বায়ুবিদ্যুৎ নাকি পরিবেশের পক্ষে নতুন সহায়তাকারী শক্তি। কিন্তু রাজস্হানে তা কিভাবে জীববৈচিত্রকে ব্যাহত করছে, বিপন্ন করে তুলছে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের মত বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের, জীববৈচিত্রে ভরা স্হানীয় মানুষের পবিত্র জমিতেও চলছে দখলদারি তা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টেরও নজর এড়ায়নি। যে ধর্মীয়-সামাজিক পরম্পরা এতদিন টিকিয়ে রেখেছে জীবকূলকে, তা রক্ষা করতে সরব স্হানীয় ধর্মভীরু গ্রামবাসীরাও। কোন পথে আসবে সমাধান? আলোচনায় মাধব শর্মা।
ওরান বা পবিত্র সমাধিক্ষেত্র রাজস্হানের সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। এগুলি স্থানীয় পরিবেশ আর জীববৈচিত্রের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। প্রকৃত অর্থেই উষর প্রান্তরের মাঝে জলাশয়সহ ওরানগুলি একেকটি মরূদ্যান। জয়সলমীরের ওরান, যা কিনা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড-এর মুক্ত বিচরণভূমি, আজ যেন এক রণভূমি, দুইধারে যুযুধান পক্ষ আজ গ্রিন এনার্জির কর্পোরেট সেক্টর আর স্থানীয় বাসিন্দারা। এই নিয়ে আশেপাশের ভিমসার, দেবদা, রাসলার মত ১০-১২টি গ্রামের বাসিন্দারা কেউ কেউ ৬০ কিলোমিটার অবধি পথ হেঁটেও স্থানীয় আধিকারিকের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন গত জুন মাসে।
তাদের বক্তব্য, সোলার পাওয়ার প্লান্টের লাইনগুলি একেবারে জয়সলমীরের দেগরাই ওরানের মধ্যে দিয়ে গেছে, যা সবার জন্যই অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। স্থানীয় সানোয়াটা গ্রামের অধিবাসী সুমের সিং ভাট্টি বললেন, "কোম্পানি এই হাই টেনশন তারগুলির উচ্চতা বেঁধে দিয়েছে ২০ ফুটে। কিন্তু উট, যা কিনা এই অঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তার উচ্চতাই তো কমবেশি ১০ ফুট হয়ে যায়, তারওপর সওয়ারীকে ধরলে আরও ৩-৪ ফুট হবে৷ তার আর সওয়ারীর মধ্যে দূরত্ব এসে দাঁড়াচ্ছে মাত্র সাত ফুট। ব্যাপারটা উট ও সওয়ারী দু'জনের জন্যেই বেশ বিপজ্জনক দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর উট ছাড়া আমাদের চলে নাকি? গোটা রাজস্থানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উট তো এখানেই পাওয়া যায়। আমারই তো চারশোর ওপর উট আছে।"
এর আগে সুপ্রিম কোর্টও গত জুনে বলেছিল রাজস্থানের কিছু কিছু জায়গায় হাই টেনশন লাইন বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলিকে মাটির নীচ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা যাতে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের মত পাখিদের বিপদ না হয়।
স্থানীয় পরিবেশবিদ ও ইতিহাসে উৎসাহী পার্থ জাগানির সাথে কথা বলে আমরা জানলাম জয়সলমীরের এই দেগরাই ওরানের ইতিহাস প্রায় ছ'শো দুই বছরের পুরনো। প্রাচীন তাম্রপত্র থেকে জানা যায় রাজা বিক্রমদেব ১৪১৯-য়ে আজমীরের পুস্করে স্নান করতে আসেন। তখনই এই দেগরাই মন্দিরের আশেপাশের প্রায় ১২ ক্রোশ বা ষাট হাজার বিঘা জমি দেবোত্তর ঘোষণা করা হয়। এই এলাকায় শিকার তো নয়ই, এমনকি চাষবাস বা গাছ কাটাও নিষিদ্ধ। এই এলাকা পশুদের বিচরনভূমি ঘোষনা করা হয়। "স্থানীয়রা এই নিয়ম আজ ছ'শো বছরের ওপর ধরে মেনে চলে আসছে। এই ওরান ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে গুরত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। তার ফলেই ধু ধু মরুভূমিরমধ্যে এই এলাকা আজ জীববৈচিত্র্যে ভরা এক গভীর জঙ্গলের রূপ নিয়েছে। আশেপাশেরপ্রায় ১২টি গ্রামের মানুষ এখানে গবাদি পশু চড়াতে আসে।" পার্থ জানান।
