top of page
  • ..

স্নো-লেপার্ডের খোঁজে লাদাখে

লাদাখ মানেই শুধু প্যাংগং, সো মোরিরির বিরাট জলরাশি বা নুব্রা উপত্যকার জোৎস্না রাত নয়। তার বাইরেও প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর লাদাখের রুক্ষ মালভূমির প্রান্তর। তারই খোঁজে সীমা মুখার্জীর কলম। সঙ্গে সূর্য রামচন্দ্রনের ক্যামেরার ছবি।



নভেম্বার ১৬, ২০১৮:

আমরা লেহ্ শহরে নামলাম। শূণ্যের নীচে তাপমাত্রার জন্য আমি তৈরিই ছিলাম। কিন্তু পাইলট যখন ঘোষনা করলেন যে শহরের তাপমাত্রা এই রোদ ঝলমলে দিনেও সকাল দশটায় মাইনাস চার ডিগ্রী, তখন শ্বাস বন্ধ হয়ে এল শুনে। ফাঁকা arrival lounge অবশ্য সেটারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। আমরা এখানে এসেছি লাদাখের বন্যজীব দেখার সফরে, আমাদের প্রকৃতিবিদ বন্ধু সূর্য রামচন্দ্রনের সাথে। আমরা মূলত: বেশ কয়েক রকম জীব দেখার লক্ষ্যে এসছি। যেমন দ্রাসের উঁচু উঁচু পাহাড়ে হিমালয়ান ব্রাউন বিয়ার/ভাল্লুক। এরা হল স্হলভাগের সবথেকে বড় আমিষাশী প্রাণী। এছাড়া দেখব হিমালয়ের এই অংশের পাহাড়ের উঁচু ঢালের অ্যান্টিলোপ- এক রকম ছাগল জাতীয় প্রাণী। আর হিমালয়ান স্নো লেপার্ড তো রয়েছেই, যাদের দেখতে আমরা যাব উলে। প্রায় অদৃশ্য থাকা এই জীবদের নিয়ে বিবিসি'র তথ্যচিত্রে যে জায়গাটার কথা এসেছে ।





লেহ্ শহরের বেশিরভাগ রিসোর্ট এই অফ সিজনে বন্ধ থাকে। শহরটাকে কেমন যেন পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে আমার ২০১৪ সালের গরমের সময় প্রথম বার আসার অভিজ্ঞতা থেকে। আমরা লেহ্-তেই হোটেলে চেক ইন্ করলাম উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেবার জন্য। যদিও হোটেলে ঘর গরম রাখার 'সেন্ট্রাল হিটিং' ব্যবস্হা রয়েছে, তবে বলা হল সেটা নাকি দিনের বেলায় চলে না! "ঠান্ডায় অভ্যস্ত হয়ে যান", সূর্য বলল আমাদের। " এটা তো সবে শুরু"। আমি ওর পরামর্শ মন দিয়ে গ্রহন করলাম,কারণ এই সফরে আমার কাছে সব থেকে চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে এই ঠান্ডার সাথে মোকাবিলা করা। বরং উচ্চতা জনিত বিষয় কখনও আগে আমাকে সমস্যায় ফেলেনি।


এখানকার বৌদ্ধরা কোন পশু বা পাখি শিকার করে না। তাই তারা সংখ্যায় প্রচুর, মানুষের উপস্হিতিকে ভয়ও পায় না। তাদের বাঁকানো অর্ধচন্দ্রাকৃতি শিং আর পায়ের কালো লম্বা দাগগুলো স্পষ্ট ধরা পড়ে ক্যামেরায়।

