top of page
..

বনের গাধা ছিল রনে

অরণ্য মানে শুধু সবুজের সমারোহ নয়, শ্যামল ছায়া নয়, পাতা ছাঁকা রোদ নয়, পাখির কলতান নয়, শুধু পাহাড়ি নদীটির আনমনে বয়ে যাওয়া, কিংবা ডোরাকাটা প্রাণীটির নিঃশব্দে চলা ফেরা করা নয়। পাশাপাশি আছে রুক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে নিত্য মোকাবিলা, রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে রোজদিন পাঞ্জা কষা কিছু মানুষ। তাদের দুঃখ,দারিদ্র, অভাব, অনটন। কচ্ছের রনে জীবজগত ও মানুষের সেই পারস্পরিক অবস্হানের বাস্তবতার কথা উঠে এল নীল মজুমদারের লেখায়।

কচ্ছের বুনো গাধার দল। ছবি: Asim Patel/ wikimedia commons


একটি ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের দীক্ষান্ত সমারোহে যোগদান করার জন্যে আহমেদাবাদ যেতে হয়েছিল। অনুষ্ঠানের আগের দিন বিকেলে ওখানে পৌঁছে জানতে পারলাম, সম্ভবতঃ গরমের কথা মনে রেখেই অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে প্রশস্ত লনে, সন্ধে বেলায়। তার মানে, পরের দিন সকাল ও দুপুরের খোলামেলা সময়টুকু আমার হাতে রয়েছে, একেবারে অপ্রত্যাশিত উপহারের মতই।

দিনটা মোটেই ছুটির দিন নয়। কারোর বাড়ি দেখা করতে গিয়ে অকারণ বিড়ম্বনায় ফেলার কোনো মানেই হয়না। তবে কি হোটেলের রুমে বসে বইপত্র, ম্যাগাজিন পড়ে, টিভি দেখে সময় কাটিয়ে দেব! স্থানীয় এক বন্ধু ফোনে উপদেশ দিল, কোনোটাই করার দরকার নেই। তুই বরং সকালে বেরিয়ে ‘লিট্‌ল্‌ রন্‌ অফ কচ্ছ'-এ চলে যা, বন্য গাধাদের অভয়ারণ্য দেখে আয়।

ভারতে এই প্রজাতির প্রাণী আর কোথাও পাওয়া যায়না। সে হিসেবে ‘অদ্বিতীয়’ এই অভয়ারণ্যের নাম শুনেছি। কিন্তু আগে কয়েকবার আহমেদাবাদ এলেও জায়গাটি দেখা হয়ে ওঠেনি। ‘রন্‌’ হিন্দি মূলের শব্দ যার অর্থ ‘মরুভূমি’ হলেও, কচ্ছের রন্‌ কিন্তু আমাদের পরিচিত অর্থে ঠিক মরুভূমি নয়। রন্‌ হল আরব সাগর উপকূলের সেই রকম একটি মরুস্থল যা বর্ষার দিনে জলে ডুবে থাকে। ভূতত্ববিদরা মনে করেন, এই জায়গাটি অতীতে আরব সাগরের একটি অপেক্ষাকৃত কম জলের ভাগ ছিল। কালক্রমে মাটি উঁচু হয়ে গিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে এই জায়গাটির ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। গুজরাটের পশ্চিম প্রান্তের প্রাচীন নাম ছিল ‘কচ্ছ’ বা ‘কচ্ছ দ্বীপ’। সেই থেকেই হয়েছে ‘রন্‌ অফ কচ্ছ’। পশ্চিম প্রান্তের বিস্তৃত ভাগ কে বলা হয়, ‘গ্রেট রন্‌ অফ কচ্ছ’। আর ক্রমশঃ পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়ে সুরেন্দ্রনগর জেলায় যেখানে ত্রিভুজাকৃতি ছোটো একটি পকেটের মধ্যে রন্‌ শেষ হয়েছে, সেই দিকটিকে বলে ‘লিট্‌ল্‌ রন্‌ অফ কচ্ছ'। আমি যাচ্ছি সেখানেই। রনে ঢোকার কয়েকটি বিকল্প পথ আছে। ‘দসাডা’ গ্রাম হয়ে ঢোকা যায়, ঢোকা যায় ‘জৈনাবাদ’, ‘ধ্যানগধ্‌রা’, কিংবা ‘বাজানা হয়েও। আমি যাবো বাজানা গ্রামের পথ দিয়ে।

