top of page
  • ..

বন-পাহাড়ের দেশে

তিনি কলমে লেখেন আজকের রূপকথা। সে রূপকথায় রুপোর কাঠি দূরের বান্দরপুঞ্ছ পাহাড়শ্রেণী, সোনার কাঠি পাইন বনের ফাঁক দিয়ে আসা এক চিলতে রোদ্দুরের রেখা। রাজপুত্র-রাজকন্যারা সব দেরাদুন, মুসৌরি, লান্ডৌর বা গাড়োয়ালের আর কত নাম না জানা গ্রামের পাহাড়ি মানুষ। প্রকৃতিকে নিয়ে চলা, ভাবা, কাজ করা কত কত মানুষের মধ্যে তাঁর কলমের চলাচল। সেই চলাচলের পথের কথা আজ বনেপাহাড়ের পাতায় সুমন্ত ভট্টাচার্য্যের কলমে।




কাঠের দরজাটা খুলে ফেলতেই আজ শিশিরে ভেজা ঘাসে পা। কুয়াশায় সামনেটা দেখা যাচ্ছে না।ছোট্ট বাগান পেরিয়ে গেটটা খুলে পথে নামতেই ধীর পায়ে এগিয়ে এল বুড়ো লোমোশ কুকুরটা। সামনের কাঠের গুদামটার এক কোনে রাতে থাকে ও। টপ টপ করে শিশির ঝরছে পাইন গাছের পাতা থেকে। পাকদন্ডী দিয়ে উঠতে উঠতে আশেপাশের বাড়িগুলো কুয়াশা ভেজা আলোয় ঘুমচোখে তাকাচ্ছে। শীতটা আজ থেকে বোধহয় জাঁকিয়ে পড়তে চলেছে। ঘরে থাকতে ততটা বোঝা যায়নি। আর একটা কোট এই সোয়েটারের ওপর চাপিয়ে নিলে হত।

নীচের পৃথিবীটা আজ অনেক পাল্টে গেছে। কিন্তু এই পথের বাঁকগুলো, চড়াই- উৎরাইগুলো আজও অনেকটা একই থেকে গেছে এই ছোট্ট পাহাড়ি জনপদে। এই মোড়ের এ বাড়িটায় নাকি ভূত থাকে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মালিক কবেই হাতবদল করে চলে গেছে।এখন এটা সামার হাউস দিল্লীর এক ব্যবসায়ীর। এই বাড়িটার আনাচে কানাচে অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে আছে ছোটবেলার। এখন এর গেট বন্ধ বচ্ছরভর। দূর থেকে একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। মর্নিং ওয়াকে বার হয়েছেন কর্নেল যোশী। কম কথার মানুষ। একটু হেসে এগিয়ে গেলেন। কুকুরটা পিছন পিছন আসছে এখনও। আসে রোজ। ফিরে গিয়ে ওর জন্য থাকে এক প্যাকেট বিস্কুট। ছোটবেলাটায় তো বাড়িভর্তি পশু পাখি, সাপ- সব নিয়েই থাকা। এখন এই বয়সে এসে ঠেকেছে এই কুকুরে।তাও মালিকানাহীন। আগে থাকত বাদামওলা বনোয়ারিলালের কাছে। বাজারের ওয়াচটাওয়ারের নীচে ছোট দোকান। পরিবারহীন বনোয়ারিলাল ওর বারান্দাতেই রাত কাটাত। সঙ্গে এই কুকুর। দু'বছর আগে শীতের এক সকালে ওখানেই বনোয়ারিলালকে শেষশয্যায় পাওয়া গেল। তারপর থেকে এই কুকুরের আশ্রয় ওই কাঠের গোলা।

