সম্প্রতি আবার খবরের শিরোনামে সুন্দরবন বারবার বাঘে ও মানুষে মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায়। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন যা বিস্তৃত ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে। ভারতের অন্যতম প্রাচীন টাইগার রিজার্ভ সুন্দরবন। কঠিন এই ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলে সংগ্রামের জীবন মানুষ ও বন্যপ্রাণী উভয়েরই। মুখোমুখি হয়ে যায় তারা কঠিন পরিস্হিতিতে। তার মধ্যে কিভাবে চলছে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কাজ! কিভাবেই বা সহাবস্হান করছে মানুষ ও বাঘের মত প্রাণী। সেখানে ঘুরে এসে লিখলনে বনেপাহাড়ের সহযোগী সম্পাদক ড: ঐশিমায়া সেন নাগ।
বিশ্বের যেকোন বন্যপ্রাণী-প্রেমীর কাছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনে বাঘের এক ঝলক দর্শন পাওয়াটা স্বপ্ন। কিন্তু যে সব মানুষ এই বাঁদাবনে বাঘের রাজত্বে বাস করেন, এই রকম দর্শনলাভ তাদের কাছে একপ্রকার মৃত্যুদণ্ড। এই একবিংশ শতকেও সুন্দরবনের বিভিন্ন দ্বীপে যারা বাস করেন, তাদের অনেকেই বাঘের হাতে প্রাণ দেন, যখন তারা সুন্দরবনের অরণ্যে বাঘের রাজত্বে প্রবেশ করেন অরণ্য সম্পদের লোভে আকৃষ্ট হয়ে। কিন্তু এটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক জীবনের নিয়ম।
"জঙ্গল তো বাঘেরই রাজত্ব।বাঘ সেখানে শাসন করে। আমরা যখন তার এলাকায় অনুপ্রবেশ করি, তখনই তারা আমাদের আক্রমণ করে। এটাই কি স্বাভাবিক নয়?", বলছিলেন সাতজেলিয়া দ্বীপের কেনারাম মিস্ত্রি, তার বাম হাতের গভীর ক্ষত দেখাতে দেখাতে। কয়েক দশক আগে বাঘের ছুরির মত ধারালো নখর তার হাতে ঢুকে যাবার সাক্ষ্য।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপ এলাকায় ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে সুন্দরবন হল একটি ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র। এখানে জীবনের আদিম ভয় এখনও মানুষের মধ্যে কাজ করে। এখানে মানুষ খাদ্য শৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত তো বটেই, কিন্তু সব সময়ে যে তার শীর্ষে থাকে তা নয়। শক্তিশালী বাঘের কাছে সে অনেক সময়ই খাদ্যে পরিণত হয়।কিন্তু বাঘে-মানুষে সম্পর্ক এই UNESCO World Heritage Site এ সবসময় এমন খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে সীমাবদ্ধ নয়। তা অনেক গভীর ও সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল।
মৃত্যুর মুখে
সুন্দরবনের গল্প অনেক দীর্ঘ ও চমকপ্রদ। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র যেখানে সমুদ্রে মিশেছে সেখানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য দ্বীপ। ঘন ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষের অরণ্য এখানকার লবণাক্ত জলের সাথে মানিয়ে নিয়ে দ্বীপগুলোকে ঢেকে রেখেছে। মানুষের অধিকারে বেশ কিছু দ্বীপ থাকলেও, অন্যগুলো এখনও বাঘেরই রাজত্ব। এই নির্মম ভূ-ভাগে যেখানে হাওয়া আর ঢেউয়ের আঘাত বারংবার আছড়ে পড়ে, সেখানে মানুষ ও বাঘের মধ্যে এক অনন্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