ট্যাক্সি নিয়ে আহমেদাবাদ থেকে পঁচানব্বই কিলোমিটারের দূরত্বে বাজানা পৌঁছতে দু’ঘন্টার বেশি সময় লাগলোনা। বেলা প্রায় দশটা।এর মধ্যেই রোদে চারিদিক বেশ তেতে উঠেছে। ফরেস্ট রেস্ট হাউসে বসে একটু চা খেয়ে ঘুরতে বের হবার আগে রেঞ্জ অফিসার বললেন, ‘মাথায় টুপি পরে নিন কিংবা কাপড় দিয়ে ঢেকে নিন স্যার, এই রোদ গায়ে যথাসম্ভব কম লাগাই ভালো’।

এপ্রিলের সবে সূত্রপাত হয়েছে। এখনও এপ্রিলের বাকি ভাগ এবং মে মাস রয়েছে। যেন আমার মনের কথা শুনতে পেয়েছেন, এইভাবে ভদ্রলোক বললেন, ‘মে মাসের শেষদিকে এখানের তাপমাত্রা আটচল্লিশ উনপঞ্চাশ দিগ্রী সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়।' বুঝলাম আসার সময়টা বেহিসাবের হয়েছে। তবে এসেছি যখন, তখন যতই গরম লাগুক সব দেখেশুনে, ঘুরেফিরেই যাবো, ঠিক করে ফেললাম আমি।

অভয়ারণ্যের ভেতর পাকা রাস্তা নেই। সুতরাং আমার আহমেদাবাদ থেকে আনা ট্যাক্সি সেখানে অচল। তাতে অবশ্য অসুবিধার কিছু নেই, ঘোরার জন্যে জীপ এখানে সব সময় পাওয়া যায়। এইরকম একটি জীপে বসে বাজানা গ্রাম পেছনে ফেলে মিনিট পনেরো কুড়ি যেতেই চোখের সামনে নিসর্গ একেবারে বদলে গেল। এরকম ধুধু মাঠ, বৃক্ষবিরল, দিগন্ত ছোঁওয়া এরকম উন্মুক্ত প্রান্তর, জয়সালমেরে ছাড়া অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়েনা। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এরই মধ্যে চোখে পড়ল একটি প্রসারিত জলাশয়। কাছে এসে দেখি জলে বসে আছে বেশ কিছু ফ্লেমিংগো। ফ্লেমিংগো নোনতা জলের পাখি। নানারকম জলজ এ্যালগি, বিশেষত ব্লু-গ্রীন এ্যালগি, ছোটো মাছ, শামুক এইসব খেয়ে জীবন ধারণ করে। গায়ের রং সাদা। কিন্তু, চামড়ার নিচে (খাবারের সঙ্গে শরীরে ঢুকে পড়া) এ্যালগির ক্যারিটিনয়েড পিগমেন্ট জমার ফলে সাদা রং লালচে বা গোলাপি দেখায়। মুম্বাইয়ের থানে ক্রীকের কাছে সেওরিতে যে সব ফ্লেমিংগো দেখা যায়, ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসে তারা সাইজে ছোট। তাদের ‘লেসার ফ্লেমিংগো’ বলা হয়।

এখানে তারা তো আছেই, তাছাড়াও আছে, সাইজে একটু বড় ‘গ্রেটার ফ্লেমিংগো’। ফ্লেমিংগো ছাড়া, ধূসর সাদা, দীর্ঘচঞ্চু ভারী শরীরের পেলিকানও দেখতে পেলাম। এই দুটি পাখির বসার ভঙ্গী একেবারেই আলাদা। ফ্লেমিংগোর লম্বা লম্বা দুটি পা দূর থেকেই দৃশ্যমান। পেলিকান বসে জলে পেট সাঁটিয়ে, তাদের পা দেখা যায়না।

