ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ যোশীমঠ শহর আজ ধ্বসের কবলে পড়ে বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে। এর ইঙ্গিত কি আগে থেকেই ছিল? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? আলোচনায় সত্যম কুমার ও শৈলেশ শ্রীবাস্তব।
ঋষি দেবী যোশীমঠের ৩৭ বছরের এক মহিলা। তিনি সেখানকার একটি সরকারি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন পরিবারের সাথে। মাইনাস ৩.৫ ডিগ্রী তাপমাত্রায় অল্প কিছু গরম পোশাকই তাদের সম্বল। তার ৬ মাসেরবাচ্চার স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি উদ্বেগে। তার মত এমন অনেক পরিবারের মানুষ এখন এভাবেই ধ্বসের কবলে পড়া যোশীমঠে অস্থায়ী সব আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছেন।
জানুয়ারির ৯ তারিখের তথ্য অনুযায়ী এখানকার ৯টি ওয়ার্ডের প্রায় ৬৭৮টি ঘরে ফাটল দেখা দেওয়ায় সেগুলি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
সমুদ্রতল থেকে ১৮৭৫ মিটার উচ্চে অবস্থানকারী যোশিমঠ অনেক অভিযানের, ট্রেকিংপথের, তীর্থযাত্রার প্রবেশদ্বার। বদ্রিনাথ ও হেমকুন্ড সাহিবের মত পবিত্র তীর্থ ও শীতকালীন স্কি রিসোর্ট আউলি যাবার পথে যোশিমঠ বিরতি নেবার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান।পর্যটক ও তীর্থযাত্রীর সংখ্যা প্রতি বছর বাড়তে থেকেছে যা স্থানীয় মানুষের রোজগারের সহায়ক হয়েছে, কিন্তু শহরটির উপরে নানারকম চাপ তৈরিও করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভঙ্গুর এই পর্বত অঞ্চলে দ্রুত রাস্তাঘাট ও বিলাসবহুল হোটেলের নির্মাণ তার সহনক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছে।
রাণীচুরির কলেজ অব্ ফরেস্ট্রির পরিবেশ বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক এস পি সতি যোশীমঠের এই বিপর্যয়ের মূল কারণগুলি নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করছিলেন।তাঁর বক্তব্য, "যোশীমঠ আসলে প্রাচীন এক ধ্বসের ধ্বংসাবশেষের উপরে গড়ে উঠেছিল।কাত্যুরি বংশের রাজাদের রাজধানী ছিল এই স্থান।এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর তাদেরকে এখান থেকে সরে যেতে হয়।"
যোশীমঠের বাড়িতে প্রথম ফাটল দেখা দেয় ১৯৬০ সালে। যোশীমঠের পাহাড়ে ভাঙ্গনের সেই প্রথম নিদর্শন দেখা যায়, যা এখানকার মানুষের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে বোঝা যায়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকার গাড়োয়াল মণ্ডল কমিশনের অধীনে মিশ্র কমিটি তৈরি করেন এর কারণ খুঁজতে। এই কমিটি ১৯৭৬এর ৭ই মে রিপোর্ট জমা করে।
এই কমটির একটি অন্যতম পরামর্শ ছিল অবিলম্বে সেখানে সমস্ত বিস্ফোরকের ব্যবহার বন্ধ করা। এছাড়াও বৃষ্টির জলের চুয়ে পড়া আটকাতে পাকা নিকাশী নালা তৈরি করা, পাহাড়ের ঢালে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা আর ভূমিধ্বস ঠেকাতে গাছ কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরামর্শও দেয় কমিটি।
যদিও এসব পরামর্শ সত্ত্বেও, রাস্তা, বাঁধ, সুড়ঙ্গ, বহুতলের নির্মাণ বিনা বাধায় চলতে থাকে। ফলে পরিস্থিতি আজ এমন দাঁড়িয়েছে যে যোশীমঠের অস্তিত্ব আজ প্রশ্নের মুখে।
এস পি সতি বললেন, “ যা ক্ষতি হয়েছে তা মেটানো আর সম্ভব না।যে গতিতে বাড়িগুলিতে ফাটল ধরছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যোশীমঠের বেশিরভাগ এলাকার অস্তিত্বই আর থাকবে না। এখন প্রশাসনের মনোযোগ হওয়া উচিত মানুষকে উদ্ধার করে তাদের অস্থায়ী কেন্দ্রে পুনর্বাসন দেওয়া। এবার যদি আমরা চাই অন্য কোন শহর যোশীমঠের মত না হয়ে যায়, তার জন্য যথাযোগ্য নীতি নির্ধারণ করা।“
যেসব সমাজকর্মীরা যোশীমঠের দুরবস্থা নিয়ে বহু বছর ধরে সরব তারাও বলছেন সরকার যেন দ্রুত মানুষকে সরানোর ব্যবস্থা করে। Social Development of Communities Foundation এর প্রতিষ্ঠাতা অনুপ নটিয়াল বলছেন , "যোশীমঠের পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে। বড়সড় গণবিপর্যয় রুখতে প্রশাসন অবিলম্বে মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিক।" যাদের বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে প্রশাসন তাদের পুরসভার বাড়িতে, গুরুদোয়ারা, স্কুলবাড়িতে বা লজগুলিতে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নটিয়াল,” এইসব জায়গা তো যোশীমঠেই, তারা কি আদৌ নিরাপদ!”
