বিশনোই সম্প্রদায় ও তাদের গুরু জম্বেশ্বরজি। প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনে তাদের অবদান পৃথিবীতে অতুলনীয়। তাদের কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন বিশিষ্ট সংরক্ষণবিদ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফটানেন্ট কর্নেল শক্তিরঞ্জন ব্যানার্জি।
এক রবিবারের সকালে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে আমার দুই প্রকৃতিবিদ বন্ধু সঞ্জীব আর প্রসাদকে নিয়ে বেরোলাম পাখি দেখতে। এই রকম আমরা প্রায়ই যাই, তফাৎ হলো সেদিন ঠিক করে বেরিয়েছিলাম দুলপুরার বিশনোই গ্রামে একবার ঢুঁ মারবো। এদের পরিবেশ সচেতনতার কথা এত শুনেছিলাম যে একবার চাক্ষুষ করার ইচ্ছে ছিল। শুনেছিলাম প্রকৃতি সংরক্ষণ নিয়ে এদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথা। কৃষ্ণসার মৃগের দলবলকে বিশেষ করে এরা সুরক্ষা দেন। লালগড়ের সেনা ছাউনি থেকে বালুপ্রান্তরের ওপর দিয়ে মিনিট কুড়ি গাড়ি চালিয়ে পৌঁছলাম এদের গ্রামে। গ্রামটি উত্তর রাজস্থানে, শ্রী গঙ্গানগর থেকে মোটামুটি ১৪ কিমি দূরে। রাজস্থান যাকে বলে পক্ষীবিদদের স্বর্গরাজ্য। পথে অজস্র পাখি চোখে পড়ে গেল। ক্রিম কালারড কোর্সার, শর্ট টো-ড লার্কের একটা বড় দল, কমন স্টারলিং এমনকি একটা কেস্ট্রেলও।
আমাদের আর্মির বড় Jonga গাড়িটা দেখে বিশনোইরা যে খুব খুশি হল না তা বলাই বাহুল্য। আমরা যে একদল সংরক্ষণবিদ, কৃষ্ণসার হরিণদের পর্যবেক্ষন করাই যে আমাদের উদ্দেশ্য তা ওদের বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হলো। অনেক বোঝানোর পর তাদের একজন, শঙ্কর লাল বিশনোই, যিনি একজন একরোখা পশুপ্রেমী মানুষ, হরিণ গুলো যেখানে ঘুরে বেড়ায় সেখানে আমাদের নিয়ে যেতে একরকম নিমরাজি হলেন। কৃষ্ণসার হরিণের বড় এক ঝাঁক দেখতে পেয়ে আমরা তো রোমাঞ্চিত । সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে তাদের কৃষ্ণ সার গায়ের চামড়া। সেই শুরু। তারপর অনেকবার গেছি সেখানে। ধীরে ধীরে গলেছে বিশনোইদের সাথে আমাদের সম্পর্কের বরফ। পরে যতবারই গেছি শঙ্কর লাল বিশনোই-ই এগিয়ে এসেছেন আমাদের লোকাল গাইড হিসেবে, দিয়েছেন উষ্ণ অভ্যর্থনা। যত কাছ থেকে দেখেছি, মুগ্ধ হয়ে গেছি বিশনোইদের প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী প্রেম দেখে।
সেই ষোড়শ শতাব্দী থেকেই বিশনোই সম্প্রদায় ভারতে বন্যপ্রাণ রক্ষার কাজে জড়িত, বা বলা যায় তারা এ ব্যাপারে রীতিমতো আত্মাহুতি দিয়ে এসেছে। এই সম্প্রদায়ের জন্ম মহারাজ জম্মেশ্বরকে (বা জম্বেশ্বর) দিয়ে, যার দূরদৃষ্টিতে সেই সুদূর ষোড়শ শতকেই ধরা পড়েছিলো ভবিষ্যতের মানুষের হাতে পরিবেশ ধ্বংসের ঈঙ্গিত। ১৫০৮ সালে রাজস্থানের যোধপুরের কাছে পিপাসার গ্রামে এই দূরদর্শী মহামানবের জন্ম। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে ১৫৪২ সালে যাত্রা শুরু বিশনোইদের। মহারাজ জম্মেশ্বর তাঁর অনুগামীদের জন্য ২৯টি নিয়মাবলির এক তালিকা তৈরি করে দেন, এই নিয়ম যারা পালন করে তারাই বিশনোই (বিশ=২০, নোই=৯)। তাতে ভ্রাতৃত্ববোধ, কৃচ্ছসাধন, সামাজিক শিষ্টাচার, নারী অধিকারের মতো আর পাঁচটা ধর্ম বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর নিয়মাবলীর মতো নিয়ম যেমন আছে, তেমনই পশুপ্রেম, বন্যপ্রাণীর অধিকার রক্ষার মত এমন কিছু নিয়মও আছে যা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের মূল ভিত্তি। বিশনোইরা এইসব নিয়ম গভীর নিষ্ঠাভরে পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
পরিবেশ রক্ষার্থে বিশনোই সম্প্রদায়ের আত্মাহুতির প্রচুর কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। ১৬৬১তে কর্মা আর গৌড়া নাম্নী দুই নারী শুকনো প্রান্তরের মরূদ্যানসম খেজড়ি গাছ (Prosopis cineraria) বাঁচাতে প্রাণ দেন। তারপর থেকে গাছ বা বন্যপ্রাণ বাঁচানোর জন্য বিশনোইদের আত্মবলিদানের অনেক উদাহরণ উঠে এসেছে। পরিবেশের ভারসাম্যের প্রয়োজনে গাছেদের অবদান এরা অনেক আগেই বুঝেছিলো। রাজস্থানের মতো ঊষর ভূমিতে এই খেজড়ি গাছ শুধু যে ভালোভাবে টিঁকে থাকতে পারে তা-ই নয়, এই গাছ নানাভাবে সাধারণ মানুষের উপকারেও আসে। বিশনোইদের বিচক্ষণতায় তাদের গ্রামের চারপাশ এই খেজড়ি গাছে ভরে উঠেছিলো। এরপরেও অনেকবার তার প্রকৃতি ও বন্যজীবদের রক্ষার জন্য আত্মবলিদান করেন। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে যোধপুরের খেজরালি গ্রামে। ১৭৮৭ সালে মারোয়াড় রাজ্যের যোধপুরের মহারাজ অভয় সিংয়ের প্রাসাদ বানানোর জন্য প্রচুর কাঠের প্রয়োজন পরে। সবার নজর যায় বিশনোইদের খেজড়লি গ্রামের ওই খেজড়ি গাছের দিকে। রাজার পার্ষদ গিরধর দাস ভান্ডারি লোকজন নিয়ে হাজির হয় সেই গাছ কাটতে। এসব দেখে প্রথমে এগিয়ে আসেন এক বিশনোই রমনী শ্রীমতী অমৃতা বেনিওয়াল। রামকুমারের স্ত্রী অমৃতা তখন দই প্রস্তুত করছিলেন। তাঁর অনুনয় কাকুতিমিনতিতে যখন কাজ হয়না তখন তিনি ও তাঁর তিন কন্যা এগিয়ে এসে গাছগুলো জড়িয়ে ধরে বসে পড়েন।
কিন্তু এতো করেও আটকানো গেলোনা রাজপেয়াদাদের। তাদের কুঠারাঘাত নেমে এলো গাছের কান্ডে, সঙ্গে নিয়ে গেলো চার নির্ভীক বিশনোই রমনীর মুন্ড! ঘটনার খবর আশেপাশের গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু কোনোরকম উদ্দাম আন্দোলনের পরিবর্তে দলে দলে বিশনোইরা এগিয়ে এসে অমৃতা দেবীর মতোই আত্মাহুতি দিতে লাগলেন। কথিত আছে সেদিন মোট ৬৯ জন নারী আর ২৯৪ পুরুষ আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। পরিবেশের স্বার্থে এমন মহতী আত্মবলিদানের উদাহরণ বোধহয় বিশ্ব ইতিহাসেই বিরল। এই খবর রাজার কানে গেলে লজ্জিত গ্লানিজর্জর রাজা ছুটে আসেন বিশনোই গ্রামে। আর কোন গাছ না কাটার প্রতিশ্রুতি দেন এর পর থেকে।