পরের দিন আমাদের ইনোভায় আমরা গেলাম চেমডি মনাস্ট্রিতে স্হানীয় উৎসব দেখতে। আমি বরাবরই হিমালয়ের মনাস্ট্রি বা গুম্ফাগুলোর রঙীন সংস্কৃতি উপভোগ করি। এমনকি আমার স্বামী ঝাম্পান, যে কিনা hardcore wildlifer- সেও তখন ডুবে যায় সেখানকার প্রথাগত নাচগানের রঙীন সমারোহের ছবি তুলতে।বিকেলটা অবশ্য থাকল পাখির জন্য। মানালি হাইওয়ে ধরে আমরা গেলাম লাটো গ্রামে। উদ্দেশ্য মূলত: দুর্দান্ত টিবেটান পারট্রিজের কিছু ছবি পাওয়া।যদিও নীলচে-ছাই রঙের ভরালের দলের দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করে দিল সেখানে।দ্রুতগতিতে, চঞ্চল পায়ে ওরা খাড়া পাহাড় বেয়ে নেমে আসছিল সিন্ধু নদীর তীরে জল খাবার জন্য।

পুরুষ ভরাল

এদের পরচিত নাম যদিও 'ব্লু-শিপ', তবে তা ঠিক নয়।ভেড়া নয়, এরা আসলে ছাগলের সমগোত্রীয় প্রানী (caprinae family)। এখানকার বৌদ্ধরা কোন পশু বা পাখি শিকার করে না। তাই তারা সংখ্যায় প্রচুর, মানুষের উপস্হিতিকে ভয়ও পায় না। তাদের বাঁকানো অর্ধচন্দ্রাকৃতি শিং আর পায়ের কালো লম্বা দাগগুলো স্পষ্ট ধরা পড়ে ক্যামেরায়।

স্ত্রী ভরাল

ঠিক যেমনটা ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখচোখ আর তাদের ফেরৎ নিয়ে চলা বয়সে বড়দে'র মুখচোখের ভঙ্গিও ধরা পড়ে আলাদা করে। প্রচুর টিবেটান পারট্রিজ দেখা মিলল একটা ফার্ম হাউসের বাইরের মাঠে, সন্ধ্যার সূর্যাস্তের সোনালি আলোয় তাদের খয়েরি-কালো শরীরের রঙ আর লালচে গলা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এরা যেন চুকর পারট্রিজ থেকেও সুন্দর, যাদের গোটা লাদাখ ভ্রমণকালেই আমরা দেখতে পেয়েছি।

টিবেটান পারট্রিজ



চুকর


নভেম্বার ১৮, গন্তব্য দ্রাস


গরম ধোঁয়া ওঠা সবুজ 'হক' (একপ্রকার কাশ্মিরী শাক) আর চিকেন কারি শেষ করে কার্গিল থেকে আমরা রওয়ানা দিলাম হুলিয়াল গ্রামের উদ্দেশ্যে যেখানে আমরা থাকব দুই রাত্তির একটা হোম-স্টে'তে। এখানকার উচ্চতা ২৮০০ মিটার।


টর্চের আলোয় আমাদের গাইড দেখিয়েছিলেন বরফের ওপর একটা বড় ভালুকের পায়ের থাবার দাগ। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত। জন্তুটা রাতের বেলায় গ্রামের পাশ দিয়েই গেছে। তারপরে উঠে গেছে পাহাড়ের ওপরে, যেদিকে আমরা এখন যাচ্ছি।
নিসর্গ

মুজাম্মিল হোসেনের সাথে আমাদের দেখা হল যিনি কার্গিলে 'রুটস্' নামে একটি পর্যটন সংস্হা চালান। বিকেল ৪টে তেই আলো কমে এল, হুলিয়াল যাবার রাস্তায় বরফ জমে আছে। হাড়কাঁপানো অন্ধকার সন্ধ্যায় গাড়ি থেকে বার হয়ে আমরা সংকীর্ন সিঁড়ি ধরে পৌঁছালাম আমাদের বাসস্হানে। গ্যাস হিটারের উত্তাপ আর মেঝেতে সাজানো নীচু টেবিলের চারপাশের গরম কার্পেট আর গদির আয়েশ আমাদের আহ্বান জানালো। প্রথাগত লাদাখি ঘর। আরামদায়ক হয়ে উঠেছে এখন গরম চা আর স্হানীয় বিস্কুট-খুরা'র সাহচর্যে। পরের দু'দিন রুটস্ এর সাথে যারা কাজ করেন তাদের সাথে পরিচিত হলাম। এটাও বুঝতে পারলাম ভারতের দূর-দূর প্রান্তের তরুণরাও মনে সেই সব স্বপ্নই লালন করে যা একজন দিল্লী বা মুম্বইয়ের তরুণ লালন করেন।

