top of page

হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা: বাঘ উদ্ধারের গল্প

..

মহারাষ্ট্রের বনবিভাগে কাজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বাঘ উদ্ধারের চমকপ্রদ এক ঘটনার কথা আই এফ এস নীল মজুমদারের কলমে।


কে আগে টের পেয়েছিল, কে আগে শুনেছিল, কে কাকে খবর দিয়েছিল এসব জানো গেল না মোটেই, তবে ফেব্রুয়ারি মাসের এক সকাল বেলায় দেখা গেল 'কাৎলাবোরি' গ্রামের জনতা অসম্বদ্ধভাবে একই দিকে ছুটে চলেছে। এসব খবর ছড়াতে দেরি হয় না। এক কিলোমিটার দূরের প্রাইমারি স্কুল থেকে ছুটতে ছুটতে চলে এল শ' খানেক ছেলে-মেয়ে। সাইকেল বা মোপেড নিয়ে চলে এলো 'তেমনকিছু করে না' গোছের দশ পনেরো জন যুবক, লাঠি ঠক ঠক করে দু-তিন জন বৃদ্ধ। এমনকি কৌতুহল সামলাতে না পেরে কয়েকজন মহিলাও ঘোমটা টেনে পথে বেরিয়ে পড়লেন।

গ্রামের সীমা শেষ হয়ে যাবার পর ছড়ানো অসমতল জমি। সবুজে হলুদে মেশানো বড় বড় ঘাসের নিচ থেকে উঁকি মারছে কালো নুড়ি পাথর। ফেব্রুয়ারির শুরুতে সকাল ন'টা সাড়ে নটার মধ্যেই রোদ বেশ ধারালো হয়ে উঠেছে। ইতস্তত ছড়ানো, মহুয়া, সালাই এইন, বাবুল ইত্যাদি গাছের একপেশে ছায়া পড়েছে ঘাসের ওপর। ঝাঁকালো একটা তেঁতুল গাছের নিচ দিয়ে পাশের কুষম্বি গ্রামে যাবার কাঁচা রাস্তা। সেই রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে প্রমাণ সাইজের একটা কুয়ো। কুয়োর কাছে এসে চোখ কপালে উঠলো সকলের।

৩০ -৩৫ ফুট গভীর কুঁয়োয় জল নেই কিন্তু আধ শোওয়া করে পড়ে আছে ডোরাকাটা বিরাট একটা বাঘ। নরম মাটিতে তার নখের আক্রোশ ফুটে আছে। মাঝে মাঝে সে চাপা গর্জন করছে তার পরিচয় জানান দেবার জন্যে। মাঝে মাঝে তাও নয়, শুধু প্রকাণ্ড হাঁ করে শাণিত শ্বাদন্ত গুলি দেখিয়ে দিচ্ছে শুধু। সরকারি জঙ্গল এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে একটু দূরে। নিঃসন্দেহে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে অসাবধানে বাঘটি পড়ে গেছে কুয়োতে। কাৎলাবোরি গ্রামে এই ঘটনা অভূতপূর্ব।কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এতটা নিচে পড়েও বাঘটি সক্ষম ভাবে বেঁচে আছে।ফরেস্ট গার্ডএসে পড়েছিল, তার কাছে খবর পেয়ে রেঞ্জ অফিসার। রেঞ্জ অফিসার অকুস্থল থেকেই ফোন করে দিলেন ডি সি এফ চন্দ্র ভানুকে, 'একটা ফিমেল টাইগার কাৎলাবোরি গাঁয়ের কাছে কুয়োতে পড়ে গেছে স্যার'।


-- সেকি! বেঁচে আছে? ঘটনার আকস্মিকতা হজম করে প্রশ্ন করল চন্দ্রভানু।

-- হ্যাঁ স্যার, বেঁচে আছে।

-- ইনজুরি?

-- ওপর থেকে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

-- কুয়োতে জল আছে? উইডথ্ কিরকম, লম্বাসিঁড়ি বা কাঠ নামানো যেতে পারে ? ওপাশ থেকে প্রশ্ন করল চন্দ্রভানু।

এপাশ থেকে রেঞ্জ অফিসার বলল, জল নেই স্যার আর কুয়ার ডায়ামিটার কম করেও আট- নয় মিটার হবে। সিঁড়ি অনায়াসে নামানো যেতে পারে তবে তাতে লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। বাঘটা ঠিকমত দাঁড়াতে পারছে না।

-- তার মানে পায়ে জখম থাকতে পারে। এদিকের সব ব্যবস্থা সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি চলে আসছি। তবে তার আগে কয়েকটা কথা। কুয়োর চারপাশে নিশ্চয়ই পাঁচিল নেই ?