গ্রেটার ফ্লেমিংগো। ছবি: J.M. Garg/ wikimedia commons

জলাশয়ের ওপাশে হালকা গাছ পালার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আমার সারথি কাম্‌ গাইড প্রাণেশ ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে সেদিকে নিয়ে আসতে দেখলাম প্রায় সবই পনেরো কুড়ি ফুট উচ্চতার প্রোসোপিস গাছ। স্থানীয় ভাষায় বলে খেজড়ি। এই গরমে শুকিয়ে ধুসর হয়ে আছে। কালচে মাটি, কোথাও সামান্য হরিদ্রাভ। ফাঁকে ফাটলে হয়তো কয়েক গুচ্ছ পিঙ্গল ঘাস বেরিয়েছে। মাথার ওপরে চৈত্রের নিদাঘ আকাশ। সব মিলিয়ে প্রকৃতির এক আশ্চর্য নিরাভরণ রূপসজ্জা।

কচ্ছের রনের প্রকৃতি। ছবি: লেখক।

এইসব দেখছি যখন, দুটি শজারু একটি ঝোপ থেকে বেরিয়ে আর একটি ঝোপের পেছনে চলে গেল অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায়। বেশিক্ষণ দেখতে পেলাম না, কিন্তু এই নিঃশব্দ নির্জন প্রান্তরে নূপুর নিক্বণের মত ছুমছুম শব্দ শুনতে পেলাম বেশ কিছুক্ষণ।

‘এখানে, নেকড়ে, হায়না, আর ডেসার্ট ফক্স মানে খুব ছোট এক ধরণের শেয়ালও আছে। তবে ওরা হল গিয়ে রাতের প্রাণী, অন্ধকার না হলে ওদের দেখা যাবেনা।' প্রাণেশ ভাই জানালো যথাসময়।

‘আচ্ছা, বর্ষার সময় যখন এই জায়গাটা জলে ভরে যায়, তখন এই বন্য প্রাণীদের তো ভারি অসুবিধা হয় নিশ্চই, তাই না? কোথায় যায় এরা তখন?' গাড়িতে বসে প্রাণেশ ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।

প্রাণেশ বলল, ‘এই যে জায়গাটা দেখছেন, আপাত দৃষ্টিতে সমতল মনে হলেও এখানে বেশ কিছু কম উচ্চতার টাপু বা ঢিপি রয়েছে। এগুলো জলে ডোবেনা। জংলি জানোয়াররা সেখানে দিন কাটায়।'

আমার মন খুঁতখুঁত করছিল, বললাম, ‘জায়গা কম পড়েনা?'

‘না, স্যার পড়েনা।'

সীটের নিচ থেকে একটা ছোট পকেট বুক বার করে দেখে নিয়ে প্রাণেশ ভাই বলল, ‘এখানে চুয়াত্তরটা এরকম টাপু আছে। আবার কিছু টাপু আমাদের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টও তৈরি করেছে। ওই দেখুন একটা তৈরি করা টাপু’, বলতে বলতে প্রাণেশ ভাই একটি দূরে একটি মাটির ঢিপির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

মাটির ঢিপি। ছবি: লেখক।

কাছে এসে দেখলাম ব্যবস্থা মন্দ না। বিরাট বড় একটি বৃত্তের পরিধি জুড়ে নালা খোঁড়া হয়েছে। সেই মাটি জমা করা হয়েছে বৃত্তের মাঝখানে। এই জায়গাটিতেই বর্ষার দিনে গজিয়ে ওঠে নানারকম ঘাস, হালকা ঝোপঝাড়। বৃষ্টিতে মাটি যাতে ধুয়ে না যায়, তার জন্যে নিচের দিকে দেওয়া হয়েছে পাথরের বাঁধ। পাথর ছাঁকা জল জমা হয়েছে নালায়।

গরম ক্রমশ: বেড়েই চলেছে। কখনও কাঁচা রাস্তায়, কখনও মাঠের ভেতর দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে প্রাণেশ ভাই। কোথাও একটা ঝাঁকালো গাছ নেই যার তলায় দাঁড়িয়ে একটু ঠান্ডা হওয়া যেতে পারে। যাদের দেখার জন্যে এই কৃচ্ছসাধন, তাদের দেখা কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি। আদৌ কি পাওয়া যাবে, বিশেষ করে এই গরমে! প্রাণেশ ভাই কে

