top of page

ছোট গল্প: ভালো থেকো ইসমাইল ভাই

  • ..
  • Sep 16
  • 8 min read

অরণ্য মানে শুধু গাছের সবুজ, পাহাড়ের ধূসর, আর পলাশের লাল নয়। ঝর্ণার ছলছল, পাখির কলতান, কিংবা ভ্রমরের গুঞ্জনও নয়। অরণ্যে যারা থাকে, কাজ করে, তাদের জীবনে আছে একাকীত্ব, আছে নির্জনতা, আছে অবসাদ। থাকে প্রকৃতিকে ঘিরে গড়ে ওঠা আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতাও। সেই সব নিয়েই ছোটগল্প সাহিত্যিক ও পূর্বতন বনবিভাগের কর্তা নীল মজুমদারের কলমে।



ree


র্ষার দিনে চিখলধারার এই ফরেস্ট রেস্ট হাউসটি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যেমন লাগতো, এসে দেখি আজও ঠিক সেইরকমই লাগছে। সেই অযত্নের লন, লনের একপাশে শ্যাওলা পড়া পাথরের বেদি। তারও ওপাশে, অতিকায় সব অশ্বত্থ, আম, শ্যাওড়া গাছ একে অন্যের সঙ্গে শাখা প্রশাখা জড়িয়ে  ছায়াচ্ছন্ন, মলিন করে রেখেছে চারিদিক, যেমন থাকতো আগেও।

তখন সকাল হত এক আশ্চর্য্য শীতল জড়তায়। জানলা দিয়ে দেখতে পেতাম গাছের মাথা কুয়াশায় ঢাকা। দমকা হাওয়ায় সেই কুয়াশা, ধোঁওয়ার মত নিচে নেমে আসত। সকালের প্রথম কাপ চা খেতে খেতেই দ্বিতীয় কাপের বাসনা জেগে উঠত মনে।

অবশ্য কিছু বলার দরকার হতনা, অন্তর্যামী ইসমাইল সব জানত। আমার রুম থেকে প্রথম্ বারের খালি কাপ প্লেট নিয়ে যাওয়ার সময় দ্বিতীয় দফার চায়ের পট আর কাপ রেখে দাঁড়াত একপাশে। খুব সহৃদয় ভাবে জিজ্ঞাসা করত, ‘রাতে ঘুম হয়েছিল? আওয়াজ উবাজ তেমন কিছু পাননি তো?’

ওপরের দিকে হাত দেখিয়ে আমি বলতাম, ‘ধুপ ধাপ করে একটা আওয়াজ সন্ধে থেকেই পাই তো, কিন্তু সেটা যে কিসের –‘

দাড়িতে হাত বুলিয়ে ইসমাইল হাসত মৃদু মৃদু, বলত, ‘ওই তো ওদের দোষ সাহেব, সন্ধে হলেই তিনটি পরিবার বড় মারামারি, খাওয়া খাওয়ি করে’।

‘- তিনটি পরিবার, খাওয়া খাওয়ি করে ! কারা, কাদের কথা বলছো?’  আমি প্রশ্ন করতাম অবাক বিস্ময়ে। ইসমাইল বলত, ‘সিলিং আর টিনের চালার মাঝখানের জায়গাটায় ওরা থাকে সব বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে! ওই যে সিভেট বিল্লি না কি যেন বলে!’

মাত্র দশদিন আগে চাকরিতে যোগ দেওয়া আমি দিশেহারা হয়ে বলতাম, ‘সেকি! এখানে !’

‘- হ্যাঁ সাহেব, সন্ধে বেলায় তাড়ি টাড়ি খেয়ে ফেরে তো –!’ কাপ প্লেট ওঠাতে ওঠাতে ইসমাইল বলত, ‘আওয়াজ উবাজ তাও ভালো সাহেব। তবে যেদিন ওদের আওয়াজ পাবেন না, সেদিন’ – গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে ইসমাইল বলত, ‘সেদিন রাতটা একটু সাবধানে থাকবেন’ , বলতে বলতে আমাকে সম্পূর্ণ রহস্যের মধ্যে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানের কুয়াশার মধ্যে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যেত।

