পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণী বাঘরোল বা Fishing cat। অবহেলিত একটি প্রজাতি। তাদের নিয়ে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে মানুষের মধ্যে এমনকি সংবাদমাধ্যমে। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের আসাবস্থল। কমে যাচ্ছে ওরা সংখ্যায়। ওদের কথা জানাতে তাই তথ্যচিত্র বানাতে এগিয়ে এলেন দুই তরুণ- শুভজিৎ মাইতি ও কৌশিক মুখোপাধ্যায়। তাদের এই নতুন ছায়াছবি নিয়ে আলাপচারিতায় বনেপাহাড়ে ওয়েবজিনের সম্পাদক সুমন্ত ভট্টাচার্য্য। আজ প্রথম পর্ব ।
বনেপাহাড়ে: আপনারা এই ফিশিং ক্যাট বা বাঘরোল নিয়ে ছবি তৈরি করার কথা কেন ভাবলেন?কিভাবে এল ভাবনাটা?
শুভজিৎ: অনেকগুলো বিষয় আছে এই ভাবনাটা আসার পিছনে। কৌশিক শহর কলকাতার ছেলে। কিন্তু আমি গ্রামীণ হাওড়ার ছেলে, ধুলাগড়ের কাছাকাছি দেউলপুর নামে একটা গ্রামে। এই যে ধুলাগড় বা এরপরে যত কোলাঘাটের দিকে চলে যাবেন- এই গ্রামীণ হাওড়াটা জলাজমির উপরে তৈরি। আমাদের হাওড়া জেলা কিন্তু খুব বেশিদিন এই নাম পায়নি। ১৯৩৮ সালে স্বীকৃতি পেয়েছে হাওড়া জেলা বলে। তার আগে হুগলীতে ছিল। এই যে ‘হাওড়া’- এই নামটা কোথা থেকে এল? আমরা যখন খোঁজখবর করলাম দেখলাম যে নামটা এসেছে হাওড় থেকে। হাওড় মানে ওয়েটল্যান্ড বা জলাজমি। তাই এইদিকের লোকজনকে হাওড়া বলা হত। তাছাড়া এখানে রেলপথ পাতার পর বা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় শুধু হাওড় দেখা যেত যাতায়াতের পথে। তাই হাওড়া বলত এইসব জায়গাকে।
বনেপাহাড়ে: অর্থাৎ হাওড় থেকে এল হাওড়া।
শুভজিৎ: হ্যাঁ। অর্থাৎ জলাভূমি অঞ্চলে আমরা বাস করছি আর এটা হল নদীর নিম্নগতির এলাকা। সমুদ্রের কাছাকাছি। আমাদের থেকে সমুদ্রের পাখির ওড়ার হিসাবে দূরত্ব ওই ১০০ কিলোমিটার। এখানে যেসব নদী আছে- গঙ্গা, রূপনারায়ণ,দামোদর- তাদের নিম্নগতি এলাকা। বর্ষায় এরা দু-কূল ছাপিয়ে যায় আর পলি পড়ে এইসব এলাকা তৈরি হয়েছে। এইসব জমি অনেকটাই নিচু। তাই বর্ষার জল বছরেরঅনেকটা সময় ধরে জমে থাকে। প্রায় ছ’মাস। এই জলটা তাই এখানে অনেকরকম গাছপালার জন্ম দিয়েছে, বিশেষত জলজ গাছ। তাদের অনেকরকম বৈচিত্র্য আছে।যেমন-খড়ি ঘাস, নল ঘাস, খাগড়া ঘাস। এরা জলটাকে সহ্য করতে পারে। বর্ষায় জলাগুলো এক হয়ে যায়। ফলে অনেক মাছ জন্মায়। চাষ করা ছাড়াই। বিশেষত জিওল মাছ। শাল, শোল, ল্যাঠা, কই। ফলে গাছ হল কটা বাসস্থান আর মাছ হল খাদ্যতাই এগুলোর যোগান থাকায় অন্য অনেক রকম জীব এখানে বাস করতে পারে যাদের
এগুলো লাগবে। উভচর প্রাণী, নানারকম পাখি। তারপরে স্তন্যপায়ীরা। এই যে খাদ্য শৃঙ্খল তার মধ্যে সবার উপরে থাকছে carnivore রা। এদের মধ্যে সবার উপরে রয়েছে অর্থাৎ apex predator হল ফিশিং ক্যাট বা বাঘরোল। ওরা একদম এই জলাজমির প্রাণী। সারা পৃথিবীতেই তাই। একটু ছোট বটে। কিন্তু অদ্ভুত রকম দেখতে। বাঘের মতই সৌন্দর্য একরকম। আর ওরা আমাদের রাজ্যপ্রাণী।
