top of page
  • ..

মুক্কি বনের রাজা

মধ্য ভারতের কানহা টাইগার রিজার্ভ। তার মুক্কি কোর জোন। সেই বনের আকর্ষন- ছোটমুন্না। পুরুষ রয়াল বেঙ্গল টাইগার। এই লেখায় উঠে এসছে টাইগার রিজার্ভে সাফারির মূল আকর্ষন বাঘের দর্শন পাওয়ার গল্পকথা। কখনও কখনও একটি বাঘ কিভাবে আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে পর্যটকদের কাছে , তার আদবকায়দা, চালচলন কেমন জাদু তৈরি করে সবুজ বনে- তারই কাহিনী শ্যামাপ্রসাদ সাঁই'য়ের কলমে ও ছবিতে।


এ এক অদ্ভুত রাজদরবার। দরবারের মাঝখানে একটা মাঝারি মাপের পুকুর। পুকুরের নামটাও অদ্ভুত-'বাবা ঠ্যাঙা'। এক পাড় দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। সাফারির গাড়িগুলো জড়ো হয়েছে সেই রাস্তার ওপর। সবার লক্ষ্য উল্টোদিকের পাড়। কারণ রাজা যে সেখানেই আসেন। ডানদিকের পাড় একটু উঁচু, আর বাঁদিকের পাড় একটু নীচু গাছপালাহীন।কিছু হরিণ বাঁদিকের পাড় দিয়ে এসে জল খেয়ে গেল, কিছু এখনও খাচ্ছে।কিন্তু, তাদের চোখের কোনে যেন ভয়ের ছাপ।

সময় সকাল সাড়ে ন'টা, চাপা একটা উদ্বেগ। কারণ, সময় যে ফুরিয়ে আসছে। এই দরবার ছেড়ে মূল ফটকে পৌঁছতে হবে ১১টায়। সে তো প্রায় এক ঘন্টার পথ। এখান থেকে তাই দশটায় বেরোতেই হবে। সবার ক্যামেরা উল্টো দিকের পাড়ে তাক করা। হতাশা লুকানো যাচ্ছে না। রাজা কই? রাজা কি তাহলে আসবেনা আজ? আমাদের গাইড দীনেশ ভাই কিন্তু আশাবাদী! একটা ময়ূর জল খেয়ে চটজলদি হরিণের ফিরে যাবার পথ ধরলো। কে যেন কোথাও বলে উঠল-"ছোটে মুন্না পধার রহে হে"! না, সত্যি সত্যি কেউ বলেনি। কিন্তু মনের ভিতরে যেন এই শব্দগুলোর অনুরণন। সবাই নিশ্চুপ। এবারে রাজা সত্যিই এসেছেন অন্দরমহল থেকে। ওপারের পিছনের দিকটা নীচু ও ঘন, তাই অন্দরমহল ভাবা যেতেই পারে। এভাবে রাজাকে দেখতে পাওয়ার বিস্ময়ে সবাই নিশ্চুপ কিছুক্ষণ। তারপর স্তব্ধতা কাটিয়ে শুরু হল ছবি তোলার হিড়িক।



রাজা হলেন কানহা বনের এক পুরুষ বাঘ, নাম- ছোটা মুন্না। বাবার নাম মুন্না। বাসস্হান- মুক্কি জোনের কোর এরিয়া। এই প্রথম তিনিও বাবা হয়েছেন। তিন সন্তানের।

রাজা তো আসেননি বিচারসভায় বিচার করতে। এসেছেন এখানে নিজের তাগিদে। তার যে ভীষন জলতেষ্টা পেয়েছে, গরমও খুব। একবার পাড়ে দাঁড়িয়ে ইতিউতি চাইলেন চারিদিকে। তারপর ধীরে ধীরে নেমে এলেন জলের দিকে। জল খেতে খেতে আমাদের একটু জরিপও করে নিলেন। তারপরে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় জলে নামা। ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে ল্যাজের দিকটা জলের দিকে রেখে, পেছনের পা'দুটো জলে ডুবিয়ে এবং শেষমেশ শরীরের অর্ধেকটা জলে ডুবিয়ে বসে পড়লেন।