বাথরুমে গীজারের বালাই ছিলনা। বর্ষায় হিম ঠান্ডা জলে চান করা ছিল রীতিমত কষ্টদায়ক ব্যাপার। কিন্তু তার প্রয়োজন হতনা। অন্তর্যামী ইসমাইল একটু পরেই দু’বালতি গরম জল এনে বাথরুমে রেখে দিয়ে যেত। তারপর দ্রুত তৈরি হয়ে কাজে বের হচ্ছি যখন, একসময় এসে বলেও যেত, ‘ফিরতে দেরি হলে বাগানের দিক দিয়ে দিয়ে হেঁটে ঢুকবেন না যেন। সামনের গেটে হর্ণ দিতে বলবেন ড্রাইভারকে। আমি উঠে গেট খুলে দেব।



সামনের বড় গেটে রাত্রে তালা দেওয়া থাকে। বাগানের পেছনের ছোট গেট দিয়ে ঢুকলে কাউকে ডাকার দরকার হয়না। তাই ফীল্ড থেকে ফিরতে দেরি হলে অনেক সময়, ওদিকেই গাড়ি থামাতে বলে ঢুকে পড়তাম। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘কেন পেছনের গেটে আবার কি হল’ ?

চোখ বড় করে গোপন কথা বলার মত খুব কাছে এসে ইসমাইল বলত, ‘আর বলবেন না, এদিকে ভালুকের উৎপাত খুব বেড়েছে আজকাল। অদ্ভুত জীব, কখন যে কি’ – বলে অসমাপ্ত কথাটা হাওয়ায় ছেড়ে দিত ইসমাইল।


আমি চোখের সামনে ভূত দেখার মত আঁতকে উঠেছিলাম। লোকটার চোখ, নাক, ঠোঁট, কান কোনোটাই নিজের জায়গায় নেই, কেউ যেন ভয়াবহ ভাবে মুচড়ে দিয়েছে।  পরে একদিন ইসমাইলকে জিজ্ঞাসা করেছেলাম, ‘ওর কি কোন এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, নাকি কোন অসুখ বিসুখ, কিছু জানো?‘- ওসব কিছু নয় সাহেব’, চোখ গোল করে ইসমাইল বলেছিল, ‘বাবন মালির এই হাল করেছে ভালুক’।
- বলো কি, ভালুক !

ভালুক সম্মন্ধে ইসমাইলের এরকম ধারণার কারণ বুঝতে পেরেছিলাম বেশ কিছুদিন পরে। সকালে তৈরি হবার সময়, জানলা দিয়ে প্রায়ই চোখে পড়ত, একজন মালি বাগানে উবু হয়ে বসে কাজ করছে। সাধারণত, আমার ঘরের জানলার দিকে পেছন ফিরে বসত লোকটি। একদিন জানলার সামনে এসে আমার ড্রাইভারকে ডাকছিলাম বেশ জোরে। সেদিন ও চমকে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়েছিল। আর আমি চোখের সামনে ভূত দেখার মত আঁতকে উঠেছিলাম। লোকটার চোখ, নাক, ঠোঁট, কান কোনোটাই নিজের জায়গায় নেই, কেউ যেন ভয়াবহ ভাবে মুচড়ে দিয়েছে।  পরে একদিন ইসমাইলকে জিজ্ঞাসা করেছেলাম, ‘ওর কি কোন এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, নাকি কোন অসুখ বিসুখ, কিছু জানো?

‘- ওসব কিছু নয় সাহেব’, চোখ গোল করে ইসমাইল বলেছিল, ‘বাবন মালির এই হাল করেছে ভালুক’।

‘- বলো কি, ভালুক !’

আমার এই বিস্ময়ের উত্তরে  দুঃখ করে ইসমাইল বলেছিল, ‘এর চেয়ে তো বাঘে ধরা ভালো! কি আর হবে বলুন, জান যাবে, এই না! বাবন মালি কে দেখুন, একে কি বেঁচে থাকা বলে?’

