top of page

প্রকৃতি নাকি উন্নয়ন! খাদের ধারে হিমাচলের ভবিষ্যৎ

  • ..
  • Jul 22, 2023
  • 5 min read

ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক সম্পত্তি ও জীবনহানি ঘটল হিমালয়ের সুন্দর রাজ্য হিমাচল প্রদেশে। এই কি শেষের শুরু? দায়ী কে? প্রকৃতি না মানুষের অপরিসীম লোভ! উত্তর খুঁজছেন ঋতিঙ্কর বসু




একদিকে প্রয়োজন রাজ্যের সার্বিক উন্নয়ন। শিল্প হবে, কর্মসংস্থান হবে। গরিবিয়ানা, বেকারত্ব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। তার জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন জল, বিদ্যুৎ, ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট সঙ্গে দ্রুত গতির ইন্টারনেট। আর এই গোটা বিষয়টা আপাত দৃষ্টিতে সমতল এলাকায় সম্ভব করে তোলা যত না সহজ, তার থেকে কয়েকগুণ কঠিন যদি এলাকাটাই পাহাড়ে ঘেরা হয়। আর অন্যদিকে সেই পাহাড় যদি সবুজে আচ্ছন্ন থাকে, তাহলে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কালঘাম ছুটে যায়। কারণ, সবদিক বিচার-বিবেচনা না করে যদি স্রেফ উন্নয়নের ধ্বজা ওড়াতেই হয় তাহলে ভবিষ্যৎ তেমন একটা সুখকর হয় না। আর সেদিকেই আপাতত এগিয়ে চলেছে হিমাচল প্রদেশ। পাহাড় যেখানে বাউন্ডারি, অরণ্য যেখানে বাহারি- সেই হিমাচল প্রদেশ। এখানে পা পড়লে বিদেশ যাবার প্রয়োজন পড়ে না। মনে হয় সত্যিই যেন নন্দন কানন। তবে সেই কাননে আজ ফুল শুকোনোর দিন আসন্ন। যেভাবে উন্নয়নের স্বার্থে প্রকৃতিকে থোড়াই কেয়ার মার্কা যজ্ঞ চলছে, তারপর হিমাচল প্রদেশের মানচিত্রে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে পড়াটা কি খুব অস্বাভাবিক ঘটনা?


জঙ্গলের প্রয়োজন কেন? এই সহজ প্রশ্নের উত্তর প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে। কিন্তু আমরা কখনো কখনো জঙ্গলের অন্য একটা দিকের ভূমিকা নিয়ে খুব একটা ওয়াকিবহাল থাকি না। জঙ্গল কর্মসংস্থান, কাঁচামাল, একটা শিল্প গড়ে তোলার পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যায়। অর্থাৎ প্রকৃতিকে অবহেলা করে শিল্প নয়। বরং শিল্পের সম্প্রসারণ প্রকৃতির অক্ষয়, অমর আয়ু কামনা করেই। অবশ্য কামনা অনেক কিছুই আমরা করে থাকি। তার কতটুকুই বা আমাদের ভাগ্যে জোটে? হিমাচল প্রদেশের ভাগ্য সেদিক থেকে খানিকটা খারাপই বলতে হবে। কারণ গাছ কাটার উৎসব।


ডিফরেস্টেশন- এই কথাটার অর্থ শুধু জঙ্গল থেকে গাছ সাফ করাই নয়। প্রয়োজনের স্বার্থে এক জায়গার গাছ কেটে আমরা যদি আরেকটি জায়গায় সবদিক বিবেচনা করে সমান সংখ্যার গাছ না লাগাই তখনই সেটা ডিফরেস্টেশনের সংজ্ঞার আওতায় চলে আসে। পশ্চিম হিমালয়ের একটি অংশ হিমাচল প্রদেশ। যার ৬৬% এলাকা জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যে মাত্র ২৬% ঘন জঙ্গলাবৃত। এই সংখ্যাটা ১৯৮০-৮১ সালে ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশের কাছাকাছি। হিমাচল প্রদেশে কত দ্রুত নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে, সেই নিয়ে একটি সমীক্ষা করা হয়। ফলাফলটা চমকে দেবার মতন। ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত হিমাচল প্রদেশ হারিয়েছে ৫.০২ কিলোহেক্টর গাছে ভরাট এলাকা। তারই ফলস্বরূপ ভূমিকম্প, ক্লাউড বার্স্ট বা মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি, হড়পা বান। প্রকৃতির রক্তচক্ষু যা কিনা আসলে ইঙ্গিত সেই মহাদুর্যোগের, কিন্তু দিনের শেষে কি আদৌ সরকারের তরফ থেকে সবিশেষ সচেতন থাকার তাগিদ লক্ষ্য করা গেছে? হিমাচল প্রদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কোন কোন জায়গায় সরকার বিশেষ নজর দিয়েছে? সেগুলো বললে লেখার গতি এগিয়ে নিয়ে যেতে আরও সুবিধে হবে।