পরিবেশবিদ ও South Asia Network on Dams, Rivers, and People (SANDRP) এর সঞ্চালক হিমাংশু ঠক্কর বললেন, “ভৌগলিক ও জলস্তরের অবস্থানের দিক থেকে যোশীমঠ সব সময়ই খুব ভঙ্গুর অবস্থানে আছে। বিগত বছরগুলোয় যোশীমঠের আশেপাশে এমন অনেক কিছুহয়েছে যা বড়সড় বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিয়েছে।“
পুরানো বিপর্যয়ের কথাগুলোর কথা বলছিলেন ঠক্কর।১৯৭০ এর ভয়াবহ ধ্বস, তপোবন-বিষ্ণুগদ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়ে আচমকা বিপুল জলস্রোতের বার হয়ে আসামাটি ফুঁড়ে, ২০২১ সালে রেনিগ্রামের কাছে হড়পা বান ধৌলিগঙ্গা নদীতে। তিনি বললেন, “প্রশাসন কিন্তু মানুষের কথা দীর্ঘ সময় ধরে না শোনার ভান করে গেছে যে বাড়িগুলিতে ফাটল ধরছে। National Thermal Power Corporation Limited (NTPC) ২০২২এর ডিসেম্বারে তাদের প্রকল্পের জন্য একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়তে বিস্ফোরকের ব্যবহার করে। এরপরে অনেক জায়গাতেই মাটি ফুঁড়ে জল বার হবার ঘটনা ঘটেছে। যোশীমঠ তো ভূমিকম্প-প্রবণএলাকায় পড়ে। ফলে এখানে তপোবন-বিষ্ণুগাদ জলবিদ্যুৎপ্রকল্পের মত পরিকল্পনা নেওয়াটাই বিপর্যয়কর। হিমালয়ের এই উঁচু এলাকায় এমন অনেক প্রকল্পই শেষমেষ মারাত্মক প্রমাণিত হবে।"
‘যোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতি’র সদস্য অতুল সতি জানালেন, "২০২১ এর ফেব্রয়ারিতে রেনি গ্রামে যে হড়পা বান হয় তাতে ধ্বংসাবশেষে নদীখাত ভরে যায়। রেনি আর যোশীমঠ একই ভৌগলিক এলাকায় হওয়ায় এই ঘটনার প্রভাব তো যোশীমঠে পড়বেই।" তিনি মনে করেন এ খন যেসব ফাটল দেখা যাচ্ছে তা আসলে ওই ঘটনারই ফলশ্রুতি। তপোবন-বিষ্ণুগাদ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এ অসংখ্য সুড়ঙ্গ খোঁড়া হচ্ছে তার ফলে ফাটল আরো বাড়বে। তিনি বললেন, মানুষ এই বিষয়ে আগে থেকেই বলে আসছে। কিন্তু সরকার কান দেয়নি। তিনি জানালেন, “প্রশাসনের উদাসীনতা দেখে নাগরিকেরা নিজেরাই একদল ভূ-তত্ববিদকে অনুরোধ করেন পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে। তাদের সমীক্ষায় ধরা পড়ে যে, যোশীমঠ ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে যা দ্রুতই বিপর্যয়ের রূপ নেবে। এরপরেই আমাদের আন্দোলন জোরদার করি, আর জানুয়ারির ৫ তারিখ বদ্রিনাথ যাবার হাইওয়েতে প্রতিবাদ জানাই”।
আন্দোলনকারীরা সরকারের উদ্ধারকাজ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। জেলা বিপর্যয় ব্যবস্থাপক কমিটি প্রতিদিনই এই নিয়ে বুলেটিন বার করছে। জানুয়ারির ৯ তারিখের বুলেটিন অনুযায়ী প্রশাসন ১১৯১ জনকে যোশীমঠেই আর ২২০৫ জনকে কাছাকাছি পিপলকোঠীতে সরিয়ে নিয়ে গেছে অস্থায়ী আবাসে। অনুপনটিয়াল বলেন, "এটা একটি আপৎকালীন অবস্থা। সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের আস্থা অর্জনে।“
৭ই জানুয়ারি উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি যোশীমঠের বিপন্ন মানুষদের সাথে দেখা করেন ও প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেন। চামোলির জেলাশাসক টুইটারে পোস্ট করে জানান যে, আগামী ছয় মাসের জন্য বিস্থাপিত পরিবারগুলিকে প্রতিমাসে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চার হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।রেশন ও রান্না করা খাবারের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে প্রয়োজনে।
মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2023/01/a-sinking-town-in-uttarakhand-what-went-wrong-in-joshimath/
Kommentarer