নীতি আয়োগের পরিকল্পনায় নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের ক্রান্তিয় বনাঞ্চলে গড়ে উঠতে চলেছে একটি কন্টেনার টার্মিনাল বন্দর, বিমানবন্দর, পর্যটন প্রকল্প, উপনগরী সহ বিরাট এক উন্নয়ন পরিকল্পনা। এখানকার বৈচিত্রময় জীববৈচিত্রের কথা মাথায় রেখে পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা আপত্তি তুলেছিলেন এই প্রকল্প নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছিল তার পরিবেশগত সমীক্ষা নিয়ে। কিন্তু শেষমেশ কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক থেকে ছাড়পত্র এসেই গেল। এতে কী কী পরিবর্তন আসতে চলেছে এখানকার বাস্তুতন্ত্রে, প্রকৃতিতে? আলোচনায় টি. রামচন্দ্রন।
ভারত সরকারের বন , পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি অবশেষে গ্রেট নিকোবার দ্বীপের পরিকাঠামো সংক্রান্ত বড়সড় বিনিয়োগ ও পর্যটন প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় environmental and Coastal Regulation Zone (CRZ) clearance দিয়েই দিল। এর ফলে এখানকার ১৫ শতাংশ অরণ্য এলাকার পরিবর্তন ঘটবে আর ৮,৫২,০০০ গাছ কাটতে হবে ধাপে ধাপে।Andaman and Nicobar Islands Integrated Development Corporation এর অধীনে এই প্রকল্প আসলে নীতি আয়োগেরই পরিকল্পনা প্রসূত।ঘন অরণ্যে ঢাকা এই দ্বীপে এখনও অবধি মানুষের কার্যকলাপ খুবই কম।
কমিটি যদিও "বাস্তুতন্ত্রে এই প্রকল্পের প্রভাবের মাত্রা" সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল বলে জানিয়ে একে সবুজ সংকেত দিয়েছে এই প্রকল্পের "অবস্থানগত গুরুত্বের" জন্য এবং প্রকল্পের কর্তৃপক্ষের "উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে অবস্থান জানার পরে"।
এই ৭৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের মূল অংশ হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক কন্টেনার টার্মিনাল বন্দর, একদম নতুন জমিতে তৈরি হবে একটি গ্রিনফিল্ড এয়ারপোর্ট যা সবচেয়ে ব্যস্ত সময়ে আগমন ও নির্গমন দুই দিকেই ৪,০০০ যাত্রী ধারণ করতে পারবে, একটি উপনগরী এবং একটি করে সৌর ও গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। নীতি আয়োগের তরফে AECOM India Private Ltd. এমনই একটা "গ্রেট নিকোবার দ্বীপের উন্নয়নের সামগ্রিক পরিকল্পনা" বানিয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে বিমানবন্দরটি সাধারণ যাত্রী পরিবহন ও সামরিক- দুই কাজেই ব্যবহার হবে যা নৌ-বাহিনীর অধীনে থাকবে। এই কর্মকান্ডের প্রথম পর্যায় ২০৩৬ সাল অবধি এবং পরবর্তী পর্যায় হবে ২০৫১ অবধি। কন্টেনার টার্মিনালটা যদিও ২০২৭-২৮ সাল থেকেই কাজ করতে শুরু করে দেবে।
পরিবেশগত সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী মোট ১৬৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা 'উন্নয়ন' প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ হবে যার ৭২ বর্গ কিলোমিটারে প্রথম তিনটি ধাপে এই প্রকল্পটির কাজ হবে। উপনগরীটি বাণিজ্যিক, শিল্পের জন্য ও আবাসিক এলাকায় ভাগ থাকবে। একটা বড় অংশ বরাদ্দ হয়েছে পর্যটন সংক্রান্ত কাজে।
আরোপিত শর্ত
পরিবেশগত সমীক্ষা কমিটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও আদিবাসীদের সুরক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। সামুদ্রিক লেদারব্যাক কচ্ছপ, নিকোবার মেগাপড পাখি, লবণাক্ত জলের কুমীর ও আরও কিছু প্রজাতির কথা ভাবা হয়েছে। তাছাড়া ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সংরক্ষণ, প্রবালের স্থানান্তরণ আর নিকোবারি ও সম্ফেন আদিবাসী গোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্যও পরিকল্পনা রয়েছে এর মধ্যে।পরিবেশগত সুরক্ষার দিকটি দেখতে তিনটি স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি তৈরি করা হয়েছে।
