গাড়োয়ালের ডায়েরি (পর্ব ২): তুঙ্গনাথের বন্য অভিজ্ঞতা
শুরু হল উত্তরাখন্ডের গাড়োয়াল হিমালয়ের ওপর ধারাবাহিক ভ্রমণ-কথা। স্মৃতি থেকে কলম ধরলেন সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।
শেষ বিকালে এক পশলা বৃষ্টি আর সঙ্গে বরফ পড়তেই হঠাৎ হু-হু ঠান্ডা নেমে এল তুঙ্গনাথের পাহাড়-চূড়ায়। দিনান্তে তখন পুণ্য কুড়াতে আসা বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের ইতস্তত ভিড় নেমে গেছে নীচে। দূর পাহাড়ে আবছা বিকেলের আলোয় এক এক করে জ্বলে উঠছে আলোর সঙ্কেত। দিগন্ত-বিস্তৃত এই কেদারনাথ অভয়ারণ্যের মাঝে মাঝে জেগে ওঠা মানুষ-বসতির চিহ্ন। তখনই একটু একটু করে উঁকি দিল ওরা। পাহাড়ের যে-দিকে গভীর খাদ, নীচে পথ চলে গেছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মন্ডলের দিকে, সেদিক থেকে ঘাস খেতে খেতে আমাদের উপস্হিতি জরিপ করতে করতে উঠে এল একদল Himalayan Thar। এক বিরল-প্রজাতির জন্তু যা বলা যায় ছাগল ও ভেড়ার নিকট প্রজাতি। এদের IUCN প্রায়-বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর পর্যায়ে ফেলেছে। নেপাল, তিব্বত ও ভারতের হিমালয়ের অরণ্যে এদের বাস। পথের সঙ্গী গৌতমবাবু জানালেন এদের 'ভরাল' নামেও ডাকা হয়। আমাদের মৃদু কথাবার্তাতেও বেচারারা বিরক্ত হয়ে দূরে সরে যাচ্ছিল। প্রকৃতির রাজত্বে মনুষ্যের অনুপ্রবেশ এরকম মুহূর্তগুলোতে লজ্জিতই করে।

ওদিকে তখন বেজে উঠল তুঙ্গনাথ মন্দিরে সন্ধ্যারতির ঘন্টা। গুটিকয়েক যে মানুষজন ছিলাম , এক এক করে জড়ো হলাম মন্দির প্রাঙ্গণে। তখন অন্ধকার নামছে পাহাড়ে। সন্ধ্যা প্রায় ৭:৩০। আরতি শেষে লক্ষণ সিং-এর ছোট্ট আস্তানায় আগুনের পাশে বসে খাওয়া-দাওয়ার পাট চোকানো। গোল হয়ে বসা আড্ডায়। স্থানীয় যারা ছিল, বন্যজন্তুদের নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা শুনছিলাম আমরা গোগ্রাসে। তুঙ্গনাথে লক্ষণ সিং নেগির এই রান্নাঘরটাই দু'দিনে আমাদের আড্ডাখানা হয়ে উঠেছিল। বরফ-পড়া ঠান্ডায় , উনুনের আঁচ আর ছোট ব্যাটারির আলোয় মোড়া ঘরটাই আমাদের আরামের বৈঠকখানা। খাওয়ার পাট চুকলে ধীর পা'য়ে বেড়িয়ে এলাম। সামনে ভরপুর জ্যোৎস্নায় চক্ চক্ করছে সবুজ বুগিয়াল। আর চড়ে বেড়াচ্ছে পালে পালে হিমালয়ান থর। মানুষের সামান্য শব্দেই চমকে উঠে টগবগিয়ে সরে যাচ্ছে দূরে। ঘরে গিয়ে বসলেও শুনতে পাচ্ছি ওদের দাপিয়ে বেড়ানোর শব্দ। এক এক করে আশেপাশের আলো নিভে যেতে বেড়েয়ে এলাম একা বারান্দায়। পাহাড় জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বন-পাহাড়ের সন্তানরা। মহাদেবের এই রাজত্বে যারা নির্ভয়। একে অপরকে সাড়া দিচ্ছে শিস দেওয়ার মত শব্দ করে। কখনও ছুটে যাচ্ছে খুড়ে ধুলো উড়িয়ে। তীব্র, আরো তীব্র হচ্ছে ছায়াগুলো.....সার্থক এই হিমালয়ের রাত।
অন্ধকার পথে শ্বাপদের আগমন
ভোর পৌনে চারটে'য় অ্যালার্ম বেজে গেল। তুঙ্গনাথ থেকে আরো ১.৫ কিলোমিটার উঠে চন্দ্রশিলায় উঠতে হবে অন্ধকারে ট্রেক করে। সূর্যোদয় দেখতে। দু'-চারটে মোটা জামা, দু'টো জ্যাকেট, গ্লাভস, মাফলার-টুপিতে আপাদমস্তক ঢাকা আমরা। মন্দির কমিটির গেস্ট হাউসের পাশের ঘর থেকে বেলঘড়িয়ার গৌতমবাবুও উঠে গেছেন। আমার হাতে সৌর লন্ঠন, ওনার হাতে টর্চ। বেড়িয়ে পড়লাম অন্ধকারেই চড়াই ভেঙ্গে উঠতে। পা টিপে টিপে চলা আঁধারে। সহধর্মীনির এবারই প্রথম ট্রেকে আসা। তাই মেপেই পা ফেলতে হচ্ছিল। এক এক জায়গা এতই খাড়া, হাতে ভর দিয়ে উঠতে হচ্ছিল। কোথাও আবার ঝোরার জলে পাথুরে পথ পিচ্ছিল। যেতে যেতে দেখছি পুবাকাশ একটু একটু করে অন্ধকারের আড়াল কাটিয়ে সাদা হচ্ছে। গৌতমবাবু বলে উঠলেন-চৌখাম্বার ছায়া দেখা যাচ্ছে দেখুন। সত্যিই তাই। ওইতো সামনে বড় প্রাচীরের মত চৌখাম্বার কালো ছায়া। এই পাহাড়চূড়াই দিনের বেলা সাদা আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়! হাঁপাতে হাঁপাতে চড়াই ভাঙ্গছি আর উপরে তাকাচ্ছি চন্দ্রশিলার চূড়ার দিকে। কতদূর আর কতদূর বল মা!!!

