top of page
  • ..

রইলাম প্রতীক্ষায়: কানহা সফর বৃত্তান্ত, পর্ব ৩

মধ্য ভারত তো বটেই, গোটা দেশের অন্যতম সেরা অরণ্য ও টাইগার রিজার্ভ হল কানহা। হাঁলো ও বানজার নদীর মাঝে অবস্থিত এই অরণ্যের ভ্রমণকাহিনী, বাঘদর্শনের গল্প লিখলেন প্রতীক মহাপাত্র। আজ তৃতীয় তথা অন্তিম পর্ব।




গত সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে যেখানে মুন্না'কে আমরা দেখেছিলাম তার আহত পায়ের চিকিৎসার পর, ঘটনাচক্রে পরের দিন সেই কানহাঘাটের পাশ দিয়েই আমাদের জিপসির অবতারণা আমাদের কানহা সফরের শেষ দিনের মুহূর্ত সঞ্চয়নের জন্য। ২০১৮-র ১৫ জানুয়ারি। সেদিন আবার দীপকদা'র জন্মদিন। তিনি বারবারই বলছিলেন, "দু'দিন জঙ্গল চষে বেড়াচ্ছি, তবে মেল টাইগার আর গাউরের দেখা নেই। এটাই সবচেয়ে বড় আফশোসের!" প্রকৃতি বোধ হয় আমাদের অরণ্যপ্রাণসর্বস্ব বার্থডে বয়ের জন্য সবচেয়ে রোমহর্ষক উপহার নিজের ঝুলিতে রেখেছিল। কাকভোরেই গাইডদের ফিসফাস, এক অতিকায় পুরুষ বাঘ'কে দেখা গেছে কানহাঘাটের কাছে সূর্যের আলো ফোটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ভাবলাম, মুন্না যখন বেশি দূর যাওয়ার মতন অবস্থায় নেই, তাহলে সেদিনের ভোরের শার্দুল দর্শন তার দেখা পাওয়ার মধ্যে দিয়েই আমাদের আকাঙ্খার পরিসমাপ্তি ঘটাবে। কয়েকটি গাড়ির আনাগোনা সবে যখন ভিড়তে আরম্ভ করেছে, আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভোরের আগন্তুক তখন তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত। কাছে যেতেই মনে একটা সন্দেহের আঁচ এসে উপস্থিত হলো। আগন্তুক যখন চলতে শুরু করলো, আমরা লক্ষ করলাম যে তার পেছনের বাঁ পায়ে সামান্য চোট। সম্ভবত এলাকার সীমানা নিয়ে কোনও প্রতিবেশীর সাথে কলহের ফল। মুন্নার চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট, আর বেশ গাঁট্টাগোট্টা। সামনের বাঁ পায়ে আঘাতের কোনও চিহ্নই নেই! খুব কাছ থেকে দেখে আশ্বস্ত হলাম অবশেষে যে আমাদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু মুন্না নয়, কড়াইঘাটি মেল বা KTR T-2। বহু পর্যটকের কাছে শুধুমাত্র বাঘের দেখা পাওয়াটাই মুখ্য উপজীব্য বিষয়, কিন্তু ছোটবেলা থেকে মার্জারকুলের প্রতি অনুপম আকর্ষণ আমাকে বরাবর তাদের দৈনন্দিন 'ঘরসংসার'-এর খুঁটিনাটির বিষয়ে আগ্রহী হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জেনে নিচ্ছি যে কোন বাঘ'কে আমরা অবলোকন করছি, মনের সাধ মেটে না কিছুতেই।



তাহলে কি মুন্না আর কড়াইঘাটি মেলের মধ্যেও এক আসন্ন বিরোধের অদৃশ্য পূর্বাভাস আমরা ইতিমধ্যেই পেতে চলেছি? নাকি বাঘের পরিভাষায় প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের দোরগোড়া ছুঁয়ে ফেলা এই দুই মহারথী নিজেদের মধ্যে আপোস করে নিয়ে নিজেদের এলাকার সীমানাটুকু কোনওভাবে টিকিয়ে রাখতে চায় যে যার মতো করে? উত্তর মেলা ভার! পুরুষ বাঘ কখনও কখনও নিজেদের এলাকার সীমানা বা home range এতটাই বিস্তার করে ফেলে যে বসবাসের এলাকার যোগ্য অন্যান্য দাবীদারদের পক্ষে তা নির্লিপ্তভাবে মেনে নেওয়া সম্ভবপর হয় না। পরিস্থিতির ইঙ্গিত যাই হোক, একটি বিষয় খুব স্পষ্ট আর তা হলো আসন্ন কোনও কমবয়সী ও তেজিয়ান নতুন শাসকের দিক থেকে বর্ষীয়ান এই দুই বাঘ'কেই অচিরে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। গাইড রামকুমার যাদব ভীষণ খুশি তাঁর অতিথিদের তাঁর সাথে সফরের একেবারে সূচনাপর্বেই এমন এক দৃশ্যে সামিল করতে পেরে। একটি কুনকি হাতি পর্যটকদের নিয়ে চলে আসায় কড়াইঘাটি মেলের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট বিরক্তি ধরা পড়লো। পায়ে চোট, তবুও কোনোরকমে সে ওই জায়গা থেকে দ্রুত সরে গিয়ে মিলিয়ে গেল অরণ্যের অন্তরালে, নিরালায়।



