top of page
  • ..

পিউ কাঁহার রাত

আজ বাংলা সাহিত্যের অরণ্যদেব বুদ্ধদেব গুহ'র চলে যাবার এক বছর হল। তাঁর স্মরণে বনেপাহাড়ের পাতায় বন-জঙ্গলের পটভূমিতে লেখা একটি ছোটগল্প সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসাবে থাকল। লেখক অপূর্ব রায়



গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে চোখে পড়া সন্ধ্যার গোলাপি আকাশ এখন অনেকটাই আবছা হয়ে এসেছে। চারপাশটা আস্তে আস্তে কালো আলোয় ঢেকে যাচ্ছে। হ্যাঁ, কালো অন্ধকারেরও একটা আলো রয়েছে যেটা বনে এলে সন্দীপন টের পায়। সামনের ঝুপসি অন্ধকারটা পেরিয়ে নীচের খাত দিয়ে কলকল করে বয়ে চলা রামগঙ্গার স্রোতের শব্দ আসছে। আর মৃদু শব্দে বাংলোর ঘর থেকে ভেসে আসছে মহম্মদ রফির গলা। "দিন ঢল যায়ে, রাত তো না আয়ে/ তু তো না আয়ে তেরি ইয়াদ সাঁতায়ে...."। শচীনবাবুর সুর।বড় প্রিয় ওর শচীন দেববর্মন। ওর ঘরে মোবাইলে সায়নী চালিয়েছে গানটা। বনে জঙ্গলে এসে সন্দীপন যন্ত্রে গান-বাজনা চালানো কখনও পছন্দ করে না। তেমন সঙ্গী পেলে নিজেরা খোলা গলায় গানে মেতে ওঠে কখনও সখনও। কিন্তু এই গানটা হঠাৎ যখন সায়নীর ঘর থেকে বেজে উঠল, তখন বুকটা ধক করে উঠেছিল সন্দীপনের।অনেকদিন পর, অনেকদিন পর সন্দীপন শুনল আবার সেই কথাগুলো, সেই সুর। আস্তে আস্তে ও বারান্দা থেকে নেমে এল খোলা চত্বরে। বাংলো থেকে একটু দূরে এসে গানের শব্দের অভিঘাত একটু কমলেও বুকের তবলায় হাতুড়ির ঠুকঠুক চলছে যেন এখনও। গানটার সুর আর কথা যেন অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে করবেটের এই বনে। সন্দীপনের মনে পড়ল ওর বাবা বলত, কোন গান কখনও কখনও একটা মূহুর্তকে কিভাবে সম্পৃক্ত করে ফেলতে পারে তা হয়ত আগের মুহূর্তেও বোঝা সম্ভব হয় না। পরিস্হিতি, পরিবেশ আর শ্রোতার মানসিক অবস্হা সেটা নিরূপণ করে। আসলে এই গানটা ছোট থেকেই সন্দীপনের কত প্রিয় তা সায়নী জানত। একসাথে শুনতে শুনতে সায়নীরও প্রিয় হয়ে উঠেছিল এক সময়।

সায়নী ওর ঘরের দরজাটা খুলল। এক চিলতে আলো এসে পড়ল অন্ধকারে। সেই দুপুর থেকে করবেটের বনে সাফারি করে বেড়িয়েছে ওরা। সকালে বনে ঢোকার সময়েও কিছুটা হয়েছে। তাই সায়নীকে একটু ক্লান্ত লাগছিল বনবাংলোয় ফিরে আসার সময়ে। নাকি সন্দীপনের অনভ্যস্ত চোখ খুঁজতে চাইছে সেই ছটফটে, তন্বী, প্রথম বসন্তের পাতার মত উজ্জ্বল সেই তরুণীকে। প্রায় ১৪ বছরের না দেখা চোখে চল্লিশে উপনীত হওয়া এই নারী কতদূর সেই তরুণীর থেকে?

কাল থেকে পরে থাকা জিনস আর শার্টটা পাল্টে সায়নী একটা কচি কলাপাতা রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে। গায়ে জড়ানো একটা বেইজ রঙের কাশ্মীরি স্টোল। মার্চের শুরুতে করবেটের বনে সন্ধে নামতেই ঠান্ডাটাও ঝুপ করে নেমে আসে উপরের পাহাড়গুলো থেকে। এখনও কুমায়ন পাহাড়ের অনেক জায়গাতেই বরফ জমে আছে।

"তোর প্রিয় গান", সায়নী এগিয়ে এসে বলল।

"মনে আছে তোর! এখনও!"

