প্যাঙ্গোলিন বা পিপীলিকাভূক বিশ্বের সবথেকে বেশি চোরকারাবারের শিকার বন্যপ্রাণী। ভারত জুড়ে এর জাল বিস্তৃত। কিভাবে হয়, কারা জড়িত! আধুনিক প্রযুক্তি কিভাবে সাহায্য করছে চোরাকারবারীদের! গ্রাউন্ড জিরো থেকে তদন্তের গতিপ্রকৃতি জানাচ্ছেন ওড়িশার বনদপ্তরের ডেপুটি কনজার্ভেটার সস্মিতা লেঙ্কা।
প্যাঙ্গোলিনরা হল দাঁতহীন একপ্রকার স্তন্যপায়ী প্রাণী। তারা একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যাদের শরীরে কেরাটিনের তৈরি আঁশ রয়েছে। তারা হল myrmecophagus। অর্থাৎ পিঁপড়ে আর উইপোকা খেয়ে বেঁচে থাকে ওরা। তাই ওদের বলা হয় পিপিলীকাভূক। পোকা ও পিঁপড়ের ডিম, লার্ভা ও পরিণত প্রাণীকে খেয়ে এরা প্রাকৃতিক উপায়ে পোকামাকড়ের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাদের লম্বা আঠালো জিভ পোকা ধরতে সাহায্য করে। এরা একাই থাকে। বাস করে মাটির গর্তে বা গাছের কোটরে দিনের বেলায়। শরীরকে ওরা বলের মত গুটিয়ে নেয় কোন আক্রমণের আশঙ্কা দেখলে। ওদের পায়ু থেকে দুর্গন্ধযুক্ত একপ্রকার রস নি:স্বরন হয়ে শত্রুকে কাছে দেখলে।
ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭২ অনুযায়ী প্যাঙ্গোলিন হল Schedule I প্রাণী, অর্থাৎ সর্বোচ্চ সুরক্ষার স্তরে রয়েছে। এছাড়া International Union for Conservation of Nature (IUCN) এর লাল সংকেত তালিকায় নথিভুক্ত অবলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসাবে। এছাড়াও এরা International Convention of Trade in Endangered Species (CITES) এর Appendix I এ নথিভুক্ত, যা একে কোনরকম আন্তর্জাতিক ব্যবসার জন্য নিষিদ্ধ তালিকায় রেখেছে।
পৃথিবীতে আট রকম প্রজাতির প্যাঙ্গোলিন আছে। চার রকম করে পাওয়া যায় এশিয়া ও আফ্রিকায়। ভারতে বাস দুই রকম প্রজাতির। চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন (Manis pentadactyla) এবং ভারতীয় প্যাঙ্গোলিন (Manis crassicaudata)। চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে ভারতীয় প্যাঙ্গোলিনের হিমালয় অঞ্চল ছাড়া সারা ভারতেই বাসস্হান।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাউথ চায়না অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি প্যাঙ্গোলিনকে কোভিড-১৯ ভাইরাসের অন্তর্বর্তী বাহক হিসাবে চিহ্নিত করে। একটি স্টাডিতে তারা নোভেল করোনা ভাইরাস-১৯ ও প্যাঙ্গোলিনের শরীরের করোনা ভাইরাসের মধ্যে ৯৯% জেনেটিক মিল খুঁজে পেয়েছেন। ভাবা হয়েছিল করোনার বিশ্বব্যাপী মহামারীর পর, প্যাঙ্গোলিন নিয়ে চোরাকারবার কমে আসবে। কিন্তু আমাদের সেই ভাবনা ভুল প্রমাণ হল।
প্যাঙ্গোলিন পোচিং এর ঘটনা ওড়িশার বিভিন্ন এলাকা থেকেই নজরে আসছে। এই সমস্যা বুঝতে হলে, এই বেআইনি ব্যবসার পদ্ধতি জানতে হলে আমাদের স্হানীয় মানুষের থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। জানতে হবে এটা কি শুধু স্হানীয় স্তরেই হচ্ছে না এর পিছনে সংগঠিত চক্র রয়েছে।
প্যাঙ্গোলিনের আঁশ আর শরীরের বিভিন্ন অংশ চাইনিজ আয়ুর্বেদিক প্রথাগত ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয়। আঁশের ব্যবহার রয়েছে ক্ষিদে না হওয়া, ঘা, ত্বকের সংক্রমণ থেকে মহিলাদের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায়।প্যাঙ্গোলিনের আঁশ কেরাটিনে তৈরি- যা দিয়ে তৈরি আমাদের চুল বা নখ। কিন্তু এর কোন নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক মাদকচক্রের সাথেও প্যাঙ্গোলিন ব্যবসার খোঁজ পাওয়া গেছে। Methamphetamine এর মত নেশার দ্রব্য তৈরিতে প্যাঙ্গোলিনের আঁশের প্রয়োজন হয়।
ওড়িশার আটগড়ের বনাধিকারিকরা ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যেই প্যাঙ্গোলিনের বিরাট বড় এক পাচার চক্রকে ধরতে সক্ষম হয়। ওড়িশার বিভিন্ন জায়গা থেকে ৩০ জনের ওপর পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তে জানা যায় অপরাধীরা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে অনলাইনে আন্তর্জাতিক স্তরে জীবিত প্যাঙ্গোলিন, তার আঁশ ও শরীরের বিভিন্ন অংশের ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। এই জন্য তারা গ্রুপ চ্যাটে নানা সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করত তথ্য আদান-প্রদানে। পাঠানো হত ছবি ও ভিডিও।