আরও একবার বারাশিঙ্গাদের শিং-বাহারের সম্মোহনের নান্দনিকতা'কে সাথী করে আমরা সকাল পর্বের সফর শেষে ফেরার পথে। চলে এলাম লাপসি কবর বলে একটি জায়গায়। কথিত আছে ১৯৩০-এর দশকে লাপসি নামের এক নির্ভীক শিকারী ও গাইড তাঁর ক্রীড়া বিভাগীয় কয়েকজন অতিথিকে এক হিংস্র পুরুষ বাঘের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাঘটির সাথে লড়াইয়ে প্রাণ হারান। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে মুক্কি জোনে তাঁদের লড়াইয়ের স্থানেই একটি সমাধিক্ষেত্র স্থাপন করা হয়। আজকের প্রেক্ষাপটেও লাপসি কবর একই রকমের তাৎপর্য বহন করে যার সাক্ষী থেকেছে স্বয়ং ইতিহাস। সফরের দরুণ এসে উপস্থিত হলাম এমন একটি এনক্লোজারের সামনে, যেখানে আসা অতিথিরা অস্তিত্বের সংগ্রামের গড়িমসিতে কানহার অন্দরে পুরোপুরি সামিল হতে পারেনি এখনও। প্রসঙ্গ কানহায় কৃষ্ণসার বা blackback-এর প্রত্যাবর্তন।

২০০৫ সালে কৃষ্ণসার কানহা থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত বলে ঘোষিত হয়। এর ছ'বছর পর, ২০১১ সালে মধ্যপ্রদেশের সিওনি জেলা থেকে পঞ্চাশটি কৃষ্ণসার'কে কানহায় এনে উপস্থিত করা হয়। তাদেরই মধ্যে বেশ কয়েকজন এই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং তাদের উত্তরসূরীরা আজ কানহার সম্পদ। মন থেকে বেশ অন্যরকমের এক সফরের অনুষঙ্গ উদযাপন করছি বলে মনে হলো, কারণ এযাবৎ কানহা সংক্রান্ত বেশিরভাগ লেখালেখিতে কোথাও কৃষ্ণসারের পুনরাগমন নিয়ে কোনও পর্যালোচনা সেভাবে পাই নি। শেষে মুক্কির মূল ফটকের কাছাকাছি আবারও দেখা ধোয়াঝান্ডি ফিমেলের (KTR T-27) সাথে। এবারেও আমরা তার শাবকদের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেলাম। তবে তার সেই দৃপ্ত ও সচেতন চাহনি আজও মনের মধ্যে উজ্জ্বল।


এক নজরে ঘুরে দেখলেই মুক্কি জোন'কে কিসলি ও কানহা'র চেয়ে বেশ আলাদা হিসেবে চিনে নেওয়া যায়। কানহার অন্তরতম এক অন্দর, যা আপাত দৃষ্টিতে মানুষের স্পর্শের নাগালের বাইরে। যত গহীনে যাওয়া যায়, যেন ততটাই আমরা অরণ্যের বিবেক'কে অনুভব করতে পারি। দু'পাশের ঘন জঙ্গলের সারির মাঝের রাস্তা যেন আমাদের প্রত্যেকটি মুহূর্তে আহ্বান করে চলেছে তার অন্তহীন রহস্যের রসদ নিয়ে। জঙ্গল থেকে ফিরেই প্রাতঃরাশ এবং মধ্যাহ্নভোজের যুগল বা brunch-এর পর আমাদের শেষ দিনের গন্তব্য ছিল স্থানীয় বাইগা গ্রামে গিয়ে সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনেদের সাথে কথা বলা। অরণ্যপ্রান্তিক জীবনের এই টান'কে আমরা উপেক্ষা করিনি কেউ। সঙ্গে ছিলেন বন্যপ্রাণপ্রেমী শিল্পী আশিস কছওয়াহা। তিনি এখানকার যাবতীয় নাড়িনক্ষত্রের সাথে ওয়াকিবহাল একজন সত্তা। আমাদেরও সামিল করলেন তাঁর অবলোকনে। বিকেলের সফরের আগে এবং সন্ধ্যায় ফেরার পর আমরাও সাক্ষী হলাম প্রান্তিক অরণ্যজীবনের এক স্বল্পশ্রুত অধ্যায়ের।



