top of page

অভয়ারণ্যের মাঝ বরাবর গণিত স্যারের বাড়ি

  • ..
  • Jul 2
  • 6 min read

ভারতের নানাদিকে অরণ্যের মাঝে প্রাচীন সভ্যতার বিস্তার ঘটেছিল, আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রকৃতির আশ্চর্য সব সত্য। তেমন এক ইতিহাস উঠে এল নীল মজুমদারের সবুজ কলমে।


ree

গণনা করতে করতেই জ্যোতিষশাস্ত্রী বাবা চমকে উঠলেন। বিয়ের পর তাঁর আট বছরের মেয়ের কপালে রয়েছে অকাল বৈধব্য। সুতরাং গণনা আর শেষ করা হলনা, পূঁথি পত্র খুলে আবার বসে পড়লেন। দীর্ঘ পরিশ্রমে খুঁজে বার করলেন, অন্য সময়, অন্য বিবাহযোগ, যাতে এই দুর্যোগের সম্ভাবনা থাকবেনা। তারপর তৈরি করলেন সঠিক কাল নির্ণয়ের একটি যন্ত্র। ছিদ্রযুক্ত একটি পাত্র থেকে বালি নিষ্কাশিত হয়ে জমা হবে অন্য একটি পাত্রে। স্থান পরিবর্তন করে দিলেই দ্বিতীয় পাত্র থেকে বালি চলে যাবে প্রথম পাত্রে। এইভাবে মাপা হবে পল, দন্ড, কাল। সব কিছু চলছিল ঠিকঠাক, সুক্ষ্ম হিসেব মতই। একদিন সেই অষ্টমবর্ষীয়া কৌতূহলী মেয়ে যন্ত্রের ওপর ঝুঁকে দেখছিল তার অপরূপ কার্যপ্রণালী। এই সময় তার নাকছাবি থেকে সবার অলক্ষ্যে একটি মুক্তো খসে পড়ল প্রথম পাত্রটিতে। এই মুক্তো অচিরাৎ পাত্রের ছিদ্রপথে আটকে যাওয়ার ফলে, বালির গতি বিঘ্নিত হল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীর অজান্তে ভুল হয়ে গেল কালের হিসেব। নির্ধারিত সময়ে মেয়ের বিয়ে হল এবং যথারীতি বৈধব্য নেমে এল তার জীবনে।


এটা গল্পই। সত্যাসত্য কেউ জানেনা, এভাবেই বলা এবং শোনা হয়। কিন্তু যে দুটি মুখ্য চরিত্র নিয়ে এই গল্প, তারা বারোর শতকের ইতিহাস স্বীকৃত বিখ্যাত মানুষ। বাবা, বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতশাস্ত্রী ভাস্করাচার্য ও তস্য তনয়া লীলাবতী। মেয়ের দুঃখ নিবারণের জন্যে এতদিন যা করেছিলেন, সেটা ছিল বাবার স্নেহ। দুঃখ ভুলিয়ে দেবার জন্যে এইবার যা করলেন, সেটা পন্ডিতের সমাধান। উনি মেয়েকে অঙ্কশাস্ত্র শিখিয়ে দিলেন কিংবা বলা যায়, অঙ্কের নেশা ধরিয়ে দিলেন। পাঠ দেবার জন্যে রচনা করলেন চার অধ্যায়ের একটি বিরাট গ্রন্থ, ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’, যার প্রথম বা অঙ্কগণিতের (Arithmetic) অধ্যায়টির নামই হল, ‘লীলাবতী’। অন্যান্য অধ্যায়গুলি যথাক্রমে, বীজগণিত, গ্রহ গণিত এবং গোলাধ্যায়। সমস্ত এই ঘটনাবলী ঘটিত হল যেখানে, অকিঞ্চিৎকর সেই গ্রামটির আজকের নাম ‘পাটনে’, ঠিকানা ‘গোতালা অভয়ারণ্য’।