আমার এই সন্দেহের কথা বলতেই, ও জবাব দিলো, 'স্যার আপনি ঘুড়খুরদের কথা বলছেন তো? ওদের ছায়া টায়া লাগেনা। খোলা আকাশের নিচে, ওরা সব দিব্যি দল বেঁধে বসে থাকে। ওই দেখুন।'

ডানদিকে তাকিয়ে দেখি, একটু দূরে সাত আটটি বন্য গাধা, কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে একেবারে খোলা জায়গায়। একটু দূরে বসে আছে আরও কয়েকটি। এরাই তারা, যাদের নামে এই অভয়ারণ্য! এতো সহজ এদের দেখা পাওয়া! আমি রীতিমত অবাক। অরণ্যের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে আত্মগোপন করে থাকা বন্যপ্রাণীদের স্বভাব। বাঘ থেকে শুরু করে হাতি, গণ্ডার কেউ এর ব্যতিক্রম নয়। সেই অর্থে এখানে অরণ্য নেই। কিন্তু তাতে এদের কোনও ক্ষতিও হয়নি। ধুসর সাদা ও বালি রং এর এই প্রাণীরাও এখানের ধুসর পরিবেশের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে খেয়াল করে না দেখলে চোখে পড়েনা। উচ্চতায় সাড়ে চার ফুটের বেশি হবেনা। মাথা

থেকে লেজ অবধি মাপলে সাত ফুটের মত। বেশ তেজী, বলিষ্ঠ গড়ন। আমাদের পরিচিত গাধাদের চেয়ে, ঘোড়াদের সঙ্গেই আকারে প্রকারে এদের মিল বেশি। গৃহপালিত গাধাদের মত এরাও ঘোড়া পরিবারের সদস্য। (ফ্যামিলি: ইক্যুয়িডি)। বৈজ্ঞানিক নাম, ‘ইক্যুয়াস হেমিওনাস’। স্থানীয় লোকেরা বলে, ঘুড়খুর। আমাদের চলতি কথায়, বন্যগাধা, ইংরিজিতে, ‘ওয়াইল্ড এ্যাস’।

এই ‘ইক্যুয়াস হেমিওনাস’ নামের প্রাণীটির বসবাস ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, উত্তর চীন অর্থাৎ, এশিয়ার বিরাট একটি অঞ্চল জুড়ে। তবে স্থান বিশেষে তাদের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য দেখা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা তাদের বিভিন্ন উপ-প্রজাতিতে ভাগ করেছেন। ভারতীয় উপপ্রজাতির নাম, ‘খুর’। তাই এদের সম্পূর্ণ নাম দাঁড়ালো, ‘ইক্যুয়াস হেমিওনাস খুর’। শোনা যায় এই খুর উপ প্রজাতির প্রাণীরা একসময়, গুজরাট তো বটেই, এমনকি, পার্শ্ববর্তী রাজস্থানেও স্বচ্ছন্দে বিহার করত। রাজস্থানে এখন আর খুর নেই। গুজরাটেও শুধু এই লিট্‌ল্‌ রন্‌ অফ কচ্ছেই এদের বাসস্থান সীমিত হয়ে গেছে। অশ্বের সঙ্গে (সেই সূত্রে অশ্বশক্তির সঙ্গেও!) আত্মীয়তা থাকার ফলেই বোধহয়, এদের স্ট্যামিনা খুব বেশি। ঘন্টায় পঞ্চাশ ষাট কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে অনেকক্ষণ। এবং শীতের রাত্রের এক দুই ডিগ্রী থেকে গরমের দুপুরের আটচল্লিশ-উনপঞ্চাশ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে অনায়াসে। বলা-বাহুল্য এরা তৃণভোজী। স্থানীয় ভাষায় ‘মোরাড’ নামে পরিচিত একটি ঘাস এদের খুব প্রিয়। তাছাড়াও অন্যান্য ঘাস, গাছের পাতাতেও আপত্তি নেই। বর্ষার পর যখন এই জায়গাটা গাছপালায় ভরে যায়, তখন এদের রসদের কোন অভাব হয়না। ক্রমশঃ জল ও ঘাস শুকিয়ে আসতে থাকে এবং এরাও তার খোঁজে ভ্রাম্যমাণ হয়ে পড়ে।


