top of page
  • ..

বাঘ-দেবতা বাঘোবা: বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ভারতীয় ঐতিহ্যের এক প্রতীক

বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের ঐতিহ্য রয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি ও পরম্পরায়। যে কারণে এত বড় জনসংখ্যার দেশেও সম্ভব হয়েছে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে সাফল্য অর্জন। এটাই বলছে সংরক্ষণ বিজ্ঞান। মহারাষ্ট্রের বাঘ ও লেপার্ড রূপে পুজো পাওয়া বাঘোবা তেমনই এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। মুম্বাই নগরীর মধ্যে রয়েছে যে আরে বনাঞ্চল, সেখানকার পুরানো অধিবাসীদের কাছে বাঘোবা তাদের রক্ষাকর্তা। সেই পরম্পরা ও আস্হা থেকে এখানে বসবাস করা লেপার্ডদের সাথে গড়ে উঠেছে এক অতুলনীয় সহাবস্হান। সেখানে দেখে এসে লিখলেন ড: ঐশিমায়া সেন নাগ

মুম্বাইয়ের আরে কলোনিতে বাঘোবার মন্দির। ছবি: লেখক।

"ভারতের অন্য শহরে কুকুর-বিড়াল থাকে, কিন্তু এখানে বনের লেপার্ড আমাদের সঙ্গী। লেপার্ডরা পরিবারের সদস্যই আমাদের কাছে। আমরা আমাদের লেপার্ড দেবতা-বাঘোবার কাছে প্রার্থনাও করি, যিনি আমাদের বিপদ-আপদ থেকে দূরে রাখেন"- প্রকাশ ভৈর, মুম্বাই।


বস্তুত: ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী ব্যস্ত নগরী মুম্বাই অন্য কোন মেট্রোপলিটন শহরের মত নয়। এই শহর যেমন ২ কোটির উপরে মানুষের বাসস্থান, তেমনি এই শহরের হৃদয়ে জায়গা আছে ৪০টির ওপর লেপার্ডেরও ! এখানে মন্দির রয়েছে বাঘোবার - যাকে আসলে বাঘের আদলে পুজো করে এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংস্কৃতি আসলে শেখায় বন্যজীবের সাথে মানুষের একত্র সহাবস্হান, যা আদপে দীর্ঘমেয়াদে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে সাহায্য করে।


মুম্বাইয়ের বনদেবতা ও বনবাসী


"আমরা মুম্বাইয়ের আদিবাসীরা পুজো করি হারা দেব(সবু্জ দেবতা)কে যিনি আমাদের বেঁচে থাকার মত প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে আশীর্বাদ করেন। আমরা বাঘোবারও পুজো করি, যিনি আসলে লেপার্ড ভগবান। তিনিই বনের রাজা। তার শক্তি ও সাহস আমাদের বনকে রক্ষা করে। আর বন আমাদের টিকে থাকার জন্য কত দরকারি তা তো জানেন," বলছিলেন চৈতালি ভৈর। তিনি একজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের তরুণী। মুম্বাইয়ের আরে মিল্ক কলোনির কেল্টিপাড়ায় তার সুন্দর মাটির ঘরটা তিনি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন।

মুম্বাইয়ের আদিবাসীরা বিভিন্ন প্রকার সম্প্রদায়ভুক্ত যেমন ওরলি, কোলি, ডাব্বা প্রভৃতি। প্রকৃতির সাথে তাদের নিবিড় যোগাযোগ। মুম্বাইতে তারা বাস করেন ছোট ছোট গ্রামে আরও মিল্ক কলোনি বা সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের মত বন্য এলাকায়। লেপার্ডরা সেখানে যথেচ্ছে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু লোকজনদের অভিযোগ নেই সে বিষয়ে। বরং তারা এই বিষয়ে গর্ব করেন।

সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশানাল পার্কের লেপার্ড। ছবি: Raju Venkatesha Murthy/ Wikimedia Commons
মানুষের ওপর বেশিরভাগ লেপার্ড আক্রমণের ঘটনা হয় অরণ্যের নিয়ম লঙ্ঘন করলে।