বসে বসেই জল খাওয়া, এধার ওধার তাকানো। কখন যে আধঘন্টা কেটে গেল খেয়াল নেই। ঘোর কাটল দীনেশ ভাইয়ের তাড়ায়। এবার যে ফিরতে হবে!বনের নিয়ম বড়ই কড়া। জি পি এস চালু আছে। তাই গাইডদের বেচাল করার কোন সুযোগ নেই। অগত্যা ফেরার পথ ধরতে হল। প্রথম দিনের প্রথম সাফারি এবারে এমন হওয়াতে মনটা বেশ খুশি খুশি।মে মাসের শেষে, কানহার এই সফরের উদ্দেশ্যই তো ছিল বনের রাজা-রানীদের ছবি তোলা।


সাফারির ছাড়পত্র খুব সহজে মেলেনি।বান্ধবগড়ের গাইড সেলিম ভাইয়ের দৌলতে চারটে সাফারির ব্যবস্হা পাকা করা গেছিল। আকাশপথে জব্বলপুর হয়ে, তারপর সড়কপথে কানহার খাটিয়া প্রবেশদ্বার থেকে দশ কিলোমিটার দূরে মধ্যপ্রদশে ট্যুরিজমের সরকারি লজে যখন পৌঁছলাম তখন রাত দশটা।ডাইনিং স্টাফেরা জেগে শুধু আমাদের অপেক্ষায়। একেবারে খাওয়া দাওয়া সেরে তবেই ঘরে ঢুকলাম। সঙ্গে সঙ্গে দীনেশ ভাইও হাজির। সাফারির ব্যাপার স্যাপার বুঝিয়ে চলে গেলেন। এবং তার কথা মত আমাদের উঠতে হবে এক প্রহর রাত থাকতেই। বারোটা বেজে গেছে প্রায়। হাতে আর বেশি সময় নেই। ক্যামেরা, লেন্স সব গুছিয়ে রেখে শুতে চলে গেলাম। একটা ঘোরের মধ্যে কাটল সময়টা। সময় হতেই উঠে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। গাড়ি নিয়ে ততক্ষণে হাজির ওয়াসিম ভাই। প্রায় চারটে তখন। ভোজনালয়ের কর্মীরা প্রাত:রাশ প্যাক করে ধরিয়ে দিলেন।


ঘুটঘুটে অন্ধকার। দশ কিলোমিটার পথ তার মধ্যে পার করে পৌঁছলাম খাটিয়া প্রবেশদ্বারে। আমরাই সবার আগে পৌঁছেছি। বেশির ভাগ পর্যটক এই খাটিয়া গেট থেকেই কানহার মূল চারটি এলাকা- কানহা, মুক্কি, কিসলী ও সরাহীতে প্রবেশ করেন। সাড়ে চারটেয় আলো ফুটল। সাফারির গাড়িরা সব এক এক করে জড়ো হতে লাগল। নিয়ম মত একটার পিছনে আর একটা, এমন ভাবে সারিতে দাড়ালো। ৫ টা'র মধ্যে গেটের সামনে মেলা বসে গেল। বনদপ্তরের অফিসেও বিরাট লাইন। কোর এলাকার প্রতিটির জন্য ১৫ টি গাড়ির অনুমতি মেলে। এক কাপ কফি নিয়ে ঘুম ঘুম ভাবটা কাটাতে চেষ্টা করলাম। বনের দিক থেকে তখন ভেসে আসছে ভোরের বাতাস।