এখানে এদের কোন প্রাকৃতিক শত্রু নেই। এরা নিজেরাও কখনো কাউকে আক্রমণ করেনা। ভারতীয় রাজা মহারাজাদের অথবা ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে কখনও বন্য গাধা শিকার করার প্রচলন ছিল, এমন কথা নথি পত্রে পাওয়া যায়না। সে হিসেবে দেখলে এদের জীবন সত্যিই নিরঙ্কুশ। এই নিরঙ্কুশ জীবনের ছাপ রয়েছে এদের আচার আচরণে। ঘুড়খুরদের দলের কাছে গাড়ি থামালে এরা ভীত ত্রস্ত হয়ে ছুটে পালায় না, আবার গাড়ির দিকে ধেয়েও আসেনা। পেছন ফিরে মন্থর পায়ে ধীরে সুস্থে অন্যদিকে চলে যায়।

নির্বিরোধী এই ঘুড়খুরদের সংখ্যাও কিন্তু একসময় কমে গিয়েছিল চিন্তাজনক ভাবে। ষাটের দশকের শেষে এই অঞ্চলে ঘুড়খুর ছিল চারশো’র থেকেও কম। ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন এ্যাক্ট (১৯৭২) অনুযায়ী বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অর্থাৎ 'শিডিউল ওয়ান’ এ রাখা হয়েছিল এদের স্বাভাবিক ভাবেই। এ্যাক্ট হবার পর, ১৯৭৩ সালে এই জায়গাটিকে‘অভয়ারণ্য’ ঘোষিত করে যথাসম্ভব সংরক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। তার ফলশ্রুতি, ২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঘুড়খুরদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজারের কাছাকাছি। কিছুক্ষণের ঘোরাঘুরিতেই আমার সঙ্গে পাঁচ ছ’টি বেশ বড় দলের সাক্ষাত হয়ে গেল। দুটি ঘুড়খুর কে ঘোড়ার মত জোড়া পায়ে (দৌড় প্রতিযোগিতা কিনা জানিনা) দৌড়তেও দেখলাম দূর থেকে।

গাধা নামের প্রাণীটিকে মানুষ চিরকাল উঠতে বসতে শুধু অপমানই করেছে। (“সুশ্রান্তোপি বহেদ্‌ভারং…” চাণক্যের সেই বিখ্যাত শ্লোকটি ছাড়া গাধার গুণগান করে সম্ভবত আর কিছুই লেখা হয়নি কখনও)। নির্বিবাদে মানুষের বোঝা বহন করে বলেই বোধহয়, মানুষ এই প্রাণীটিকে নির্বোধ ও মূর্খ ভেবেছে চিরদিন। শুধু ভেবেই ক্ষান্ত হয়নি, ব্যবহারের কলাকৌশলে গাধা, গর্দভ, গাড়ব এই শব্দগুলিকে প্রায় গালাগালির পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তবু দেশের অন্তত একটি জায়গায়, এই প্রাণীদের নামে একটি অভয়ারণ্যের নামকরণ করে এবং এদের সংরক্ষিত প্রাণী ঘোষণা করে সেই দুষ্কর্মের ভার যে একটু লাঘব করার চেষ্টা করা হয়েছে দেখে খুব ভালো লাগলো। ফেরার সময় সারথিকে বললাম, প্রাণেশ ভাই, ঘুড়খুরদের এখানে কোন প্রাকৃতিক শত্রু নেই, শিকারও করা হতনা। তাহলে এদের সংখ্যা এতো কমে গিয়েছিল কেন ?

‘সংখ্যা কমে যাওয়ার বেশ কয়েকটা কারণ ছিল স্যার’, মাথা চুলকে প্রাণেশ বলল। ‘অনেকদিন আগে ঘুড়খুরদের একটা মহামারি হয়েছিল- সুরা। অনেক প্রাণী মারা পড়েছিল তাতে। আমি দেখিনি, শুনেছি। আশেপাশের গ্রাম থেকে বর্ষার পর লোকেরা গরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল চরাতে নিয়ে আসত এখানে। ফলে এদের খাবারে টান পড়ত। তখন এই সব জানোয়াররা গ্রামের ক্ষেতে গিয়ে ফসল নষ্ট করত। তাতে গ্রামের মানুষ রেগে গিয়ে ট্র্যাপ করত, পাথর ছুঁড়তো, মারধোর করত। অভয়ারণ্য হবার পর থেকে এসব অনেকটাই কমে গেছে। তবে একটা ব্যাপার এখনও রয়ে গেছে। সেটা চলুন নিজের চোখেই দেখবেন।'