চূড়ার দিকে তাকাতে তাকেতে কিছুক্ষণ ধরেই আমার নজরে পড়ছিল একটা ঢিপির মত কোনকিছুর দিকে। হঠাৎ দেখলাম সেটা একটু একটু নড়ছে। বুঝলাম একটা জানোয়ার!! এই কেদারনাথ স্যাংচুয়ারির মধ্যিখানে এই রাত্তির কালে তো আর কোন পোষা জন্তু হবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গীদের দাড়াতে বললাম। ওদের দেখালাম ব্যাপারটা। আমার মনে আসছিল ভাল্লুক নয় তো। কোন চিতা বাঘ হলে অত চিন্তার নয়। ওরাও মানুষকে ভয় পায়। একমাত্র হিমালয়ের ভাল্লুকই কোন প্ররোচনা ছাড়াই মানুষকে তেড়ে এসে আক্রমণ করতে পারে। বাকিদের বললাম । দাঁড়িয়ে গেলাম তিনজন। আমাদের মধ্যে মৃদু স্বরে আলোচনা চলছে। হঠাৎ দেখি জন্তুটা আমাদের দিকেই হেলেদুলে নেমে আসছে। আমাদের উপস্হিতি টের পেয়েছে ওটা। একটু ভয় বুকে জমতে লাগল। এই অন্ধকারে খাড়া রাস্তায় পিছনে পালানোর ব্যাপারটা মোটেই সুবিধাজনক হবে না। আমি তো ভাবছি যদি ভাল্লুক হয়। এরকম পরিস্হিতির কথা এখানে ট্রেক করতে আসা কারুর মুখেই শুনিনি। তাই এই পরিস্হিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আবার স্হানীয় কেউ নেই সঙ্গে।কি করা...কি করা.... আমি একটা বড় পাথর ছুড়লাম পাথরের উপর- শব্দ করার জন্য। অন্ধকারে ভালো ঠাহরও হল না জন্তুটার গতিবিধি, কারণ অন্ধকার পাহাড়ে বেশ কিছুটা নেমে এসেছে, যে পিছনের আবছা আকাশের পটভূমিতে দেখব তার উপায় নেই। আমরা ঠায় দাড়িয়ে একজায়গায়। বিরক্তও লাগছে। এখনও অনেকটা উঠতে হবে। প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে গেল দাড়িয়ে। পিছনে একটা দল আসছে দেখলাম। বুকে একটু ভরসা এল। তাকিয়ে আছি ঠায়। হঠাৎ দেখলাম ওটা আবার উঠে যাচ্ছে। পাথর ছোড়ায় কাজ হল? পেছনের দলের গাইড ছেলেটি আগে আগে এল। ও'কে জানালাম। ও দেখে বলল -ভাল্লুক তো নয়। তবে কি!! ভগবান জানে...ওটা এবার চলতে লাগল পাহাড়ের ওপর। না ভাল্লুক তো নয়। ওত মোটা না। হরিণ বা থরও নয় । ওরা দলে থাকে। মানুষ দেখলে এগিয়ে আসে না। একটা লম্বা ল্যাজ দেখা গেল। তবে? চিতাবাঘ?? কালই গেস্ট হাউসের কেয়ার টেকার রাম সিং রাণা আমাদের জানিয়েছেন দু'-তিনদিন আগেই মন্দিরের পিছনে চিতাবাঘ দেখতে পাওয়ার কথা। জঙ্গলে সাফারিতে গিয়েও তো সবসময় পাওয়া যায় না এর দর্শন। আর ট্রেকে এসে দেখা দিচ্ছে অযাচিতের মত। পিছনের যাত্রীদের দলের কলরব বাড়ল। ছায়াময় আগন্তুক আস্তে আস্তে চন্দ্রশিলা পাহাড়ের ওপারে চলে গেল। হাঁফ ছাড়া গেল....আমরা আবার উঠতে লাগলাম। যে দৃশ্য দেখতে এসেছিলাম তার টানে....সে তো এক অন্য অনুভূতিমালা। কিন্তু এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!!সত্যি, বিচিত্র এই হিমালয়। কত রহস্যই এমন রহস্য হয়ে থেকে যায় তার আস্তিনে।
লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।
ছবি: লেখক
বনেপাহাড়ে- বাংলায় প্রথম বন্যপ্রাণ ও পরিবেশ বিষয়ক ওয়েবজিন।
Click here to join us at Facebook. LIKE and Follow our page for more updates.