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সায়নী। আধ-ফোটা ঠোঁটটা বন্ধ করে। তাকিয়ে রইল দূরের অন্ধকারের দিকে।

একটা সিগ্রেট বার করে অন্ধকারটাকে একটু আলোর ছ্যাঁকা দিয়ে সেটা জ্বালালো সন্দীপন।

"এখনও ছাড়তে পারিসনি?" সায়নী বলল।

"কি করব। তুই তো বলিস নি আর।"

"আহা রে! আমি বললে কত শুনতিস....একদিন তো অনেক বলেছি", গলায় কপট রাগ এনে বলল সায়নী। তারপর জিজ্ঞাসা করল, "তোর বউ বলে না কিছু?"

"সে তোরা মেয়েরা না বলে ছাড়বি কি! কিন্তু তুই বলায় যখন ছাড়তে পারিনি, আর তাই ছাড়ার কথা ভাবিনি।রিয়েলি! আই মিন ইট" গলাটা একটু ভারী হয়ে এল সন্দীপনের।

চুপ করে থাকল সায়নী। কখনও কখনও কোন কথা ভাল করে শুনতে হলে নীরবতাকেও শুনতে হয় কথার পিঠে। তবে সিগারেটের ধোঁয়া, জীবনের ওঠাপড়া যে সন্দীপনের ওপর খুব প্রভাব ফেলেছে কাল ১৪ বছর পর ওকে দেখে মনে হয়নি সায়নীর।অন্তত বহিরঙ্গে। ওল্ড দিল্লী স্টেশনে রাণীক্ষেত এক্সপ্রেস ধরার জন্য এসে প্ল্যাটফর্মে ওর দেখা পেয়ে তার ফেলে আসা দিনের সেই প্রেমিক পুরুষটিকে আবার দেখতে পেয়েছে পুরানো আয়নায়। সেই ছটফটে, দোহারা রয়েছে সন্দীপন। মাথা ঢাকা এখনও একরাশ কালো ঢেউ খেলানো চুলে। বরং বয়সের আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায় সায়নী ও আর আগের সেই মেয়েটা নেই।কানের পাশে চুলে হালকা পাক ধরেছে।নরম মুখশ্রীতে সময়ের আস্তরণ। মেয়েরা কি তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যায়? নাকি এতগুলো বছরের একাকীত্বে, কাজের মধ্যে দিনরাত নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়ায় নিজের দিকে আর ফিরে তাকাতে সময় পায়নি ও?

এগিয়ে এসে সায়নীর কাঁধে হাত রাখল সন্দীপন। "ওপরের দিকে দেখ। সপ্তর্ষিমণ্ডল দেখতে পারছিস? সেই একই রকম রয়েছে ওরা। সেই কলেজের ট্রিপে ডুয়ার্সে গিয়ে মূর্তি নদীর পাশে দাঁড়িয়ে এমন এক সন্ধ্যারাতে দেখছিলাম আমরা তারা ভরা আকাশ। মনে আছে? নদীর স্রোত, বসন্তের আসা যাওয়া, সপ্তর্ষিমণ্ডল আর লুব্ধক একই আছে। আমরাই বুড়ো হয়ে গেলাম। পাল্টে গেলাম"।

"বহুদিন পর দেখলাম রে এমন তারাভরা আকাশ। শহরে থাকতে থাকতে এসব তো ভুলেই গেছিলাম। তুই তো খুব ঘুরিস বনে-জঙ্গলের কাজে।এসব খুব দেখিস। মনে হয় সেই দিনটার কথা কখনও? না আজ আমায় দেখে মনে পড়ল?"