ঠিক সাড়ে পাঁচটায় গেট খোলা মাত্র আমাদের গাড়ি সবার প্রথমে প্রবেশ করল। একটা চাপা উত্তেজনা। পরে বুঝলাম প্রথমেই থাকার আগ্রহটা দীনেশ ভাইয়ের কেন এত বেশি। প্রথম কারণ, মুক্কি জোনের টিকিট মিলেছে। এই খাটিয়া থেকে সেখানে পৌঁছতে লেগে যাবে প্রায় এক ঘন্টা। আর দ্বিতীয়ত: সামনের গাড়ির ধুলোর হাত থেকে মুক্তি। সাত সকালে ঘুম ভাঙ্গা অরণ্যের রূপ।সৌন্দর্য ও শান্ত, শীতল পরিবেশ উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম মুক্কিতে। সকালটা এ-পথ ও-পথ বাঘ মামাদের খোঁজে ঘুরে তাদের দেখা না পেয়ে গাড়ি পৌঁছাল বিশ্রামের জায়গায়। এখানে রয়েছে টয়লেট ও প্রাত:রাশের জন্য রেস্তোঁরা। মুখ হাত ধুয়ে, চা খাওয়া হল, সঙ্গে প্রাত:রাশ। এরপরে আমরা হাজির হয়েছিলাম সেই রাজ দরবারে। তার কথা তো আগেই বলেছি।


প্রথম দিনের প্রথম সাফারি এমন নেশা ধরিয়ে দিল যে, আমরা পূর্ব পরিকল্পনা বদলে চারদিন রয়ে গেলাম বানজার নদীর ধারে রিসর্টে।সেরে ফেললাম ৭টা সাফারি। ৫ টা সাফারিতে দেখা পেলাম বনের রাজার। শুধু ছোটমুন্নাই নয়, দেখা মিলল নয়না ও নীলম নামের দুই বোনের। দেখা পেলাম T11 ও T66 যুগলের। দেখা দিল লেপার্ড, গাউর, বারাশিঙ্গা, ভল্লুক, সমবার, গাউর, বন্য শূকরেরও। জীববৈচিত্র্য যেমন, তেমন নয়নাভিরাম প্রকৃতি। এবং ছোটমুন্না যে রাজকীয়তা দিয়ে শুরু করেছিল, তেমনিই তার "ডোন্ট কেয়ার" রাজকীয় ভাব দেখেই শেষ হয় আমাদের অভিযান। এখানে শুধু তার কথাই বলব।

সেদিন ছিল সফরের শেষ দিন। আগে থেকে কোন টিকিট পাওয়া যায়নি সাফারির। তাই বনের সামনে ভোর থেকে অপেক্ষার ব্যাপারও ছিল না। তবে সাড়ে ছ'টার মধ্যে প্রস্তুত হয়ে বসে ছিলাম হোটেলেই। প্রস্তুতির কারণ দীনেশ ভাইয়ের আশ্বাস। অনলাইনে যারা টিকিট কাটেন, দু'একজন হয়ত আসতে পারেন না। তাদের শূণ্যস্হান পূর্ণ করারই ইচ্ছা আমাদের। প্রায় ৭টার দিকে দীনেশ ভাইয়ের ফোন এল আর সাথে সাথে হাজির ওয়াসিম ভাই। সাড়ে সাতটায় মূল গেট পার হয়ে গাড়ি ঢুকে গেল বনের মধ্যে। টিকিট যেহতু মুক্কি জোনের, তাই এক ঘন্টা লেগে গেল সেখানে পৌঁছতে। পৌঁছে যেন এক অদ্ভুত নীরবতা গ্রাস করল। মনে হল সবাই যেন ফিরে গেছে আশাহত হয়ে। আসলে বনের মধ্যে শিরা-উপশিরার মত রাস্তা ধরে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে ডোরাকাটাদের।

একটা গাড়িকে ঘন জঙ্গলের সীমান যেখানে হালকা হয়েছে সেখানে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দীনেশও আমাদের গাড়ি দাঁড় করাল।দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির গাইডের সাথে কথা বলে জানা গেল একটু ভেতরের দিকে বসে রয়েছে ছোটমুন্না। অল্প চেষ্টাতেই তার দেখা মিলল। কিন্তু দীনেশ ভাইয়ের কথায় আমাদের গাড়ি একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। সামনেই বাঁধানো ছোট একটা জলাধার। জলাধার থেকে আমরা বড় জোর ২৫ ফুট দূরে।