আসার সময় দূর থেকে চোখে পড়েছিল, ছোট ছোট সাদা ঢিপি এবং তার আশেপাশে ইতস্তত ছড়ানো কয়েকটা চালা ঘর। গাড়ি ঘুরিয়ে সেদিকে আনার পর কাছ থেকে দেখলাম, অনেকখানি জায়গা, চাষের জমির মত আল দিয়ে ভাগ করা রয়েছে। চৌরস মাটি একেবারে সাদা। সেই সাদা মাটিতে দুপুরের রোদ প্রতিফলিত হয়ে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। কোথাও সাদা অংশ মাটি থেকে কাঁচিয়ে তুলে একপাশে প্রমাণ সাইজের স্তূপের মত গুছিয়ে রাখা। কোথাও আল দিয়ে বাঁধা জায়গাটিতে ‘গোড়ালি ডোবা’ জল থৈথৈ করছে। বুঝতে অসুবিধা হয়না, এখানে নুন তৈরি হচ্ছে। মুম্বাইয়ে সাব আর্বান অঞ্চলে খালের নোনা জল নালা কেটে ভেতরে এনে সেই জল শুকিয়ে নুন তৈরি করতে দেখেছি। কিন্তু এখানে খাল বিল নালা কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। বস্তুত সমুদ্র এখান থেকে অনেক দূরে। নোনা জলটা তাহলে আসছে কোথা থেকে?

‘জল এরা কুয়ো খুঁড়ে, ডিজেল পাম্প দিয়ে বের করে। সেই জল মাটিতে ঢালে আর শুকিয়ে নুন তৈরি করে। জলের লেভেল তো খুব নিচে নয়।'

মাটিতে পোঁতা কয়েকটি কাঠ, দড়িদড়া, যন্ত্রপাতির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রাণেশ বলল।

‘এরা মানে কারা?' জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না।

‘এরা সব ‘আগরিয়া' সম্প্রদায়ের লোক। বর্ষার জল শুকিয়ে যাবার পর, এই ধরুন অক্টোবর মাসে আশেপাশের গ্রাম থেকে এখানে চলে আসে। মে মাস অবধি চলে নুন তৈরির কারবার। জুন মাসের প্রথম কি দ্বিতীয় সপ্তাহে বৃষ্টি নামার আগেই কাজ গুটিয়ে আবার গ্রামে ফিরে যায়।'

‘কিন্তু বন বিভাগ অভয়ারণ্যের ভেতর এই কারবার চলতে দিচ্ছে কেন?'

‘স্যার, এদের মধ্যে অনেকে নুন বানাতে শুরু করেছে অভয়ারণ্য ঘোষণা করার অনেক আগে থেকে। তাদের হুট করে সরিয়ে দেবে কি করে! সেট্‌ল্‌মেন্ট করতে হবে। অভয়ারণ্যের অধিকাংশ ভাগটাই বন বিভাগের জমি নয়, রেভেনিউ ল্যান্ড। তাই, আমি যতদূর জান, বন বিভাগ এবং রেভেনিউ বিভাগ মিলেমিশে সেট্‌ল্‌মেন্টের কাজ করছে।'

খুব ছোট কয়েকটি খড়ের চালা দেখা যাচ্ছিল একটু দূরে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু’চার জন মহিলা, পুরুষ, বাচ্চা কাচ্চা। সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম, খুব বেশি লোকজন তো দেখছিনা।

দু’দিকে দু’হাত প্রসারিত করে প্রাণেশ বলল, ‘আছে স্যার, আছে, নানা দিকে, নানা জায়গায়। যাকে লিট্‌ল্‌ রন্‌ অফ কচ্ছ বলা হয়, সেটা বিরাট বড়। শুধু অভয়ারণ্যই সাড়ে চার হাজার স্কোয়্যার কিলোমিটার। তার বাইরেও রন্‌ আছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এখানে, আঠেরো থেকে বিশ হাজার মানুষ নুন বানায়।'