সরকারের লক্ষ্য এখন গ্রিন মোবিলিটি। গাছ কেটে গ্রিন মোবিলিটি! একটু অবাক হবার মতনই। বৈদ্যুতিক গাড়ি, জল বিদ্যুৎ , সৌর শক্তি- অর্থাৎ অপ্রচলিত শক্তিখাতে হিমাচলপ্রদেশ একটা নজির তৈরির জন্য চরম ব্যস্ত। সবথেকে হাস্যকর বিষয় হল, এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়েই মাটির শক্তি কমছে। মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়ছে তার ধরে রাখার ক্ষমতা। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সপাটে। ঘনঘন ধস নামছে, ভূমিকম্প হচ্ছে। অবশ্য এসবের তোয়াক্কা করে কজন? অদূর ভবিষ্যতে হয়ত গাঢ় সবুজ পাতায় ঘেরা গাছগুলো তাদের চিরহরিৎ কৌলীন্য হারাবে। প্রকৃতি ঘেরা রাজ্যে তৈরি হচ্ছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ধুলো এবং ধোঁয়ার লালন-পালনে বুড়িয়ে যাবে হিমালয়ের কোলে বেড়ে ওঠা এই প্রকৃতি। জানা যাচ্ছে, হিমাচল প্রদেশ নিজের আয় ধরে রাখতে পেরেছে ট্যুরিজম এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। গোটা রাজ্যে ৩৩-টি হাইড্রোইলেকট্রিক প্রোজেক্ট চলছে। যদিও এই রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ থাকেন গ্রামাঞ্চলে এবং তাদের উপার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম চাষবাস। তবে এখানেই শেষ নয়। পাইপলাইনে রয়েছে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি এবং ফারমাসিউটিকাল ইন্ডাস্ট্রি। অর্থাৎ শিল্পোন্নয়নের আগ্রাসী হাঁ-এর মধ্যে পড়ে গিয়েছে রাজ্যের প্রকৃতি। প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই প্রভাব পড়বে আবহাওয়া, জঙ্গলে থাকা প্রাণীকুলের বাস্তুতন্ত্রে। সুতরাং সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর দিশা...সেগুড়ে বালি।


হিমাচল প্রদেশের ভবিষ্যৎ যে খুব একটা সুবিধের নয় এই নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিয়েছে ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ভারতের এই পার্বত্য এলাকাটি দিনেদিনে আরও নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। সারমর্ম এই যে হিমাচল প্রদেশের ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবার পিছনে এক এবং একমাত্র কারণ মানুষের উন্নাসিকতা এবং প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত অপদার্থসুলভ মনোভাব। এই রাজ্যের ইকোলজি আজ এতটাই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে যাচ্ছে যে ভবিষ্যতে সরকারের খরচ আরও বেড়ে যাবার সম্ভাবনা সমূহ। একইসঙ্গে মানুষের প্রাণ, অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থান। কয়েকদিন আগেই যে প্রলয় ঘটে গেল সেই খেয়াল সকলেরই রয়েছে। ২৪ জুন বর্ষা ঢোকে হিমাচল প্রদেশে। ভরা বর্ষার মরশুমে হিমাচলে দৈনিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৮ মিমি-এর আশেপাশে। সেখানে একদিনে বৃষ্টি হল ৯০ মিমি! বিয়াস নদী উত্তাল হল। ছন্দ হারাল প্রকৃতি। তারই রুদ্ররূপ দেখে ফের নড়েচড়ে বসল সরকার। দিন দুই-তিনের তাণ্ডবে সরকারের ক্ষতি ৫ হাজার কোটি টাকা। আর প্রশ্নটা সেখানেই।


প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উন্নয়ন অসম্ভব। প্রয়োজনে বিকল্প শিল্প নিয়ে আসা প্রয়োজন। পায়ের চটি মাথায় তোলা উচিৎ নয়। সেটা করলেই ছন্দপতন। মানে, যাহা চলে সমতলে তাহাই কি পাহাড় বলে? সেটা হতে পারে না। সমতলের ভৌগলিক চরিত্র এবং পাহাড়ের ভৌগলিক চরিত্র এক নয়। সেখানে দাঁড়িয়ে একের পর এক শিল্পকে ডেকে আনা, আদৌ সেটা পাহাড়ের আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত কিনা- আমরা কি সেদিকে ন্যূনতম দৃষ্টিপাত করি?


