top of page
  • ..

"গান, কবিতা, খাওয়া দাওয়া, আর হাসি-ঠাট্টায় ভরা লালাদা'র স্মৃতি"

বেতলা ন্যাশানাল পার্কের যে তরুণ গেম-ওয়ার্ডেনকে দেখে বুদ্ধদেব গুহ'র কল্পনা একদা লিখে ফেলেছিল 'সবিনয় নিবেদন' এর মত অনন্য পত্রোপন্যাস, সেই সঙ্গম লাহিড়ীর কলমে দীর্ঘদিনের পরিচয়ের আলোকে তাঁর সশ্রদ্ধ স্মৃতিচারণ বনেপাহাড়ের পাতায়।



বিখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ'র সাথে আমার চেনাজানা সেই ১৯৮৩ থেকে। আমি তখন সদ্য পালামৌ টাইগার রিজার্ভের বেতলায় গেম ওয়ার্ডেন পদে যোগদান করেছি দেরাদুনের ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট থেকে ওয়াইল্ডলাইফ ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা অর্জন করে।

প্রথমবার তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় ফেব্রুয়ারির এক শীত সকালে কেঁড় বনবাংলোর বারান্দায়। প্রথমেই তিনি জানতে চান যে, এই বিখ্যাত বনবাংলোটির পাশেই কেন একটি নতুন দুই ঘরবিশিষ্ট কটেজ তৈরি করা হচ্ছে এর সৌন্দর্যহানি করে। আমি তাঁকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করি যে, আমরা পর্যটকের ঢলটা বেতলা থেকে এইদিকটায় কিছুটা সরিয়ে আনতে চাই আর সাইদুপ কম্পার্টমেন্ট ১ কে বেতলা পার্কের বিকল্প সাফারি অঞ্চল হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। আলোচনা চলছিল মানুষ-বন্যজীব সংঘাত, গবাদি পশু হত্যার ক্ষতিপূরণ, বনদেশে বিদ্যুতের সংকট ও প্রকৃতি সংরক্ষণের বিভিন্ন বিষয়ে। দেখলাম বন ও বন্যজীব সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান বিশাল এবং মনে হল অনেক বনবিভাগের আধিকারিকের থেকেই তিনি অনেক বেশি বন্যজীবের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানেন। এদিকে তিনি একজন প্রখ্যাত চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টও। গল্পগুজবের মাঝেই তিনি এক এক সময় তাই ছিপাদোহরের কাঠ ব্যবসায়ী মোহন বিশ্বাসের হিসাব নিকাশের মধ্যেও ঢুকে পড়ছিলেন। এরপর তাঁর সাথে একটু চটজলদি দ্বিপ্রহরিক ভোজনের পর বেতলার উদ্দেশ্যে বার হয়ে গেলাম।


লালাদার ছিল হাতির মত স্মৃতিশক্তি। উনি আমাদের বন্যজীব নিয়ে মুখোমুখি হবার ঘটনাগুলো মন দিয়ে শুনতেন, আর গ্রিন-টি"তে চুমুক দেবার মধ্যেমধ্যে নোট করে নিতেন তাঁর ডায়েরিতে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর জোর থাকলেও নির্জনতাকে উপভোগ করতে অন্যসব গানও করতেন সেসময়।

তিনি আমার জলপাই সবুজ ইউনিফর্ম আর গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার খুব পছন্দ করতেন। বলতেন, একজন ফরেস্ট অফিসারকে তার ইউনিফর্মেই উজ্জ্বল দেখায়। ফরেস্ট গার্ডদের উদ্দেশ্যে তিনি খুব উৎসাহব্যঞ্জক কথাবার্তা বলতেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ওনার মাধ্যমে কলকাতায় চিকিৎসা করাবার সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল।

সঙ্গম লাহিড়ী

একবার ১৯৮৬ সালে বেতলার ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন মোহন বিশ্বাসদের সঙ্গে। আমি দেখা করতে গেলাম উনি এসেছেন খবর পেয়ে। আমাকে ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, তোমায় ভেবে 'সবিনয় নিবেদন' লিখলাম। আর তুমি বিয়ে করে ফেললে এত তাড়াতাড়ি!! তখন আমার সদ্য বিবাহ হয়েছে। সেইদিনটা আমি ভুলতে পারিনা যেদিন সেবছরেই তিনি ডালটনগঞ্জে আমার শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসেন ও খুব আয়েশ করে 'চচ্চড়ি' খেয়েছিলেন। আমাদের বছর শেষের যে উৎসব হত কেঁড়, কেচকি বা মারোমারে খাওয়া দাওয়া, গান, কবিতা আর হাসি-ঠাট্টায় ভরা তা সবসময় মনে পড়ে। তাঁর সব বইগুলো যে কত বিভিন্ন বয়সী বাঙালী মানুষকে ভারতের বিভিন্ন স্হান থেকে পালামৌ আর বেতলায় টেনে এনেছে তার কোন সীমা নেই।