" আমরা বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলির লাইন টানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি।গত কয়েক বছর ধরে দেশ-বিদেশের বহু বড় কোম্পানি এদিকে হাত বাড়াচ্ছে। সরকারের খবরদারিও বেড়েছে", পার্থ বলেন।
সমস্যার মূল খুঁজতে গিয়ে কথা হলো দুর্জন সিংয়ের সাথে, যিনি স্থানীয় ওরান বাঁচাও কমিটি ও দেগরাই মন্দির ট্রাস্টের সম্পাদক। গন্ডগোল জমির নথিভুক্তিকরণেই। সেই স্বাধীনতার পর যখন মাপজোক করা হয় তখনই এই জমি ভুলক্রমে চাষজমি হিসেবে নথিবদ্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে শুরু। পরে যদিও স্থানীয়দের সক্রিয়তায় খানিকটা জমি ওরান হিসেবে নথিভুক্ত করা যায় কিন্তু তা মোট ষাট হাজার বিঘার মাত্র চব্বিশ হাজার। বাকি ছত্রিশ হাজার বিঘা জমি ওরান ঘোষণা করা নিয়ে তাদের আন্দোলন এখনো চলছে। কিন্তুআসল সমস্যা ওই ছত্রিশ হাজার নিয়েই। সরকার ওই ছত্রিশ হাজার বিঘা জমিতেই প্রাইভেট কোম্পানিগুলিকে তাদের সৌরবিদ্যুৎ আর বায়ুশক্তি প্রকল্পের টাওয়ার ইত্যাদি বসানোর অনুমতি দিয়ে দেয়। আজ সেই কোম্পানিগুলি বাকি চব্বিশ হাজার বিঘা জমিও ব্যবহার করতে শুরু করেছে তাদের হাই টেনশন তার ও টাওয়ার বসানোরজন্য যা শুধু এখানকার বড় বড় পাখিদের অস্তিত্বের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
রাজস্থানের রাজ্য পশু উট ছাড়া আর কিই বা হতে পারে? তেমনই সেখানকার রাজ্য পাখি এই গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড যার পোশাকি নাম Ardeotis nigriceps। এই পাখিটি ১৯৭২-য়ের Wildlife Protection Act-য়ে'র প্রথম তফসিল অনুযায়ী সংরক্ষিত। শুধু তাই না, Conference of the Parties to the Convention on the Conservation of Migratory Species of Wild Animals in 2020 এর তালিকা অনুযায়ী এই পাখি রীতিমতো critically endangered। সারা পৃথিবীতেএই পাখিটি শুধু রাজস্থানেই পাওয়া যায়, সেই সংখ্যাও আজ নামতে নামতে হাতে গোনা ১২০-১৩০-য়ে এসে ঠেকেছে। Wildlife Institute of India (WII) আর দেশের পক্ষীবিদেরা মিলে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এই পাখিটিকে অবলুপ্তি থেকে বাঁচাতে। যে পথের একটা বড় কাঁটা এই পাওয়ার সেক্টরের ট্রান্সমিশন টাওয়ার আর লাইন গুলো। পার্থ জানালেন "গত সেপ্টেম্বরেই একটি great Indian bustard এই বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা গেছে। শেষ পাখিটির দেখা মিলেছে এ'বছরের মার্চে।" WII-য়ের ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৮৩৮৬৮ টি নানা ধরনের পাখি মোটামুটি ৪২০০ বর্গ কিলোমিটারের নিরীক্ষিত এলাকার মধ্যে মারা গেছে, অঙ্কের নিয়মে যা বছরে প্রতি হাজার বর্গ কিলোমিটারে প্রায় বিশ হাজার পক্ষীমৃত্যুর সমতুল! বিদ্যুৎ পরিবাহী তার পাখিদের জন্য কতটা মারাত্মক সেটা বোঝা যায় যখন হিসেব করে দেখা যায় প্রতি এক কিলোমিটার কম ভোল্টেজের(৩৩ কিলোওয়াট) বিদ্যুতের তার প্রায় ৩.২২ টি পাখির মৃত্যুর কারণ হয়, আর বেশি ভোল্টেজের তার হলে সেই হিসেব প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ৬.২৫ টি পাখির মৃত্যুতে!