অন্ধকার ভোরের বাতাসে ভাসছে আজানের সুরেলা ধ্বণি। এখন ভোর পাঁচটা আর একটা পনি ঘোড়ায় চেপে আমরা একটা পাহাড়ের শীর্ষদেশের দিকে যাচ্ছি গ্রিজলি ভলুকের ভারতীয় আত্মীয়ের সন্ধানে। এর আগেই যখন পনিতে চাপতে যাচ্ছিলাম, টর্চের আলোয় আমাদের গাইড দেখিয়েছিলেন বরফের ওপর একটা বড় ভালুকের পায়ের থাবার দাগ। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত। জন্তুটা রাতের বেলায় গ্রামের পাশ দিয়েই গেছে। তারপরে উঠে গেছে পাহাড়ের ওপরে, যেদিকে আমরা এখন যাচ্ছি।

পায়ের ছাপ

আমরা যতগুলো বরফ ঢাকা শৈলশিরায় উঠছি, ততবার ভাবছি যে চূড়ায় পৌঁছে গেছি হয়ত। কিন্তু আরো বড় পাহাড় ততবার সামনে দেখা দেয়। ভোর হচ্ছে জমে থাকা বরফকে ধূসর-গোলাপি রঙে রাঙ্গিয়ে। অবশেষে আমরা চূড়ায় পৌঁছলাম। সূর্য আগেই একদল 'স্পটার' কে পাঠিয়ে রেখেছিল উল্টো দিকের পাহাড়ে কোন ভাল্লুকের উপস্হিতি নজর রাখতে। আমাদের পেছন দিকে দাড়িয়ে আছে টাইগার হিল- কার্গিলের যুদ্ধের স্মৃতি বহন করে। উত্তেজনা, প্রত্যাশা, পা গরম রাখতে ছটফট করা বারবার। সব মিলেমিশে একাকার। একঘন্টা কেটে গেল পাহাড়চূড়ায় চা আর স্যান্ডুইডের সাথে। কিন্তু ভাল্লুকের দেখা নেই। অন্যরা যখন আরো অপেক্ষা করবে স্হির করল, আমি আর ঝাম্পান পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আস্তে আস্তে আমাদের গ্রামের কটেজের দিকে ফিরব ঠিক করলাম।


উপর থেকে আমাদের গ্রাম


তাই এ বরফে ঢাকা ঢাল দিয়ে ঘোড়ার পায়ের দাগ দেখে দেখে আস্তে আস্তে নামাটা আমার কাছে ততটা সুখকর ছিল না। যদিও উজ্জ্বল রোদ্দুর আমাকে উত্তাপে ভরিয়ে দিচ্ছিল।