কিন্তু প্রশ্ন হল, গোতালা অভয়ারণ্যটা কোথায়? দূরপাল্লার সুপারফাস্ট ট্রেন দাঁড়ায়না। অন্যান্য ট্রেন দাঁড়ালেও, কলকাতা মুম্বাই রেলরাস্তায় ভুসাবলের কাছেই ছোট্ট একটা স্টেশন ‘চালিশগাঁওয়ের’ দিকে আমরা খুব একটা নজর দিইনা। এইখানে নেমে, যদি মোটরপথে ঔরঙ্গাবাদ রওনা হন, পাহাড় ঘেঁষে জিলিপির প্যাঁচের মত একটি রাস্তা আপনাকে পার হতেই হবে। এই পাহাড়টির নাম ‘সাতমালা- অজন্তা’ পাহাড়। দুর্গম এই রাস্তাটিকে ২১১ নম্বর রাষ্ট্রীয় মহামার্গের মর্য্যাদা দেওয়া হয়েছে আজকাল। তবে স্থানীয় লোকেরা এই রাস্তাটিকে, ‘আউটরাম ঘাট’ হিসেবেই জানেন। কারণ, আউটরাম নামের জনৈক বৃটিশ সার্ভেয়ার এই রাস্তাটি নির্মাণের সময় প্রধান সার্ভেয়ারের ভূমিকায় ছিলেন। রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের গায়ে, গভীর নয় শুকনো হালকা জঙ্গল। এই জঙ্গলটির পোশাকি নাম, ‘গোতালা আউটরাম ঘাট অভয়ারণ্য’ বা সংক্ষেপে ‘গোতালা অভয়ারণ্য’। এইখানে আমাদের আপাতত থাকতে হবে কিছুক্ষণ, কারণ এইখানেই উত্তর দক্ষিণ দুই প্রান্তে রয়েছে আমাদের দেশের প্রাচীন দুটি শিল্প ও বিজ্ঞান মননের অমূল্য স্মৃতি।


লেখকের অন্য রচনা: মায়াবী বনের কাছে



খ্রীষ্টের জন্মের একশো থেকে দু’শো বছর আগে, সাতবাহন রাজাদের সময়, হীনযান শাখার একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এসেছিলেন এইখানে। আধ্যাত্ম চিন্তা, ধ্যান ও উপাসনার জন্যে গুহা নির্মাণের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। এই পাহাড়ের একপ্রান্তে ‘পিতলখোরা’র অসমাপ্ত ১৪ টি গুহায় তার চিহ্ন রয়ে গেছে। পাহাড়ের খাড়া দেওয়াল কেটে তৈরি করা এই গুহাগুলি, পাথর জীর্ণ হয়ে ভেঙ্গে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন প্রায় ধ্বংসের মুখে। সামনের খোলা চত্বর পার হলেই দেখা যায় প্রধান চৈত্যের প্রবেশদ্বার। দ্বারের দুপাশে যক্ষ ও নাগ মূর্তি এখনও স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। প্রায় ৩০/৪০ ফুট উঁচু পাথরের ছাত ধরে রাখার জন্যে ওঁরা তৈরি করেছিলেন বর্ণময় অনেকগুলি স্তম্ভ। কালের অমোঘ নিয়মে তার অধিকাংশই ভেঙ্গে পড়েছে। সংরক্ষণের জন্যে বেশ কয়েকটিকে সিমেন্ট কংক্রীটের পিলার দিয়ে বিকল্পিত করা হয়েছে ইদানিংকালে। এই চৈত্যের দুপাশে ছোট ছোট কয়েকটি বিহার, যা ব্যাবহৃত হত সন্ন্যাসীদের থাকার, ধ্যানের এবং অধ্যয়নের জন্যে। চৈত্যের দু’ একটি জায়গায় বিনষ্ট প্রায় কিছু ছবি এখনও দেখা যায়।অজন্তার আদলে আঁকা রৈখিক, দ্বিমাত্রিক ছবি। সেই একই রকম অসাধারণ অভিব্যক্তি। একই রকম, মাটি হলুদ, লাল, খয়েরি, ও কালো রং এর প্রয়োগ এবং নীলের আশ্চর্য্য অনুপস্থিতি। পেছনের কয়েকটি গুহায় প্রমাণ সাইজের স্তুপও আছে। যদিও আধার শিলার সঙ্গে স্তুপ একাত্ম মনে হয়না, মনে হয়, পরবর্তী সময়ের সংযোজন। আধ অন্ধকার গুহায় ঘুরেফিরে সব দেখতে দেখতে একটু ভ্রমিত লাগে।