সুন্দরবনের বাঘের পক্ষে শিকার এক কঠিন কাজ। তাদের সাবধানে পা ফেলতে হয় শিকারের খোঁজে ঘন ও গভীর কাদার মধ্যে দিয়ে যেখানে ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল দাঁতের মত মাটি থেকে বার হয়ে থাকে। লম্বা সময় ধরে কুমীর ও হাঙ্গরে ভরা জলের স্রোতে ভেসে যেতে হয় বাঘেদের খাদ্য, বাসস্হান ও সঙ্গীর খোঁজে। এই রকম পরিস্হিতিতে বাঘের সাথে হোমো স্যাপিয়েন্সের হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে দ্বিতীয় জনের জন্য সেটা খারাপ খবর ছাড়া কিছু না।
যদিও মানুষজনের অরণ্যের ওপর অতি নির্ভরশীলতা এমন দেখা-সাক্ষাৎকে মোটেই আর কোন দুর্লভ ঘটনার পর্যায়ে রাখেনি। সুন্দরবন বিখ্যাত তার মাছ, কাঁকড়া আর মধুর জন্য যার বাজারদর বেশ চড়া। বেশিরভাগ অরণ্য অঞ্চল সংরক্ষিত থাকায় আইন অনুসারে নিয়ন্ত্রিত কিছু এলাকাতেই মধু সংগ্রহ ও মাছ, কাঁকড়া ধরতে যেতে পারে মানুষজন। কিন্তু দারিদ্র্য আর লোভের কারণে সেই আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিষিদ্ধ অঞ্চলেও মানুষ চলে যায় আরও কিছু পাবার আশায়।
ভবতোষ মন্ডল ও তাঁর স্ত্রী কল্পনা দু'জনেই মধ্যবয়স্ক। সুন্দরবনের বেশ কিছু এলাকায় তারা কাঁকড়া সংগ্রহে যান জীবিকার খাতিরে। কেন তারা জীবনের এত ঝুঁকি নিয়ে এমন সব জায়গায় যান জানতে চাইলে ভবতোষ বলেন, " সুন্দরবনের বাইরেও কায়িক শ্রমের কাজ করেছি জীবিকার জন্য। কাজগুলো খুব পরিশ্রমের আর রোজগারও সেই অনুপাতে তেমন নয়। তাই আমি ফিরে আসি এবং ঠিক করি যে ঘরের কাছে জঙ্গলেও যাওয়াই ভাল উপার্জনের জন্য, যদিও এতে বাঘ আর কুমীরের আক্রমণের ভয় থাকেই।"
যদিও বন বিভাগ থেকে প্রতিবছর বন থেকে উপার্জনে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের অনুমতিপত্র বা পারমিট দেওয়া হয়, কিন্তু এই পারমিট সংগ্রহ বেশ খরচসাপেক্ষ এবং তা মাত্র কিছু এলাকাতেই যেতে অনুমতি দেয়। এর ফলে বাঘেদের জন্য যে সুরক্ষিত বনাঞ্চল তৈরি করা হয়েছে তা আইনভঙ্গকারীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তার প্রাচুর্যের জন্য। বেআইনি ভাবে জঙ্গলে অনুপ্রবেশ করার ঘটনাগুলোর কোন নথিভুক্তিকরণ হয় না এবং এই নিয়ম না মানলে বন্য শ্বাপদের হাতে আক্রান্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার কোন ক্ষতিপূরণের যোগ্য হন না।
" পারমিট খুব খরচের ব্যাপার। আমরা ভাগ করে সেটা নিতে পারি আর বড় দলে জঙ্গলে যেতে পারি। কিন্তু এতে যা লাভ হবে, তা-ও ভাগ করে নিতে হবে। এটা পোষায় না আমাদের। আমাদেরও তো বাচ্চা আছে, তার জন্য রোজগার হওয়া দরকার সেইমত", বললেন গোপাল গায়েন। তিনি তাঁর স্ত্রী মিনতির সাথে জঙ্গলে যান কাঁকড়া ধরতে। যদিও বাঘের হানায় তিনি তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন অতীতে। গোপাল আর মিনতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তাদের সন্তানদের এই বিপজ্জনক কাজে পাঠাবেন না ভবিষ্যতে।