২০১০ সালের এপ্রিলে রাঁচিতে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যখন তিনি মুখ্য অতিথি হয়ে আসেন, তখন দেখা হয়। সেখানে তিনি প্রবাসী বাঙালীদে'র নিয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করেন বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় তারা যে এখনো দারুণ ভাবে সচেষ্ট তার জন্য। তাঁর ব্যক্তিত্বই ছিল আকর্ষণীয়। এমনকি অবাঙালীরাও তাঁর প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে ছোট বক্তৃতাগুলো মন দিয়ে শুনতেন। ডালটনগঞ্জের বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশান কয়েক বছর আগে তাঁকে বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানায়, কিন্তু স্বাস্হ্যজনিত সমস্যায় তিনি আসতে পারেননি। বনদেশের গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের সংস্কৃতি, জীবনধারা, বৈবাহিক রীতি-রেওয়াজ, তাদের প্রকৃতির সাথে নৈকট্যর প্রতি তাঁর গভীর আসক্তি ছিল। এবং এসবই তাঁর লেখাকে প্রভাবিত করেছে। তিনি ভালো শ্রোতা ছিলেন এবং তাঁর অতুলনীয় স্মৃতিশক্তিতে সহজেই ধরে রাখতেন বিভিন্ন ঘটনা, জায়গা, পথঘাট ও মানুষজনকে।

স্মৃতি ভরা মারোমারে সঙ্গম লাহিড়ী।

কয়েকমাস আগেই পালামৌর ওপর তাঁর আরও একটি লেখা পুজোয় যে আসতে চলেছে আমি তাঁর এক শুভার্থীর থেকে শুনেছিলাম।লালদার ম্যাকলাস্কিগঞ্জের কটেজ'টার কথা মনে আছে যেখানে তিনি স্বল্প সময়ের জন্য আসতেন প্রকৃতি ও মানুষজনের সাহচর্য পেতে। নেতারহাট ছিল তাঁর আরও একটি প্রিয় জায়গা।সেখানে কিন্তু তিনি যেতেন মারোমার, আকসি, মহুয়াডারের পথ ধরে বেশিরভাগ সময়ে। খুব কম সময়ই বরং গারু, রুদ আর বানারি হয়ে তুলনামূলক স্বল্প দৈর্ঘ্যের পথটি নিতেন। এর কারণ হল গারু ও বাড়েসান ব্লকের অসাধারণ সুন্দর ঘন শাল ও বাঁশের বনের (এশিয়ার অন্যতম সেরা বাঁশবন) মধ্যের পথ দিয়ে গাড়ি চালানো উপভোগ করা। মিরচাইয়া, সুগা বাঁধ বা লোধের জলপ্রপাতের সৌন্দর্য তো আছেই। বনের সব চেক-নাকাতেই তিনি বনকর্মীদের সাথে কথা বলতেন। বনের আর জন্তু জানোয়ারদের খোঁজ নিতেন। খোঁজ নিতেন তাদের ভালোমন্দেরও। এমনটাই ছিল জায়গা, মানুষ ও বনবিভাগের কর্মচারীদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। কখনও কখনও বেতলা বা নেতারহাটে পর্যটকদের সাথে মিশে যেতেন আর তাঁর এই দ্বিতীয় ঘর নিয়ে কত কথা শোনাতেন।

তাঁর ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি ছিল গাড়ুর রেঞ্জ অফিসার প্রয়াত এস এন সিনহার সাথে, কারণ তাঁকে লালাদা সেই হাজারিবাগে বিট অফিসার পদে কাজ করার সময় থেকে চিনতেন। কেঁড়-এ একবার লালাদা আমায় বলেছিলেন যে, তিনি একটু আধটু পাখি চিনতে শিখেছেন ৭০-র দশকে এস এন সিনহার সহযোগিতাতেই। এস এন সিনহা ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ অফিসার।


ধন্যবাদ লালাদা সবকিছুর জন্য। পালামৌর মানুষরা আপনার অভাব অনুভব করবে।


বর্ষার দিনে মিরচাইয়া



লেখক পরিচিতি: শ্রী সঙ্গম লাহিড়ী পালামৌ টাইগার রিজার্ভে দীর্ঘ ৩৮ বছর বন অধিকারিক হিসাবে কর্মরত ছিলেন ও ঝাড়খন্ড বনবিভাগের ডি এফ ও (সোশাল ফরেস্ট্রি) হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। Pugmarks in Palamau বইয়ের লেখক।


অনুবাদ: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।








Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page