"জীবনে প্রথমবার অমন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দেখার মত করে আকাশ দেখেছিলাম। পাশে ছিল প্রিয় মানুষ, প্রিয় সঙ্গী। সেটা তো শুধু দেখা নয়। অনুভব করা।সেই তারারা টুকরে হয়ে ছড়িয়ে গেছিল প্রতিটা রোমে রোমে। অমন এক একটা সন্ধ্যা হয়ত মানুষের জীবনে একবারই আসে। হাজার সাজিয়ে, আয়োজন করেও সেই রঙ্গমঞ্চ আর ফিরে পাওয়া যায় না বুঝলি। কোনদিন না। ভুলব কি করে। এমন তারাভরা আকাশের নীচে একা এসে যখনই দাঁড়িয়েছি মনে পড়েছে"।

"মিস্ করেছিস আমাকে?", সায়নীর গলায় কিশোরীর কৌতূহল।

সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল। ফেলে দিয়ে আস্তে করে সায়নীর হাতটা ছুঁল সন্দীপন। ছুঁয়েই একটু কেঁপে উঠল ভিতরে যেন। হাতের স্পর্শ দিয়ে যেন চলে গেল কতগুলো বছর। কিন্তু ও তো এখন আর সায়নীর নয়।অন্য কারুর। দুই সন্দীপনে যেন ধাক্কা লেগে গেল এই স্পর্শের অভিঘাতে।

তাহলে আজও সেই স্পর্শে ঘটে যায় এতরকম রাসায়নিক উথালপাতাল মনে-শরীরে!হালকা শীতের সেই নেমে আসা রাতে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়েও শরীরে উত্তাপ বেড়ে গেল মনে হল সায়নীর। আজ ঠিক সন্ধ্যার আগে সাফারিতে শেষ বেলায় যখন বিরাট পুরুষ বাঘটিকে রাস্তা পার হতে দেখেছিল তখন উত্তেজনায় সন্দীপনের হাতটা চেপে ধরেছিল ও। পরিস্হিতির ত্রহ্যস্পর্শে তখন এই বোধটা আসেনি যে কত যুগের পর সেই একই পুরুষের হাতে হাত রেখেছে ও, যেটা এখন এই নির্জনতায় দাঁড়িয়ে অনুভব করতে পারল। সেই পুরুষ, যার হাতে হাত ধরে চলার কথা ছিল ওর। আট বছরের নিবিড় সম্পর্কের শেষ একটা বছরে বার বার ধাক্কা খেয়েছে সেই ভাবনা। বোহেমিয়ান যে পুরুষকে বাঁধতে চাচ্ছিল দশটা-পাঁচটার নিগড়ে, সেটা যেন পেরে উঠছিল না। পড়াশুনায়, মেধায় সায়নীর থেকে অনেক এগিয়ে ছিল সন্দীপন। কিন্তু ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসে দু'জেন ঢোকার পর কেরিয়ারে বেলাইন হতে থাকল সন্দীপন। ওর বনে-জঙ্গলে চষা যে সব বন্ধু-বান্ধব ছিল তাদের সাথে যেন আরও জড়িয়ে গেল ও। বন-জঙ্গল, ওয়াইল্ড লাইফ, তাদের নিয়ে কাজ- এসবে ডুবে যেতে লাগল ও। বেশ বুঝতে পারছিল সায়নী যে, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হওয়া আর হবে না সন্দীপনের। অবশ্য তাতে সন্দীপনের কিছু যায় আসছিল না। কিন্তু ছোট থেকে জীবনের প্রতি ফোকাসড্ সায়নী যেন অস্হির হয়ে উঠছিল। জীবনসঙ্গী হবে যে মানুষটি, তার চরিত্রের এই বৈপরীত্য ও মেনে নিতে পারছিল না। এটাও বুঝছিল যে জোর করে বাঁধা যায় না সন্দীপনের মত পুরুষকে। হ্যাঁ, সন্দীপন সত্যিই পুরুষ মানুষ। যেমনটা আজকের এই চকমকি কাচে সাজানো পৃথিবীতে পাওয়া বিরল সায়নী জানত। যার শরীরে মিশে গেলে বন্য এক সতেজতা মিশে যায় সত্ত্বায়। কিন্তু ওর হিসাব করার অ্যাকাউন্টেন্সির খাতায় তা ধরা যাচ্ছিল না কোন হিসাবেই। তাই এক-দেড়টা বছরের অস্হির টানাপোড়েনের পর সরে আসে ও নিজেই।