আর এরা একরকম বিড়াল যারা জল হল তাদের জীবন, যেখানে অন্য রকম বিড়ালরা জল থেকে দূরে থাকে। একেবারে জলের নীচে ঢুকে মাছ ধরে খায়। শুধু মাছ নয়, নানারকম প্রাণী ধরে খায়। আমরা ছবিতে পেয়েছি সাপ মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা পেয়েছি ব্যাঙ, ইঁদুর, নানা পাখি খাচ্ছে। মাছের সংখ্যা এখানে অনেক বেশি। তাই মাছ ধরার একটা পদ্ধতি এরা তৈরি করছে। একটা কথা ভাবুন সুমন্তবাবু,রাতের অন্ধকারে একটা বাঘরোল পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে এবং জলের নীচে মাছেদের কি কার্যকলাপ সেটাও বোঝে।মাছ রাতে জলের উপরে চলে আসে পাড়ের দিকে, পেট ঠেকিয়ে ঘুমায়। কিছু কিছু মাছকে মাঝে মধ্যে উপরে উঠে অক্সিজেন নিতে হয়, যেমন ক্যাটফিশদের। এই বাঘরোলরা জলের নীচে ঢুকে জ্যান্ত মাছ ধরে উপরে উঠছে। একটা মাছ কত জোরে সাঁতার কাটে ভাবুন তো। আমি আপনি সহজে ধরতে পারব?
অথচ ওরা ওদের শিকারের ক্ষমতা কেমন করেছে যে এইসব মাছকে ধরে নিচ্ছে! এইসব দেখে অবাক হয়ে যেতাম। এইসব নিয়ে খোঁজখবর শুরু করলাম। সে প্রায় ১৫ বছর আগে। তখন কোথাও কোন তথ্য পেতাম না। না গুগলে বা অন্য কোথাও। তখন এগুলোখতিয়ে দেখার ইচ্ছা হল। দিনের পর দিন জলার ধারে পড়ে থেকেছি ক্যামেরা নিয়ে ওদের কার্যকলাপ ধরে রাখব বলে। ছবির থেকে বেশি ঝোঁক ছিল ভিডিও তোলার। কারণ ওদের আদব কায়দা আমার খুব ভাল লাগে দেখতে। ২০১৩ সালের কিছু ফুটেজও কৌশিক ব্যবহার করেছে এই ছবিতে। তাই না কৌশিক।
কৌশিক: হ্যাঁ। একদমই তাই।
শুভজিৎ: আমাদের ছবি হল ২০২৩ এ। তার দশ বছর আগের ফুটেজ ব্যবহার হয়েছে। খড়ি বনের মধ্যে ঢুকতাম। সেখানে দাঁড়ানো যায় না। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। মানে আমরা হামাগুড়ি দিলে যে উচ্চতা হবে ফিশিং ক্যাটের উচ্চতাও সেরকম।ভেতর দিয়ে রাস্তা তৈরি হয়ে আছে যেন অদ্ভুতভাবে। বাইরে থেকে আমরা দেখছি ঘাসবন। ভিতরে সুন্দর রাস্তা। থাকার জায়গা। এগুলো দেখে ক্যামেরা ট্র্যাপ জোগাড় করে কিছু ফুটেজ জোগাড় হল সেখানকার।
আরো আগ্রহ বাড়ল যে আরও কিছু করি। এইসময়ে কৌশিকের সাথে আমার আলাপ হয়। ও একজন রক ক্লাইম্বার,ফটোগ্রাফার। ওর সাথে দেখলাম আমার মানসিকতা খুব মিলছে। আমরা একইরকম ভাবি। আমাদের বেশিরভাগের কাছেই মানুষের গুরুত্ব যতটা, পশু-পাখি-প্রকৃতিকে ততটা দিতে পারে না। কেউ ভালবাসলেও মানুষের সমান কি আর ভাবতে পারে! আমরা দিই। আমরা জঙ্গল, প্রকৃতিকে যারা ভালবাসি- আমরা গুরুত্বটা দিই মানুষের মতই। সেই মানসিকতাটা মিলে গেল কৌশিকের সাথে আমার।
বনেপাহাড়ে: ছবিটা আপনারা বানাবেন এই ভাবনটা ঠিক কতদিন আগে আপনাদের মাথায় এল?