প্যাঙ্গোলিনকে জীবিত অবস্হায় বা তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবসা সংগঠিত পাচারকারীদের জন্য এক বিপুল লাভদায়ক ব্যবসা। এই কাজে তারা বনের হতদরিদ্র অধিবাসীদের নিয়োগ করে তাদের অবস্হার সুযোগ নেয়। এসবের ফলে ইতিমধ্যেই দুর্লভ জীবগুলো বিলুপ্তির পথে তো যাচ্ছেই, এই সব আদিবাসী সম্প্রদায়কেও বিপদে ঠেলে দিচ্ছে। বেআইনি উপায়ে প্যাঙ্গোলিনদের মারা হচ্ছে, ওড়িশা ও দেশের অন্যান্য প্রান্তে অবৈধ ব্যবসা চলছে, বিদেশেও পাচার হচ্ছে।
এই বেআইনি বন্যপ্রাণী ব্যবসাটা দাড়িয়ে ছিল ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও একটা সংগঠিত চক্রের মাধ্যমে যারা গোপনে কাজ করত।কিন্তু সাইবার বিস্ফোরনের সাথে সাথে অনলাইনের বিভিন্ন সাইটে ও সামাজিক মাধ্যমে এই ব্যবসার আরও বাড়বাড়ন্ত হয়েছে ২০০০ সালের পর থেকে।বিপন্ন তালিকায় নাম থাকা প্রাণী ও উদ্ভিদের ছবি, ভিডিও অনলাইন সাইটে খুঁজলে পাওয়া যায় যা অবৈধ ব্যবসার কাজে ব্যবহার হয়। মিডলম্যান বা দালালরা তাদের সংগ্রহে থাকা প্যাঙ্গোলিনের ছবি ও ভিডিও অনলাইনে তাদের ব্যবসায়িক সহযোগী ও দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের কাছে পাঠায়, তাদের আকর্ষিত করে কেনার জন্য। এভাবেই পাচারকারী ও অপরাধী গোষ্ঠী বিভিন্ন ই-কমার্স ও সোশাল মিডিয়া সাইট'কে তাদের অবৈধ ব্যবসার কাজে লাগাচ্ছে।
আমাদের তদন্তে এবং চোরাশিকারী ও পাচারকারীদের জেরা করে প্যাঙ্গোলিন শিকারের পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানা গেছে তা হল- প্রথমে প্যাঙ্গোলিনের গর্তগুলো সনাক্ত করা ওদের কাজ।পা ও ল্যাজের ছাপ অনুসরণ এতে সাহায্য করে। এরপর গর্তের বাইরে অপেক্ষা করে ওরা। জীবগুলো গর্ত থেকে বার হলেই ওদের মাথায় আঘাত করে।কখনও কখনও গর্তের মুখে আগুন দিয়ে বার করে আনে প্যাঙ্গোলিনদের।শিকারী কুকুরও ব্যবহার করে চোরাশিকারীরা। এমনকি রাতের বেলাতেও তারা এই কাজগুলো করে, যেহতু প্যাঙ্গোলিন মূলত: নিশাচর প্রাণী। একবার এই প্রাণীগুলোকে ধরা গেলে কোন থলেতে বন্ধ করে তাদের পাচার করা খুবই সহজ, কারণ এই নিরীহ প্রাণীগুলো কোনরকম প্রতিরোধ করতে অক্ষম।
আগেকার দিনে স্হানীয় অধিবাসীরা মূলত: মাংসের লোভেই শিকার করত এই প্রাণীদের। তারপরে তাদের ছাল বা আঁশগুলো পুড়িয়ে ফেলত বা ফেলে দিত।কিন্তু এখন এইসব লোকেরা চোরাবাজারে এই বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত। তাই তারা চেষ্টা করে এদের বাঁচিয়ে রেখে ক্রেতা খুঁজতে। চড়া দামে স্হানীয় চোরাবাজারে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হয় প্যাঙ্গোলিন। এটাই এখন প্যাঙ্গোলিন চোরাশিকারের মূল কারণ হয়ে গেছে। প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়া এখন সহজেই বন সংলগ্ন গ্রামের স্হানীয় শিকারীদের সাথে শহরে বসে থাকা ক্রেতার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে দালালচক্রের সহায়তায়।
বন্যপ্রাণীর এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করতে আমাদের মূল হাতিয়ার কিন্তু সেই বনের অধিবাসীরাই, যারা এইসব প্রাণীর সাথে সহাবস্হানে আছে দীর্ঘদিন। যতদিন না তাদেরকে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের প্রক্রিয়ায় অংশীদার বানানো যাচ্ছে নানারকম সামাজিক উৎসাহমূলক কাজকর্মের মাধ্যমে, ততদিন কিন্তু এই ব্যবসা রোখা সম্ভব হবে না। বরং পরিস্হিতি আরো খারাপ হবে।
বনবাসী সম্প্রদায়ের সহোযোগীতাতেই এই অবৈধ শিকারে রাশ টানা দরকার।বিভিন্ন দায়িত্বশীল সংস্হা, বনদপ্তর, প্রশাসন, গবেষক, NGO এবং মূলত: বনবাসী সম্প্রদায় মিলে একযোগে কাজ করলে তবেই এই অবৈধ চোরাকারবারের জাল কাটার উপায় বার করা যাবে। তবেই বাঁচানো যাবে বিপন্ন প্রাণী প্যাঙ্গোলিনকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে।
ছবি ও ভিডিও: লেখক
লেখক পরিচিতি: সস্মিতা লেঙ্কা ওড়িশার বনদপ্তরের পদাধিকারী। বর্তমানে ডেপুটি কনজার্ভেটার পদে কর্মরত।
Comments