-- না স্যার, নেই।

-- ওখানে দুজন গার্ড রাখো, তারা লক্ষ্য রাখবে গ্রামের মানুষজন বিশেষ করে বাচ্চারা যেন কুয়োর বেশি কাছে না যায়। একবালতি জল দড়িতে বেঁধে নিচে নামিয়ে দাও।

-- আচ্ছা স্যার।

-- আর হ্যাঁ, বাঘটিকে যেন কোনমতেই বিরক্ত না করা হয়।

কথা বলা শেষ করে দ্রুত চিন্তা করে নিল চন্দ্রভানু। বাঘটি যদি সত্যিই আহত হয়ে থাকে তাহলে তাকে ধরে বা বেঁধে বারকরা ছাড়া আর উপায় নেই।সেক্ষেত্রে বাঘটিকে অজ্ঞান করা প্রয়োজন এতটা মনে হতেই চন্দ্রভানু ফোনে চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন এর কাছ থেকে অজ্ঞান করার অনুমতি নিয়ে নিল। এ্যাক্ট অনুযায়ী এই অনুমতি উনি ছাড়া আর কেউ দিতে পারেন না। কাগজে-কলমে অনুমতি আসবে যথা সময়ে, কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করা চলে না। সরকারি পশু চিকিৎসক এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী দু-তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদেরও অনুরোধ জানালো, তার অফিসে আসতে। ডার্ট গান চালনায় এ সি এফ দেশমুখের চেয়ে অভিজ্ঞ আর কেউ নেই সারা রাজ্যে। ভাগ্যক্রমে ও আজ অফিসেই আছে, ট্যুরে বেরোয়নি। এই সময় চন্দ্রভানুর মনে পড়ল মাউন্টেনিয়ারিং গোষ্ঠীর সদস্যদের কথা। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ওদের সাহায্যের প্রয়োজন হবেই। পুলিশ সুপার রেড্ডি তার বন্ধু। কাৎলাবোরির কাছাকাছি কোন থানা থেকে ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য ওকে পুলিশ বন্দোবস্তের অনুরোধ জানিয়ে ফোন রাখলো চন্দ্রভানু।

খুব সংক্ষেপে সকলকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে এবং আবশ্যক কিছু জিনিসপত্র সঙ্গে নিতে খুব একটা সময় লাগেনি তবু তিনটে গাড়িতে ভাগ হয়ে প্রায় ছেচল্লিশ কিলোমিটার দূরের কাৎলাবোরি গ্রামে পৌঁছতে দুপুর প্রায় একটা বেজে গেল। চড়ারোদ গ্রাহ্য না করে ততক্ষণে আশেপাশের দু-তিনটি গ্রাম থেকে উৎসাহী জনতা চলে এসেছে। কোনক্রমে সেই উপচে পড়া ভিড় সামলাচ্ছে পুলিশ। কুয়োর ভেতরে বাঘটি অস্থির আক্রোশে মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠেই ঝিমিয়ে পড়ছে। স্পষ্টতই তার পেছনের পায়ে তেমন জোর নেই। ফ্র্যাকচার আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

পরিস্থিতি ভালো করে দেখে নিয়ে আলোচনা করতে বসলো সবাই। এসব ক্ষেত্রে যা হয় নানামুনির সম্ভব অসম্ভব নানা মত। সেই সব মত একসূত্রে বাঁধাটাও বিরাট একটা কাজ। তাছাড়া, সময়ের বন্ধন আছে, অন্ধকার নামার আগেই সব কাজ শেষ হওয়া দরকার। নির্ধারিত প্ল্যান অনুযায়ী, শক্ত দড়ির একটা বড় জাল চাই এবং অন্তত ৩০-৩২ ফুট লম্বা একটি মজবুত সিঁড়ি । তাছাড়া একটা খাঁচা চাই বাঘটিকে এইখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।এসব জিনিস গ্রামে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং সব জিনিসপত্র নিয়ে একটি ট্রাক রওনা করার জন্য নাগপুরে তার অফিসে ফোন করে দিল চন্দ্রভানু।