সুমিত দুকিয়ার সাথে কথা হলো। সুমিত গুরু গোবিন্দ সিং ইন্দ্রপ্রস্থ ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি জানালেন মিডিয়াতে এরকম রিপোর্টও নাকি আছে যেখানে বলা হয়েছে এই great Indian bustard নাকি দেশে গ্রিনএনার্জির প্রচলনের পথে বড় অন্তরায়! দেগরাই ওরান রসলা গ্রামের সন্নিহিত এলাকায় যা পড়ছে ডেজার্ট ন্যাশানাল পার্কের মধ্যে। এই বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে শুধু দেগরাই ওরানেই প্রায় ৪৫টি বড় মাপের পাখির মৃত্যু ঘটেছে স্রেফ বিদ্যুৎ পরিবাহী তারে জড়িয়ে। দেগরাই ওরানের মধ্য দিয়ে ৩৩ কিলোওয়াট থেকে ১২ মেগাওয়াটের পাঁচটি বিদ্যুতের তার চলে গেছে! আছে তাদের জন্য একটি ৭৬৫ কিলোওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রও।
এই প্রসঙ্গে অপর পক্ষের মতামত জানতে গেলে ReNew Power Private Limited এর সুনীল জোশি জানালেন তারা সম্পূর্ণ রূপে দেশের আইন মেনেই যা করার করছেন। আরেকটি কোম্পানি যারাও এখানে কাজ করছে সেই Rajasthan Renewable Energy Corporation Limited এর তরফে জেনারেল ম্যানেজার সুনীল মাথুরের কোনও মন্তব্য অবশ্য পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে জয়সলমীরের ডিএফও কপিল চন্দ্রওয়াল এটা মেনে নেন যে এই পাওয়ার কোম্পানিগুলোর জন্য সাধারণ গ্রামবাসীরা খুবই অসুবিধায় পড়েছে। কিন্তু তার সাথে এটাও বলেন যে এই দেগরাই ওরান আসলে ওনার আওতার মধ্যে আসেনা, ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরই এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন৷ তবে এ প্রসঙ্গে জয়সলমীরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর আশীষ মোদির কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় পরিবেশসচেতন মানুষেরা কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তারা এইসব পাওয়ার কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনি পথে হেঁটেছেন। সুপ্রিমকোর্ট আর National Green Tribunal (NGT)-তে মামলাকরেছেন তারা। পরিবেশবিদএম ভি রনজিৎ সিং ২০১৯-এর জানুয়ারিতে এরকমই এক মামলা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। সেই কেস দু'বছর চলার পর মহামান্য আদালত রায় দেন পাওয়ার লাইনে রিফ্লেক্টর লাগানোর সপক্ষে। কিন্তুরণজিৎ সিংয়ের বক্তব্য পাওয়ার কোম্পানিগুলো এই রায় ঠিকমতো মানছে না। তারা নামমাত্র কিছু রেডিয়ামের রিফ্লেক্টর লাগিয়ে দায় সেরেছে যা একেবারেই প্রয়োজনের ক্ষেত্রে কার্যকরী নয়। Great Indian bustard পাখিটির বৈশিষ্ট্যই হলো উড়তে উড়তে চারদিকে তাকানো, যার ফলে তারা প্রায়ই মাঝ-আকাশে বিদ্যুৎ পরিবাহী তারে জড়িয়ে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়। এ'ঘটনা বেশি করে পুরুষ পাখির ক্ষেত্রেই ঘটে কারণ খাদ্যের সন্ধানে তারাই বেশি ওড়াউড়ি করে।
সুমিত দুকিয়া জানালেন সুপ্রিম কোর্টের আদেশক্রমে কোম্পানিগুলোর মাটির নীচ দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবাহী তার নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা। এর জন্য WII-য়ের বিজ্ঞানী সুতীর্থ দত্ত, নতুন ও নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞানী রাহুল রাওয়াত আর করবেট ফাউন্ডেশনের দেবেশ গাধভিকে নিয়ে তিন সদস্যের এক কমিটিও করে দেওয়া হয়। কিন্তু পাওয়ার কোম্পানিগুলো এখনো এই কমিটিতে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে উঠতে পারেনি। এই প্রকল্পে আসন্ন বিপুল খরচের কথা ভেবেই হয়তো তারা টালাবাহানা করছে। কমিটিকে একটি ইমেল করে জানতে চাওয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মান্য করার ব্যাপারে কোম্পানিগুলো কতদূর পদক্ষেপ নিয়েছে। তার উত্তরে কমিটি শুধু একটি কথাই জানিয়েছে যে কোম্পানি গুলির কোনো অবস্থাতেই মাটির উপর দিয়ে হাই টেনশন বিদ্যুৎ পরিবাহী তার টেনে নিয়ে যেতে দেওয়ার অনুমতি মেলেনি।
মূল প্রবন্ধটি Mongabay পত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2021/08/rajasthans-orans-and-bustards-under-threat-from-green-energy-infrastructure/
অনুবাদ: শমীক নন্দী।
Comments