top of page
  • ..

সামরিক প্রকল্পের খাতিরে অনেক বনাঞ্চলের আইনি রক্ষাকবচ তুলে দিতে চাইছে সরকার

সামরিক প্রকল্প খাতে আরো বেশি জমির জন্য ও অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের জন্য অনেক বনাঞ্চল যা এতদিন আইনি সুরক্ষা পেত তা আইনের পরিবর্তনে হারাবে সেই সুরক্ষা কবচ। যার মধ্যে রয়েছে প্রায় গোটা হিমালয় ও উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিম অরণ্যও। কেমন হবে তার প্রভাব? আলোচনায় কুন্দন পান্ডে





সরকার প্রস্তাবিত ফরেস্ট (কনজারভেশন) অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২৩ অনুযায়ী অরণ্যের বেশ কিছু এলাকার ভবিষ্যৎ পড়তে পারে অনিশ্চয়তার মধ্যে। থাকবে না আইনের সুরক্ষাকবচ। গত ২৯ মার্চ ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট লোকসভায় এই বিল পেশ করেছিল। মুখ্য কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, দেশের নিরাপত্তাজনিত কারণে দ্রুত কিছু প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন পড়েছিল ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট, ১৯৮০-র সংশোধন নিয়ে আসা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা অন্য ভয় পাচ্ছেন। জঙ্গলের এলাকা যদি সংরক্ষণের আওতামুক্ত করা হয়, তাহলে ব্যবসার স্বার্থে সেই সকল এলাকা ব্যবহার করা হতে পারে।

অরণ্য এবং তার সম্পদ সংরক্ষণের আইনি কবচ ছিল এই ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট। আজ ফাঁসের গেরো আলগা হলে জঙ্গলের কোন সকল এলাকার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে জানেন? রেল লাইনের ধারে যত জঙ্গল রয়েছে, অথবা সড়কের ধারে (০.১০ হেক্টর এলাকা পর্যন্ত), বৃক্ষরোপণ বা বনসৃজন হয়েছে এমন এলাকা, সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমানা , লাইন অফ কন্ট্রোল বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের ১০০ কিমি এলাকা আইনের হাতে বাঁধা থাকবে না। এই বিল লাগু হলে নিরাপত্তাজনিত পরিকাঠামো তৈরির জন্য ১০ হেক্টর পর্যন্ত জমির ক্ষেত্রেও ছাড় পাওয়া যাবে। ঐ এলাকা ব্যবহার করা হবে প্রতিরক্ষাজনিত বিভিন্ন প্রোজেক্ট, আধাসামরিক বাহিনীর ক্যাম্প অথবা পাবলিক ইউটিলিটি প্রোজেক্ট যা কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। একইসঙ্গে বামপন্থী উগ্রবাদী অধ্যুষিত এলাকার ৫ হেক্টর পর্যন্ত জমি সংশোধনী বিলের সৌজন্যে আইনের পরিধি থেকে বেরিয়ে যাবে।

পরিবেশবিদ দেবাদিত্য সিনহা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমাদের দেশে ‘জঙ্গল’ শব্দের সরকার নির্দেশিত কোন ঠিকঠাক ব্যাখ্যা নেই। ১৯৯৬ সালে টি.এন.গোদাবর্মন এবং ইউনিয়ন গভর্নমেন্টের মধ্যে আইনি লড়াইয়ে যে কারণে সুপ্রিম কোর্ট বহু জঙ্গলকে আইনি সুরক্ষার মধ্যে নিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। নতুন সংশোধনী বিল সেই সকল এলাকার সংরক্ষণকে আবার প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেবে।

বহু বিশেষজ্ঞের ধারণা, বিলে নির্দেশিত ‘public utility specified by central government’ বিষয়টাই আসলে অস্পষ্ট। ফলে জায়গা অপব্যবহারের সুযোগ থেকে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