ভালুকের হিংস্র স্বভাবের দায়িত্ব যেন আমার এইভাবে নালিশ করার মত ইসমাইল আরও নানা কথা বলত, ‘—কি আশ্চর্য্য দেখুন, নিরামিষাশী প্রাণি, রক্তমাংস কিছুই খায়না, তবু মানুষের ওপর কীসের যে এত আক্রোশ বুঝিনা। যেন রাগ পুষে রেখেছে। আর থাকেও তো একা, সারাক্ষণ একা। তাও ভালো রেস্ট হাউসের হাতার ভেতর কখনও দেখিনি, এই যা সান্ত্বনা’।

কাজের দিন কেটেই যেত মোটামুটি। নির্জন, নির্বান্ধব এই রেস্টহাউসে বর্ষাকালের ছুটির দিনগুলোই ছিল অসহ্য।  মেঘ আর কুয়াশার জন্যে আলো কম। সেই কম আলোয় গাঢ সবুজ, হালকা সবুজ, কালচা সবুজ, হলদে সবুজ, গাছের গুঁড়ির ওপর মসের শুকনো সবুজ, এসব রং এর তারতম্য বোঝা যেতনা মোটেই। আলো কম বলেই বেলা বাড়তনা কখনই, ঘড়ির কাঁটা নিজের নিয়মে ঘুরতো ঠিকই। কিন্তু দিন, সেই একই রকম ধূসর ফ্রেমে বাঁধা স্থির হয়ে থাকত, একই জায়গায়। রেস্ট হাউসের পেছন দিকের বড় বারান্দায় বসে পাঁতি পাঁতি করে খব কাগজ পড়তাম আমি। ছোট ছোট রঙ্গিন কাচের টুকরোর মত টাইল লাগান বারান্দায় ঝাড়ু লাগাতে লাগাতে ইসমাইল বলত, ‘একা হাতে সবদিক সামলাতে পারিনা সাহেব, একটু দের সবের হয়েই যায়। তার ওপর আজকাল হয়েছে আর এক জ্বালা। কুকুরের পিল্লাগুলোকে সামলাতে গিয়েও ফিজুল সময় যায়!’

ইসমাইল কুকুর পোষে জানি। কিন্তু তাদের বাচ্চা সামলে রাখতে হবে কেন, বুঝতে না পেরে আমি জিজ্ঞাসা করতাম, ‘কুকুর বাচ্চা সামলে রাখার কি দরকার ইসমাইল?’

‘- কি যে বলেন’, গলায় রীতিমত বিস্ময় ফুটিয়ে ইসমাইল বলত, ‘আগের দুটো বাচ্চা গেছে বিবটার পেটে।‘

স্থানীয় ভাষায় ‘বিবট’ বা ‘বিবটা’ বলে লেপার্ডকে। কিন্তু লেপার্ড এই রেস্ট হাউসের কাছে !

‘অকসর!’  ইসমাইল বেশ জোর দিয়ে বলত, ‘জঙ্গলে নয়, লেপার্ড জঙ্গলের ধারে কাছেই দেখবেন বেশি। আর সাহেব আপনি তো জানেন কুত্তা হল গিয়ে ওদের প্রিয় খাবার। আর শুধু কুত্তাই বা কেন,’ গলার স্বর নামিয়ে ইসমাইল বলত, ‘আমার তো ধারণা রোজিকেও –‘

‘- রোজি ! রোজি আবার কে ?’ আরও আশ্চর্য্য হয়ে আমি প্রশ্ন করতাম।

‘- এই দেখুন, কথা বলতে বলতে রান্নায় দেরি হয়ে যাচ্ছে’, বলতে বলতে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কুয়াশার মত অস্পষ্ট রেখে ইসমাইল চলে যেত।