৫ মিনিটের মধ্যেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে ছোট মুন্না ওই জলাধারের দিকেই আসতে লাগল। জলাধারে এসে সামনের পা দুটো নিজস্ব ভঙ্গীতে ছড়িয়ে দিয়ে জল খেতে লাগল। আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে চাওয়া। এত কাছ থেকে বনের মধ্যে বনের রাজার দেখা মিলবে ভাবিনি। গায়ের রোম খাড়া করা পরিস্থিতি। আমার একট ক্যামেরায় ৩০০ প্রাইম লেন্সের সাথে ১.৪ টেলি কনভার্টার লাগনো বলে পুরো শরীরটা ফ্রেমে আনতে পারছি না। শুধু মুখটুকুই এল। ভাগ্যিস অন্য ক্যামেরায় ছিল ৫০-৫০০ জুম লেন্স। তাই গোটা শরীরটাই এবার পেলাম ক্যামেরায়। জলাধারটা ছোট বলে গোটা শরীরটা ছড়াতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে বুঝলাম। বেশ কিছু মৌমাছিও ওকে বিরক্ত করছে।

দীনেশ ভাইয়ের নির্দেশ মত গাড়িটা একটু এগিয়ে গেল রাস্তা ধরে। বুঝলাম এবার দীনেশ ভাইয়ের অভিজ্ঞতার দাম। গাড়ি একটু এগোতেই বাঘ-বাহাদুর জল ছেড়ে রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ির দিকেই আসতে লাগল। ছোটমুন্নার গতির সাথে তাল রেখে দূরত্ব মেনে গাড়িও এগোচ্ছে। লক্ষ্য করার চেষ্টা করছি তার প্রতিটা পদক্ষেপ। সত্যিই don't care ভঙ্গি। প্রায় এক কিলোমিটারেরও বেশি তার হাঁটা প্রত্যক্ষ করলাম। গায়ের ডোরাকাটা দাগ আর গাছ-গাছালির মধ্যে দিয়ে আসা আলো-ছায়ায় সত্যিই এক মনোমুগ্ধকর পরিবশে।


কিন্তু এভাবে আর ওনার হাঁটতে ভাল লাগল না। এবার রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়লেন জঙ্গলে। এধারে একে একে আরও গাড়ি জড়ো হতে লাগল। দীনেশের কথা মত আমরা সেই ভিড় ছেড়ে বার হলাম এবং বুঝলাম রাজামশাইয়ের লক্ষ্য সেই বাবাঠ্যাঙা নামক পুকুরটিতে যাওয়া। একটু এগিয়ে আমাদের গাড়ি দাঁড়ালো। উদ্দেশ্য বুঝলাম। রাস্তার বাঁদিকে ৯০ ডিগ্রী কোনে চলে গেছে রাস্তার মতই 'ফায়ার লাইন' অঞ্চল। পকুরের দিকে যেতে হলে ওই ফায়ার লাইন তাকে পার হতে হবে। আবার তাকে দেখা ও ছবি তোলা-দুইই হবে। আস্তে আস্তে অন্য গাড়িগুলোও রওয়ানা দিয়েছে। বুঝতে বাকি রইল না যে বাঘ বাহাদুর বনের ভিতর দিয়ে রওনা দিয়েছেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে তিনি ফায়ার ব্রেকার লাইন পার না করে রাস্তার দিকেই আসতে শুরু করলেন। যদিও গাড়ির জটলা দেখে তিনি আর রাস্তা অবধি না এসে রাস্তার সমান্তরালে হাঁটতে শুরু করলেন। রাস্তাটা একটু এগিয়েই ৯০ ডিগ্রী বাঁক নিয়েছে। ঠিক তার আগেই ছোটমুন্না জঙ্গলে ঢুকে গেল আবার।


এক অদ্ভুত ভাললাগা, শিহরন ও ছবি তুলতে পারার আনন্দকে সাথে নিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। দীনেশ আর ওয়াসিম ভাইকেও বেশ খুশি দেখাচ্ছে। আসলে এই ডোরাকাটা চতুষ্পদকে দেখতে পাবার থেকে দেখাতে পারার আনন্দও কম নয় কোন অংশে। এরপর বিকেলের সাফারি। তারপরে দীনেশ ভাই আর ওয়াসিম ভাইকে বিদায় জানানো। পরের দিন তো সেই জব্বলপুর হয়ে ঘরে ফেরার পালা।







119 views0 comments
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page