আবহাওয়া সংক্রান্ত লক্ষ্যপূরণের জন্য এই বিলে উল্লেখ রয়েছে। মূলত আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনের জন্যই নাকি এই বিল সংশোধনের তড়িঘড়ি উদ্যোগ। দূষণের মাত্রা একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনা, ফরেস্ট কার্বন স্টকের পরিমাণ একই রাখা অথবা বৃদ্ধি করা, আর ২০৩০ সালের মধ্যে ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমান একটি কার্বন সিঙ্ক তৈরি করা, জঙ্গল নির্ভর অর্থনীতির উন্নতি, সঙ্গে সমাজ এবং প্রকৃতির লাভ কিসে হবে- এই এতোগুলো বিষয় খেয়াল রেখেই বিল সংশোধনের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।

পিসিসিএফ বা ফর্মার প্রিন্সিপাল চিফ কনজার্ভেটর অফ ফরেস্ট বি.কে.সিং একটা বিশেষ জায়গায় নজর দিতে বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, বনাঞ্চলের যে ১০০ কিমি জায়গাকে স্ট্র্যাটেজিক কারণে ব্যবহার করা হবে বলা হয়েছে, তার মধ্যে কোন এলাকা পড়তে পারে জানেন? দেশের উত্তর-পূর্ব এলাকা এবং হিমালয় অঞ্চলের অনেকটাই। পরিবেশের জন্য ঐ জায়গাগুলো যথেষ্ট স্পর্শকাতর। একইসঙ্গে বহু বন্য প্রাণীর একমাত্র থাকার জায়গা।

তিনি যোগ করেছেন, জঙ্গলের গুরুত্ব কতটা আর বাস্তুতন্ত্রের জন্য সেই জঙ্গল কতটা দায় নিজের কাঁধে নিতে পারে, তার সর্বোত্তম উদাহরণ কর্ণাটকের কোদাগু জেলা। ৪ লক্ষ ১০ হাজার ৭৫ হেক্টর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই জেলার পুরোটাই জঙ্গল। আর এই গোটা বনাঞ্চলের চার ভাগের মধ্যে এক ভাগের একটু বেশি, ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৬১৫ হেক্টর এলাকাকে জঙ্গল বলেই সরকারিভাবে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, জঙ্গলের বাকি অংশটা স্থানীয় পরিবেশের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। “আমরা জঙ্গলের যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলেছি, এবার বন্ধ হওয়া প্রয়োজন”।

জঙ্গল আসলে কী

অরণ্য নিধন রুখতেই দ্য ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট, ১৯৮০ নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সেই আইনে জঙ্গল কী, তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা নেই। টি.এন.গোদাবর্মন এবং ইউনিয়ন গভর্নমেন্টের মধ্যে যে আইনি ঝামেলা চলছিল, তারই প্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে দেশের শীর্ষ আদালত সাফ জানিয়ে দেয়, বনজঙ্গল সেটাই যা অভিধানে বলা আছে। এই রায়ের পর সরকারের রেকর্ডে থাকা সকল বনাঞ্চলগুলোয় ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্সের প্রয়োজন পড়ে। যা একমাত্র দিতে পারত মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ।

“যেসকল এলাকা বা জমিকে ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট, ১৯২৭ বা এই সংক্রান্ত যে কোন আইনে জঙ্গল বা অরণ্য হিসেবে নির্দেশিত করা হয়েছে, সেই সকল এলাকা আওতাভুক্ত হবে”। অন্তত তেমনটাই বলা রয়েছে এই বিলে। যা আসলে রিজার্ভড ফরেস্ট, প্রোটেকটেড ফরেস্টের মত এলাকা।

আবার অন্য একটি ধারা অনুযায়ী, এই বিল মারফৎ জানা গিয়েছে, ১৯৮০ সালের ২৫ অক্টোবর বা তার পর সরকারি রেকর্ডে যে সকল এলাকা বন হিসাবে চিহ্নিত রয়েছে, সেগুলো এখনও আসবে এই আইনের আওতায়।