ree

ক্রমশঃ চাকরিতে আমার বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছি, ইসমাইলের বন্যপ্রাণি বিষয়ক জ্ঞান কিন্তু একেবারে নস্যাৎ করে দেবার মত নয়। পাম সিভেটরা পুরোনো বাড়ির সিলিং এর ওপর জায়গা পেলে সত্যিই বসবাস করে। ওরা যে তাড়ি খেতে ভালোবাসে এও প্রমাণিত সত্য। যদিও তিনটি পরিবারের অস্তিত্ব ইসমাইল কি করে বুঝেছিল, আমাকে বলেনি। এখানের ভালুকদের পুরোপুরি নিরামিশাষী বলা না গেলেও, রক্তমাংসে তাদের সত্যি রুচি নেই। প্রজননের সময় ছাড়া তাদের একা থাকাটাও প্রমাণিত। তেমনি প্রমাণিত জঙ্গলের বাইরে লেপার্ডদের ঘোরাঘুরি করার কথা। এত প্রামাণিক কথাবার্তা বলে যে লোক, সে একটি বিশেষ জায়গায় এসে হোঁচট খায় কেন! না কি এটাই ওর গল্প বলার স্টাইল! একদিন সুযোগ বুঝে আবার কথাটা পাড়লাম ইসমাইলের কাছে।

সেদিন ঝড়ে গাছ পড়ে গিয়ে তার টার ছিঁড়ে পাওয়ার কাট হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর সন্ধে থেকেই মুষলাধারে বৃষ্টি। রাত্রে খাওয়ার পর আমার ঘরে লন্ঠন রাখতে এসেছিল ইসমাইল। সোজাসুজি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, এই রোজির ব্যাপারটা কি বলোতো ইসমাইল? আর কথাটা তুমি লুকিয়ে রাখার চেষ্টাই বা করো কেন?’

খুব সঙ্কুচিত হয়ে ইসমাইল বলল, ‘না না সাহেব, লুকিয়ে রাখার মত কিছু নয়। আসলে আমার সামনে কিছুই ঘটেনি। আর তাছাড়া এসব কথার জিক্র করাটাও তো ভালো কিছু নয়!’

‘বুঝলাম, কিন্তু কথাটা কি?’

‘- স্যার, অনেক বছর আগে, দু’তিনটি পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বেড়াতে এসেছিলেন এখানে, সম্ভবতঃ দিল্লির ওদিক থেকে। তিন চার জন সাহেব, মেমসাহেব, বেশ কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে। এদের মধ্যে রোজি বলে একটা বছর দশেকের মেয়ে ছিল। গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরতেন, হৈ হুল্লোড় করতেন সারাদিন। এমনি একদিন জঙ্গলের বাইরে, পাহাড়ের মাথায় একটা ফাঁকা মত জায়গায় পিকনিক চলছিল। বাচ্চারা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে খেলছে, মহিলারা টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খাবার দাবার বের করছেন, পুরুষরা তাস খেলতে বসেছেন একদিকে।  হটাৎ সকলের খেয়াল হল, রোজি নেই। তাই তো, কোথায় গেল রোজি! সকলে ডাকাডাকি, খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলনা রোজিকে। বিকেলের দিকে পুলিশকে খবর দেওয়া হল। পুলিশও খুঁজল তন্নতন্ন করে। জঙ্গল, পাহাড়, খাদ, নদী , কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু সব নিষ্ফল, রোজিকে কোথাও পাওয়া গেলনা।‘

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইসমাইল থামতেই আমি উদগ্রীব হয়ে বললাম, ‘তারপর?’

‘- তারপর আর কি, দশ বারো দিন পর ওঁরা সব ফিরে গেলেন। কিন্তু রেস্ট হাউসে শুরু হল এক অদ্ভুত ব্যাপার। সবদিন নয়, কোন কোন দিন। এই রেস্ট হাউস আর তার আসে পাশে, একটা বাচ্চা মেয়ের কান্না শোনা যায়। সেই সঙ্গে একটা রক্ত জল করা চিৎকার, কাহাঁ গয়ে মম্মি, পাপা, কহাঁ গয়ে!আমি কান্নার শব্দ পেয়ে কতবার সব খালি ঘর খুলে খুলে দেখেছি। টর্চ নিয়ে বাগানে গিয়ে দেখেছি। যখন যে ঘরে যান, মনে হবে পাশের ঘর থেকে শব্দ আসছে। আর মাঝে মাঝে ছুটে যাওয়ার শব্দ। সেই সব রাতে সাহেব, সিভেট বিল্লি গুলো চুপচাপ থাকে। আমার কুত্তা গুলোও কেঁউ কেঁউ করেনা একদম’।