পথের শেষে এই ভিলা- হুইসপারিং পাইন। আগে ছিল কুষ্ঠরুগীদের হসপিটাল। স্কটিশ মিশনারিদের। এখন হয়েছে হোটেল। অতিথিরা আসলে নতুন মুখের আনাগোনা এই পাইন ঘেরা রাস্তায়। এরপর আর ঘর বাড়ি নেই। সামনেটা পাইন বনের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। কুয়াশা আর সদ্য ফোটা আবছা আলোয় নাটকীয় হয়ে আছে তার দৃশ্যপট। পথ খুঁজে পেতে দিশাহারা হতে হয় অচেনা পথিকের। তবু কত চেনা তার ধোঁয়াশা ভরা অলিগলি। একদিন এই পথেই সন্ধ্যার পর একটা শেয়ালকে মনের আনন্দে নেচে বেড়াতে দেখা গেছিল। পথ ছেড়ে দিয়ে পথিক নেমে গেছিল নীচের পাকদন্ডী পথে।

দূর থেকে শোনা যাচ্ছে বয়ে যাওয়া ঝরনার শব্দ। এই ঝরনা গিয়ে মিশেছে নীচের নুন নদীতে। এই ঝরনার পথ ধরে ধরে একসময় নেমে যাওয়া হত নীচের উপত্যকায়। নদীর ধারে। সে কোন ছোটবেলার গল্প। আজ নেই আর সেই পথ হারানোর সঙ্গীরা। কিন্তু এখনও রাতের বিশ্রাম ঝেড়ে ফেলে ভোর আসে সেই আগের মতই। পাখিদের ডাক শোনা যায়। এই পাইন বনের মধ্যে রয়ে গেছে সেই বুড়ো ডাক্তারের কবর, যে এই পাহাড়ে টিবি রুগীদের চিকিৎসা করতে এসে একদিন ওই রোগেই এখানে শেষ নি:শ্বাস ফেলেছিলেন। পথের পাশের বুনোফুল তুলে তার কবরে রাখাটা রোজকার কাজ। বুনোফুল যেন বলছে- যে দেশ আমার, সে দেশ কি তোমারও নয়! এই ফুলেরা ফুটত যখন বুড়ো ডাক্তার এই পথ দিয়ে নেমে যেতেন নীচের গ্রামে। The world keeps on changing, but there is always something, somewhere, that remains the same. দেখতে দেখতে গাছের ফাঁক দিয়ে তেরছা করে সূর্যের নরম আলোরা এসে পড়ছে মাটিতে। কুয়শার ধোঁয়ায় ঢাকা আলো ও অন্ধকার। তবু কুয়াশা কাটছে বোঝা যাচ্ছে। বনের পথের শেষে উন্মুক্ত সবুজ ঘাসের প্রান্তর। দূর থেকে দূরে চলে গেছে পাহাড়ের ঢেউ। নীল পাহাড় রেখায় রেখায় এখনও জ্বলছে নিভছে দূরের টিমটিম করা গ্রামগুলোর আলো। ওইসব ঢেউয়ের মাথার ওপর দূর আকাশে ফুটে উঠেছে বরফ চূড়ার দীর্ঘ প্রাচীর।গ্রেটার হিমালয়। এবারে পথ চলার শেষ। একটা বড় পাথরের ওপর বসে পা ছড়ালেন তিনি।মি:বন্ড বা রাস্টি- যে নামেই ডাক না কেন তাঁকে। কোন ছোটবেলার থেকে সঙ্গী এই পাথরের সিংহাসন। এখানে বসেই জীবনের সব আক্ষেপ, না পাওয়া তুচ্ছ হয়ে যায়। এখানেই শুরু। এখানেই শেষ। মাঝখানে শুধু জীবনের হযবরল। বড় ভাগ্যবান মনে হয় নিজেকে এই আশ্রয়ে থেকে, বড় হয়ে, বুড়ো হয়ে। আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই।


" Once you have lived mountains, there is no escape. You belong to them."


লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্য নিয়ে আগ্রহী মাত্র। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।

116 views0 comments

Recent Posts

See All
2 e paa_edited.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page