গত এক বছরে প্রায় ১০০-টির ওপর পাখিকে উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্হা 'বন্য'-র মুক্ত বিহঙ্গ প্রকল্প। সেই নিয়ে কলম ধরলেন বন্য-র সদস্য সঙ্গীতা সরকার।
"তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরোনা পাখা"-রবীন্দ্রনাথঠাকুর
যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি যদি পাখি হতেন, তাহলে কি করতেন? এর সহজাত একটি উত্তর আসতো যখন খুশি তখন ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে পারতাম।
উড্ডয়ন পৃথিবীর বেশিরভাগ পাখির চলাচল করার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি।খাদ্য সংগ্রহ, প্রজনন,শিকারির হাত থেকে রক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে পাখির উড্ডয়ন ক্ষমতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সামনের দুটি উপাঙ্গ বহু বছরের বিবর্তনে অভিযোজিত হয়ে ডানায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং এই ডানার বিভিন্ন ব্যবহারের ফলেই পাখি আকাশে ভেসে থাকতে পারে।
কিন্তু পাখির এই স্বাধীনতায় বাদ সেধেছে মানুষ।আমাদের কিছু ভুল, কিছু বিলাসিতা, কিছু মজার শিকার হতে হচ্ছে পাখিদের এবং তার ফলে ওদের মৃত্যু অথবা অঙ্গহানি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।

পুকুর, বাগানে জাল,
আর সুতোয় চীনা মাঞ্জা,
নিরীহ পাখিরা লড়ছে শুধুই,
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।
আর কি কি সমস্যা পাখি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সে ব্যাপারে আলোকপাত করা যাক।
"শব্দ দূষণের প্রভাব
ঘটাবে পাখির অভাব"
শব্দ দূষণের ফলে পাখিরা তাদের সাথীকে আকর্ষণ করার এবং অন্যান্য পাখির সাথে সামাজিক সম্পর্কের ক্ষমতা হারায়।
"শোধন করো জল, বায়ু,
নইলে কমবে ওদের আয়ু"।

সমুদ্রের তেল পাখির পালক আটকে দেয়, তারা যখন চেটে পরিষ্কার করার চেষ্টা করে, তেল পেটে গিয়ে বিষক্রমে তাদের মৃত্যু হয়।ধূমপান, উদ্বেগজনক নানা গ্যাসের কারণে বায়ু দূষিত হয়। এই দূষণের প্রভাব মেরু অঞ্চলে ছড়িয়েছে এবং ওখানকার আর্কটিক পাখির জীবন ঝুঁকির মধ্যে।
কীটনাশক, ভারী ধাতু জলে মিশে পাখির অসুস্থতার কারণ হয় আবার জলে অক্সিজেন মাত্রা কমলে মাছ মারা যায়। যেসব পাখি মাছের ওপর নির্ভরশীল, তারা অন্যত্র চলে যায়, ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।
পাখির ওড়ার সময় শ্বাসপ্রশ্বাস এর হার খুব বেশি থাকে ।ফলে বায়ু দূষক এদের শরীরে প্রবেশ করে অসুস্থ করে দেয়।
করোনা ভাইরাসের কারণে lock down চলছে, কারখানা বন্ধ, চিমনির ধোঁয়া নেই, তাই শিল্পনগরী দুর্গাপুরসহ অন্যান্য জায়গায় ফিরে এসেছে মুনিয়া, বসন্ত বৌড়ি, নীলল্যাজা বাঁশপতি, দুধরাজ, রেখা বসন্ত, হুপে প্রভৃতি পাখি।
"অরণ্য নিধন সর্বনাশা,
ওরা হারাচ্ছে আশ্রয়, ওদের ভাঙছে বাসা"
গাছ কেটে পাখির আশ্রয় নষ্টকরা হচ্ছে, বাসা বাঁধবে কোথায়, কোনো জায়গা নেই এবং খুব সহজেই পাখিরা শিকারিদের হাতে পড়ছে।
নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলায় বেশ কিছু প্রজাতির ধনেশ (hornbill) বিলুপ্তির পথে। এরা পাহাড়ি ফল খেয়ে অন্যত্র বীজ ফেলে পাহাড়ি বনায়নে সাহায্য করে।
হাইকোর্টের আদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানুষ পাখি ধরছে, খাচ্ছে এবং বাড়িতে খাঁচায় বন্দি করে রাখছে।
"বেআইনি আবাসন না হলে বন্ধ,
ওরা মরবে অথবা হবে অন্ধ"
পরিযায়ী পাখিদের যাতায়াতের পথে বেআইনি বহুতল নির্মাণ করা হচ্ছে, প্রায়শই ওদের দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়, স্ট্রিটলাইট সন্ধের আগে জ্বেলে দিলে ওরা বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
প্রতিকার -খুব সহজ সরল কিছু উপায়
পাখিরা তাদের বেঁচে থাকার জন্য গাছ এবং জলাশয়ের উপর নির্ভরশীল, তাই বনায়ন ও জলাশয় সংরক্ষণ পাখিদের বাঁচানোর প্রধান উপায় |
মোবাইল টাওয়ার গাছপালা থেকে দূরে করতে হবে কারণ রেডিয়েশন চড়ুই, শালিক টিয়া টুনটুনির জন্য ক্ষতিকর।
আমরা হিলিয়াম বেলুন আকাশে ছাড়ি, যার সুতো পাখি-রপক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর কারণ এগুলো পাখির গলায় আটকে ঝুলতে থাকে।
‘বন্য’-র নতুন এবং অভিনব একটি উদ্যোগ হলো "মুক্তবিহঙ্গ"। ২০২০ সালে এই প্রকল্পটির শুভ উদ্ভোধন হয়।বিশ্বকর্মা পুজোর আগে ও পরে ঘুড়ির সুতোয় অনেক পাখি আহত অথবা নিহত হয়, সেইসব পাখি উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলার লক্ষ্যে মুক্তবিহঙ্গের অভিযান শুরু হয়।
জাল দিয়ে পুকুর ও ফলের গাছ ঢাকা হয়, যাতে প্রচুর পাখি আটকে প্রাণ হারায় | পাখি-রা খুবই অল্প সংখ্যক ফল ও মাছ খায়,তাই আমাদের এই সব জাল ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে |
পুরসভা গাছ কাটার অর্ডার দিলে সেই গাছ যেন পরীক্ষা করে নেওয়া হয়, সেখানে কোনো পাখির বাসা আছে কিনা |
ঘুড়ি ওড়ানোর মাঞ্জা পাখিদের জন্যে মরনফাঁদ, তাই আমাদের এই মাঞ্জা থেকে বিরত থাকতে হবে |
গরমকালে ছাদ এবং অন্যান্য জায়গায় ছোট জলের জায়গা রাখলে পাখিরা খুবই উপকৃত হতে পারে |
পাখি মৃত্যু কমাবার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে " বন্য" নামের সংস্থা, যারা বিশেষত বন্যপ্রাণী, প্রকৃতি এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন।
‘বন্য’-র নতুন এবং অভিনব একটি উদ্যোগ হলো "মুক্তবিহঙ্গ"। ২০২০ সালে এই প্রকল্পটির শুভ উদ্ভোধন হয়।বিশ্বকর্মা পুজোর আগে ও পরে ঘুড়ির সুতোয় অনেক পাখি আহত অথবা নিহত হয়, সেইসব পাখি উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলার লক্ষ্যে মুক্তবিহঙ্গের অভিযান শুরু হয়।
উপরোক্ত সমস্যাগুলি পাখি মৃত্যুর গুরুত্বপূর্ণ কারণ এবং এইগুলো মাথায় রেখে "বন্য" "মুক্তবিহঙ্গ" প্রকল্পের মাধ্যমে পাখিদের বিপদমুক্ত রাখতে তৎপর হয়েছে।
এখনো অবধি গত এক বছরে প্রায় ১০০-টির ওপর পাখিকে উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এই দলটি।