কৌশিক: ২০১৮ এর শেষ দিকে আমাদের পরিচয়। তারপর থেকে কাজ শুরু। শুভজিৎদা অনেক কিছু বলল। আমি তার সাথে দুটি জিনিস যোগ করব। ফিশিং ক্যাট আমাদের রাজ্য প্রাণী তো বটেই তার সাথে largest cat among the lesser cats। সবচেয়ে বড় কথা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণী হলেও এরা খুব অবহেলিত, জানেও না
সবাই। আরও বাজে ব্যাপার সংবাদমাধ্যম অনেক সময় চিতাবাঘ বলে এদের চালিয়ে দিচ্ছে। এইসব বিষয়গুলো আমাদের তাড়া করেছে। তাই এই ছবির মাধ্যমে এইতথ্যগুলি পৌঁছে দিতে চেয়েছি যে এরা বাঘ নয়, এরা বিড়াল। এবং এরা মানুষের জন্য কোনরকম বিপদের কারণ নয়। বরং মানুষের উপকারই করে থাকে নানাভাবে।
প্রকাশিত হয়েছে তথ্যচিত্রটির ট্রেলার
এখানে যেহেতু একটা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা চলে গেছে-ন্যাশনাল হাইওয়ে,সেখান থেকে সংযোগকারী রাস্তাগুলো ঢুকছে তাদের আশেপাশে জলাজমিতে ফ্লাই অ্যাশ ফেলে জলাগুলো বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার উপরে কারখানা হচ্ছে। আমরা কিন্তু উন্নয়নের বিরোধী নই।কিন্তু এই জলাজমি যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে তা মানুষের বসবাসের উপযোগী থাকবে না। পরের প্রজন্মকে রেখে যাব এখানে। কিন্তু কারখানা হয়ে যদি সব শেষ হয়ে যায় আমরা খাব কি, নি:শ্বাসটা নেব কিভাবে!
শুভজিৎ: ফিল্মমেকার নয়, আমি নিজেকে পরিবেশকর্মীই বলব। সংরক্ষণটা ভীষণভাবে দরকার। নয়ত সভ্যতাটা শেষ হয়ে যাবে। চোখের সামনে দেখছি এই গুরুত্বপূর্ণ জলাজমি যা আইনত সংরক্ষিত, সেখানে রোজ দেখছি তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখানে যেহেতু একটা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা চলে গেছে-ন্যাশনাল হাইওয়ে, সেখানথেকে সংযোগকারী রাস্তাগুলো ঢুকছে তাদের আশেপাশে জলাজমিতে ফ্লাই অ্যাশ ফেলে জলাগুলো বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তার উপরে কারখানা হচ্ছে। আমরা কিন্তু উন্নয়নের বিরোধী নই। কিন্তু এই জলাজমি যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে তা মানুষের বসবাসের উপযোগী থাকবে না। পরের প্রজন্মকে রেখে যাব এখানে। কিন্তু কারখানা হয়ে যদি সব শেষ হয়ে যায় আমরা খাব কি, নি:শ্বাসটা নেব কিভাবে! বিশুদ্ধ পানীয় জল আসবে কিভাবে! আমরা তো এখানে বেশ ভাল ছিলাম। উন্নয়নের স্রোতে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বনেপাহাড়ে: এর সাথে সাথে কি বাঘরোলের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে?