পশুচিকিৎসক ওষুধের পরিমাণ ঠিক করে দিলেন। ডার্ট গানে দৃষ্টি সংযোগ করল দেশমুখ। ট্রিগারে আঙ্গুল। এদিকে ওপরে জনসমাগম বেড়ে যাওয়ায় বাঘটি ভীষণ ছটফট করছে। কয়েক মিনিটের স্তব্ধতা তারই মধ্যে ক্যামেরার আলো ঝলসে উঠছে বারবার। ডার্ট গিয়ে লাগলো লেজের গোড়ার দিকে, পাশে।ভেষজ ক্রিয়ার পরিণাম বোঝা গেল প্রায় ১০ - ১২ মিনিট পরে।

এরপরের কার্যপ্রণালী আগেই ঠিক করা আছে। চার কোণে লম্বা দড়ি বেঁধে প্রথমেই শক্ত দড়ির জাল নামিয়ে দেওয়া হলো কুয়োর ভেতরে। লম্বা ধাতব সিঁড়ি নামানো হলো তারপরে। পর্বতারোহী সংস্থার একজন সদস্য শংকরলাল সেই সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা নিচে নেমে হাতে বাঁশ নিয়ে বাঘটির হাতে,পায়ে, গায়ে ছুঁয়ে দেখে নিলেন সত্যিই অজ্ঞান হয়েছে কিনা। নিশ্চিত হওয়ার পর উনি এবং ওর পিছনে দড়ি নিয়ে আরো দুজন স্টাফ নিচে গিয়ে বাঘটির পাশে দাঁড়ালো।

কুয়োর ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে, চাপা গরম। এই দিনের বেলাতেও আধা অন্ধকার। কোন কারণ নেই, তবু যেন মনে হয় নিঃশ্বাস নেবার মতন পর্যাপ্ত হাওয়া নেই এখানে। মাত্র দু হাত দূরে পূর্ণদৈর্ঘ্যের বাঘিনী অচৈতন্য নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। গভীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে তার বুক। ঠিক এইরকম অভিজ্ঞতা আগে হয়নি কখনো। মাথা তুলে একবার ওপরে দেখলেন শঙ্করলাল। আলোক বৃত্তের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের পৃথিবী।কয়েকজন মানুষের উৎকণ্ঠিত মুখ আর তার অনেকও পরে, নীল আকাশ।

জাল দিয়ে বাঘের সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে ফেলা হল। পর্বতারোহণের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের দড়ি দিয়ে সামনের পা এবং পেছনের পা দুটি একসঙ্গে দ্রুত বেঁধে ফেললেন দুজনে। ওপর থেকে নামিয়ে দেওয়া দড়ির সঙ্গে পা বাঁধা দড়িগুলি যুক্ত করে দিলেন তাঁরাই। তারপর সাবধানে জাল সরিয়ে নিয়ে বাঘের পাশে বিছিয়ে দেওয়া হল। এক এক করে তিনজনে ওপরে আসার পর বাকি কাজ।হাত-পা বাঁধা দড়িগুলির সাহায্যে ওপর থেকে বাঘটিকে তুলে পাশে বেছানো জালের উপর শুইয়ে দেওয়া হল। ওপর থেকে দড়ি ধরে এসব করতে সময় লাগছে প্রচুর। জালির চারকোণে বাধা দড়ির প্রান্তও ওপরেই আছে।সেই দড়ি ধরে বাঘ সমেত জাল তুলতে গিয়ে দেখা গেল বাঘটি নড়াচড়া শুরু করেছে আবার। সুতরাং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আবার ডার্ট গান, আবার দেশমুখ।

খাঁচাসহ ট্রাক কুয়োর কাছেই আনা হয়েছিল যতটা সম্ভব। জালে শোওয়া অজ্ঞান বাঘ দেখার উৎসাহী জনতা কে আর আটকানো গেল না। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান ফেরার ইঞ্জেকশন এবং অন্যান্য প্রাথমিক উপাচার শেষ করতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। দেখে শুনে চন্দ্রভানু সিদ্ধান্ত নিল, বাকি ইনভেস্টিগেশনের জন্য নাগপুরে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

চিফএবং অন্যান্য সিনিয়র অফিসার,যারা সঙ্গে যাননি এক জায়গায় বসে অপেক্ষা করছিলেন ফোন করে তারই মধ্যে এক ফাঁকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুব সংক্ষেপে জানিয়ে দিল চন্দ্রভানু।