ভেঙ্গে পড়েছিল সন্দীপন।আরও বেশি করে জড়িয়ে গেছিল প্রকৃতির সাথে। ওর নিরাময়, ওষুধ! বন্ধুদের মুখে খবর পেয়েছিল সায়নী। ও নিজেও কম দুমড়ে মুচড়ে যায়নি। যার আঘাতের নিরাময় ওর আজও হয়নি। আর কোন সম্পর্কে জড়াতে পারেনি সায়নী। অন্য পুরুষের সান্নিধ্য পেয়েছে সায়নী, কাছে এসেছে তারা। কিন্তু যে বনজ নেশা ধরিয়ে গেছিল সন্দীপনের আটটা বছরের সান্নিধ্য তা কাটিয়ে আর কোন পরিণতির দিকে যেতে পারেনি ও। কাজ আর কাজে ডুবে গেছিল। চষে বেড়িয়েছে গোটা দেশের সব শহর এই ক'টা বছরে। মা-বাবা'র শত চেষ্টাতেও আর ঘরে বাঁধেনি সায়নীর মন।

"তোর বউ জানে তুই আমার সাথে এসেছিস?", সায়নী জানতে চাইল সন্দীপনের মুখের দিকে চেয়ে। আবছা তারার আলোয় ঢাকা ওদের মুখ।

" না রে! মানুষের মন। সব কিছু কি সরল গতিতে চলে! জীবনের কত ওঠা-নামা থাকে ।তার সব কটায় সবাই তো সঙ্গে থাকে না। যে থাকেনা সে বুঝবে কি করে তার গভীরতা। অযথা নৌকাডুবি হয়।"

"আসলে তোকে যখন বললাম এবার একবার দেখা করব, আর যখন শুনলাম তুই দিল্লী হয়ে করবেটে আসছিস এই সময়ে কাজে, তখন যখন একসাথে আসতে চাইলাম- তখন অনেক দ্বিধা, অনেক দ্বন্দ্ব নিয়েই বলেছিলাম। আজ এত বছর হয়ে গেল আমরা নিজেদের পুরানো দিন থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। জীবন অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে হয়ত। গত এক বছরে ফেসবুকে যোগাযোগ হবার পর থেকে এমন তো নয় খুব বেশি কথা হয়েছে আমাদের মধ্যে। তবু হঠাৎ মনে হল দেখি না, মানুষ হিসাবে কি সময় আমাদের অচেনা করে দিয়েছে! একটু খেলতে চাইছিলাম নিজের সাথে। তুই এখন সংসারী মানুষ। তোর জীবন অন্য খাতে। তোর পরিবার, সন্তানের ছবি দেখতে পাই ফেসবুকে। তাই তোকে আবার ডাক দিতে অনেকটা সংকোচ কাটাতে হয়েছে।"

"তোর চিন্তা ভাবনাগুলো এখনও সেই রকমই রয়েছে। সেই নিয়মের নিগড়ে বাঁধা। Come on সায়নী। আমরা এই শতাব্দীর মানুষ। আমরা নিজেদের জানি, চিনি। হ্যাঁ, বেশ অনেকটা বছর বয়ে গেলেও। সব সম্পর্ক আলাদা স্কেলে তার স্বরবিস্তার করে। তার সবটা হয়ত সার্থক সঙ্গীত হয়ে ওঠে না। যেমনটা আমাদের হয় নি। তার মানে এই নয় কখনও চলতে চলতে একটু থেমে হারানো সেই সুর শোনার অধিকার নেই আমাদের।"

"তুই কি বলতে চাইছিস...? দেখ এমন করে আমি কিছু বলিনি বা ভাবিনি...", সায়নীর গলায় দ্বিধা।