শুভজিৎ: হ্যাঁ। বাঘরোলের সংখ্যাও কমছে। আমরা বারবার বলি নতুন জঙ্গল কেন তৈরি হবে না। ওই জঙ্গল ,জলাজমি যদি বাঁচে মানুষও বাঁচবে, বাকি বন্যপ্রাণীও বাঁচবে।
বনেপাহাড়ে: এই জলাজমি যার আইনি রক্ষাকবচ থাকলেও শেষ হয়ে যাচ্ছে, আপনাদের ছবি হয়ত সেই বিষয়ে মানুষকে বার্তা দিতে পারবে যে এই জলাজমিও একটা বাস্তুতন্ত্র যার গুরুত্ব অরণ্যের মতই।
শুভজিৎ: একদম। আমরা ওটাই বোঝাতে চেয়েছি। এই যে এত গাছ লাগাচ্ছে তাতে তো অরণ্য তৈরি হচ্ছে না, বাগান তৈরি হচ্ছে। প্রকৃতি নিজে যেটা বাঁচাবে সেটাই অরণ্য। আপনি একটা জায়গা ফাঁকা রেখে দিন, কাউকে ঢুকতে দেবেন না। প্রকৃতি নিজেই জঙ্গল তৈরি করে নেবে।
কৌশিক: আমরা তো একটা কথা বলি যে, প্রকৃতিকে যদি ভালবাস তবে তাকে কিছু করতে যেও না। তাকে ছেড়ে দাও।
বনেপাহাড়ে: আমাদের পত্রিকাতেই এর আগে মহারাষ্ট্র থেকে পরিবেশকর্মীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম যারা ঘাসবন নিয়ে কাজ করছে। উন্নয়নের দাপটে বা বৃক্ষরোপণ করে প্রাকৃতিক ঘাসজমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যেখানে নেকড়ে, হায়না, শিয়াল, হরিণ ও নানারকম পাখির বাস।
তা আপনারা বললেন যে এই জলাজমিগুলি আইনত সুরক্ষিত তা এদের দখল হওয়া থেকে বাঁচাতে বনদপ্তর বা প্রশাসন কেউ কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে না?
শুভজিৎ: না। নিচ্ছে না। একদম কেউ কোন দায়িত্ব পালন করছে না।
কৌশিক: ভোটাধিকার নেই এইসব প্রাণীদের। তাই তাদের নিয়ে ভাবার কেউ নেই।
বনেপাহাড়ে: আপনি তো ছোট থেকে ওদের দেখছেন। এখন নিশ্চই ওদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে আগের তুলনায়?
শুভজিৎ: অনেক কমে গেছে।
বনেপাহাড়ে: ফিশিং ক্যাট ছাড়া এই অঞ্চলে আর কোন কোন শিকারি প্রাণী রয়েছে?
শুভজিৎ: শিয়াল আছে। গোল্ডেন জ্যাকেল, বেঙ্গল ফক্স। বনবিড়াল বা খটাশ। এরাও আছে তো।
বনেপাহাড়ে: এরা এখানে কোন ধরনের খাদ্য খায়?
শুভজিৎ: শিয়াল তো সব খায়। Scavenger জাতীয় প্রাণী এরা। বন বিড়ালরা মূলত: ইঁদুর খায়।
বনেপাহাড়ে: এইসব এলাকায় যারা মাছচাষ করে তাদের সাথে বোধহয় একটা Man-animal conflict এর জায়গা তৈরি হচ্ছে ফিশিং ক্যাট নিয়ে।
শুভজিৎ: আছে তো। খুব আছে। এমন অনেককেই চিনি যারা বলে গত দশ বছরে তারা প্রায় ৩০টার মত বাঘরোল মেরেছে। এমন লোকদের সাথে কথা বলি আমি। নিয়মিত কথা বলি। বোঝাই।
বনেপাহাড়ে: কিভাবে মারে ওরা?
শুভজিৎ: বিষ দিয়ে মারে। ফাঁদ পেতে মারে। মাছের ভেড়ি রক্ষা করার জন্য। এক এক রাতে দু’টো তিনটে ফিশিং ক্যাট দুই তিন কিলোর কাতলা তুলছে। কাতলা উপরের জলের মাছ। এক একটা কাতলা ৩৫০ টাকা কিলো প্রতি। ফলে বিরাট একটা ক্ষতি হচ্ছে তাদের।
বনেপাহাড়ে: তাহলে এই সংঘাতের জায়গাটা কিভাবে সমাধান করা যাবে?
শুভজিৎ: তাদের কে সচেতন করতে হচ্ছে প্রথমে। তারা তো জানে না যে এটা রাজ্যপ্রাণী। তাদের অহংকারের জায়গা। কতটা গুরুত্ব তার। State animal আমাদের বাড়ির পিছনে থাকে। এটা তো তারা জানত না।
বনেপাহাড়ে: ওরা বিষয়টা বুঝেছে?