পরিবেশগত সমীক্ষা কমিটি তিনটি নতুন অভয়ারণ্যের ঘোষণা করেছে। একটি লিটল নিকোবারে (১৪ বর্গ কিলোমিটার-লেদারব্যাক কচ্ছপের জন্য), মেঞ্চলে একটি(১.৩ বর্গ কিলোমিটার, মেগাপডের জন্য) আর মেরো দ্বীপে (২.৭ বর্গ কিলোমিটার, প্রবালের জন্য)।
সরকারি নথি অনুযায়ী, নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের ৯১১ বর্গ কিলোমিটারের ৯৫ শতাংশের উপরে এলাকা ন্যাশনাল পার্ক, সুরক্ষিত বনাঞ্চল এবং উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা। গ্রেট নিকোবার বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ এই আদিম অরণ্যভূমিকে ধারণ করে আছে।World Network of Biosphere Reserves এর অন্তর্গত এই অরণ্য ইউনেস্কোর মতে "বিশিষ্ট ও সংকটাপন্ন এক ক্রান্তীয় চিরহরিৎ অরণ্য"। একটি বৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র রয়েছে এখানে- ৬৫০ প্রজাতির অ্যাঞ্জিওস্পার্ম জাতীয় উদ্ভিদ, ফার্ন, জিমনোস্পার্ম, ব্রায়োফাইটের অস্তিত্ব এখানে।১৮০০ প্রজাতির উপরে প্রাণী প্রজাতি আছে, যাদের মধ্যে কিছু শুধু এখানেই পাওয়া যায়(endemic)।
এই অরণ্যে রয়েছে দুটি জাতীয় উদ্যান- একটি হল ক্যাম্পবেল বে ন্যাশনাল পার্ক আর একটি হল গ্যালেথিয়া ন্যাশানাল পার্ক। ঘন অরণ্য ও গাছপালায় গোটা দ্বীপটাই ঢাকা। সাম্প্রতিক উপগ্র্হ চিত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মাত্র ৫-৬ শতাংশ এলাকাই ঘন গাছপালায় ঢাকা নয়, তা আসলে উপকূল ও জলাভূমি এলাকা। গ্রামীণ এলাকা একেবারেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।কৃষি জমি মাত্র ৩৫ বর্গ কিলোমিটার।
দ্বীপের একটা দীর্ঘ ফালি যা এমন ঘন অরণ্যে ঢাকা তাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে এই প্রকল্পের জন্য।প্রকল্পের ১৬৬ বর্গ কিলোমিটারের ১২২ বর্গ কিলোমিটার হল অরণ্য আর ৯ বর্গ কিলোমিটার অরণ্যের মতই এলাকা। প্রকল্পের উত্তরভাগ পড়ছে বাযোস্ফিয়ার রিজার্ভের মধ্যেই। অর্থাৎ বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের ৭১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নেওয়া হচ্ছে প্রকল্পের জন্য। গ্যলাথিয়া বে অভয়ারণ্যের সুরক্ষিত তকমা কিছুকাল আগে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে যা ছিল লেদারব্যাক কচ্ছপের ডিম পাড়ার ও প্রজননের এলাকা। প্রকল্পের মূল অংশ অর্থাৎ, কন্টেনার টার্মিনাল ও বিমানবন্দর গড়ে উঠবে এখানেই।
প্রকল্পের সন্নিহিত গ্যলাথিয়া ন্যাশানাল পার্ক অনেকটাই অসুরক্ষিত হয়ে পড়বে যেহেতু এর কোন বাফার এলাকা আর থাকবে না। যদিও এই জাতীয় উদ্যানের সন্নিহিত এলাকার অনেকটাই ইকোটুরিজমের জন্য বরাদ্দ যেখানে নাকি বড় সড় কোন নির্মাণ করা যাবে না।কিন্তু ৪.২১ বর্গকিলোমিটার যে এলাকায় বন্দর ও বিমানবন্দর গড়ে উঠবে সেখানকার নির্মাণ কাজের জন্য অরণ্য সংকটাপন্ন হবেই। এইসব পরিকাঠামো নিরমানের কাজ ও উপনগরী গড়ে উঠার জন্য দ্বীপের জনসংখ্যার একটা বিরাট বৃদ্ধি ঘটবে।
বর্তমানে ক্যাম্পবেল বে হল সবথেকে বেশি মানুষ বসতির এলাকা এই দ্বীপে, প্রায় ৬৯ শতাংশ (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী সংখ্যাটা ৮,৪০০ যা বর্তমানে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১২,০০০ হয়েছে)। কিছু গ্রাম আর কৃষি জমি পূর্ব উপকূল বরাবর রয়েছে। এই সংখ্যাটাই প্রকল্পের ফলে ২০২৫ এ ৫২,০০০ দাঁড়াবে আর ২০৪০ এ ১.৬৫ লাখে পৌঁছবে।
সামনের মাস এবং বছরগুলোয় প্রকল্প এগোবার সাথে সাথে স্পষ্ট হবে গ্রেট নিকোবারের অরণ্য ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কতটা হবে।
মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2022/10/maps-environmental-path-cleared-for-great-nicobar-mega-project/
Comentários