বিকেলের দিকে আমরা গেলাম মুস্কো গ্রামের দিকে।কার্গিল যুদ্ধের আর একটা রণভূমি। কামড় দেওয়া ঠান্ডা হাওয়াকে উপেক্ষা করে রাস্তার ধারে আমরা দাড়িয়ে ছিলাম দূরবীনে চোখ রেখে উল্টোদিকের পাহাড়ে। “There, there, there!” সূ্র্য চেঁচিয়ে উঠল। ওর হাতের যন্ত্রটা বেশি শক্তিশালী। প্রাপ্তিযোগের আনন্দ ওর চোখে মুখে। ও আমাদের ব্রাউন বিয়ার দেখাতে পেরেছে। একটা নয়, দু-দু'টো মা ভাল্লুক। একজনের সাথে দু'টো আর একজেনর সাথে তিনটে ছোট বাচ্চা। উফ্, সত্যিই ওরা খুব বড় জন্তু। ওই অত উঁচুতেও ওদের কত বড় দেখাচ্ছে। পাথরের ওপর লাফ দিয়ে দিয়ে খাবারের খোঁজে চলেছে ওরা শীতকালের দীর্ঘ নিভৃতবাসের সময় শুরু হওয়ার আগে। তারা যে যার নিজের নিজের পথে। কিন্তু ওদের ছোটরা মা'য়ের কাছে কাছেই থাকছে। মায়ের সাথে তাল মিলাতে কখনও বা পাথরে গড়িয়ে নীচে পড়ছে। দূরবীনের ঝকঝকে লেন্স দিয়ে আমরা ঘুরে ফিরে দেখছি। লেন্সে মোবাইল ক্যামেরা ঠেকিয়ে ভিডিও নিচ্ছি পরবর্তী সময়ে জাহির করার জন্য।



ব্রাউন বিয়ার


নভেম্বর ২০:

দিস্তার পর দিস্তা লেখা যেতে পারে লাদাখের অদ্ভুত, বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর উপরে। কিন্তু এখন আমি নজর সরাব না অন্য কিছুতে এই লেখায়। আমরা আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য উলে'র দিকে চলেছি। মাত্র ছয়টি ঘরের বসতি শাম এলাকার সেই গ্রামে ৪,১৫০ মি. উচ্চতায়। আমাদের পথ সিন্ধু নদীর দীর্ঘতম গিরিখাতকে পাশে রেখে চলেছে। বাতালিক আর আর্যদের বিখ্যাত বসতি দা-হানু গ্রাম পার হয়ে আমরা কমলালেবু আর অ্যাপ্রিকট গাছে ভরা উপত্যকায় চলে এলাম। অন্ধকার হয়ে এল, কিন্তু আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে এখনও কয়েক ঘন্টা। তবে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম স্নো-লেপার্ড লজে যেখানে আমরা পরের পাঁচটা রাত কাটাব। রাতের গরম ডিনার আমাদের জন্য সেখানে প্রস্তুত ছিল। এবং তারপরে নরম লেপের তলায় গরম জলের বোতলের উপস্হিতি দেখে আর আমার মুখে খুশির হাসি চাপা থাকল না সেই ঠান্ডায়। কিন্তু এক ঝাঁকুনিতে বাস্তবে ফিরে এলাম এটা বোঝার পর যে, জলের সব পাইপ বরফে জমে গেছে। সুদৃশ্য আধুনিক শাওয়ার আর জলের ট্যাপ কোন কাজে আসবে না। বাথরুমে দুই বালতি জলই আমাদের ভরসা এখন।


নভেম্বর ২১-২৫:

আমাদের এই পাঁচটা দিন রোজই কেটেছে বন্যপ্রাণী চাক্ষুষ দেখার উদ্দেশ্যে ঘোরাঘুরিতে। গাড়িতে করেই যাতায়াত। আর শক্তিশালী দূরবীনের মাধ্যমে হিমালয়ের এই উচ্চতায় জন্তু ও পাখিদের দেখা। কিন্তু প্রবাদপ্রতিম প্রাণীবিদ জর্জ শ্যালারের কথাও মনে এল যিনি ১৯৭৩ সালে উত্তর নেপাল পায়ে হেঁটে পরিক্রমা করেছিলেন ভরাল এবং আইবেক্স, উরিয়ালের মত অন্যান্য caprinae গোত্রের প্রাণীদের পর্যবেক্ষন করতে- যেগুলো আমরা পরে দেখতে পেয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গী ছিলেন পিটার ম্যাথিসেন যিনি ওই বরফের উত্তুঙ্গ গিরিমালায় নিজের স্ত্রী বিয়োগের পর অন্তরের শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। যদিও এই অভিযান শেষে স্নো-লেপার্ডের খোঁজেই পরিণত হয় বেশিটাই এবং তার ওপর ভিত্তি করে শ্যালার তাঁর সেরা রচনাটি লেখেন।