স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেই রাত্রে আমার ঘুম আসেনি। রোজির অসুখী আত্মার উপস্থিতি টের পাইনি অবশ্য। তবে গলা নামিয়ে চড়িয়ে, চোখ বিষ্ফারিত করে বলা ইসমাইলের গল্পটি আমাকে সারা রাত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, ঘুম না আসা ঝড়ের রাতের প্রতিটি ঘন্টা, মিনিট মুহূর্ত্ত, আসলে কত বড়।

 পড়ুন লেখকের বনবিভাগের অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য রচনা: সাহেবের গামবুট


রং ঘষে গেলেও, বারান্দায় রঙ্গিন কাচের টুকরোর মত টাইল গুলো আজও আছে। সেই একই জায়গায় রাখা চেয়ার টেবল। বারান্দার পেছনে বেড়া দেওয়া বাগানে সন্ধের অন্ধকার নেমেছে। তার বাইরে গাছ পালার ফাঁক ফোকর দিয়ে টিমটিমে তারার মত চিখলধারা শহরের একটি দুটি আলো দেখা যাচ্ছে অনেকদূরে। আমি ছাড়াও আরও দু’তিনজন অতিথি আছেন আজ রেস্ট হাউসে। এখনকার খানসামা, আলি ছুটোছুটি করে সকলের দেখাশোনা করছে। রাতের খাবার কখন দেবে জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল। আমি বললাম, ‘একটা কথা বল আলি, অনেকদিন আগে সন্ধে বেলায় এই রেস্টহাউসের পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় লোকে মশাল হাতে নিয়ে, মুখে ‘হো হো’ শব্দ করতে করতে যেত ভালুকের ভয়ে। এখন সেরকম কিছু দেখছিনা তো।‘

আলি বলল, ‘আজকাল স্যার লোকজন বেড়েছে, ট্যুরিস্ট বেড়েছে অনেক। আজকাল আর আর ভালুক রাস্তায় বের হয়না। আগে হত, আমিও শুনেছি চাচার কাছে’।

‘তোমার চাচা কি এখানেই থাকতেন নাকি’?

‘জী, এই রেস্ট হাউসেই খানসামা ছিল, ইসমাইল খান’।

‘ইসমাইল তোমার চাচা! আরে কি আশ্চর্য্য, কাল থেকে আমি ওর কথাই ভাবছি। কোথায় আছে আজকাল ইসমাইল?’

‘চাচা তো স্যার সাত বছর হল রিটায়ার করেছে। এখানেই শহরের দিকে একটা বাড়ি করেছে, সেখানেই থাকে’। আলি বলল।

‘বাহ, চমৎকার। আর তুমি?’

‘আমি থাকি এখানে, খানসামার সরকারি কোয়ার্টারে’।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চাচার সঙ্গে দেখা টেখা হয়’?

‘জী স্যার হয় বৈকি। ছুটির দিনে আমি যাই। কখনও চাচাও আসে। একটু দূর হয়ে যায় অবশ্য।‘

‘তা- এবার যখন চাচার সঙ্গে দেখা হবে, ওকে বোলো, ওর কথা আমার খুব মনে পড়ে’।

একগাল হেসে আলি বলল, ‘জী জরুর’।

 

এই জরুর কথাটি যে আলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে, তখন বুঝতে পারিনি। পরের দিন দুপুরে আমার ফেরার সময় তৈরি হয়ে গাড়ির কাছে এসে দেখি, গলায় একটা মাফলার জড়িয়ে, হাতে টর্চ নিয়ে ইসমাইল দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। ‘আরে, ইসমাইল ভাই’, খুব উৎসাহিত হয়ে আমি বললাম, ‘কি খবর, সব খ্যায়রিয়ত?’