এই ঘটনার স্মরণে ওই খেজড়লি গ্রামে প্রতি বছর শহীদি মেলা বসে এখনও। (***রাজস্থান ও মধ্য প্রদেশের বনবিভাগ থেকে প্রতি বছর অমৃতা দেবী বিশনোই স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য )। মনে করা হয় এই ঘটনাই ভবিষ্যতের 'চিপকো' আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। সুন্দরলাল বহুগুনার নেতৃত্বে যে আন্দোলনে বহু মানুষ একইভাবে গাছের গায়ে 'চিপকে' থেকে, মানে গাছকে জড়িয়ে ধরে গাছ কাটা বন্ধ করেছিলেন।
বিশনোইদের কাছে যেকোনো প্রাণই পূজ্য। রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের উন্মুক্ত প্রান্তর একসময় আজকের বিলুপ্তপ্রায় কৃষ্ণসার হরিণের চারণভূমি ছিলো। এরা যেহেতু শুষ্ক, বালুময় খোলা প্রান্তরে চড়ে বেড়াতে ভালোবাসত, তাই একসময় এরা হয়ে উঠলো গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ানো শখের বন্দুকবাজদের প্রিয় শিকার। ঝাঁকে ঝাঁকে মারা পড়তে লাগল কৃষ্ণসার হরিণ। এই হরিণ বিশনোইদের কাছে পূজ্য এবং অবধ্য। (অনেকে মনে করে এই কৃষ্ণসার হরিণ বিশনোইদের গুরু মহারাজ জম্মেশ্বরেরই অবতার।) বিশনোইরা মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তারা নিজেদের চাষের ফসল অবধি পশুপাখির সাথে ভাগ করে নেয় এই বিশ্বাসে যে ভাগ করে নিলে ভগবান তাদের জন্য আরও বেশি শস্যের জোগান দেবেন। আজ ভারতে কৃষ্ণসার হরিণ বিলুপ্ত না হয়ে যাওয়ার অনেকটা কৃতিত্ব বিশনোইদের প্রাপ্য। ১৯৬১ সালে পাঞ্জাবে বিশনোইরা শিকার বিরোধী কমিটি গঠন করে।
১৯৭৪য়ে তার নাম হয় 'বিশনোই জীব রক্ষা সভা'। ১৫ই জানুয়ারি, ১৯৭৫য়ে তা হয়ে ওঠে 'অল ইন্ডিয়া জীব রক্ষা বিশনোই সভা'। এদের উদ্যোগে পাঞ্জাবের ফজিলকা জেলার ১৩ টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে কৃষ্ণসার হরিণের অভয়ারণ্য।
সারা পৃথিবীতে পরিবেশ রক্ষা এবং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে বিশনোইদের তুলনা বোধহয় কেবল তারাই। সকল বিশনোইদের যেন একটাই মূল উদ্দেশ্য, যেভাবেই হোক পরিবেশ রক্ষা। সেইজন্যই নাম-না-জানা বিশনোই মা এগিয়ে আসে নিজের সন্তানের সাথে সাথে মা-হারা কৃষ্ণসার শাবককে স্তন্যপান করাতে। বা শোনা যায় সেই বিশনোই রমনীর কথা যে একা হাতে চোরাশিকারির বন্দুকের সামনে থেকে বাঁচিয়ে আনে কোনো আহত বন্যপ্রাণীকে। পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আজ মানুষ বুঝতে শিখেছে, চিন্তাভাবনার পেছনে এসেছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। কিন্তু আজ থেকে চারশো বছর আগেই এক দূরদর্শী মহতী প্রাণ মানুষ, বিশনোইদের গুরু মহারাজ জম্মেশ্বরজি তাঁর অনুগামীদের দিয়ে গেছেন পরিবেশকে বাঁচানোর শিক্ষা। সেই শিক্ষা আজও ভোলেনি বিশনোইরা, ভবিষ্যতেও তারা সেই পথেই চলবে।
লেখক পরিচিতি: লেখক ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত লেফট্যানেন্ট কর্নেল ও একজন পরিবেশ সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ। WWF India র পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রাক্তন ডিরেক্টর। বর্তমানে Wildlife Protection society of India র সাম্মানিক ডিরেক্টার।
Comments