শুভজিৎ: পুরোপুরি বুঝেছে। কেউ ফিশিং ক্যাট মারে না আর। কেউ কেউ যারা এইসব বিষয় নিয়ে ভাবেন আমাদের সাথে যোগাযোগ করে টাকা পয়সা দিয়ে যান। সেই টাকায় আমরা মাছ ছেড়ে দিই এদের পুকুরে।
বনেপাহাড়ে: সরকার থেকে কি কোনরকম পদক্ষেপ আছে ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য? যেমনটা বাঘ গবাদি পশু খেলে বা হাতি সম্পত্তির ক্ষতি করলে দেওয়া হয়?
শুভজিৎ: না না। কোন পদক্ষেপ নেই সরকারের থেকে। ফিশিং ক্যাট শুধু মাছই খায় না। মাঝে মধ্যে এক আধটা ছাগলও তুলে নিয়ে যায়। বুঝতে পারছেন ছাগল তুলে নিলে মালিকের কতটা ক্ষতি!
বনেপাহাড়ে: তাহলে বলছেন পিটিয়ে মারার বিষয়টা এখন কমে গেছে।
শুভজিৎ: হ্যাঁ, সেটা এখন নেই বললেই চলে।
কৌশিক: হাওড়া জেলায় এখন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে Feral boar এর। এরা বাচ্চাও দেয় অনেক, যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়ে ক্ষতি করে চাষের জমির। ফলে এদের ধরতে ফাঁদ পাতছে। তাতে ফিশিং ক্যাট সহ নানা জন্তু ধরা পড়ছে। ওয়াটার মনিটার পড়ছে। এটা এখন একটা সংকটের কারণ হাওড়া জেলায়।
বনেপাহাড়ে: তা এই ফাঁদে ফিশিং ক্যাট পড়লে আপনারা কি উদ্ধারে যান?
শুভজিৎ: হ্যাঁ, যেতে হয় তো খবর পেলে।
বনেপাহাড়ে: তার মানে তারা এই বিষয়ে সচেতন যে বনবিড়াল পড়লে খবর দিতে হবে?
শুভজিৎ: হ্যাঁ, সচেতন। সচেতনতা বেড়েছে। কারণ এই নিয়ে কাজ হচ্ছে অনেকদিন ধরে।
বনেপাহাড়ে: দুই-তিন বছর আগে একটা খবর এসেছিল, বেশ হইচই হয়েছিল অনেকগুলো বাঘরোলকে একসাথে মেরে ফেলার ব্যাপারে।
শুভজিৎ: হ্যাঁ। কালিকাপুরে হয়েছিল। সেখানে দুইজনকে গ্রেফতার করার পর গ্রামবাসীরা বনবিভাগের লোককে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে যে ওদের চাষের ক্ষতি হচ্ছে শূয়রের জন্য সেই নিয়ে সরকারে হুঁশ নেই। কেন ফিশিং ক্যাট মেরেছে বলে গ্রেফতার করতে এসেছে! আমরাই পরে সেখানে সচেতনতার প্রচার করি। আমরা অনুরোধ করেছিলাম বাঘরোল না মারতে। আমরা সরকারকে আলাদা করে আর্জি সবার কাছে ফোন । কেউ যদি ছবি তুলে নিয়ে যায় যে ফিশিং ক্যাট তার পুকুরের।
বনেপাহাড়ে: সরকারের কোন সাড়া আছে এই নিয়ে?
শুভজিৎ: দেখুন ফিশিং ক্যাটের জন্য সরকার কিছু করেনি এখনও পর্যন্ত।
বনেপাহাড়ে: এই কারণেই হয়ত আপনাদের ডকুমেন্টারিটা গুরুত্বপূর্ণ সবার জানার জন্য বিষয়গুলো। হাওড়ার কোন কোন জায়গার ছবি আপনারা তুলে এনেছেন এতে?