ওপরের দিকে হাত দেখিয়ে ঘাড় কাৎ করে বিনীত ভাবে হাসল ইসমাইল। অর্থাৎ, ঈশ্বরের কৃপায় ও ভালো আছে।

ভালো তো নিশ্চই। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেলেও ইসমাইলকে প্রায় অপরিবর্তিত বলা চলে। স্বাস্থ্য অটুট, মুখের হাসিটি অমলিন, আর কি চাই ভালো থাকার জন্যে! ‘এখানে আসার পর থেকেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। সেই সঙ্গে তোমার বলা নানা গল্পের কথাও।‘

আমার কথার উত্তরে আবার বিনীত ভাবে হাসল ইসমাইল। ও এইভাবেই হাসে চিরদিন। কিন্তু, এত কম কথার মানুষতো ও নয়। বর্ষাকালে চিখলধারা ঠান্ডা হয়ে যায় বলে অনেকে মাফলার টাফলার বাঁধে ঠিকই, কিন্তু দিনে দুপুরে ওর হাতে টর্চ কেন! আশ্চর্য্য হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি ইসমাইল, টর্চ?

আমার প্রশ্নের উত্তরে ওই জিনিষটা মাফলারের ওপর চেপে ধরে, চিঁচিঁ করে ইসমাইল বলল, টর্চ নয়, মেশিন, মেশিন!

‘- মেশিন! কিসের মেশিন? তোমার কি হয়েছে ইসমাইল?

বাঁ হাতের তর্জনীর ওপর ডান হাতের তর্জনী ঘষে আকুল ভাবে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করল ইসমাইল। হাতের পাঁচটা আঙ্গুল দেখাল। তারপর কন্ঠার হাড়ের ওপর প্রমাণ সাইজের একটা গর্ত দেখাল মাফলার সরিয়ে।

আর আমার জিজ্ঞাসা করার কিছু নেই। যেটাকে এতক্ষণ টর্চ ভাবছিলাম, আসলে সেটা স্বরযন্ত্রের কম্পন অস্পষ্ট ধ্বনিতে বদলে দেওয়ার একটা উপকরণ আঙ্গুলে আঙ্গুল ঘষে ইসমাইল খুব সম্ভব বোঝাতে চাইছিল সার্জারি। অনুমান করতে পারি , বছর পাঁচেক আগে কোনো শস্ত্রক্রিয়ায় ইসমাইলের স্বাভাবিক কন্ঠস্বর চিরদিনের মত হারিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে হারিয়ে গেছে আষাঢে গল্পের একটা জগৎ। হারিয়ে গেছে পারিবারিক কলহে লিপ্ত তাড়িখোর সিভেটরা, একা একা থাকার জটিল মানসিকতা গ্রস্থ সব ভালুকরা। হারিয়ে গেছে মা বাবাকে খুঁজে বেড়ান বাচ্চা মেয়ে রোজির অশরীরি কান্না। চোস্ত উর্দু উচ্চারণ, গল্পের মায়া, টান টান নাটকীয়তার সেই আশ্চর্য্য চুম্বক।

কথা বলতে ইচ্ছা করছিলনা। ওর কাঁধে হাত রেখে তবু কোনরকমে বললাম, ‘ভালো থেকো ইসমাইল ভাই, খুদা হাফেজ’।

আমার চাকরি জীবনের শুরুর দিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে থাকা ইসমাইল খান সস্নেহে হাসল। গলার ওপর মেশিন চেপে প্রাণপণ চেষ্টায় বলল, বর্ষার দিন, পাহাড়ি রাস্তা, একটু সাবধানে যাবেন। তারপর, গাড়ির জানলার খুব কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘এই রেস্টহাউসে থাকতাম স্যার, একা একা কি আর করব, ওই সব গল্প টল্প বলতাম। তবে, য়কীন করুন, আমার সব গল্পই কিন্তু বানানো গল্প  নয়’।


লেখক পরিচিতি: লেখক অবসরপ্রাপ্ত আই এফ এস আধিকারিক এবং ঔপন্যাসিক।


(লেখাটি আপনার কেমন লাগল, আপনার মতামত নিচে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই লিখবেন।)



ree

গল্পটি লেখকের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ 'চেনামুখ' গল্প সংকলনের অংশ। অরণ্য তো বটেই, জীবনের অন্য অঞ্চল থেকেও সংগ্রহ করে আনা উর্মিলার মত আরও অনেক মানুষের কথা নীল মজুমদারের কলমে । বইটি অনলাইনের সংগ্রহ করা যাচ্ছে অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্টে। উৎসাহীদের জন্য বই সংগ্রহের লিঙ্ক:




Comments


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
 

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page