top of page
  • ..

আমার বন্ধু 'বিলি' অর্জন সিং

তিনি ছিলেন এক অদ্ভুত মানুষ। বড় করেন রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বা লেপার্ডকে ঠিক পোষা কুকুরের মতই। তারপরে তাদের অরণ্যে ছেড়ে আসেন সন্তান হারানোর ব্যথা নিয়ে। তাঁর এইসব পরীক্ষা তুলেছিল বিতর্কের ঝড়। বস্তুত: বিতর্ক তো তাঁর সঙ্গীই ছিল। সেসব কিছু নিয়েই জীবনভর চলেছেন। যেমন জীবনভর আগলে রেখে গড়ে তুলেছেন দুধওয়া টাইগার রিজার্ভের মায়াবী অরণ্যকে। তাঁর স্মৃতিতে মজলেন ব্রিগেডিয়ার রঞ্জিৎ তলোয়ার


লেপার্ডের সাথে বিলি। photo courtesy: TIGER HAVEN SOCIETY


বিলি অর্জন সিং। যার নাম দুধওয়া টাইগার রিজার্ভের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে এমন এক সময় থেকে যখন এই লেখা যারা পড়ছেন, তাদের বেশিরভাগ জন্মাননি। যখন ভগবানেরও 'কি করিতে হইবে' তালিকায় ছিল না এই অরণ্যের কথা, তখন থেকেই তিনি যত্ন নিতে শুরু করেছিলেন দুধওয়া'র।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে সেনাবাহিনীর কাজ কাজ ছেড়ে এসে তিনি তরাই অঞ্চলে কিছু জমি নেন। তখন সরকারও এই জলাজমি অঞ্চলে লোকজনকে চাষবাসের জন্য উৎসাহ দিচ্ছিল। এটা ১৯৪৫ সালের ঘটনা, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তুদের এই এলাকায় আসার প্রায় এক দশক আগের কথা। তাঁর অধিগ্রহণ করা এলাকা এখন জসবিরনগর নামে পরিচিত। যদিও, বিলি বলতেন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চাষবাসের জন্য এই এলাকায় আসা, কিন্তু আমার মনে হয় এই বাঘ ও ডাকাত অধ্যুষিত, ম্যালেরিয়া প্রবণ পাণ্ডববর্জিত জঙ্গল এলাকায় তাঁর আসার আসল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর শিকারের নেশা।বিলি তখন মাত্র ২৮ বছর বয়সের। কাপুরথালার রাজপরিবারের এই সদস্যের সামনে এক পৃথিবী সম্ভাবনা খোলা ছিল। কিন্তু বেপরোয়া হৃদয় তখন কথা বলত মস্তিষ্কের ওপর, যে জিনিসটা পরেও বারবার তিনি দেখিয়েছেন জীবনে।


বিলি আর দুধওয়ার মধ্যে প্রেমের শুরু হল তাঁর সেই জায়গায় আসার পর যেখানে আজকের ‘Tiger Haven’ দাঁড়িয়ে আছে। যা হয় বেশিরভাগ শিকারির ক্ষেত্রে এক সময়ে, বিলিরও তাই হল। তিনি শিকারে তাঁর সব আগ্রহ হারালেন এবং যেহেতু ওই এলাকার সব রকম জীবজন্তুর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছিল, তাদের সংরক্ষণে তিনি তাঁর সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপালেন। রাজপরিবারের লোক হওয়ায়, নেহেরু পরিবারের সাথে তাঁর কিছু যোগাযোগ ছিল, যে পরিবার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে উৎসাহী ছিলেন। দুধওয়া ন্যাশনাল পার্ক তৈরি হল উত্তরপ্রদেশ সরকারের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও। এই বিরোধিতার কারণ ন্যাশনাল পার্ক হয়ে গেলে সেই এলাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতে হবে। তখনকার দিনে ভাবনাচিন্তা আলাদা রকম ছিল। একমাত্র কাজ হাসিল করার উপায় ছিল প্রধানমন্ত্রীর আস্হা অর্জন করা এবং বিলি সেটা করতে পেরেছিলেন। শ্রীমতী গান্ধী সবরকম ভাবে চেষ্টা করেছিলেন এবং উত্তরপ্রদেশ সরকারকে 'পথে আসতে' নির্দেশ দেন। দুধওয়া তৈরি হয়।