চৈতালির শ্বশুড়মশাই প্রকাশ ভৈর বললেন, "বন্যজীবদের আর তাদের জীবনযাত্রাকে আমরা সমীহ করি। রাত হয়ে গেলে আমরা ঘরের ভেতরেই থাকি, বাইরে যাই না। এটা তো লেপার্ডদের ঘোরাফেরার সময়। কখনও সখনও ওরা আমাদের গবাদি পশুর ওপর হামলা করে। তাই লেপার্ডের গর্জন শুনলেই আমরা একটা নারকেল ফাটিয়ে বাঘোবাকে ডাকি যে তিনি যেন আমাদের গবাদি পশুটাকে বাঁচিয়ে দেন আর আমাদের বন এবং জীবনকে রক্ষা করে চলেন যেমন যুগ যুগ ধরে করছেন"।প্রকাশ স্হানীয় পুরসভার কর্মী একজন। তাঁর মতে মানুষের ওপর বেশিরভাগ লেপার্ড আক্রমণের ঘটনা হয় অরণ্যের নিয়ম লঙ্ঘন করলে। অন্য কোন জায়গা থেকে আগত কোন ব্যক্তি বনের জমি দখল করে অনেক সময় প্রকৃতির নিয়ম না মেনে। গাছ কেটে, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে তারা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে।বাসস্হান ও খাদ্য কমে আসার ফলে তারা কুকুর এবং ময়লা স্হানে ঘুরে বেড়ানো শুকরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এভাবে ওরা মানুষের বাসস্হানের কাছে চলে আসে। ফলে মানুষের সাথে সাংঘর্ষিক পরিস্হিতিতে জড়িয়ে পড়ে আর দাবি ওঠে সেই লেপার্ডকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে দেবার।

আরে কলোনিতে লেপার্ড। ছবি: A.Davey/ Flickr
আমাদের অনাদিবাসী প্রতিবেশীদের থেকে আমাদের ফারাক এই যে আমরা লেপার্ডদের দূরে সরাই না।

ভৈর বললেন, "আমাদের অনাদিবাসী প্রতিবেশীদের থেকে আমাদের ফারাক এই যে আমরা লেপার্ডদের দূরে সরাই না। আমরা আমাদের চারপাশ পরিষ্কার ও আবর্জনামুক্ত রাখি যাতে লেপার্ড এলেও বেশিক্ষণ না থাকে। কয়েকমাস আগে আমার ছেলের বিয়ের আগের দিন একটা লেপার্ড আমার বাড়ির পিছনেই এসে উপস্হিত হয়। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় চুপচাপ। আমি আমার স্ত্রী'কে বললাম যে বাঘোবা এসেছেন আমাদের আশীর্বাদ করতে।"

ভৈরের মতে এটা দুর্ভাগ্যজনক যে সংবাদ চ্যানেলে দেখানো হয় লেপার্ড মানুষের ঘরে চলে এসেছে, যেখানে বাস্তবে মানুষই ওদের ঘর দখল করছে। তিনি আশঙ্কা করেন লেপার্ড নিয়ে মানুষের মনে এই ভয় অরণ্যের ক্ষতি করবে। তাঁর কাছে লেপার্ডরা সুন্দর দেখত জানোয়ার, হিংস্র, রক্তখেকো কোন দৈত্য নয় যেমনটা লোকেরা ভাবে অনেকসময়। প্রকৃতি তাদের এমনভাবেই বানিয়েছে যে বেঁচে থাকার জন্য তাদের শিকার করতে হয়। তার জন্য তারা বিপজ্জনক হয়ে যায় তা তো নয়। তাই হলে বলতে হয় মানুষও বিপজ্জনক। ভৈর ও তার সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে অবশ্য লেপার্ডরা পরিবারের মতই। " ওদের সাথে আমাদের যোগ এমনই যে, এক সপ্তাহ ধরে যদি আমরা লেপার্ডের দেখা না পাই বা দেখতে পাওয়ার কথা না শুনি, আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে যাই। আমরা চিন্তা করি যে কেউ হয়ত তাদের মেরেছে বা কোন ক্ষতি করেছে", ভৈর বলেন।

নিজেদের মাটির বাড়ির সামনে ভৈর পরিবার। বাড়ির দেওয়া ওরলি ধারার দেওয়াল-চিত্র। ছবি: লেখক।

যখনই এই বনাঞ্চলের ওপর কোন আঘাত আসে ভৈর ও তার সম্প্রদায়ের অন্যরা জেগে ওঠেন। "আরে বাঁচাও আন্দোলনে" তাদের অনেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন গাছ কেটে মেট্রোরেলের কারশেড বানানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে। এই প্রতিবাদ অবশ্য বিফলে যায় নি। ওই প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয় আর আরে বনাঞ্চলের একাংশ সংরক্ষিত বলে ঘোষিত হয়।


"আরে বাঁচাও আন্দোলনে" তাদের অনেকেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন গাছ কেটে মেট্রোরেলের কারশেড বানানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিজ্ঞান ও মানুষের বিশ্বাস