"আমি কিছুই বলছি না। দেখ প্রকৃতির কাছে, বন্য জীবনের কাছে আমি শিখেছি যে এই পৃথিবীতে সবটাই অনিত্য। যে কোন সময়ে থেমে যেতে পারে সব সুর। সবুজ ঘাসে চড়ে বেড়ানো একটা সোনার হরিণ, নিমেষের মধ্যেই বিশ্রীভাবে রক্তাক্ত হয়ে শিকার হয়ে যেতে পারে একটা চিতাবাঘের হাতে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতে যেতে তবু জীবনের সবুজ ঘাসের মাঠ আর নীল জলের নদীর পারে এসে একটু দাঁড়িয়ে শ্বাস নেব না আমরা! তুই না বললে হয়ত আমিই তোর সাথে একদিন দেখা করতে চাইতাম। দেখতে চাইতাম আমার সেই সুন্দরী প্রেমিকাটি আজ আরো কত সুন্দর হয়ে উঠছে এত গুলো বছরের পাহাড় পার করে!" তারপর একটু থেমে ও বলল, "কিন্তু তুই একটা কথা বল, তুই বিয়ে করলি না কেন এত বছরে কাউকে? এটা যবে থেকে জেনেছি, একটা চাপা অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে।"

"তোর কেন অপরাধবোধ হবে রে পাগল! সব সম্পর্কের আলাদা স্কেল যেমন থাকে, সব প্রেমিকজনেরও তো স্বরবিস্তার এক হয় না। কেউ হয়ত পরে স্কেল পাল্টে ফেলে সময়ের সাথে। কেউ পারে না।তার গান থেমে যায়। তবু পারে না। আমি যেমন পারিনি", বলে আস্তে আস্তে বাংলোর বারান্দার দিকে ফিরে গেল সায়নী।

চৌকিদার গিরিশ এসে বারান্দার সামনে ডালপালায় আগুন জ্বেলে দিয়ে গেল। একটু শীত তাড়াবার উপক্রম। গিরিশ বলল, " স্যার, আপনারা বেড়ার ধারে বেশি যাবেন না। বলা তো যায় না, লেপার্ডরা তো ঘুরে বেড়ায়। তবে আপনাকে আর কি বলব সার। আপনি তো কম জানেন না জঙ্গল। তবু আমাদের নিয়ম গেস্টদের বলে দেওয়া।" এক গাল হেসে চলে গেল গিরিশ রান্নাঘরের দিকে। ওদিক থেকে আবছা আলো ভেসে আসছে। সিমলা মির্চের সব্জিটা ভাল বানায় গিরিশ। আজ রাতে ওটাই বানাচ্ছে।

"এমন করে জঙ্গলে কোনদিন রাত কাটাতে পারব, ভাবিনি", সায়নী বলল। "তুই যে এই জীবনটাকে এত প্যাশন দিয়ে ভালবেসেছিস, এতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিস, তোর ওয়াইল্ড লাইফ এন জি ও এত ভাল ভাল কাজ করছে এটা জেনে যে আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম বলে বুঝাতে পারব না। অথচ ভাবলে অবাক লাগে এই কারণেই আলাদা হয়ে গেছিলাম আমরা। আক্ষেপ হয় কিনা বুঝিনা!"


"জানিস তো একটা কথা আছে সায়নী-In nature there is no finality.... আমরা যতই যন্ত্রসভ্যতায় অভ্যস্ত হই না কেন, প্রকৃতিই আসলে সব নির্ধারণ করে। এখনও। তাই জীবনে কোন কিছুই ফাইনাল নয়। এই যে আমরা এতদিন পরে আবার এমন নিরালায় বসে মন উজাড় করে কথা বলছি, কিছুদিন আগেও আমাদের মনে আসেনি এমনটা। হয়ত এই প্রকৃতি কোথাও সেগুলো ঠিক করে রেখেছিল।"

"বাবা তুই তো অদৃষ্টবাদীর মত কথা বলছিস। এসবে বিশ্বাস কবে থেকে শুরু করলি?"

"প্রশ্নটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নয়। এতগুলো বছর প্রকৃতির অন্দরে-কন্দরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এই জিনিসটা বুঝেছি যে প্রকৃতি সব কিছু একটা নিয়ম বানিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সে তুমি যতই বড় সভ্যতার বড়াই কর না কেন! অভিজ্ঞতা সেটা শিখিয়েছে। এটাকেই আগেকার সময়ে লোকে অদৃষ্ট বলত।"