A TRIBUTE TO BILI ARJAN SINGH


বিলি অর্জন সিং এর বই “India’s Wildlife” এর ভূমিকায় স্বাধীন ভারতে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সবথেকে শ্রদ্ধাস্পদ ব্যক্তিত্ব এম কে রজনীতিশ লেখেন, "ভবিষ্যতে যদি কাউকে এই সুন্দর এলাকাটার দুধওয়া ন্যাশনাল পার্কে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব দিতে হয়, তবে তিনি অবশ্যই বিলি অর্জন সিং"। ১৯৫৮'র সোয়াম্প ডিয়ার স্যাংচুয়ারি থেকে ১৯৭৭ সালে ঘোষণা হওয়া ন্যাশনাল পার্ক- এই যাত্রাকালে বিলিই সেই লোক যিনি এই দুধওয়ার প্রতি আন্তর্জাতিক নজর টেনে আনতে পেরেছিলেন। ড: এম কে রজনীতিশ আরও যোগ করেন, " আমার সৌভাগ্য যে এই যাত্রাপথের উত্থান-পতনের সাক্ষী থাকতে পেরেছি।এবং পুরোটা জুড়ে একজন চ্যাম্পিয়ানকে দেখেছি"। এবং এই চ্যাম্পিয়ান আর কেউ নন, স্বয়ং বিলি অর্জন সিং। দুধওয়া ১৯৫৮-এ অভয়ারণ্য থেকে ১৯৭৭-এ ন্যাশনাল পার্কে রূপান্তরিত হয়, তারপরে অবশেষে টাইগার রিজার্ভ ১৯৮৭ তে। এবং প্রতিটা ক্ষেত্রেই তার চালিকাশক্তি একজনই- কুমার বিলি অর্জন সিং। এই জাতীয় উদ্যানের সাথে তাঁর নাম জড়িয়ে এমনভাবে, তা মুছে ফেলা যাবে না। বিলি আর দুধওয়া দুটো নামকে আলাদা করা যায় না।

ব্যাঘ্রশাবক তারার সাথে বিলি। photo courtesy: TIGER HAVEN SOCIETY

এটা সবাই জানে যে বন দপ্তরের সাথে বিলির সখ্য ছিল না। সম্পর্ক ছিল অপছন্দ থেকে শুরু করে সরাসরি ঘৃণার। ব্যাপারটা তিক্ত রূপ নেয় যখন আজকের Tiger Haven যেখানে দাঁড়িয়ে সেই জায়গাটা তিনি নেওয়ার পর থেকে। নাকুয়া নালা ও সুহেলি নদীর মধ্যবর্তী এই জায়গায় তাঁর জমিটা ছিল দারুণ এক অবস্হানে। গোটা অরণ্যের এক অসাধারণ দৃশ্য এখান থেকে চোখে পড়ে। এবং যথেষ্ট বিচক্ষণতার সাথে এখান থেকে তিনি বারশিঙ্গা, বাঘ, অন্যান্য বন্যপ্রাণী ও তাঁর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারতেন। যেহেতু বনদপ্তরকে তিনি অতটা পাত্তা দিতেন না, তাই একটা 'লড়াই' সবসময় চলত তাদের মধ্যে। অ্যাডভেঞ্চারাস ও বিদ্রোহী স্বভাবের বিলি কখনই তেমন নিয়ম-টিয়ম মানার তোয়াক্কা করতেন না ও বন দপ্তরের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার তাই যথেষ্ট কারণ ছিল।


সুহেলি নদীর দক্ষিণ পাড়ে যেখানে দুধওয়ার জঙ্গলের সীমানা সেখানে Tiger Haven নামক জায়গাটায় বসে থাকা লোকটা "বড্ড বেশি জানত", তাই বেশির ভাগ বন অধীক্ষকের সুনজরে ছিলেন না তিনি। ব্যতিক্রম পরের দিকের কয়েকজন। এমন কিছু বন অধীক্ষক বা ফিল্ড ডিরেক্টরকে আমার জানার সুযোগ হয়েছিল। সুদক্ষ বনাধিকারিক হিসাবে নিপুণতার সাথে তাঁরা এই দুরন্ত মানুষটিকে বাগে আনতে পেরেছিলেন, তাঁদের কাজে সাহায্য পেয়েছিলেন ও তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। যদিও, অন্যদের কথা বিবেচনা করে এটা বলতেই হয় যে, বিলিকে নিয়ে চলা ছিল খুবই কঠিন, কোন নিয়মের শেকলে তাঁকে বাঁধা যেত না এবং তাঁর পোষ্য রয়েল বেঙ্গল তারা আর দুই লেপার্ড জুলিয়েট ও হ্যারিয়েটকে দুধওয়ার জঙ্গলে ছাড়ার সময় যথেষ্ট স্বাধীনতা তিনি পেয়েছিলেন। এইসব পরীক্ষাগুলো ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর নামে কুখ্যাতিও কিছু ছড়িয়েছিল। বনবিভাগের উচ্চ পদাধিকারীরা এই সুযোগগুলো ছাড়েননি বিলির বদনাম করতে। এটা বিলির বর্মে একটা ফাটল হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্দ্বিধায় ওঁর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল।