গবেষকরা জানিয়েছেন, পিতলখোরার এই সব গুহা, মূর্তি, চিত্রশিল্প অজন্তার সমসাময়িক। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, অজন্তা থেকে মাত্র সত্তর আশি মাইলের ব্যাবধানে, ওঁরা কি অজন্তার মতই আরও একটি কাজ করতে চেয়েছিলেন? তাহলে শেষপর্যন্ত করলেন না কেন? কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বস্তুতঃ অজন্তার আগেই এসেছিলেন এখানে। কয়েকবছর কাজ করার পর এখানের পাথর তাঁদের কাজের উপযুক্ত মনে না হওয়ায়, পার্শ্ববর্তী অজন্তায় চলে গিয়েছিলেন। অজন্তার তুলনায় অনেক জীর্ণ এই গুহাগুলি দেখে, অনুপযুক্ততার যুক্তি অবিশ্বাস্য মনে হয়না। কিন্তু অজন্তার প্রথম দিকের গুহাগুলিতে ভাস্কর্য্য তেমন নেই। আছে, পরবর্তী কালের গুহাগুলিতে। আর আছে, ইলোরার বৌদ্ধ গুহাগুলির বেশ কয়েকটিতে। তাই এখানকার সেই প্রস্তর শিল্পিরা যে শেষপর্যন্ত, ইলোরায় গিয়ে স্থিতু হয়েছিলেন কিনা তাই বা কে জানে! তাছাড়া, আমরা যাকে অসমাপ্ত ভাবছি তা সত্যিই অসমাপ্ত নাও হতে পারে। বস্তুতঃ, আমার মত অর্বাচীনের নিছক কৌতূহলে নয়, এই সব জটিল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বস্তুনিষ্ঠ গভীরতর অনুসন্ধানে।