শুভজিৎ: মূলত: হাওড়ার পাঁচলা ব্লক ও ডোমজুড় ব্লকে কাজ করেছি আমরা তারমধ্যে আমার দেউলপুর গ্রামেই বেশি কাজ হয়েছে।
কৌশিক: শ্যামপুরে শুটিং হয়েছে।
শুভজিৎ: হ্যাঁ, শ্যামপুরেও হয়েছে। ওটা মেদিনীপুরের গা ঘেঁষে। বাগনানেও শ্যুট করেছি আমরা।
কৌশিক: সেখানে ডাক্তার সৌরেন্দ্রশেখর বিশ্বাসের ইন্টারভিউ করা হয়েছে। ওনার যে ভেষজ উদ্ভিদের বাগানটা আছে সেখানে।
শুভজিৎ: আমরা দেখিয়েছি যে আলাদা করে জঙ্গল তৈরি করার জন্য জমি কেনা যায়।ওনার যে ছ’বিগে জমিতে জঙ্গলটা তৈরি হয়েছে সেটা আমরা দেখিয়েছি।
বনেপাহাড়ে: ওখানে কি বাঘরোল আছে?
শুভজিৎ: হ্যাঁ, ওখানে বাঘরোলের বাসস্থান রয়েছে তো। উনি তিনখানা বাঘরোলের বাচ্চা উদ্ধার করেছিলেন। সেই ছবি দেখিয়েছেন।
বনেপাহাড়ে: কিভাবে ওদের ছবিতে শ্যুট করতেন?
কৌশিক: এটা একটু লম্বা বিষয়। প্রথম থেকেই বলি। আমি তো আগে বাঘরোল সেরকম দেখিনি। শুভজিৎদার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে। পুরোটাই শুভজিৎদার থেকে জেনেছি। কোনটা বাঘরোলের পায়ের ছাপ, কেমন ওদের ফেরোমেনের গন্ধ। কোন জায়গায় ওরা থাকে, কিভাবে থাকে, না থাকে। ওর পূর্ব অভিজ্ঞতা, নানা গল্প। এগুলো ও শিখিয়েছে। তারপরে আমরা একসাথে অনেক কিছু খুঁজেছি। এ জলা-সে জলা।
শুভজিৎ: আমরা তো দিনের পর দিন ক্যামেরা ট্র্যাপ লাগিয়েছি। তার ফুটেজ আমাদের কাছে অনেক ছিল। এছাড়াও দিনের আলোয় ছবিগুলোও ছিল আমার ক্যামেরার।।
বনেপাহাড়ে: দিনের আলোতেও তার মানে বার হয় ওরা?
শুভজিৎ: দিনের আলোয় ওরা বার হয় শীতকালে। রোদ পোহাতে। খড়ি বনের মধ্যে রোদটা ভাল ঢোকে না। যদিও ওদের চামড়া খুব মোটা, তার নীচে ভাল চর্বি থাকে। লোমের দুটি স্তর থাকে। খুব ঠাণ্ডা যে লাগে তা নয়। তবে রোদ পোহাতে বার হয় শীতে। ২০১২ থেকেই টানা ওদের পিছনে পড়ে রয়েছি আমি ।তথ্য যখন অন্যত্র আমি পাইনি, এখান থেকেই জোগাড় করতে হবে আমায়। ছবি নাহলে কোথায় পাব? তথ্য পেয়েছি আমার বাবা, জ্যাঠা, দাদুদের থেকে। তাদের তো এখানেই জমিজমা ছিলচাষবাসের জন্য। শুনেছি পান বরজে তারা এসে বসে থাকত। সামনে যাওয়া যেত না এত বড় আকারের ছিল! এখানে নাকি একটা জাঁতিকলে একবার একটা বাঘরোল ধরা পড়েযাকে লোকেরা পিটিয়ে মারে। তার ওজন নাকি ২৫ কিলো হয়েছিল। অথচ রেকর্ড বলছে ১৪ কিলোর উপরে হয় না। যদিও আমরা পেয়েছি ১৮ কিলো।
বনেপাহাড়ে: আপনারা কিভাবে মেপেছেন?
শুভজিৎ: রাস্তায় মারা পড়েছিল গাড়িচাপা পড়ে। তুলে এনে মেপেছিলাম। তখন বন দপ্তর অত আসত না ওদের বডি তুলতে। আমরাই পুঁতে দিতাম মারা গেলে।
বনেপাহাড়ে: রাতের ছবিগুলো কিভাবে পেতেন?
[চলবে]
*সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত বক্তব্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিজস্ব।
ছবি : কৌশিক মুখোপাধ্যায় ও শুভজিৎ মাইতি এবং চিত্রক প্রামানিক।
Kommentare