বিলির অন্যান্য দিকও ছিল। তিনি খুবই পাশ্চাত্যঘেঁষা ছিলেন এবং তাঁকে 'বিলি' বলে ডাকতে জোর দিতেন অন্যদের। প্রথমবার ১৯৯৫ সালে যখন আমি তাঁর দেখা পাই সোনারিপুর বনবাংলোয়, আমার চিরাচরিত সেনা প্রশিক্ষণের স্বভাবমতই আমি তাঁকে 'স্যর' বলে সম্বোধন করি। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলেন, "আমায় বিলি বলবেন"। বেশ অস্বস্তি সত্ত্বেও এরপর থেকে তাঁকে আমি 'বিলি' বলেই ডাকতাম। এদিকে, WWF- India'র উত্তরপ্রদেশ বিভাগের এক সহকর্মী যখনই বিলির সাথে দেখা করেন, মুখের হাসি চেপে তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন, তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতেন। এইসময় তাঁকে বিব্রত হয়ে কুঁকড়ে যেতে দেখা বেশ মজার ছিল।


উত্তরপ্রদেশের পুরানো বনাধিকারীরা অস্বীকার করতেই পারেন, কিন্তু দুধওয়া টাইগার রিজার্ভ নামে যে অরণ্য আজ হয়েছে তার মূল কৃতিত্ব 'ওয়ান ম্যান আর্মি' কুঁয়ার বিলি অর্জন সিং-এরই। জিম করবেটকে যেমন হেইলি ন্যাশনাল পার্ক তৈরি করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যার বর্তমান নাম করবেট ন্যাশনাল পার্ক, তেমন বিলি অর্জন সিং এর এই একার হাতে দুধওয়া টাইগার রিজার্ভের তৈরি করা ও যত্ন নেওয়ার বিস্ময়কর ঘটনা কিন্তু নন্দিত হয়নি সেভাবে তাঁর বন বিভাগের সাথে দীর্ঘ দ্বন্দ্বের কারণেই।

২০০৪ সালে বিলি পেলেন WWF- International এর তরফে বিখ্যাত পল গেটি পুরষ্কার। পুরষ্কার দেওয়ার অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় দুধওয়াতেই WWF-India আর উত্তর প্রদেশ বনবিভাগের তরফে। বড় সংখ্যায় বনবিভাগের কর্মচারী ও অন্যান্য অতিথিরা উপস্হিত হন সেখানে। হঠাৎই WWF-India এর CEO রবি সিং এর মনে হল আমরা একটা বিস্ফোরক পরিস্হিতিতে যেন রয়েছি। পরবর্তীতে ভাষণ দেওয়ার সময়ে বিলি যথারীতি বন বিভাগের বিরুদ্ধে কথা বলবেন এবং ব্যাপারটা আমাদের পক্ষে খুব অস্বস্তিকর হয়ে যাবে। তাই অনুষ্ঠান শুরু হবার কয়েক মিনিট আগে বিলিকে আমি শান্ত ও সংযত থাকতে বললাম। আমি বিলির কাছে গিয়ে তাঁকে একদিকে নিয়ে গেলাম ও বিষয়টা বললাম। আমার অনুরোধ শুনে বিলি দীর্ঘক্ষণ ভাবল এবং তারপরে একটু থেমে বলল, "ঠিক আছে তোমরা যদি না চাও আমি সত্যিটা বলি...আমি খারাপ কিছু বলব না তাদের সম্বন্ধে...কিন্তু.. কিন্তু ... আমি ভাল কিছুও বলতে পারব না ওদের সম্বন্ধে"।

লেপার্ডের সাথে। photo courtesy: TIGER HAVEN SOCIETY

'বিলি' অর্জন সিং একজন বড়মাপের মানুষ এবং আমার সৌভাগ্য যে আমি ওনাকে চিনতাম। সব ঠিক থাকলে দুধওয়ার নাম হওয়া উচিত 'বিলি অর্জন সিং টাইগার রিজার্ভ' তাঁকে সম্মান জানাতে, যিনি একদা এই নষ্ট হয়ে যাওয়া অরণ্যকে বড় যত্নে আজকের অবস্হায় নিয়ে এসেছেন। আর এটা তো উত্তরপ্রদেশে নতুন করে নামকরণের যুগ চলছে।


বিলির মৃত্যুর পর (২০১০) আমার আর দুধওয়া যাওয়া হয়নি। কিন্তু যদি আবার যাই...আর একবার গিয়ে দাঁড়াই, নাকুয়া নালা পার করার পর এবং সুহেলি নদী আসার আগে, আমি বাঁদিকে বাঁক নেব টাইগার হাভেনের পথে। সেখানে এই মানুষটির স্মৃতিতে একটি প্রদীপ জ্বালাব, কারণ সেখানেই রয়েছে দুধওয়ার অরণ্যের আত্মা।



লেখক পরিচিতি: লেখক ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার ও WWF India'র বাঘ সংরক্ষণ দলের সদস্য।


photo courtesy: TIGER HAVEN SOCIETY









Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page