এসে পড়ল জোরালো এক থাবা তাঁর মুখের ওপর। তারপর? সেখানেই শেষ নাকি সেখানেই শুরু? রনথোম্বরের প্রাক্তন চীফ কনজার্ভেটার দৌলত সিং শখতওয়াতের মুখেই শোনা সেই গল্প উঠে এল সুমন্ত ভট্টাচার্য্যের কলমে। ভারতের মাটিতে বাঘ ও বন্যপ্রাণ বাঁচানোর লড়াইতে এ এক অভূতপূর্ব কাহিনি।
ওইদিকে দাড়িয়ে প্রায় তিন হাজার জনতা। তাদের তাড়া খেয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত বাঘটা এদিকে ছুটে আসছে। একটু আগে ছোঁড়া ঘুমপাড়ানি গুলিটা ঠিকমত জায়গায় লাগেনি বাঘটার এই ছটফটানির জন্য। এদিকে গোটা এলাকাটা জলাজমি। ফলতঃ জিপসিতে করে আসা যায়নি। পায়ে হেঁটেই আসতে হয়েছে বাঘটাকে ধরার জন্য বনকর্মীদের।খবর গেছিল বন থেকে বাঘ বেরিয়ে আশেপাশের গ্রামে, বজরার ক্ষেতে ঘোরাফেরা করছে। একটা মহিষ মেরে ফেলেছে। দলের সবার আগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দৌলত সিং শখতাওয়াত। রনথোম্বর টাইগার রিজার্ভের তৎকালীন ডাকাবুকো অ্যাসিস্টেন্ট কনজার্ভেটার। বাঘটা এবার মুখোমুখি প্রায়। কিছু শব্দ করে বাঘটাকে সরাবার চেষ্টা করলেন। না। উত্তেজিত বাঘটা বরং গর্জন করে উঠল। সঙ্গে বিরাট থাবাটা সজোরে এসে পড়ল দৌলত সিং এর ডান গালে। ঠিকরে বার হয়ে এল চোখটা। রক্ত ফিনকি দিয়ে বার হল মুখ থেকে।তাঁর সঙ্গীদের হইহই চিৎকারে আর লাঠির খোঁচায় বাঘটা সজোরে দৌড় দিল। এদিকে প্রায় অচেতন দৌলত সিং শুধু মাথা তুলে একবার বলতে পারলেন তাঁর ব্লাড গ্রুপের কথাটা সহকর্মীদের। কাছের স্বাস্হ্যকেন্দ্রে খাটিয়া করে নিয়ে যাবার পর প্রাথমিক কিছু ড্রেসিং করে দেওয়া হল। এদিকে খবর চলে গেছে ডি এম, এস পি হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও। রনথোম্ভর আর দৌলত সিং তো সমার্থক তখন রাজস্হানে। সেদিনই মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লী যাবার কথা হেলিকপ্টারে। সেই হেলিকপ্টারই এল তাঁকে এয়ার লিফট্ করতে। প্রথমে জয়পুর , তারপর দিল্লীতে দীর্ঘ দশমাস চিকিৎসা চলে। তিনটে প্লেট, ২২টি স্ক্রু বসল মুখে। তিন তিন বার প্লাস্টিক সার্জারির পর ফালাফালা হয়ে যাওয়া মুখটা তো আবার তৈরি হল, কিন্তু একটা চোখ বরাবরের মত হারাতে হল। কিন্তু তিনি দৌলত সিং শখতওয়াত। রণথোম্ভরের বাঘ আর তিনি একই ধাতুতে গড়া। হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়েই ফিল্ডের কাজে তো যোগ দিলেনই, খোঁজ নিতে শুরু করলেন সেই বাঘের যে তাকে আহত করে পালায়। কি ভাবছেন এবার তো প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বে রাজপুতের ব্যাটা? হা হা...রণথোম্ভরের শুরুর দিন থেকে যিনি প্রাণপাত করেছেন বাঘেদের জন্য, তাদের জীবনের নাড়ি নক্ষত্র নিয়ে পড়ে থেকেছেন তিনি একথা কিভাবে ভাববেন! বাঘের হাতে তো আগেও আহত হয়েছেন তিনি 1997 তে। চোরাশিকার রুখতে গিয়ে স্হানীয় গ্রামবাসীর ছোড়া গুলিতে তাঁর পাশেই মৃত্যু হয়েছে সহকর্মীর। আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের মত মানুষের জীবনপণ লড়াইতে মাথা তুলে দাড়িয়েছে প্রজেক্ট টাইগার। তাই তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন সেই বাঘটির নিরাপত্তা নিয়ে। জানা গেল RT-7 নামের সেই বাঘটা দু'শো কিলোমিটার পার করে ঠাঁই নিয়েছে মথুরার বনে। সরকার সিদ্ধান্ত নিল তাকে কোন টাইগার রিজার্ভে পাঠাতে হবে। সরিস্কায়। দৌলত সিং অনুরোধ করলেন তিনি যেন এই উদ্ধার কাজে থাকতে পারেন দলে। যে বাঘটিকে বাঁচাতে জীবন লড়িয়েছেন, তাকে নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে এলেই তবে শান্তি। সেই দলে তিনি ছিলেন। উদ্ধার কাজ সফল হয়েছিল। 