এক সকালে আমরা দাড়িয়েছিলাম একটা সঙ্কীর্ন শৈলশিরার ওপরে। সেখানে মেষপালকের একটা কুঁড়ে ছিল আর কিছু প্রার্থনা মন্ত্র লেখা পতাকা উড়ছিল। আমরা পর্বতে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম কোন কিছু নজরে আসে কিনা! দুটো রাজকীয় গোল্ডেন ঈগল একটা পাহাড়ের ওপর বসে নীচের উপত্যকায় শিকারের খোঁজে তাকিয়ে ছিল- ছোট ভেড়া, স্নো পিজিওন- কোন কিছু হলেই চলবে। একটা লেমারগেয়ার (lammergeier,একপ্রকার শকুন) আকাশে ওর বিরাট ডানাগুলো মেলে উড়ে গেল। আমি উল্টোদিকের উপত্যকায় একটা খামারের দিকে তাকিয়েছিলাম। একটা শূণ্য ক্ষেতের ধার ধরে লম্বা পাথরের দেওয়াল। সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছে বিন্দুর মত ইয়াক আর জো (dzo, ইয়াকের সমগোত্রীয় গবাদি পশু)। একটা ছোট ঝরনা বয়ে গেছে সেখান দিয়ে আর পুরো ভূসম্পত্তিটির ওপর নজরে রেখেছে যেন একটি টিলার ওপর একটি বৌদ্ধস্তূপ। সবাই হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে পড়ল। উল্টোদিকের পাহাড়ের ঢালে একদল আইবেক্সের আগমন। দলের দুটি পুরুষ পিছনের পায়ে দাড়িয়ে পড়ে শিঙের ঠোকাঠুকিতে লড়াই বাঁধিয়েছে। এই প্রজনন ঋতুতে যেটা হামেশাই দেখা যায়।" ধো ধো আধ্ধো" আমাদের লাদাখি গাইড শব্দ করে সেই নাটকে শব্দ যোগ করলেন, যে জিনিসটা এতদূর থেকে শোনা যাচ্ছিল না।



রোজ সকালেই খোঁজ খবর চলে স্নো-লেপার্ডের। আমি বলি, "মনে হয় ওরা খুব লাজুক"। কিন্তু সূর্য বলল, "লাজুক নয়, চালাক ওরা। তোমাকে ওরা সবসময় নজর রাখছে, কিন্তু নিজেরা দেখা দেবে না"।

আইবেক্স


পাহাড়ের শীর্ষে

পরের দিনটা কাটল আলচি মনাস্ট্রি ভ্রমণে। মোহমুগ্ধকর এই মনাস্ট্রিতে দশম শতাব্দীর বোধিসত্ত্বের অপরূপ ম্যুরাল রয়েছে। আজও আমরা কিছু আইবেক্স আর ঊরিয়াল দেখতে পেয়েছি সিন্ধু বরাবর যাতায়াতের পথে। রোজ সকালেই খোঁজ খবর চলে স্নো-লেপার্ডের। আমি বলি, "মনে হয় ওরা খুব লাজুক"। কিন্তু সূর্য বলল, "লাজুক নয়, চালাক ওরা। তোমাকে ওরা সবসময় নজর রাখছে, কিন্তু নিজেরা দেখা দেবে না"। আর একদিন লাঞ্চ প্যাকড করে আমরা শাম ভ্যালির ছোট একটা ট্রেক রুট বরাবর গাড়ি করে একটা চ্যাপ্টা মত পাহাড়ের চূড়ায় গেলাম। জায়গাটা বোধহয় বেশ জনপ্রিয় এখানে ক্যাম্পিং এর জন্য। কারণ দু'টো ছাউনি দেওয়া টয়লেটও রয়েছে। উল্টো দিকের পাহাড়ে আইবেক্সদের দেখা যাচ্ছে। আর আমাদের দলের আরও ছটফটে সদস্যরা কিছুটা রাস্তা আরও ট্রেক করে গিয়ে ওদেরকে কাছ থেকে ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করল।