বলে কি, এ যে বিরাট ব্যাপার! আমার মনে পড়ল, আহমেদাবাদ ও তার আশেপাশের এই অঞ্চলটির সঙ্গে নুন তৈরির একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। ১৯৩০ সালের ১২ই মার্চ মহাত্মা গান্ধীর লবণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আহমেদাবাদের পার্শ্ববর্তী সাবরমতী থেকেই, যা কিনা কালক্রমে একটি রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের রূপ নিয়েছিল।

‘এখন তো কাউকে দেখছিনা কাজ করতে?', অন্যমনস্কতা কাটিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম। প্রাণেশ বলল, ‘ভোর পাঁচটায় উঠে কাজ শুরু করে এরা। কাজ চলে এগারোটা, সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। সূর্য ডোবার পর আবার কাজ করে, যতক্ষণ দিনের আলো থাকে ততক্ষণ। মাঝখানের সময়টা এখানে কাজ করা অসম্ভব। তখন এরা ওই ঝোপড়ি গুলোতে কোনো রকমে গাদাগাদি করে শুয়ে বসে থাকে।

'নুন বিক্রি করে কোথায়?'

'এরা ঠিকেদারের মজুর, কিলোর দরে বিক্রি করে ঠিকেদারকেই। তারপর নুন সাফ সাফাই করার জন্যে ফ্যাক্টরিতেপাঠানো, হোল সেল মার্কেটে পাঠানো, মেশিনের খরচা, ডিজেলের খরচা, এসব ঠিকেদারের কাজ। আমি এইমজুরদের অনেককে চিনি। এরা ভীষণ গরীব স্যার। কোনোরকমে দুবেলা খাওয়া জোটে শুধু, কখনও তাও না। সাত আট দিন পর পর স্নান করার সুযোগ পায়। এই গরমে প্রায়ই শরীর খারাপ হয়। সাদা নুনে ঠিকরে পড়া রোদে খুব অল্প বয়েসে চোখ খারাপ হয়ে যায়। সারা দিন রাত নুন লেগে লেগে পায়ে চর্মরোগ হয়। আবার এদের মধ্যেই কেউ কেউ বেআইনি ভাবে নুন তৈরি করার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে।'

'বেআইনি ভাবে মানে?'

নুনের সমুদ্র। ছবি: লেখক।

'অনেকদিন আগে সরকারের কাছ থেকে ঠিকেদাররা লম্বা সময়ের জন্যে এই সব জায়গা লীজ নিয়েছিল নুন বানাবে বলে। তখন অভয়ারণ্য ছিলনা। কেউ কেউ লীজ রিনিউ করিয়েছে। কেউ করায়নি। যারা করায়নি তারা বেআইনি। আর জেনে অথবা না জেনে তাদের সঙ্গে মজুরি করে যারা, তারাও বেআইনি।'

প্রাণেশ ভাইয়ের তথ্য সমৃদ্ধি দেখে আমারও প্রশ্ন বেড়েই চলেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যাদের লীজ শেষ হয়ে গেছে, তারাও রিনিউ করিয়ে নেয় না কেন?'

মুচকি হেসে প্রাণেশ বলল, ‘কারণ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এখন আর নতুন করে লীজ রিনিউ করতে উৎসাহী নয়। ডিপার্টমেন্টের মতে এই সব কাজ কারবার, ঘুড়খুরদের একটা অসুবিধার কারণ।'

'নিজেরাই এত কষ্টে, এত অসুবিধার মধ্যে থাকে যারা, তারা ঘুড়খুরদের অসুবিধার কারণ! কি বলছো প্রাণেশ ভাই!' খুব আশ্চর্য হয়ে আমি বললাম।

