয়ে গেছিল
প্রজাতির জীবনচক্রের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় এলাকায় জায়গা পরিবর্তনে সাহায্য করা
বাসস্হানের সার্বিক আয়তন বাড়ানো, বিশেষত: যে সকল জন্তুর বড় এলাকা প্রয়োজন হয় বেঁচে থাকার জন্য
প্রশস্ত করিডরগুলি সার্বিকভাবে বাস্তুতন্ত্রকে সাহায্য করে, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের এক অরণ্য থেকে অন্য অরণ্যে ছড়িয়ে যেতে সাহায্য করে কয়েক প্রজন্ম ধরে। এগুলো বস্তুত: ভূ-ভাগের মধ্যে আন্ত:সংযোগ, যেমন বালাঘাটের মধ্যে চিয়ে কানহা ও পেঞ্চের যোগাযোগ। সুরক্ষিত বনাঞ্চলের থেকে এইসব করিডর কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় জীববৈচিত্র ও প্রজননের কথা মাথায় রাখলে। বাঘেদের একটা তরতাজা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয় এমন সব করিডর। এখানে জন্ম নেওয়া শাবকেরা আশেপাশের টাইগার রিজার্ভে ছড়িয়ে যায়, এমনকি আধিপত্য বিস্তার করে সেখানে।
(শেষ)
লেখক পরিচিতি: লেখক Carl Zeiss Conservation Award জয়ী বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ ও সংরক্ষণবিদ। Wildlife Conservation Trust এর পরিচালক ও সভাপতি। National Tiger Conservation Authority ও মহারাষ্ট্র রাজ্য বন্যপ্রাণী পর্ষদের সদস্য।Bombay Natural History Society’ (BNHS) এর গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য।
মূল প্রবন্ধটি Sanctuary Asia ( Vol. 38 No. 12)পত্রিকাতে প্রকাশিত। অনুমতিক্রমে বনেপাহাড়ের জন্য অনুবাদ করলেন সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।
Comentários