'এই বাঘটি এখন সরিস্কার dominant male'। নতুন নাম হয়েছে তার ST-6। কথাটায় তৃপ্তি ঝরে পড়ছিল তাঁর গলায়। এখনও তিনি মাঝে মাঝে দেখা করতে যান সেই পুরানো 'আততায়ী'র সাথে। প্রায় দু'বছর আগে , যখন করোনা আমাদের জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়নি একে অপরের থেকে, তেমন এক সন্ধ্যায় তাঁর মুখেই শুনেছিলাম এই অদম্য লড়াইয়ের কথা কলকাতায় বসে SHER আয়োজিত বন্যপ্রাণ সচেতনতা সভায়।
'আসলে বাঘটির তো দোষ ছিল না। গ্রামের লোকরা ওকে ওভাবে তাড়া না করলে ও আমায় অ্যাটাক করত না'।
স্মৃতিচারণ করছিলেন তিন দশ বছর আগের অগাস্ট মাসের সেই দিনটার।'আসলে বাঘটির তো দোষ ছিল না। গ্রামের লোকরা ওকে ওভাবে তাড়া না করলে ও আমায় অ্যাটাক করত না'। এই হল ডেডিকেশান, স্পিরিট।ভাবুন তো। কুকুর রাস্তা অপিষ্কার করে গেলেও তো ক'জন (অ) মানুষ তাকে মারার জন্য নিশপিষ করে। আর তিনি তো একচুলের জন্য বেঁচে গেছেন । এমন মানুষরা ভারতে চরম প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূল পরিস্হিতির মধ্যে প্রাণপণ করে লড়াই করছেন প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার। আজও তাই শারীরিক অসুবিধা নিয়েও অবসর নেবার পরেও তিনি জড়িয়ে থাকেন বনকর্মীদের প্রশিক্ষণের কাজে। রনথোম্বরে কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে রয়েছে তাঁর বই- My encounter with the Big Cat, যেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে এই বাঘে-মানুষে লড়াইয়ের কাহিনী যেমন, তেমনই বন বাঁচাতে তাঁর ও তাঁর মত নিবেদিতপ্রান মানুষদের লড়াই, আত্মত্যাগের কথাও। রনথোম্বরের সংরক্ষনের ইতিহাসের সাথে ওতোপ্রত ভাবে জড়িয়ে পাচারকারীদের সাথে ও স্হানীয় দুষ্কৃতিদের সাথে লড়াইয়ের কাহিনীও। সেসব গল্প উঠে আসে তাঁর সাথে আলাপচারিতায়। তাই তিনি যখন বলেন- বাঘ আছে বলে বন বেঁচে আছে। বন আছে বলে নদী, জল পাচ্ছি আমরা- তখন তা আজকের এই জলবায়ু সংকটে আক্রান্ত দেশে গভীর তাৎপর্য বয়ে আনে। এদের জন্য ভাবলে গর্ব হয় ভারতীয় হিসাবে, যেমন লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় কিছু নেতা, মন্ত্রীদের কথা ভাবলে যারা বলে বাঘ বাঁচানোর পিছনে খরচ করা আমাদের মত দেশে মানায় না! এই পরিস্হিতি তাই পথ নির্ধারন করার এই দুঃসময়ে। তাই দৌলত সিংদের কথা আমাদের আরও জানতে হবে, শুনতে হবে। কারণ তা জীবনের কথা, ভবিষ্যতের কথা। বিজ্ঞানের কথা।
ধন্যবাদ জানাই জয়দীপ কুন্ডু ও সুচন্দ্রা কুন্ডুকে এই সুযোগ করে দেবার জন্য কলকাতা শহরে। সাধুবাদ জানাই তাঁকে ও তাঁর সংস্হাকে সেই সব সাধারণ বনকর্মীদের দিনের পর দিন সম্মান জ্ঞাপন করার জন্য, যারা ঢাল তলোয়ার ছাড়াই বন বাঁচানোর কাজ করে চলেছেন পশ্চিম বাংলায় প্রত্যন্ত সব এলাকায়। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গে যারা বন্যপ্রাণী ও সংরক্ষণ নিয়ে ছিঁটেফোঁটা কাজ করার চেষ্ট করছেন, তাদের অনেকের কাছেই জয়দীপ বাবু ও তাঁর সংস্হা 'শের' অনুপ্রেরণার মত। বন বাঁচানোর কাজ তো মানুষ বাঁচানোর থেকে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, হয়ত বেশিই আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভাবলে।
ছবি: ইন্টারনেট ও ফেসবুক থেকে
লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।
Comments