বাঘোবা ও প্রকৃতির অন্যান্য রূপকে উপাসনা করার প্রথা শুধু এই এলাকা নয়, অন্যত্রও রয়েছে ব্যাপক ভাবে। Frontiers in Conservation Science এ ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে মুম্বাই ও মহারাষ্ট্রের অন্যত্র ওরলি আদিবাসীদের গ্রামে ১৫০টির ওপর বাঘোবার মন্দির আছে। লোককথা অনুযায়ী, বাঘোবা আসলে মানুষ-জন্ম নিয়েছিলেন।সময়ের সাথে তার মধ্যে বাঘ/চিতাবাঘের প্রকৃতি দেখা যায় এবং গ্রামের গবাদি পশু মারতে থাকে। আতঙ্কিত গ্রামবাসী বাঘোবাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হলে তার মা বাধা দেন ও একটি সমঝোতা করেন গ্রামবাসীদের সাথে। সমঝোতা মত, বাঘোবা জঙ্গলে থাকবে কিন্তু কোন গবাদি পশু মারবে না। এর বদলে গ্রামবাসীরা বাঘোবার মন্দির স্হাপন করে তার পুজো করবে আর কখনও সখনও পশুবলি দিয়ে তাকে তুষ্ট রাখবে।গবেষকদের মতে, এই প্রাচীন কাহিনীই বাঘেদের সাথে মানুষের হার্দিক যোগাযোগের কথা বলে। এই গবেষণার একজন সদস্য, বিশিষ্ট সংরক্ষণবিদ ও ওয়াইল্ডলাইফ কনজার্ভেশান ট্রাস্টের সভাপতি শ্রী অনীশ আন্ধেরিয়া বলেন, "ভারত তার সংস্কৃতির মাধ্যমেই প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজ করে আজ হাজার হাজার বছর ধরে। বাঘোবার মত সাংস্কৃতিক প্রতীক এক্ষেত্রে চালিকাশক্তির কাজ করছে। প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিপত্রে জীবজন্তুকে ভগবানের রূপ হিসাবে মানা হয়েছে। হাতি থেকে বাঘ, পিঁপড়ে থেকে ইঁদুরকে পুজো করা হয় এই দেশে। জীবজন্তুর প্রতি এই শ্রদ্ধা পরিবেশ ও বন্যপ্রানী বাঁচাতে অনুঘটকের কাজ করেছে।" ড: অন্ধেরিয়ার মতে বিশ্বায়ন ও পণ্যায়নের এই যুগে এই ধরনের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যগুলি হারিয়ে যাবার আগে চিনে নেওয়া এখন খুব বেশি করে দরকার যেগুলো প্রকৃতির সাথে যোগসূত্র স্হাপন করে। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এই বন্ধনকে পুনরুজ্জীবিত করা ও সংরক্ষিত করা খুব দরকার। তিনি স্হানীয় মানুষজনকে সংরক্ষণের বিষয়ে যোগদানের গুরুত্বের উপর জোর দেন।

ভারত তার সংস্কৃতির মাধ্যমেই প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজ করে আজ হাজার হাজার বছর ধরে। বাঘোবার মত সাংস্কৃতিক প্রতীক এক্ষেত্রে চালিকাশক্তির কাজ করছে।
ওরলি চিত্রশিল্পী আঁকছেন লেপার্ডের ছবি আরে কলোনির ঘরের দেওয়ালে। ছবি: Mahesh Yadav/JY Brothers


প্রকৃতিপুজোর ধারাবাহিকতা


বর্তমানে ভারতের আর্থ-সামাজিক মানচিত্রে দ্রুত বদল আসছে। নগরায়ন গ্রাস করছে গোটা দেশকে দ্রুতবেগে। মুম্বাইয়ের আদিবাসীদের নগরজীবনে মিশে যাওয়া তাদের প্রকৃতিকেন্দ্রিক সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। কিন্তু ভৈরদের মত কিছু মানুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই প্রথা বজায় রাখার ব্যাপারে।

মহারাষ্ট্রে ভারোয়ারেতে একটি বাঘোবা মন্দির। ছবি: Ramya Nair/Project Waghoba.

"লোকে বলে আদিবাসীরা গরীব ও অশিক্ষিত। কিন্তু আমাদের ঘর দেখ হাজার হাজার গাছে ঘেরা, জীববৈচিত্রে ভরা। এত প্রাকৃতিক সম্পদ থাকতে আমরা গরীব হতে যাব কেন! যে জ্ঞান আমরা পূর্বজদের থেকে পেয়েছি তার জন্য গর্বিত। আমরা জানি বন আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। অক্সিজেন, খাবার, আরও কতকিছু দিচ্ছে। তাই আমরা জল, মাটি, বন আর বন্যজীবের পুজো করি। আমাদের এই প্রথার জন্য আমরা গর্বিত যা ভবিষ্যতের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদকে বাঁচাচ্ছে, সুরক্ষিত রাখছে," প্রকাশ ভৈর বললেন। "আমরা এই পৃথিবীতে অতিথি মাত্র। আমাদের জীবনের জন্য আমাদের পৃথিবী মা'কে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।তাই তার কোন ক্ষতি কর না।অন্য কোন জীব তো তা করে না," ভৈর বললেন সবার উদ্দেশ্যে।




লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বর্তমানে বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহযোগী সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।








2 e paa_edited.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page