দারিদ্র্যই একমাত্র কারণ নয় এই বিপজ্জনক পেশা বেছে নেবার পিছনে- এমনটাই মত জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটির (JFMC) সদস্য হিমাংশু মন্ডলের। "কিছু লোক প্রয়োজনে যায়, কিন্তু সমস্যা হল বেশিরভাগ যায় লোভে পড়ে। অন্যভাবে অনেক পরিবারই যথেষ্ট রোজগার করে।কিন্তু কম সময়ে বেশি টাকা রোজগারের আকর্ষণে এরা জঙ্গলে ছুটে যায়", তাঁর বক্তব্য।
JFMC র সদস্য হিসাবে সাতজেলিয়ার বাসিন্দা হিমাংশু মানুষ-বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব সমাধানে কাজ করে। JFMC তৈরি হয় বনবিভাগের কর্মচারী ও স্হানীয় গ্রামবাসীদের নিয়ে, যারা একসাথে সুন্দরবন অরণ্যের সংরক্ষণের জন্য কাজ করে। এই কমিটি বন দপ্তর ও গ্রামবাসীদের মধ্যে যোগাযোগের সেতু।
অনেক বছর ধরেই বনবিভাগ ও বিভিন্ন অসরকারি সংগঠন যারা সুন্দরবনে সক্রিয় তারা গ্রামবাসীদের বিকল্প রোজগারের জন্য ব্যবস্থা করছে যাতে তাদের জঙ্গলে না যেতে হয়।
" আমরা গ্রামবাসীদের পোলট্রি ও মৎস্যচাষে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি যাতে তাদের প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের গৃহস্হ চাহিদা পূরণ হয় আবার উদ্বৃত্ত জিনিস বেচতে পারে বাজারে। তাদের বাড়ির বাইরে সব্জি বাগান করতেও শিখিয়েছি আমরা যাতে তারা নিজেদের খাবার নিজেই তৈরি করতে পারে। Indian Council of Agricultural Research (ICAR) ও অন্য সংগঠনের সহায়তায় আমরা তাদের একাধিক শস্য উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দিয়েছি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে।পর্যটনও স্হানীয়দের জন্য একটা ভাল উপায় রোজগারের। বন বিভাগও স্হানীয় যুবকদের অনেককে প্রশিক্ষণ দিয়ে টুরিস্ট গাইডের কাজে নিযুক্ত করছে। পর্যটন থেকে হওয়া আয়ের অনেকটাই স্হানীয় এলাকার উন্নয়নে লাগানো হচ্ছে। এখানে আমরা গ্রামে হোম-স্টে তৈরিতে সাহায্য করছি যাতে পর্যটনের টাকা স্হানীয়দের কাছে যায়", বললেন অনিল মিস্ত্রী, Wildlife Protection Society of India (WPSI) নামক একটি এন জি ও-র মুখ্য ফিল্ড অফিসার। WPSI বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিয়োজিত।
এত সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একটা বড় সংখ্যায় মানুষ উপার্জনের জন্য বনের ওপর নির্ভর করে এবং তা বোঝা যায় তাদের জঙ্গলে যাবার সংখ্যা দেখেই। "অন্য উপায় তো আছেই উপার্জনের, কিন্তু জঙ্গল আসলে এ টি এম মেশিনের মত কাজ করে। মাছ, কাঁকড়া, মধু বিক্রি করে যা লাভ হয় তা অনেক বেশি আর হাতে টাকাও আসে দ্রুত। তাছাড়া, পুরানো প্রজন্মের মানুষরা নতুন করে চাষবাস বা অন্যকিছু শিখতেও অনাগ্রহী। তাদের জন্য বনে গিয়ে উপার্জনই ভাল উপায় প্রাণের ভয় থাকা সত্ত্বেও", বলছিলেন প্রশান্ত মুখার্জী। তিনি কলকাতার একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, এখন পাকাপাকি সুন্দরবনের বাসিন্দা।তিনি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সামশেরনগরের একটা আদিবাসী গ্রামে বাস করেন ও গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়ান। তাঁর মতে নতুন প্রজন্মের ভাবনাচিন্তা আলাদা। "তরুণরা অন্য নানা উপায়ে উপার্জনের জন্য চেষ্টা করছে। তারা আর জঙ্গলে যাবার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক নয়", তিনি বললেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনের বাঘ এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে একমাত্র যেটার উদ্রেক করে তা হল 'ভয়'।কিন্তু এটাই পুরো সত্যি নয়।