মলিন হেসে প্রাণেশ বলল, ‘পাম্প চলার ঘট ঘট আওয়াজ, ডিজেল পেট্রলের ধোঁওয়া, গন্ধ, নুন নিয়ে যাওয়ার জন্যে যখন তখন ট্রাকের আসা যাওয়া, এসব তো ঘুড়খুরদের জন্যে অসুবিধাই। তাছাড়া, এরা অভয়ারণ্যের ভেতর ঝোপড়ি বানিয়ে থাকে, আগুন জ্বালিয়ে রান্না করে, শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে বসে। আপনিই বলুন, এসব কি অভয়ারণ্যের ভেতর অনুমোদন করা যায়? কেউ কেউ আবার একটু একটু করে জায়গা বাড়িয়ে নিচ্ছে। মানে ঘুড়খুরদের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। রনের নিচে খারা পানি তো আছেই। এদের ছেড়ে দিলে পুরো রনেই এরা নমক বানাবে। আপনিই বলুন স্যার, তাহলে ঘুড়খুর বেচারারা যাবে কোথায়? ডিপার্টমেন্ট চাইছে, এরা কাজ গুটিয়ে অন্ততঃ অভয়ারণ্যের সীমার বাইরে চলে যাক। রনের সবটা তো অভয়ারণ্য নয়।'


অর্থাৎ সেই চিরকালীন স্বার্থের সংঘাত। যার একদিকে রয়েছে নিরীহ, বিপন্ন কিছু বন্যপ্রাণী। এত বড় ভারতবর্ষে এই জায়গাটিই যাদের একমাত্র এবং শেষ ঠিকানা। অন্যদিকে রয়েছে, দারিদ্র সীমার অনেক নিচে পশুর অধম জীবন যাপন করা কিছু মানুষ, এই জায়গাটিতেই যারা পুরুষানুক্রমে নুন তৈরি করে আসছে। বড় সূক্ষ্ম একটি বিন্দুর ওপর ভারসাম্য বজায় রেখে অস্তিত্বের লড়াই লড়ছে দুটি গোষ্ঠী, যার একচুল এদিক ওদিক হলেই ‘লিট্‌ল্‌ রন্‌ অফ কচ্ছের’ চালচিত্র একেবারে বদলে যাবে।

একটা সময় ছিল যখন মানুষ তার গায়ের জোরে, বুদ্ধির জোরে প্রকৃতি শাসন করত। সেই মানুষের মধ্যেই এখন নবীনতর ধারণার জন্ম হয়েছে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে, পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে। সেই সংরক্ষণের জন্যে যদি, মানুষেরই গোষ্ঠী বিশেষের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, তাহলে তাদের জন্যে বিকল্প পথ খোঁজা ছাড়া আর উপায় কি ?

'লিটল রন্‌ অফ কচ্ছ’ ছাড়া ঘুড়খুরদের আর কোন থাকার বিকল্প নেই। কিন্তু মানুষের মানিয়ে নেবার ক্ষমতা অনেক বেশি। সুতরাং এখানের ‘নুন তৈরি করা’ মানুষদেরই উজ্জলতর বিকল্পের সন্ধানে ঠিকানা বদলাতে হবে। বলাবাহুল্য, কাজটা কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। সেট্‌ল্‌মেন্টের ব্যাপারে সরকারী বিভাগ গুলির আরও তৎপর, আরও সক্রিয় ভূমিকা চাই। বিকল্পের জন্যে চাই আর্থিক সাহায্য, যেমন দেওয়া হয় টাইগার রিজার্ভের আভ্যন্তরীণ গ্রামে। মধ্যস্থতা করার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থাদেরও।


-------


পরামর্শ: বন্য প্রাণী দেখার ব্যাপারে যারা উৎসাহী, ‘ঘুড়খুর’ দেখতে চাইলে তাঁদের এই অভয়ারণ্যে আসতেই হবে। (দেশের বাইরে গিয়ে অবশ্য দেখা যেতে পারে)। এখানে আসার উপযুক্ত সময়, ডিসেম্বর – জানুয়ারি। যারা একদিন থাকতে চান, তাঁদের জন্যে ‘ধ্রানগধরা’ হয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ ওখানে সরকারী এবং প্রাইভেট গেস্ট হাউস আছে বেশ কয়েকটি। ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা করেন যারা তাঁরাও প্রাইভেট গেস্ট হাউসের সঙ্গে জড়িত। আহমেদাবাদ থেকে একশো ছাব্বিশ কিলোমিটার দূরত্বে ধ্রানগধরা একটি ছোট্ট স্টেশন। ট্রেনে প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগে।

ছবি: Shaunak Chitgopkar/ wikimeida commons

লেখক পরিচিতি: লেখক অবসরপ্রাপ্ত আই এফ এস আধিকারিক এবং ঔপন্যাসিক।







Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page