এবার হিমাচলের ভৌগলিক সৌন্দর্যের দিকে নজর ঘোরানো যাক। ২০০৩ সালের ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তথ্য মোতাবেক হিমাচল প্রদেশে অরণ্য ছড়িয়ে রয়েছে ৬৬.৫২% এলাকা জুড়ে। এখানকার গাছপালা উচ্চতায় অনেকটা। পুরোটাই রোদ, বৃষ্টি এবং ঠাণ্ডার সঙ্গে মানানসই। রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ওষধি গাছ। রয়েছে সুগন্ধি গাছ। গাছের বৈচিত্র্য হিমাচলের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর যত গাছ, তত প্রাণীজগতের হাসিখুশি বিস্তার। এখানে প্রায় ৪৬৩ প্রজাতির পাখি, ৭৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮০ প্রজাতির মাছের দেখা মেলে। এখানেই রয়েছে বড় বড় পাঁচটি উদ্যান। যার মধ্যে অন্যতম গ্রেট ন্যাশনাল হিমালয়ান পার্ক।


হিমাচল প্রদেশের রাজ্য জিডিপি-র দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখব হিমাচল প্রদেশে বেকারত্ব তুলনামূলকভাবে অন্য রাজ্যের থেকে কম। তার একটা প্রধান কারণ কৃষিকাজ। রাজ্যের ৯ শতাংশ মানুষ চাষাবাদ করেন। এখানকার অন্যতম প্রধান ফল আপেল। যা রফতানি হয়ে যায় নিরন্তর। এই রাজ্যের হরটিকালচার যথেষ্ট ভালো। গ্ল্যাডিওলা, কারনেশন, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, টিউলিপ, লিলি, গোলাপের চাষ হয় ভালোরকম। ফল এবং ফুল- তাদের যত্নে লালন-পালন করা হয় এবং বাজারজাত করা হয়। এই রাজ্যের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত ট্যুরিজম। মুশকিল হচ্ছে এই ট্যুরিজমের ঘূর্ণাবর্তে পড়েও কিন্তু ক্ষইতে শুরু করেছে হিমাচলের স্বাস্থ্য।


একটা হাড় হিম করা তথ্য দিই আপনাদের। দুর্যোগের যদি একটি তালিকা তৈরি করা হয় তার অধিকাংশটাই ভয়াবহ রূপ নেবে যদি হিমাচল প্রদেশে আছড়ে পড়ে। ছাম্বা, কিন্নর, কুলু, কাঙরার কিছুটা অংশ এবং সিমলা- এই কয়েকটি এলাকার ভবিষ্যৎ সামান্য দুর্যোগের ধাক্কা সামলাতে পারবে না। এছাড়া কাঙরা, মাণ্ডি, উনা, লাহুল এবং স্পিতি রয়েছে বড়সড় ঝুঁকির মধ্যে। এটা ঠিক যে, হিমাচল প্রদেশে ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেই মানব উন্নয়ন সূচকের কাঁটা পেন্ডুলামের মতন ডানদিক-বাঁদিকে দুলতে থাকে। সুতরাং নজর জোরালো করতে হয় উন্নয়নের দিকে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, জল, আরও শিল্পের প্রবেশ। কিন্তু সবটাই হওয়া উচিৎ ভারসাম্য রেখে। না-হলে দিনের শেষে মৃত্যু, ব্যাধি, খাদ্যাভাব, মানুষের রোষ আরও কত কী না দেখতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত হিমাচলের মাটি আজ নড়বড়ে। যেভাবে বছর বছর পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে, যে গতিতে সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে এই রাজ্যের সর্বত্র প্রকৃতি বিরূপ মনোভাবের ছবিগুলো এঁকে চলেছে, তারপর হিমাচলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ আরও জোরালো হওয়াটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ পরিস্থিতি নিত্যদিন জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে কি শিল্প সম্ভব নয়? মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব নয়? মানুষের নিত্যদিনের মানের সূচক-বৃদ্ধি সম্ভব নয়? হিমাচলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির দিক থেকে মুখ আর কতদিন ফিরিয়ে রাখবেন সকলে? উন্নয়নের যজ্ঞমোহে যেন হিমাচল নিজেই না ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় কালগর্ভে।



লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় সংবাদকর্মী। নেশা লেখালিখি, সিনেমা এবং প্রকৃতি। বনেপাহাড়ের পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক।

Comentários


474525369_1074216644505260_833710345513391369_n.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page