অনেকক্ষণ ধরে নদীর ধার থেকে একজোড়া টিটি পাখির ডাক ভেসে আসছিল। চাঁদের আলোয় ভরা রাতের নি:স্তব্ধতাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দিয়ে। এবারে নদীর এদিকেই একটা ময়ূর জোরে জোরে ডেকে উঠল। তার সাথেই শোনা গেল বার্কিং ডিয়ারের ঘাঁউ ঘাঁউ ডাক।বেশ ঘন ঘন ডাকছে হরিণটা। কথাবার্তা থামিয়ে সন্দীপন কানটা পেতে থাকল। হঠাৎ বাংলোর খানিক পিছন থেকে জোরে শোনা গেল বাঘের গর্জন। গাছপালা, নদীর স্রোত, বনবাংলোর পুরানো থাম- সবকিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে। তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পিছনের পাহাড়টার ওপর থেকে শোনা গেল আবার বাঘের ডাক। তবে এটা অন্য। জড়সড়ো হয়ে সায়নী এসে দাঁড়াল সন্দীপনের গা ঘেঁষে। ওর কাছে এমনটা অভূতপূর্ব তো বটেই, অচিন্তনীয়। দুই-তিন বার বাঘেদের ডাক শোনা যাওয়ার পর থেমে গেল। কিন্তু তখনও চলছে ময়ূর আর বার্কিং ডিয়ারের ডাকাডাকি।

একটু পরে দেখা গেল দৌড়াতে দৌড়াতে টর্চ হাতে আসছে গিরিশ আর ড্রাইভার ওসমান । "শুনা স্যার আপ লোগো নে। শুনা...?", ওসমান উত্তেজিত।

"মেটিং কল ছিল। বাঘ-বাঘিনীর", সন্দীপন বলল।

"মানে?", সায়নী বলল। ওর শরীর অল্প অল্প কাঁপছে তখনও সন্দীপন পাশে দাঁড়িয়ে বেশ বুঝতে পারছে।

"মানে আর কি! বাঘ-বাঘিনী এই বসন্ত-রাতে মিলিত হতে চাইছে। ওদের জীবনে কিন্তু সব সুর এক স্কেলে বাঁধা। খাও, ঘুমাও আর..."। বলে হা হা করে হসে উঠল সন্দীপন।

তারপরে ওর, গিরিশ আর পুরন্দরের মধ্যে ওই দুই বাঘ-বাঘিনীর সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি, জীবন ইতিহাস নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা চলল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কাল সায়নী চলে যাবার পর ওদের নিয়েই তো কাজ শুরু হবে সন্দীপনের। এসে পড়বে আরও দলের লোকজন। এই জোনে টাইগার সেনসাস এবার ওদের দায়িত্বে। সায়নীর দেখা করার ইচ্ছার কথা শুনে ও একদিন আগে বনবাংলোর বুকিং নিয়ে চলে আসে।এই বাংলোটা তো পর্যটকদের দেয় না। ওয়াইল্ডলাইফ সংস্হার কর্তা হিসাবে অবশ্য সন্দীপনদের অবারিত দ্বার। বড় প্রিয় রামগঙ্গার ধারে এই দুই কামরার বাংলোটা সন্দীপনের। করবেটের কত সুন্দর দুপুর, সন্ধ্যা, রাত যে এখানে কাটিয়েছে ও।

বনফায়ারের আগুনটা নিভে এসেছিল। গিরিশ জানাল খাবার তৈরি প্রায়। ওরা যেন ডাইনিং এ গিয়ে বসে। ও খাবার লাগাচ্ছে।

বাঘের গর্জনের সাথে সাথে বন যেমন জেগে উঠেছিল, এখনও যেন তার রেশ রয়ে গেছে। অন্তত সায়নীর মনে। শিহরন, ভয়, রোমাঞ্চ, আনন্দ-সব অনুভূতি মিলেমিশে যাচ্ছিল। চুপচাপ সোলার লাইটের মিটমিটে আলোয় ওরা খেয়ে যাচ্ছিল গিরিশের যত্ন করে বানানে ডাল, চাউল, স্যালাড, সিমলা মির্চের তরকারি আর চাটনি।