ভগীরথ মন্ডল এমন একজন মানুষ যিনি তাঁর ৭০ বছরের জীবনে তাঁর অনেক পরিবারের সদস্য ও বন্ধুকে বাঘের হাতে মরতে দেখেছেন। তিনি বললেন, "ধরুন আমি আমার ঘরে তালা না দিয়ে আমি অনুপস্হিত, তাহলে ডাকাতরা তো এসে সব লুঠ করে চলে যাবেই।তেমনই, বনে বাঘ না থাকলে বনও হারিয়ে যাবে। বাঘের ভয় না থাকলে লোকেরা সব গাছ কেটে নেবে, কিছুই ছাড়বে না।তাই বন বাঁচাতে হলে বাঘ থাকতে হবে। আর বন ছাড়া আমরা তো বাঁচবো না।"
"আমরা তো বাঘের খাদ্য। আমরা খাবার জন্য কাঁকড়া ধরি। বাঘ খাবার জন্য আমাদের ধরে।তাহলে বাঘের ওপর রাগ কেন!", বলছিলেন কুন্তলা। মধ্য তিরিশের যুবতী। তিনি তাঁর স্বামী ও শ্বশুর দু'জনকেই বাঘের হানায় হারিয়েছেন। তাঁরা তাদের সাতজেলিয়ার ঘরের কাছেই কাঁকড়া ধরতে গেছিলেন। দুই সন্তানের মা হিসাবে তিনি নিজের আর জঙ্গলে যাবেন না বলে ব্রত নিয়েছেন, না যেতে দেবেন তাঁর সন্তানদের। তাঁর বাড়ির বাইরে সব্জি বাগানই তাঁর পেট চালানোর ভরসা।
অসিত গায়েন কুমিরমারির বাসিন্দা। তিনিও একই কথা বললেন। অসিতের বাবা নিয়মিত অরণ্যে যেতেন। বাঘের হাতে তিনি প্রাণ দেন এক বছর আগে। "আমরা ওনাকে বোঝাতাম না যেতে,কিন্তু তিনি শুনতেন না। জঙ্গলে যাওয়া একটা নেশার মত ছিল তার কাছে", আক্ষেপ ঝরে পড়ছিল অসিতের গলা থেকে তার অসহায়, বয়স্ক মায়ের পাশে বসে। যখন জানতে চাইলাম তিনি কি বাঘের ওপর ক্ষুব্ধ এই কারণে, তিনি বললেন-" না না। আমরা তো জানি বন আছে সেখানে বাঘ আছে বলে। আর আমরা এটাও জানি বনে ঢুকতে গেলে আমরা প্রাণও হারাতে পারি।"
অর্থাৎ সুন্দরবনের বাঘেরা শুধু ভয় না, শ্রদ্ধারও পাত্র।যদিও কয়েক দশক আগে ব্যাপারটা ছিল একদম আলাদা।
হিমাংশু জানালেন, " এইসব গ্রামে আপনি ১৫-২০ বছর আগে এলে লক্ষ্য করতেন সেই সময়ে সব কিছু কেমন অন্যরকম ছিল।বন দপ্তর ও গ্রামবাসীদের ঝামেলা লেগে থাকত। প্রতিবার কোন বাঘের আক্রমণে মানুষ মারা গেলে বা গ্রামে বাঘ ঢুকে এলে গ্রামবাসীরা বন দপ্তরকে দায়ী করত, এমনকি বাঘকে আক্রমণ করত। অনেক বাঘকে মানুষের হাতে মারা পড়তে দেখেছি।"
শুধু সুন্দরবনের বাঘই নয়, সারা ভারতেই অরণ্যের বাঘেরা বিলুপ্তির মুখে এসে গেছিল বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। ১৯৭২ এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অবশ্য তাদের রক্ষক হয়ে দেখা দিল। বাঘ হত্যা বেআইনি ঘোষণা হল। ভারত সরকারেরও বাঘ বাঁচাতে প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। ১৯৭২ সালে বাঘকে জাতীয় পশু ঘোষণা করা হল।বাঘের সংখ্যা ২০০৬ এ ১৪১১ থেকে ২৯৭৬ এ পৌঁছায় ২০১৮ তে। সুন্দরবনের বাঘ ও অরণ্যও এই আইনের বলে সুরক্ষা পেল।