এই প্রকল্পে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন।উত্তর কলকাতায় বৌবাজার, গলিফ স্ট্রিট, মহাত্মাগান্ধীরোড থেকে শুরু করে দক্ষিণে বেহালা,ঠাকুরপুকুর, হাওড়া প্রভৃতি জায়গায় পার্থসারথি লায়েক, অনির্বাণ সরদার, সুব্রত বসু, শমিক দত্ত, দীপ্তিময় ঘোষ,অনন্যা দে, দীপঙ্কর পাল,মৃন্ময় বাগ,পৃথ্বীশ ঘোষ এর মতো সদ্যদের উদ্যোগে চিল, কাক, ময়না, পায়রা,কাঠঠোকরা, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, বসন্তবৌড়ি প্রভৃতি পাখি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
এছাড়াও উত্তর২৪পরগনা, হুগলী, কল্যাণী, বরানগর থেকেও বসন্তবৌরি, সরলহাঁস, জলপিপি, বক ইত্যাদি উদ্ধার করে বনদপ্তরের হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বন্যর উদ্যোগে সামিল হয়েছেন সাধনা সরদার বা শৈবাল পালের মত কলকাতা পুলিশের কর্মকর্তারাও।

সকলের কাছে"বন্য"-র পক্ষ থেকে অনুরোধ- যদি কেউ আহত পাখি দেখতে পান, তাহলে বার্ড রেসকিউ হেল্পলাইন নম্বর +91 70445 44445 -এ যোগাযোগ করে জানাতে পারেন।
"বন্য" সংস্থাটির সভাপতি শ্রী সৌম্যদীপ মুখোপাধ্যায়ের তত্বাবধানে তৈরি এই "মুক্তবিহঙ্গ" প্রকল্পটি এই একবছে শুধুমাত্র কলকাতা নয়, বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন রাজ্যে আজ পরিচিত একটি প্রকল্প।
আরো বিশদে জানতে ওয়েবসাইট https://bonyo.org/mukto-bihongo-save-birdsদেখুন |
সকলের কাছে"বন্য"-র পক্ষ থেকে অনুরোধ- যদি কেউ আহত পাখি দেখতে পান, তাহলে বার্ড রেসকিউ হেল্পলাইন নম্বর +91 70445 44445 -এ যোগাযোগ করে জানাতে পারেন।
এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আরো অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রয়োজন, ইচ্ছুক ব্যাক্তি ৭০৪৪৫৪৪৪৪৫ (7044544445) এই ফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।
" মুক্ত বিহঙ্গ, মুক্ত আকাশ,
মুক্ত তাদের পথ,
মুক্তির আস্বাদ ফিরিয়ে দিতে,
ছুটছে ‘বন্য’-র মনোরথ"।।


লেখক পরিচিতি: লেখিকা পেশায় শিক্ষক। একজন প্রকৃতিপ্রেমী। ভালবাসেন পাখি। 'বন্য'-র সদস্য।

Comentarios