"বাঘেদেরও কি বিচ্ছেদ, মিলন এসব আছে?", নি:স্তব্ধতা ভেঙ্গে জিজ্ঞাসা করল ও।

"আহা থাকবে না কেন। খুব আছে। ওরা তো আর আমাদের মত কৃত্রিম নিয়মে বাঁধা নেই। প্রয়োজন মত সঙ্গী পাল্টায় ওরা। সঙ্গীর খোঁজে মাইলের পর মাইল হেঁটে নদী, পাহাড়, বন, হাইওয়ে, রেললাইন পার হয়ে কত দূরে দূরে পাড়ি জমায়", খাবার চিবোতে চিবোতে সন্দীপন বলল।

খাবার পরে আর বেশি কথা হল না। আসলে সন্দীপনের বেশ পরিশ্রান্ত লাগছিল। কাল রাতে ট্রেনেও তেমন ঘুম হয়নি। এত বছর পরে সেই মানুষটাকে দেখতে পাবার উত্তেজনায় ট্রেনের বার্থে ছটফট করেছে ও। অন্ধকারে বোঝার চেষ্টা করেছে নীচের বার্থে সায়নীও কি তেমনই ভাবছে!কত স্মৃতি মনে ভিড় করে আসছিল। অদ্ভুত এক আবেগ...যার কোন ব্যাখ্যা হয় না। তারপরে আজ সারাদিন বনে ঘুরাঘুরি।হালকা চাঁদের আলোয় সন্দীপন সায়নীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।কিছু না....আসলে বারবার সেই মানুষটাকে খোঁজার চেষ্টা করছে ওই চোখে, ঠোঁটে, ভুরুতে, চিবুকে। বারান্দার থামে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল ও। ধোঁয়াটা পাক খেতে খেতে হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে দেখছিল সায়নী। বসন্তের বনের হাওয়ায় কতরকম গন্ধ মিলেমিশে আছে নাম না জানা ফুল, পাতা, ফলের। একটা পাখি কখন থেকে করুণ সুরে ডেকে চলেছে। সন্দীপন বলল কমন হক কুকো। দেশীয় ভাষায় বলে পিউ কাহাঁ। ইংরে্জরা বলত-ব্রেন ফিভার। ডাকটা ইংরাজিতে ভাবলে এমনটাই মনে হয়। এমন সুরেই সঙ্গীকে ডাক দেয় সে দিনে বা রাতে। কাল সকাল হতেই এই বন ছেড়ে চলে যেতে হবে যেন এখন ভাবতে পারছে না সায়নী। মনে হচ্ছে এখানে যেন ও কতদিন ছিল, সন্দীপনের সঙ্গেই। প্রকৃতির জাদুটান যে এমন মারাত্মক হতে পারে তা অনুভব করল। এই একটা দিনেই। সন্দীপন সত্যিই ভাগ্যবান যে এই জাদুতে মজে আছে। এই জাদু যদি ওকেও কোনভাবে ছুঁত...হয়ত জীবনের গতিপথ অন্যরকম হত। একটু কি দুর্বল হয়ে পড়ছে ও মনে মনে কাল থেকে? যখন সন্দীপনের সাথে দেখা করতে চেয়েছিল এত শত কথা মনে আসেনি ওর, একটু দ্বিধাদ্বন্দ থাকলেও। আসলে প্রকৃতির এমন নিবিড় সান্নিধ্য যেন মনের মধ্যে কতরকম বিক্রিয়ার অনুঘটকের কাজ করল। তবে স্বাবলম্বী, সফল, পেশাদার নারী হিসাবে সায়নী সেই দুর্বলতা কাটিয়ে দিতে চাইল মনের ভেতর শক্তি সঞ্চয় করে। ওর বিচরণ যে জগতে সেখানে ও এখন একজন কেউকেটা। এত দুর্বল হয়ে পড়ে ও বোধহয় নিজের ওপর ঠিক বিচার করছে না। গুড নাইট জানিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে গেল ও।