বাইগা গ্রামের আদিবাসীদের অকৃত্রিম আরণ্যক উদযাপন ছাড়াও আমরা যে রিসর্টে ছিলাম, সেই মোটেল চন্দন-এর বিপরীতে রয়েছে কালাদীর্ঘা হ্যাণ্ডিক্র্যাফ্ট সেন্টার। স্থানীয় মানুষদের হাতে তৈরি কিছু অমোঘ শিল্পের সমাহার যেমন রয়েছে একদিকে, তেমন রয়েছে নানান প্রান্ত থেকে আমদানি করা শীতের পোশাক, শৌখিন সজ্জাসামগ্রী এবং নানান জিনিস। পোড়মাটির নানান মূর্তি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। খাটিয়া গেট বরাবর ঢুকে অল্প কিছুক্ষণের হাঁটাপথের পর বাঁদিকে অবস্থান এই হস্তশিল্প কেন্দ্রের। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকেই রয়েছে বিশাল গণেশ মূর্তি। সম্ভবত, সিলিকনের কাজ। শেষ দিন হাতে কম সময় থাকার কারণে আর সেভাবে খুঁটিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা হয় নি।

জঙ্গলের ছোঁয়া জড়িয়ে রয়েছে, এমন অনেক জিনিসই কিনলাম। কানহার স্মৃতি। শেষদিনের, অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারির সন্ধ্যায় দীপকদা'র দ্বিতীয় ইচ্ছেও পূরণ করলো প্রকৃতি। কানহা'র ফিল্ড ডিরেক্টর ড. সঞ্জয় শুক্লার সাথে কিসলি গেস্ট হাউসে ছিল সেদিন আমাদের একান্ত সাক্ষাৎকার। মূলত, তাঁর লেখা বাঘকেন্দ্রিক একটি বই'কে ঘিরে আমাদের উৎসাহ নিরসনের জন্যেই এই বসা। ড. শুক্লা, আমরা, ও গাইড রামকুমার যাদব ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দুই দম্পতি ও তাঁদের সন্তানেরা। জমিয়ে আড্ডা চলছে, হঠাৎই সবাই গেস্ট হাউস লাগোয়া তৃণপ্রান্তরের দিকে চেয়ে হতচকিত হলেন। অদূরেই সন্ধ্যার ম্লান আলোয় দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ কালাপাহাড়—এক পুরুষ গাউর! প্রথম দিনের বিকেল সফরে বেরিয়ে বজরং সম্প্রতি গাউর শিকার করেছে শুনে দীপকদা মজা করে বলছিলেন যে বজরং বোধ হয় কানহা'র শেষ গাউরটাকেই মেরে ফেলেছে। যাই হোক, সেসব বালখিল্যতা এখন অতীত, প্রকৃতি দু'হাত ভরে এই শীতের সন্ধ্যেবেলায় তার সঞ্চয়ের শেষ উপহারটাও উজাড় করে দিল। এবার ফেরার পালা। চেনা জীবনের কর্মতৎপরতায়। অরণ্য কি তবে অবকাশ? বোধ হয় নয়। আমরা সঞ্জীবনীর টানে অরণ্য'কে আলিঙ্গন করি। সেই আলিঙ্গনের উষ্ণতা নিছক সময় কাটানোর অভিব্যক্তি হতে পারে না। এই সবুজ, হরিণের চকিত চাহনি, বারাশিঙ্গার শিংবাহার, নরম রোদ আর ক্যাম্পফায়ারের আঁচ, আড্ডা-গল্প-আর অরণ্যচর্চা এবং সবশেষে যার কথা উল্লেখ না করলে অনেক কিছুই বলা হয় না—হলুদ-কালো ডোরাকাটার দৃপ্ত পদচারণা। এখনও মনে পড়ে শেষ বিকেলের সাফারির শেষে মহাবীর ফিমেলের (KTR T-33) এক পুরুষ শাবকের উপস্থিতি টের পেলেও তাকে দেখতে না পাওয়ার আকুতির কথা। ভরাট গলায় একটা হালকা হুঙ্কার ছাড়লো সে—"আউউউউউমমমমমমম্"। আলো-আঁধারিতে ঘেরা কী অপূর্ব বিদায়বেলা! ভালো থেকো কানহা, আবার দেখা হবে। রইলাম প্রতীক্ষায়।


(সমাপ্ত)


ছবি: লেখক




লেখক পরিচিতি: লেখক পেশাগতভাবে শিক্ষক এবং ইংরেজি সাহিত্যের গবেষণার আধারে সম্পৃক্ত। বন্যপ্রাণ তাঁর অন্যতম ভালোবাসার জায়গা। অরণ্যধর্মী কাজ হিসেবে তিনি স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রকৃতি সচেতনতামূলক শিবিরের এবং তথ্যচিত্রভিত্তিক নিবন্ধ রচনার সাথে যুক্ত বনেপাহাড়ের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য।







Recent Posts

See All

Comments


Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page