পরিবেশবিদ দেবাদিত্য সিনহার সংশয় তো এখানেই। এই সংশোধন অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের আগে থেকে রিজার্ভ ফরেস্টের আওতায় যেসকল জঙ্গল পড়ছে না অথচ সরকারি রেকর্ডে রয়েছে, সেই সকল বনাঞ্চল এই অ্যাক্টের বা আইনের আওতায় পড়বে না। এটা সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯৬ সালের যে রায়ে বলা আছে যে সরকারি নথিতে থাকা যে কোন অরণ্য আইনি সুরক্ষা পাবে-তার পরিপন্থী।

কমিটি নিয়ে বিতর্ক

জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটিতে বিলটি পাঠানো হয়েছে। যদিও প্রাক্তন পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ যিনি নিজে রাজ্যসভার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি, পরিবেশ, জঙ্গল এবং আবহাওয়া পরিবর্তন সংক্রান্ত পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান, তিনি নিজেও বিষয়টা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। ২৯ মার্চ, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়কে তিনি একটি চিঠি লেখেন। তিনি বলেন, “স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রাথমিক কাজই হল বিলগুলি পরীক্ষা করে দেখা। আর সেটা তখনই সম্ভব যদি সেই বিল তাদের বিবেচনা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ফরেস্ট (কনজারভেশন) অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২৩-কে জয়েন্ট কমিটিতে রেফার করা হচ্ছে। এর মানে পরিষ্কার। ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট ইচ্ছাকৃতভাবে স্ট্যান্ডিং কমিটিকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। যেখানে সকল অংশীদারদের এই বিলটি সম্পূর্ণভাবে খতিয়ে দেখার পূর্ণ আইনি অধিকার রয়েছে”।

এছাড়া আরও একটা সমস্যার কথা তিনি তুলে ধরেছেন। জয়েন্ট কমিটির জন্য সরকার নির্বাচিত রাজ্য সভার যে সদস্যরা রয়েছেন, সেই তালিকায় বিরোধীদের কেউ নেই। ফলে গোটা বিষয়টাই বড় একপেশে হয়ে যাচ্ছে।

৬ এপ্রিল রমেশ আরেকটি চিঠি লেখেন, যেখানে আঙুল তোলা হয়েছে সরাসরি রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের দিকে। রমেশ অভিযোগ তুলেছেন যে, স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রাথমিক কাজ বা দায়িত্বগুলোকেই কার্যত অবহেলা করা হচ্ছে। এরপর রমেশের কাছে একটি চিঠি এসে পৌঁছয়। রাজ্য সভা সচিবালয়ের সচিব রঞ্জিত পুনহানি রমেশকে তাঁর আপত্তির জায়গাগুলি সরাসরি সংক্ষিপ্ত আকারে জানাতে বলেছেন।

এই বিলের জন্য জয়েন্ট এবং সিলেক্ট কমিটিই হল সেই কমিটি যাদের তৈরি করা হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু কারণের জন্য। প্রয়োজন মত তারা কাজ সমাপ্ত করবে এবং রিপোর্ট জমা দেবে। এরপর আর এই কমিটিগুলির অস্তিত্ব থাকে না। স্ট্যান্ডিং কমিটি হল স্থায়ী ও নিয়মমাফিক কমিটি সময়ের ব্যবধানে যারা তৈরি হয় যা আইনসভার আইনগুলি নিয়ে আলোচনা করে এবং লোকসভায় গতিপ্রকৃতি বিবেচনা করে ।



ভাষান্তরঃ ঋতিঙ্কর বসু


ছবিতে হিমালয় এলাকার করবেট ন্যাশানাল পার্ক।


মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2023/04/legal-protection-of-certain-forest-land-to-be-removed-as-government-pushes-security-projects/







2 e paa_edited.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page