শুতেই বেশ ঘুম এসে গেছিল সন্দীপনের।পিউ কাঁহাটা তখনও ডেকে চলেছে আশপাশ থেকেই। ওর মনে ভিড় করছিল কত পুরানো ঘটনা, হাসি-আনন্দ-কান্নাভেজা মুহূর্তের ছায়ারা।অদ্ভুত একটা পুরানো গন্ধ মাখা দিন কাটল। মনে মনে বলল ও। সেসব ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে এসেছিল ওর।কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ জোরে জোরে দরজা ধাক্কার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর। একটু অবাকই হল। বাইরে তখন একটা সম্বর হরিণ বনের ভিতর থেকে বেশ জোরে জোরে ডাকছে। চিতলের ডাকও শুনতে পাচ্ছে।'কল' চলছে বনের ভাষায়।থাকবে কোন বাঘ বা লেপার্ড কাছাকাছি। তাড়াতাড়ি আলো জ্বেলে দরজা খুলে দেখল বাইরে অন্ধকারে সায়নী দাঁড়িয়ে। দরজা খুলতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ও সন্দীপনের বুকে। পাতলা একটা টি-শার্ট পড়েছিল সন্দীপন। নীল ডোরাকাটা নাইটি পড়া সায়নীর গা থেকে বেশ সুন্দর একটা গন্ধ আসছে। যদিও হালকা সেই গন্ধ। কোন ক্রিমের হবে। জড়িয়ে ধরে একটু একটু করে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সেই নারী। "কি হল রে!", সন্দীপন আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করল সায়নীর দুই হাত ধরে।

"তুই এই বনের অন্ধকার রাতে কিভাবে একা আমাকে একটা ঘরে রেখে এলি! কখন থেকে নানারকম আওয়াজ আসছে চারদিক থেকে। আমি তো ঘুমোতেই পারছি না। ভীষণ ভয় করছিল আমার।"

ছোট্ট একটা পাখির মত তিরতির করে কাঁপছিল সেই নারী সন্দীপনের বুকে। এমন আহত পাখি সন্দীপন ওর বন-জঙ্গলের জীবনে অনেক উদ্ধার করেছে, শুশ্রূষা করেছে। হাত ধরে নিয়ে গিয়ে খাটে বসাল ওকে।

"একটু জল খা। শান্ত হ", জলের বোতলটা এগিয়ে দিল সায়নীর দিকে।

"বনের রাত তো এমনই হয়। বন কখনও ঘুমায় না রাতেও। সেখানে বাঘ যেমন ডেকে ওঠে, হরিণ যেমন ভয়ে চিৎকার করে, তেমনি প্যাঁচার কর্কশ স্বর, নাইটজার, ঝিঝির ডাক আর পিউ কাঁহার কাতর রবেও বন ভরে থাকে রাতে। যাদের আমি আমার জীবনে ভালবাসি, যত্ন নিই-তাদের জন্য এমন একটা বনের রাত উপহার হিসাবে দেওয়া ছাড়া আমার তো আর কিছু দেওয়ার নেই রে। প্রকৃতির থেকে বড় উপহার আর কে দিতে পারে আমাদের। এটাই আমার জীবন। আমার দর্শন। কেউ সে উপহার একা উপভোগ করে রাত জেগে। কেউ বা প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে, আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে।কাল যখন তুই চলে যাবি বনের পথ দিয়ে এই রাতটাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবি।ভয় পাস না। উপভোগ কর। enjoy। "

সন্দীপনের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল সায়নী। কথা শেষ হতেই ও সন্দীপনের কাঁধে মাথা রাখল। আলোটা নিভিয়ে সন্দীপন এসে শুইয়ে দিল সায়নীকে বিছানায়। ঘরে জানালা দিয়ে চাঁদের আবছা আলো এসে পড়েছে। সেই আলোয় সায়নীর ভিজে চোখ-দু'টো দেখা যাচ্ছে। ওর পাশে শুয়ে সায়নীকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরল সন্দীপন। ওর আবার মনে পড়ে যাচ্ছে শচীন দেব বর্মণ -মীরা দেব বর্মণ।


মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে

তেমনি আমাতে তুমি..


এই রাত যেন নদীর ধারে এসেও তেষ্টা না মিটিয়ে ফিরে যাওয়া এক হরিণীকে ভালোবাসার ধারায় ভিজিয়ে দেবার রাত। যে ভালবাসার নদী এতদিন ফল্গুধারার মত লুকিয়ে গেছিল, তাতে যেন ঢেউ এসেছে আবার। পিউ কাঁহা পাখিটা কেঁদে কেঁদে থেমে গেছে এখন বাইরে। বোধহয় ওর সঙ্গীকে পেয়ে গেছে।

159 views0 comments
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page