প্ল্যান অনুযায়ী এতটা ঠিকঠাক হলেও পরদিন সকালে কিন্তু পর্দা সরিয়ে বাঘের খাচায় উঁকি মেরেই বন অধিকারী এবং বিশেষজ্ঞরা চমকে উঠলেন। তিনটি অপরিণত মৃত শাবক প্রসব করে বাঘিনী খাঁচার এক কোণে নিথর হয়ে বসে আছে। বাঘিনী যে সন্তান সম্ভবা একথা গতকাল বোঝা গিয়েছিল ঠিকই তবু এই সম্ভাবনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। ৩০- ৩৫ ফুট গভীরেআচমকা পড়ে যাওয়া, ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করা, জ্ঞান ফেরানো, অতখানি ট্রাক জার্নি করে আসা , ঠিক কি কারণে যে ঘটেছে এই প্রমাদ এই নিয়ে তর্ক বিতর্ক, আলোচনা চলল কিছুক্ষণ। কিন্তু কুয়ো থেকে জলজ্যান্ত একটা বাঘ উদ্ধার করার আনন্দ যে অন্তত একদিনের জন্যে রাহুগ্রস্থ হয়ে গেল তাতে কোন সন্দেহ নেই।

"নানা কারণে বাঘের মৃত্যু হয়ে থাকে তার মধ্যে যেমন বার্ধক্যজনিত মৃত্যু আছে তেমনি আছে চোরা শিকারির গুলি, বিষ, ট্র্যাপ ইত্যাদি এবং অপঘাত মৃত্যু। আপনাদের সকলের সহযোগিতায় একটি বাঘকে যে অপঘাত মৃত্যুর হাত থেকে আমরা বাঁচাতে পেরেছি তার জন্য আপনাদের সকলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ" , কাৎলাবোরি গ্রামের মানুষজন বেসরকারি সংস্থার সদস্য, পর্বতারোহণ সংস্থার সদস্য, সাংবাদিকইত্যাদিদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় বলছিল চন্দ্রভানু। "- তবে আমার কিন্তু আপনাদের কাছে কয়েকটি অনুরোধ আছে। গ্রামের কুয়ো যেন কোনো মতেই পাঁচিল বিহীন, অরক্ষিত না হয়। শুধু বাঘের সুরক্ষার জন্যেই নয়, মানুষ এবং গরু মোষের সুরক্ষার জন্যেও বলছি। অনেক সময় চোরা শিকারিরা জঙ্গলের ভেতর, আশেপাশে, বিশেষ করে জলার ধারে হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিকের তার বিছিয়ে রাখে যাতে শক লেগে বাঘেরমৃত্যু হয়। এই সব থেকে আপনারা নিজেরা সতর্ক থাকবেন। আপনাদের গরু ছাগল ইত্যাদি সাবধানে চরাবেন এবং এরকম কিছু দেখতে পেলে দয়া করে বন বিভাগের কর্মচারীদের খবরদেবেন। জঙ্গলে কখনোই একা যাবেন না এবং সবসময় চোখ-কান খোলা রাখবেন।"


-- এরপর কি করবেন আপনারা?

-- এই বাঘটির ভবিষ্যৎ কি ?

দু'একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন।

-- বাঘটির অসুস্থতা কিসে তা জেনে এবং তার চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সংক্ষেপে জানাল চন্দ্রভানু।

ইতিমধ্যে মৃত শাবকগুলি পশু চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দেওয়ার পর আবার বাঘটির দিকে মন দিয়েছেন সকলে।ডাক্তারদের পরীক্ষা করার খাঁচা আলাদা। সেই খাঁচায় বাঘটিকে স্থানান্তরিত করে এবং পরীক্ষা করে পশু চিকিৎসকরা নিশ্চিন্ত হলেন। বুকের উপরে যে ক্ষত দেখা যাচ্ছিল সেটা তেমন গভীর নয়, সম্ভবত, পড়ে যাওয়ার সময় কুয়োর দেওয়ালে ঘষা লেগে হয়েছিল। এছাড়া ফ্র্যাকচার বা তেমন কোনগুরুতর সমস্যা নেই। সুতরাং এইবার বাঘটির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় হয়েছে।

এসব ক্ষেত্রে সাধারণত বন্যপ্রাণীদের ভবিষ্যতের দুটি পথ খোলা থাকে।কোন চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেওয়া কিংবা আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া। অসুস্থ অবস্থায়, মানুষের আদরে আপ্যায়নে খাঁচায় বেশ কিছুদিন থাকলে দেখা গেছে শিকারি বন্যপ্রাণীদের শিকার করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে আবার জঙ্গলে ছেড়ে দিলে তারা, হয় আশেপাশের লোকালয়ে এসে মানুষ মারার চেষ্টা করে কিংবা না খেয়ে, অক্ষম হয়ে, মারা যায়। এমত অবস্থায় তাদের চিড়িয়াখানায় রেখে দেওয়াই সমুচিত। এই বাঘটি কিন্তু মাত্র চার দিন কাটিয়েছে খাঁচায়। হয়তো আরও তিন চার দিন থাকবে। আকার প্রকার দেখে বয়স ৪-৫ বছরের বেশি মনে হয় না। এই বয়সের একটি বাঘকে আজীবন চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দী থেকে মানুষের মনোরঞ্জন করতে হবে?