বন বিভাগ ব্যাপক সচেতনতা অভিযান চালিয়েছে এবং কড়া আইন রয়েছে বাঘেদের রক্ষা করার জন্য। বনাঞ্চলের বড় অংশেই সাধারণ মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় বন ধ্বংস রুখতে এবং বাঘেদের খাদ্য যেসব পশু তাদের বাঁচাতে। গ্রাম থেকে বাঘেদের এই আবাসকে নাইলনের জাল দিয়ে আলাদা করে ফেলা হয়।সরকার ও অসরকারি সংস্হাগুলি গ্রামবাসীদের রোজগারের বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্হা করে যাতে তাদের বনে না যেতে হয়। বাঘই এখন সুন্দরবনের ভবিষ্যতের প্রতীক- বাদাবনের অভিভাবক।
অনিশ্চিত সেই ভবিষ্যৎ
বর্তমানে ভারতীয় সুন্দরবনে রয়েছে ৯৬টি বাঘ আর বাংলাদেশের অংশে প্রায় ১১৪ টি। ভারত ও বাংলাদেশের অংশের জনসংখ্যা যথাক্রমে ৪০ লক্ষ ও ৩০ লক্ষ। আইনি সুরক্ষা ও বন সংরক্ষণের উদ্যোগ অনেকটাই মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাত কমাতে সক্ষম হয়েছে। স্হানীয় মানুষও অরণ্যে বাঘের সহজাত অধিকারের বিষয়টায় মান্যতা দিয়েছে।
যদিও সবকিছুই পাল্টে যেতে পারে আগামী কয়েক দশকে যেহেতু সুন্দরবন হল এমন একটি এলাকা যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সব থেকে সংবেদনশীল স্হানগুলির অন্যতম। আবহাওয়ার দুর্বিপাকে সাম্প্রতিক কালে বারবার ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছে সুন্দরবন। " এখন এখানে বছরে দু'বার করে সাইক্লোন হচ্ছে। আগে হয়ত এক দশকে একটা হত। জলের স্তর পাল্টেছে অনেকটাই", চিন্তান্বিত মুখে বলছিলেন ভগীরথ। এবং এই দুর্যোগের সময়ে মানুষেরা বন ও বাঘের প্রতি আরও যত্নশীল হয়েছে। হিমাংশু বললেন, "একটার পর একটা সাইক্লোনের আঘাতে এখানকার লোক বুঝেছেন যে তারা অরণ্য ছাড়া বাঁচবেন না। যেসব জায়গায় বনের ঘনত্ব বেশি সেখানে ক্ষতি হয়েছে কম। তাই লোকেরা এখন বেশি করে বন বিভাগকে সাহায্য করতে তৈরি বন ও বাঘ বাঁচাতে। ওদের নিজেদের মধ্যেই ঝামেলা হয়েছে অরণ্য ধ্বংস বন্ধ করা নিয়ে। যেমন কারুর ছাগল বনে চড়তে গেলে অন্য কেউ তাকে ভৎর্সনা করে কারণ ,ছাগল বনের গাছপালা খেয়ে ফেলে"।
যদিও এই সহাবস্হান কতদিন থাকবে সেটাই প্রশ্ন। বিজ্ঞানীদের মতে জলবায়ু পরিবর্তন মানুষ ও জানোয়ারদের স্হান পরিবর্তনে বাধ্য করবে, তাদের প্রাণহানির কারণ হবে। ফলে এই ভূ-ভাগে ভবিষ্যতে অনেক রকম পরিবর্তন দেখা দেবে বাস্তুতন্ত্রে। সময়ই বলবে বাদাবনের বাঘ ও মানুষের সম্পর্ক কেমন হতে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দুনিয়া কেমনভাবে এগোয় তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
কৃতজ্ঞতা: লেফটানেন্ট কর্নেল শক্তিরঞ্জন ব্যানার্জী, সাম্মানিক ডিরেক্টার, ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশান সোসাইটি অব ইন্ডিয়া; নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী, সচিব, অনুভব।
লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বর্তমানে বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহযোগী সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।
Comments