২০২৫ সালের অতিবৃষ্টি: জলবায়ু পরিবর্তনের অশনিসংকেত
- ..
- 14 hours ago
- 4 min read
২০২৫ সালের বর্ষা সারাদেশে অস্বাভাবিক আচরন করল। দেশের একটা বড় অংশে বর্ষন সমস্ত স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেল, কোথাও বা আবার স্বাভাবিকের থেকে কম বৃষ্টিপাত দেখা দিল। দেশের বিভিন্ন অংশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি বিপুল আকার ধারন করেছে। এবং এই ধরনের ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।
বনেপাহাড়ে ডেস্ক

২০২৫ সালের বর্ষা ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক বিশেষ দাগ কেটে গেল। জাতীয় গড় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের তুলনায় মাত্র কয়েক শতাংশ বেশি হলেও বিভিন্ন রাজ্যে এর প্রভাব ছিল ভয়ঙ্কর—উত্তর ভারতে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বাধিক বর্ষণ, পশ্চিম ভারতে রেকর্ড বন্যা, আবার উত্তর-পূর্বে ঘাটতি। এ যেন চরম বৈপরীত্যের এক খেলা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মূলে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত।
বর্ষার শুরুতেই তার কেরালায় প্রবেশ ঘটে স্বাভাবিক সময়ের থেকে আট দিন আগে। জুন–জুলাই মাসে দেশের সামগ্রিক বৃষ্টিপাত গড়ের তুলনায় প্রায় ৬.৪% বেশি ছিল। তবে আঞ্চলিক স্তরে দেখা গেছে প্রকট বৈষম্য।
দিল্লি ও আশেপাশে (অগস্ট ২০২৫): ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি—৭২% বেশি গড়ের তুলনায়।
রাজস্থান ও লাদাখ—যেখানে সাধারণত শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে, এ বছর সেখানে গড়ের তুলনায় প্রায় ৬০% বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
কোস্টাল কর্ণাটক জুন–জুলাইতে সর্বোচ্চ ২,২৮১ মিমি বৃষ্টিপাত পায়, যা দেশের মধ্যে শীর্ষে।
হরিয়ানা ও পাঞ্জাব অগাস্টে ভয়াবহ অতিবৃষ্টির শিকার হয়। হরিয়ানায় এটি ছিল গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বর্ষাস্নাত অগাস্ট, আর পাঞ্জাবে বন্যায় প্লাবিত হয় এক হাজারেরও বেশি গ্রাম, ক্ষতিগ্রস্ত হয় লক্ষাধিক মানুষ।
বিহার ও ঝাড়খণ্ড: মাঝারি থেকে বেশি বৃষ্টিপাত, গঙ্গা ও উপনদীগুলির জলস্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়েছিল।
ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ: কয়েক দফায় নিম্নচাপ থেকে প্রবল বর্ষণ, উপকূলীয় প্লাবন।
একই সময়ে কিছু অঞ্চলে বর্ষার ঘাটতি উদ্বেগ তৈরি করেছে।
মেঘালয়, যেটি বর্ষার জন্য বিখ্যাত, এ বছর অস্বাভাবিকভাবে কম বৃষ্টি পেয়েছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য অংশ—আসাম, অরুণাচল, মণিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরার কয়েকটি জেলাও ঘাটতির শিকার হয়েছে।
অন্ধ্র প্রদেশের রেয়ালসীমা অঞ্চল মৌসুমের শুরুতে প্রায় ২৪% ঘাটতিতে ভুগলেও পরবর্তী মাসে হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে ঘাটতি মিলিয়ে গিয়ে উদ্বৃত্তে রূপ নেয়।

বর্ষাকালে কয়েকটি দিনে ভয়াবহ বৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে।
জুন মাসেই ৫০ মিমির বেশি বৃষ্টিপাতের ৪১৫টি ঘটনা রেকর্ড হয়, যার প্রভাব ছিল গুজরাট, কেরালা ও মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি।
উত্তরাখণ্ড, হিমাচল ও কাশ্মীরে ক্লাউডব্রাস্ট ও ভূমিধসে প্রাণহানি ও পরিকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ১০০ এর উপর প্রাণহানি ঘটেছে মানুষের। ধ্বসে উত্তরাখন্ডে বন্ধ হয়ে যায় চারধাম যাত্রা আর জম্মুতে বৈষ্ণোদেবী যাত্রা। গত বছর কেরালার ওয়াইনাড়ে অতিবৃষ্টিজনিত ভূমিধ্বসে ২০০ এর উপর ব্যক্তি মারা গেছিলেন।
অন্যদিকে পাকিস্থানেও ভয়াবহ বন্যায় ২ লক্ষের উপর বেশি মানুষ ঘরছাড়া। গোটা বর্ষায় ৮০০ এর উপর মানুষ মারা গেছেন পাকিস্থানে। লাহোরের মত শহর বন্যায় আক্রান্ত। যুদ্ধকালীন সম্পর্কের শৈত্য ঝেড়ে ফেলে এইসময়ে ভারত সরকার পাকিস্থানের সাতে যোগাযোগ করে আসন্ন বন্যার সতর্কবার্তাও দেয়। পাকিস্থানের National Disaster Management Authority এর চেয়ারম্যাম ইনাম হায়দার সামনের বছর আরো বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
পশ্চিমী ঝড় ও মৌসুমি বায়ুর দ্বন্দ্ব
বর্ষা মৌসুমে পশ্চিমী ঝড়ের প্রবল উপস্থিতি এ বছরের আবহাওয়াকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এবার মে মাসেই ৫–৭টি পশ্চিমী ঝড় সক্রিয় হয়েছে, যেখানে সাধারণত ১–২টির বেশি দেখা যায় না। এগুলি যখন বঙ্গোপসাগরের আর্দ্র মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়, তখন প্রবল বর্ষণের ঝুঁকি বাড়ে। হিমালয়ের পাদদেশে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের পেছনে এই মিথস্ক্রিয়ার বড় ভূমিকা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা একে কেবল আবহাওয়ার স্বাভাবিক ওঠানামা হিসেবে দেখছেন না। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ভারতীয় মৌসুমি বায়ুর আগমনকে ক্রমশ অনিশ্চিত ও তীব্র করে তুলছে।