শেষ সন্ধ্যাটা কাটাচ্ছিলাম আমাদের মত করে, স্নো-লেপার্ডদের দেখার আর একটা ব্যর্থ অভিযান সেরে আসার পর। টেবিলে গোল হয়ে বসে আড্ডা চলছিল। সূর্য ওর প্রথম স্নো-লেপার্ড দেখার কথা বলছিল। "নরবু (ওই লজের সবথেকে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গাইড) আর আমি একটা পাহাড়ের ওপর দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ ও চেঁচিয়ে উঠল- ওই যে ওরা! আমি আমার বাইনোকুলার সরিয়ে যত দূর যায় দেখা, ততটা দেখতে চেষ্টা করলাম। মধ্য ভারতে ছ'বছর প্রকৃতিবিদ হিসাবে কাজের সব গর্ব আমার বার হয়ে গেল। আমি একদমই বড় বিড়ালগুলোকে দেখতে পাচ্ছিলাম না আর নরবু আমাকে চোখ ঘোরাতে নির্দেশ দিচ্ছিল এমন ভাবে যেন আমি একটা বাচ্চা। অবশেষে বাইনোকুলারেই চোখ রাখতে হল, যেটা আমি চাইছিলাম না। পাহাড়ের ধূসর-সাদা রঙের সাথে ওরা মিশে ছিল। তিনটে স্নো-লেপার্ড- আমার প্রথমবার দর্শন। দারুণ সুন্দর কিছু জীব , ধূসর রঙের চাকা চাকা দাগ আর লম্বা, মোটা ল্যাজ তাদের। বাচ্চাগুলো খেলছে আর নজর রেখে শান্ত হয়ে বসে তাদের মা। এর থেকে সুন্দর কিছু হয় না। ওই এলাকায় আরো তিনটে ছিল! উল্টোদিকের পাহাড়ে আমার বাইনো দিয়ে নরবু সেগুলো দেখতে পেয়েছিল। আমি বুঝলাম এখনও অনেক শেখার আছে।"


স্নো-লেপার্ড দম্পতি। সূর্যের পুরানো ভ্রমণের অ্যালবাম থেকে নেওয়া।

ম্যাথিসেন তার পরিক্রমা শেষ করেছিলেন একটাও স্নো-লেপার্ড না দেখে।তার জেন গুরু'র "expect nothing", কোন কিছুর প্রত্যাশা রেখ না- মন্ত্র তাঁকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েছিল। ভাগ্য মনে হচ্ছে আমাদের সাথেও সেই খেলাই খেলল। আবার ফিরে আসার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা মনে নিয়ে, আমরা ফিরে চলেছি লেহ্ শহরের দিকে বিমান ধরতে। নরবু এখনও দূরবীন দিয়ে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে খুঁজে চলেছে।

লাদাখের পাইকা

হঠাৎই দেখা গেল একটা পাইকা'কে পাথরের আড়াল থেকে বার হয়ে আসতে। Lagomorph শ্রেণীর এই জন্তুকে আমার প্রথম দেখা। সমস্ত সৃষ্টিই সুন্দর। ম্যাথিসেনের মতই আমি আমার প্রাপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট। প্রকৃতিকে সব থেকে সুন্দর রূপে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে চলেছি।








লেখক পরিচিতি: লেখিকা প্রকৃতিপ্রেমী। বর্তমানে কানহা নিবাসী। 'শালবন' হোম-স্টে'র কর্ত্রী।


ফটোগ্রাফি: সূর্য রামচন্দ্রন। প্রকৃতিবিদ ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার।







2 e paa_edited.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page