ঘোর আপত্তি জানিয়ে চন্দ্র ভানু এবং আরো কয়েকজন অফিসার বললেন, কখনোই না । তার চেয়ে অনেক ভালো কাৎলাবোরির পাশের যে জঙ্গল থেকে এসেছিল সেখানেই এই বাঘটিকে আবার ছেড়ে দেওয়া। এই ব্যাপারটিও অবশ্য চিফ-ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেনের অনুমতি সাপেক্ষ। ওর কাছ থেকে অনুমতি আসতে দেরি হল না।


কাৎলাবোরি গ্রামের গা- ঘেঁষা জঙ্গল আরও একবার পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, এখানে জল এবং হরিণ, বনশুয়োর ইত্যাদি প্রাণী যথেষ্ট সংখ্যায় আছে। এমন কি আরও বাঘের উপস্থিতিও টের পাওয়া গেল। অর্থাৎ একটি বাঘের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু দরকার, অন্তত মানুষের ধারণা অনুযায়ী, তার অভাব নেই মোটেই। সাবধানতা হিসাবে আবার আশেপাশের দু'তিনটি গ্রামেসভা ডেকে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দেওয়া হল। যোগ্য জায়গায় ক্যামেরা ট্র্যাপ লাগানো হল বেশ কয়েকটি, যাতে ভবিষ্যতে বাঘটি ওই জঙ্গলেই রয়েছে কিনা তার মোটামুটি একটা আন্দাজ পাওয়া যায় রেকর্ড হওয়া ছবি দেখে।


বুকের ক্ষত শুকিয়ে যাবার পর পরীক্ষা করে ডাক্তাররা ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন। প্রতিদিন তিন চার কেজি পাঁঠার মাংস খেয়ে বাঘটির স্বাস্থ্য এবং লাবণ্য ফিরে আসছে ক্রমশ। অতঃপর কুয়ো থেকে উদ্ধার করার আট দিনের মাথায় এক গভীর রাত্রে বাঘটিকে নিয়ে অন্য একটি যাত্রা শুরু হল। শুধু বন বিভাগের অধিকারীরাই নন, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সঙ্গে আছেন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা, সাংবাদিকরা, তাদের সঙ্গে আলোকচিত্রীরা। আছেন গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যরা। এবার যাত্রার উদ্দেশ্য একেবারেই আলাদা।

মুক্তি। ছবি: লেখক

নিজের হাতের পাতা দেখা যায়না এত অন্ধকার চারিদিকে।ডানায় ঝটপট শব্দ তুলে উড়ে গেল গোটা দুয়েক ত্রস্ত নাইটজার। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে টর্চ জ্বালিয়ে আর একবার সমস্ত ব্যবস্থা দেখে নিল চন্দ্রভানু। ট্রাকের পিছন দিকের পাল্লা খুলে দেওয়ার পর আস্তে আস্তে খাঁচার পর্দা সরিয়ে দেওয়া হল। কাছাকাছি বিভিন্ন গাড়িতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছেন সকলে। এইবার খাঁচার পেছনের দরজা খুলে দেওয়া হল যান্ত্রিক ভাবে। অনেকগুলি বড় টর্চের আলো এসে পড়েছে ট্রাকের পেছন দিকে খাঁচার কাছে। সেই আলোয় খোলা ট্রাকের কিনারায় দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত সময় নিল বাঘটি। হোক না মাত্র আটদিন, তবু তো লোহার গারদ, তবু তো বন্দী জীবন।সেই জীবন পেছনে ফেলে, অনেক জোড়া চোখের সামনে হলুদ তরঙ্গের মতো তার পরিচিত পৃথিবীতে লাফিয়ে পড়লো বাঘটি মুক্তির আনন্দে। পরমুহূর্তেই তাকে আর দেখা গেল না।

-------- -------

[আনন্দবাজার পত্রিকা (মুম্বাই সংস্করণ) রবিবারের ক্রোড়পত্রে চব্বিশে জুন, ২০১২ সালে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।]


লেখক পরিচিতি: লেখক অবসরপ্রাপ্ত আই এফ এস আধিকারিক এবং ঔপন্যাসিক।






Comments


474525369_1074216644505260_833710345513391369_n.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page