উষ্ণায়নের ফলে বাতাসে জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বেড়েছে।জলবায়ু উষ্ণায়নের ফলে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বেড়েছে। ফলে স্বল্প সময়ে প্রবল বর্ষণ হয়ে থাকে—এটি ২০২৫ সালের অতিবৃষ্টির এক উল্লেখযোগ্য চালিকা শক্তি। পশ্চিম ও উত্তর ভারতে অস্বাভাবিক পরিমাণ বৃষ্টিপাতের প্রধান কারণও এটি।
গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৭০ বছরে ভারতে অতিবৃষ্টির ঘটনা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি মৌসুমি বায়ুকে অস্বাভাবিক শক্তি জুগিয়েছে তার বাষ্পধারন ক্ষমতা বাড়িয়ে, যা অতিবৃষ্টিকে তীব্র করেছে। হিমালয়ের হিমবাহ দ্রুত গলছে। এতে হঠাৎ গ্লেসিয়াল লেক ফেটে যাওয়া ও ধ্বংসাত্মক বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে।অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রায় হিমালয়ের উচ্চতায় অবস্থিত গ্লেসিয়াল লেকগুলির ধ্বংস হয়ে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করছে। এমন গ্লেসিয়াল লেকের ভেঙ্গে পড়াতেই ২০১৩ সালে কেদারনাথে ভয়ানক দুর্যোগ ঘটেছিল।
নগরায়ণ ও মানবসৃষ্ট কর্মফল
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে অবাধ নগরায়ণ। শহরের খাল-বিল ও জলাভূমি ভরাট হওয়ায় প্রাকৃতিক নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কংক্রিটের জঙ্গলে মাটির শোষণ ক্ষমতা নষ্ট হওয়ায় সামান্য অতিবৃষ্টিও শহরকে জলাবদ্ধ করে ফেলছে। ফলত, দিল্লি, মুম্বাই কিংবা বেঙ্গালুরুর মতো শহরগুলি পরিণত হচ্ছে জলবায়ু দুর্যোগের হটস্পটে।
ভবিষ্যতের পথ
২০২৫ সালের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে এক নির্মম সত্য দাঁড় করিয়েছে—ভারতের মৌসুমি বৃষ্টি আর কেবল প্রাকৃতিক ছন্দে চলছে না, বরং বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে।
এখন জরুরি তিনটি পদক্ষেপ:
জলবায়ুর সাথে অভিযোজন : কৃষি, নগর পরিকল্পনা ও জলসম্পদ ব্যবস্থাপনায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের ভাবনা অন্তর্ভুক্ত করা। যেমন চেন্নাই তার হারিয়ে যাওয়া জলাভূমি পুনরুদ্ধারে মন দিয়েছে ভয়াবহ বন্যার থেকে শিক্ষা নিয়ে। দিল্লিতে জল যাতে ভূ-গর্ভে যেতে পারে এমন ফুটপাত বানানোর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রকৃতির সংরক্ষণ: জলাভূমি, নদী ও বনভূমি রক্ষা করা, যাতে তারা প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে।
নগর পুনর্বিন্যাস: শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা পুনর্গঠন, খাল, নদীর পুনরুদ্ধার এবং সবুজ পরিসর বাড়ানো।
আরো পড়ুন: ধ্বসের কবলে যোশীমঠ: একটি পর্যালোচনা
ভারতে ২০২৫ সালের অতিবৃষ্টি এক কঠিন সতর্কবার্তা। জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর ভবিষ্যতের সমস্যা নয়, বরং বর্তমানের কঠিন বাস্তবতা। যদি এখনই পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে আগামী বছরগুলোতে অতিবৃষ্টি ও খরার চক্র আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে গভীর সংকটে ফেলবে।
তথ্যসূত্র:
India Meteorological Department (IMD) – Rainfall Statistics and Monsoon Bulletins, 2025
https://mausam.imd.gov.in
Economic Times – Why is India witnessing heavy rainfall? IMD explains the science behind 1200% excess rains (2025)
Link
Down To Earth – Monsoon rains 2025: How climate change intensified India's rains (2025)
Link
AP News – Climate change makes South Asia's monsoon season more prone to floods, landslides and heavy rains (2025)
Link
Time Magazine – Urbanization is intensifying India’s summer heat and rain (2025)
Link
The World (PRI) – Monsoon mayhem: How climate change is fueling floods and landslides across India (2025)
Link
Council on Energy, Environment and Water (CEEW) – Predicting erratic, unseasonal monsoon and rainfall patterns in a changing climate (2025)
Link
Reuters – India’s monsoon set to cover entire country over a week early (2025)
Link
Times of India – Rainfall likely to be below normal in NE: IMD (2025)
Link
Wikipedia – Western Disturbance (for climatological background)
Link
Wikipedia – Bharat Forecasting System (for weather prediction systems)
Link
Comments