ree



পিতলখোরা থেকে বনপথে হেঁটে গেলে পাটনে গ্রাম কিংবা সেখানের পাটনা দেবীর মন্দির দুই তিন কিলোমিটারের বেশি নয়। গাড়িতে গেলে বেশ অনেকটা। আমার পছন্দ হাঁটা। শেষ জানুয়ারির হাল্কা রোদ গায়ে মাখতে মাখতে আমি পাহাড়ি পথ ভাঙ্গি। এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি নয়। স্বাভাবিক ভাবেই এখানের জঙ্গলও বেশ রুক্ষ, যার পারিভাষিক নাম ‘ড্রাই ডেসিড্যুয়াস ফরেস্ট’। পাতা ঝরিয়ে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ‘সেগুন’, স্থানীয় ভাষায় ‘সাগবান’। পাথুরে জায়গায়, ‘সালাই’ গাছ, খোলামেলায় ‘বাবুল’, ‘খয়ের’। নুড়ি বেছানো শুকনো জলধারার কাছে, ‘অর্জুন’। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণকায় ‘তেন্দু’ কিংবা লাল মাথা ‘কুসুম’। পায়ের নিচে শুকনো পাতা ভাঙ্গার মুচমুচ শব্দ হয়। ত্রস্ত পায়ে রাস্তা পার হয়ে যায়, ধূসর বেজি। ঝোঁপের পেছন থেকে উড়ে যায় এক ঝাঁক কালো মাথা মুনিয়া। নিদাগ আকাশে চক্রাকারে ঘোরে ল্যাপউইঙ্গ। প্রায় ছাব্বিশ হাজার হেক্টারের এই জঙ্গল মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ এবং জলগাঁও জেলায় ছড়িয়ে আছে। আগে শুধুই রিজার্ভ ফরেস্ট ছিল, ১৯৮৬ সালে ‘অভয়ারণ্যের’ মর্যাদা পেয়েছে। একদা মধ্য প্যালিওলিথিক যুগে এখানে ভূগর্ভে প্রচন্ড আলোড়নের ফলে ‘তাপ্তি’ নদী গর্ভের সৃষ্টি হয়েছিল। এই অভয়ারণ্যে সৃষ্ট ‘পূর্ণা’ নামের একটি জলধারা গিয়ে মিলেছে তাপ্তির সঙ্গে। এছাড়াও এখানে আছে আরও কয়েকটি জলধারা যা গিয়ে মিলেছে গোদাবরী নদীর সঙ্গে। খনন কার্য চালিয়ে এখান থেকে পাওয়া গেছে উত্তর প্যালিওলিথিক যুগের কিছু প্রস্তর আয়ুধ। তাই পঁচিশ হাজার বছর আগেও যে এখানে মানুষের বসবাস ছিল, একথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মূল পাটনে গ্রামের কাছেই জঙ্গলের মধ্যেই পাটনা দেবীর মন্দির। অন্য গাছের ভীড়েও বড় বড় অঞ্জন গাছ আলাদা করে চোখে পড়ে। শুধু বর্ষায় সজীব হয় এমন একটি শুকনো জলধারা, চারিদিকে ঝামা পাথর ছড়িয়ে আছে। সে সব পার হয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে মন্দিরে পৌঁছলাম। প্রবেশদ্বারের দুপাশে মিনারের মত দুটি দীপস্তম্ভ বিশেষ ভাবে চোখে পড়ার মত। দেবী ভবানী কে উৎসর্গিত এই মন্দিরের একটি গর্ভগৃহে দেবী ষোড়শী রূপে প্রতিষ্ঠিত। অন্যপাশের গর্ভগৃহে শঙ্কর পার্বতীর মূর্তি। এই দুইয়ের মাঝখানের একটি কক্ষে আছেন বিষ্ণু। প্রায় ১০০০ সাল থেকে ১২২৬ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে ছিল নিকুম্ভ রাজত্ব। তখন তাপ্তি নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী এই জায়গাটিকে বলা হত ‘দক্ষিণ খান্দেশ’। পাটনা দেবীর এই মন্দির, ১১২৮ সালে তৈরি করেছিলেন নিকুম্ভ রাজারা। এই মন্দিরের সামনের পরিসরে খনন করে পাওয়া গেছে দেবনাগরী লিপিতে লেখা একটি শিলালেখ। ১২০৮ সালের এই জীর্ণ শিলালেখের পাঠোদ্ধার করে জানা গেছে এক বিস্ময়কর তথ্য। বিখ্যাত গণিতশাস্ত্রী ভাস্করাচার্য্যের পৌত্র চাঙ্গদেবকে, ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ এবং গণিত শাস্ত্রের অন্যান্য গ্রন্থ পঠন, পাঠন, শিক্ষাদেনের জন্যে নিকুম্ভ রাজাদের তরফ থেকে মঠস্থাপন করার জন্যে এইখানে জমি দান করা হয়েছিল। মন্দিরের সামনে শুকনো নদীগর্ভে আরও একটি শিলালিপিও পাওয়া গিয়েছিল, যা এখন চালিশগাঁও এ স্থানান্তরিত হয়েছে। এই লিপিতে ভাস্করাচার্য্যের স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাওয়া গেছে। প্রথম ভাস্করাচার্য্যের সঙ্গে যাতে গুলিয়ে না যায়, তাই এইখানে জানিয়ে রাখি, প্রথম ভাস্করাচার্য্যও একজন বিখ্যাত ভারতীয় গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্রী। তবে কিনা তিনি সাতের শতকের মানুষ। আর আমাদের আলোচ্য এই ভাস্করাচার্য্য হলেন, ভাস্করাচার্য্য (দ্বিতীয়)। এঁকে জিনিয়াস বললে বোধহয় সবটা বলা হয়না। Negative numbers, Quadratic equation, Indeterminate equation, ইত্যাদি গণিতশাস্ত্রের নানা শাখায় কাজ করেছেন তিনি। বিদেশী গণিতশাস্ত্রে যাকে Pulverizer বলা হয় আর্য্যভট্ট তাকে বলতেন, ‘কুট্টক’। আর্য্যভট্টের কুট্টক সমাধান আরও সরলীকৃত করে দিয়েছিলেন ভাস্করাচার্য্য। পেল এর সমীকরণ (Pell’s equation) সমাধান করার ভিন্নতর পদ্ধতি খুঁজে বার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, আমাদের আবাল্য পরিচিত ‘পাইথোগোরাস’ উপপাদ্যের ভিন্ন প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। Differential coefficient, Differential calculus এর স্পষ্ট ধারণা ওঁর ছিল, জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কে ওঁর অসীম জ্ঞানের পরিচয় ছড়িয়ে আছে ‘কারণ কৌতূহল’ গ্রন্থে। পৃথিবীর সূর্য্য প্রদক্ষিণের যে সময় উনি গণনা করেছিলেন, আধুনিক বিজ্ঞানের গণনা করা সময়ের সঙ্গে তার তফাৎ খুব সামান্য।


