ওড়িশায় হাতির সংখ্যা অসম, কেরল, কর্নাটকের মত রাজ্যের থেকে কম হলেও, হাতির মৃত্যুর হার সবথেকে বেশি ওড়িশাতেই। কমে আসা বনভূমি, খাদ্যের সংকটে বিপন্ন তারা। খাদ্যের সন্ধানে বাড়ছে মানুষের সাথে সংঘাতের আবহ। এই অবস্হায় দাড়িয়ে নতুন কী সমাধান বার করার চেষ্টায় ওড়িশার বনবিভাগ? জানাচ্ছেন ওড়িশার বনবিভাগের ডেপুটি কনজার্ভেটার সস্মিতা লেঙ্কা।
আটাগড় বনবিভাগ ওড়িশার সেই সব এলাকার মধ্যে একটা যেখানে মানুষ আর হাতির মধ্যে নিত্য সংঘাতের পরিবেশ। হাতিরা বনে থেকে প্রায়ই আটাগড় ও খুনটুনি রেঞ্জের বনে চলে আসে, ক্ষতি করে এলাকার ক্ষেতের ফসলের। এমনকি ফলের গাছ বা সব্জির বাগানকেও ছাড়ে না। কখনও মানুষ মারা গেলে তো পরিস্হিতি হাতের বাইরে চলে যায়। চন্দকা-ডামপাড়া অভয়ারণ্যের হাতিরা এখানে এসে প্রায় ৭-৮ মাস থাকে। ওই অভয়ারণ্যের অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে ভুবনেশ্বর শহরের পরিধি বাড়ার কারণে। ফলত: চলে আসা হাতিরা শস্যের ক্ষতি করে, এমনকি গ্রামে ঢুকে পড়ায় জনবসতিতেও ক্ষয়ক্ষতি হয়।
আসলে হাতিরা মানুষের মধ্যে চলে আসে ওদের বসতি, অরণ্যে যথেষ্ট খাবার না পেলে। এই সমস্যাটার সমাধান করতে পারলে, ওদের এই খাবারের খোঁজে জনবসতিতে হানা দেওয়াটা কমানো যেতে পারে। এক একটা হাতির তো দিনে ১৫০ কেজি খাদ্য লাগে।তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই ওদের জন্য বাঁশবন তৈরি করার। কিন্তু শ্রমিক-মজদুরের অভাব আছেই আর তার সাথে আর্থিক সংকোচ। এর সমাধানে একটা অন্য উপায় নিল ওড়িশার বন বিভাগ। উদ্ভিদের বীজ দিয়ে বানানো হল গোলা বা 'বোমা'। ছোড়া হল তা বনের বিভিন্ন জায়গায়। গ্রামবাসীরা, যারা মূলত: এই হাতির উপদ্রবের আসল শিকার, তারাও হাতে হাত মিলায় এই বীজ-গোলা বানানোর কাজে। আটাগড় বন বিভাগের অন্তর্গত ৩৮টা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কাজটি শুরু হয়।
২০১৯ সালে এই বনবিভাগ প্রায় ৯৫০কেজি বীজ-গোলা প্রয়োগ করে, যা মূলত: বাঁশগাছের বীজ নিয়ে তৈরি। এদের বেঁচে থাকার হার ৫০-৬০%। প্রতি গোলার ১০-১৫ টা বীজের মধ্যে অন্তত ৫টি বেড়ে উঠলেও যথেষ্ট । বাঁশগাছের বংশবৃদ্ধি হাতিদের খাদ্য সংকট মেটাবে বলে আশা।ময়ূরভঞ্জ জেলার জোশীপুর থেকে এক কুইন্টাল বাঁশ গাছের বীজ নিয়ে আসা হয়। গ্রামে গ্রামে এই নতুন উদ্যোগ নিয়ে প্রচার অভিযানও করা হয় জোরদার। গ্রামবাসীরা এই আশা নিয়ে যোগ দেয় এই উদ্যোগে যে, খাদ্য সংকটের সুরাহা হলে হাতিরা আর গ্রামে হানা দেবে না।
এই বীজের গোলাগুলি আসলে কাদামাটি, পাতা পচা ও গাছের বীজ নিয়ে বানানো মন্ড। কম্পোস্ট বা পাতা পচা বীজগুলোকে জরুরি পুষ্টি সরবরাহ করে, তাদের শিশু অবস্হায় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আর কাদামাটি ধরে রাখে এই সব উপাদানকে। যখন তাদের ছুড়ে দেওয়া হয় অনাবাদি জমিতে বা বনের মধ্যে, কাদামাটির শক্ত স্তর ভেঙ্গে যাওয়া থেকে রক্ষা করে এই গোলাকে। প্রতিটি গোলাই এক একটা ক্রিকেট বলের আকারের, ৫০ থেকে ১০০গ্রাম কাদামাটি আর ১০-১৫ টি বাঁশগাছের বীজ এতে থাকে। কীটনাশকও মিশিয়ে দেওয়া হয় যাতে পোকার আক্রমণে তা ক্ষতিগ্রস্হ না হয়। এগুলো ছোড়ার আগে ২৪-৪৮ ঘন্টা শুকিয়ে নেওয়া হয়। Dendrocalamus strictus (Salia) বা বাঁশ হল হাতিদের খুব প্রিয় খাবার।
এই বাঁশকেই আমরা বীজ-গোলা বা seedball এর আসল উপাদান হিসাবে বেছে নিই। ফলাফল বেশ সন্তোষজনক। বনের বেশ অনেক জায়গায় নতুন নতুন বাঁশের ঝোপের দেখা মিলছে। এই উদ্যোগ আরো বড় আকার নেয় ২০২০ সালে। আমাদের মূল লক্ষ্য পরিক্তত্য জমিগুলো বাঁশের বনে ভরিয়ে দেওয়া। এর সাথে হাতিদের যাতায়াতের করিডরগুলোতেও এই পদক্ষেপ নিচ্ছি আমরা। এই গোলাগুলির কোন যত্নের প্রয়োজন নেই। তারা নিজেরাই অঙ্কুরোদ্গমের পর বেড়ে উঠে। এই উদ্যোগকে অকুন্ঠ সমর্থন দিচ্ছে এলাকার গ্রামবাসীরা। এর সাথে সাথে বনদপ্তর থেকে হাতিদের স্বাভাবিক আবাসভূমি সংরক্ষণের পক্ষেও নিয়মিত প্রচার চালানো হচ্ছে। তাই গ্রামবাসীরা আসছে এই বীজ গোলা বানাতে বনকর্মীদের সাথে, এমনকি তা ছড়িয়ে দিতেও সক্রিয় ভূমিকায় তারা। এই উদ্যোগ মানুষে-হাতিতে সংঘাত কমাবে এটা ওদেরও আশা।
ছবি: লেখক
Comentários