এ হেন প্রতিভাবান ভাস্করাচার্য্যের জীবনী পাঠ করে দেখা যাচ্ছে, উনি ছিলেন ‘বিজ্জল বীড’ নামের একটি জায়গার মানুষ। কয়েকজন গবেষকের ধারণা, এই জায়গাটি, আধুনিক কর্ণাটকের বিজাপুরের কাছে। অন্য মতে বিশ্বাসী গবেষকরা এই অনুমান নস্যাৎ করে বলেছেন, তখনকার বিজ্জল বীড ছিল এই পাটনে গ্রাম বা তার কাছাকাছি কোনো জায়গায়। তা যদি না হয়, তবে, ভাস্করাচার্য্যের পৌত্র চাঙ্গদেব কে মঠ স্থাপনের জন্যে এখানে জমিদান করার কি যৌক্তিকতা হতে পারে? ভাস্করাচার্য্যের জীবনকাল ১১১৪ সাল থেকে ১১৮৫ সাল পর্য্যন্ত। ১২০৮ সালে তাঁর পৌত্রকে জমি দান করা এবং অন্য শিলালিপিতে ভাস্করাচার্য্যের প্রত্যক্ষ উল্লেখ, এই দুটি তথ্যের ভিত্তিতে দ্বিতীয় পক্ষের দাবীতে প্রত্যয় হওয়াই স্বাভাবিক। জন্মস্থান হোক বা না হোক, এই জায়গাটির সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় গণিতের দিকপাল ভাস্করাচার্য্যের যে গভীর সম্পর্ক ছিল, এবিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকেনা।

ভাস্করাচার্য্য কি আরও কোনো গ্রন্থ রচনা করেছিলেন? লীলাবতীও কি অঙ্কশাস্ত্রে বাবার মত ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন? সেই সময় মহিলাদের বিদ্যাচর্চা কি বাধাহীন ছিল? বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাই বা কেন চলে গিয়েছিলেন? ওঁরা কি সত্যিই অজন্তার শিল্পীদের পূর্বসূরী? এইসব এবং আরও অনেক প্রশ্ন আপাতত অতীতের ধূসর ছায়ায় স্তব্ধ হয়ে আছে। যদি কোনোদিন সত্যিকারের যোগ্য কোনো মানুষ এসে, তাঁর গবেষণার, তাঁর মনীষার সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দেন, হয়তো এই প্রশ্নগুলি নড়েচড়ে উঠবে। তখন হয়তো সত্যিই কথা বলবে অতীত।

সারাদিন এই সব অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে ক্লান্ত হয়ে সন্ধে বেলায় অভয়ারণ্যের রেস্ট হাউসে এসে আমি অবাক। সাধারণত এখানে রেস্ট হাউসের স্যুটের নাম হয়, চন্দন, কুসুম, নীলগিরি, সাগবান, এইসব। এখানে দেখি দুটি মুখোমুখি স্যুট, একটির নাম ভাস্করাচার্য্য, অন্যটির নাম, লীলাবতী। আমার থাকার ব্যাবস্থা হয়েছে, প্রথমটিতে। অঙ্ক বিষয়টির সঙ্গে আমার সম্মন্ধ কখনই খুব একটা মধুর নয়। তাছাড়াও অন্য বিপদ আছে। অঙ্কের সূত্র ইত্যাদি উনি লিখতেন সংস্কৃত ভাষায়। সেখানেও আমার অবস্থা মনে করুণ রস জাগিয়ে তোলে। যে স্যুটের নাম ভাস্করাচার্য্য, সেখানে কি আমার রাত্রিবাস করা উচিত! তবু সাতপাঁচ ভেবে আমি দু’কাপ চা আনতে বলে দিলাম। এক কাপ অবশ্যই আমার জন্যে। আর অন্য কাপ, ……না, মানে পুরোনো দিনের মাষ্টারমশাই মানুষ আর এই তল্লাটেই ছিল ওঁর বাড়ি। …… যদি সত্যিই এই সন্ধে বেলায় লাঠি ঠক ঠক করে এসে পড়েন, একটু চা বিস্কুট তো নিবেদন করতেই হবে !



লেখক পরিচিতি: লেখক অবসরপ্রাপ্ত আই এফ এস আধিকারিক এবং ঔপন্যাসিক।


ree

Comments


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
 

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page