বনে ঘোরার গল্প। তাও একজন বনবিভাগের কর্তার কলমে। মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন অ্যাডিশনাল পি সি সি এফ নীল মজুমদারের লেখা নেপালের চিতবন ন্যাশানাল পার্কে বনবিহারের আখ্যান। বনেপাহাড়ের পাতায়।

গোটা কয়েক শাল গাছের ছায়ায় যেখানে আমাদের মিনিবাস দাঁড়ালো, সেই জায়গাটি বেশ খোলামেলা, মনোরম। অনেকটা বাসস্ট্যান্ডের মত, তবে অত ব্যস্ততা নেই। আরও কয়েকটি বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, তবে ‘সনৌলি’ নামের এই জায়গাটি আসলে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও নেপালের মধ্যবর্তী সীমা, ভারতের গোরখপুর থেকে নেপালের ‘ভৈরওয়া’ যাওয়ার রাস্তায়। আমার গন্তব্য, নেপালের ‘পোখরন’। কিন্তু তার আগে দেখে যাবো, ঘন নীল আকাশের নিচে শিবালিকের বিস্তীর্ণ উপত্যকা, মায়াবী অরণ্যে আশ্চর্য সুন্দর বনস্পতির বৈঠক, আর বিশিষ্ট বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ।

ভারতীয় নাগরিকদের নেপাল যেতে ভিসা, পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়না ঠিকই তবে সীমার দুপাশেই বেশ কয়েকটি চেকপোস্টে বাসের কাগজ পত্র, যাত্রীদের পরিচয় পত্র, বিদেশী ঘড়ি ,ক্যামেরা জাতীয় জিনিশ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরিদর্শন করার ব্যাপারটা আছেই। সনৌলিতে দুই দেশের মাঝে রয়েছে একটি উপচারিক ‘শান্তি-দ্বার’। কাছাকাছি,ভারতীয় টাকার বিনিময়ে নেপালি মুদ্রা সংগ্রহের কয়েকটি কেন্দ্র। আর নিয়ম ও অনুষ্ঠানের একঘেয়েমিতে যাত্রীরা যাতে হাঁপিয়ে না ওঠেন, তার জন্যে আছে চা, পান সিগারেটের দোকান, ছোটখাটো হোটেল, চানাচুর ও বাদামবালাদের দল। খুবই চেনাশোনা দেশী পরিবেশ। পানের দোকান থেকে ভেসে আসা হিন্দি ছবির গান, হিন্দি কথাবার্তা, দেওয়ালে চেনা মুখের সব পোস্টার দেখতে দেখতে কখন যে অন্য দেশে ঢুকে পড়লাম, সত্যিই বোঝার উপায় নেই।
ভৈরওয়া নেপালের একটি ছোট জনপদ, গোরখপুর থেকে একশো সাত আট কিলোমিটারের অন্তরালে। গোরখপুর ছেড়েছিলাম দুপুরবেলায়। কিন্তু বেশ কয়েকবার দাঁড়ানোর ফলে ভৈরওয়া পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। আমাদের আজকের রাত্রিবাস এখানেই। আগামী কাল রওনা হব চিতবন রাষ্ট্রীয় উদ্যানের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে দেখে যাবো ‘লুম্বিনি’।
বুদ্ধের জন্মস্থান যে এখানেই কোথাও আছে, এরকম ইঙ্গিত চীনের বিখ্যাত পর্যটকরা যদিও বহুকাল আগেই দিয়েছিলেন, নির্ভুল ভাবে লুম্বিনির স্থান নির্দেশ করেছিলেন জার্মান পূরাতত্ববিদ এ্যালয়িস ফুরার, ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। এরপর থেকেই লুম্বিনির বিশ্বখ্যাতি। দর্শনীয় একটি স্তূপ ছাড়াও এখানে আছে সম্রাট অশোক স্থাপিত একটি স্তম্ভ। স্তম্ভের গায়ে ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা বুদ্ধের প্রতি সম্রাটের প্রণতি। অশোক স্তম্ভের কাছেই রয়েছে সেই প্রাচীন জলাশয়। কথিত আছে গৌতম জননী রাণী মায়া গৌতমকে জন্ম দেবার আগে এইখানে স্নান করেছিলেন। জলাশয়ের পাশেই বয়োবৃদ্ধ শাখা প্রশাখা সমৃদ্ধ বিরাট একটি বট গাছ দাঁড়িয়ে আছে সময়ের প্রহরীর মত। মায়াদেবী মন্দিরের গর্ভগৃহে খনন কার্য চালিয়ে সাম্প্রতিক কালের গবেষকরা গৌতমের জন্মস্থান নির্ভুল ভাবে চিহ্নিত করেছেন বলে দাবী করা হয়। এ দাবী সত্যি হোক বা নাহোক এই জায়গাটি বড় মনোরম। চারিদিকে নিরবচ্ছিন্ন, নিবিড় প্রশান্তি।

ভারতীয় উপমহাদেশের যে কয়েকটি মুষ্টিমেয় অরণ্যে বিখ্যাত ভারতীয় ‘একশৃঙ্গী’ গণ্ডার এখনও ভালোভাবে বেঁচেবর্তে আছে, তার মধ্যে ‘চিতবন’ অন্যতম। লুম্বিনি ছেড়ে চিতবনের রাস্তায় বেরিয়ে সেকথা নতুন করে মনে পড়ে গেল। বস্তুতঃ গণ্ডারের সংখ্যা বিচার করলে অসমের কাজিরাঙ্গার পর দ্বিতীয় স্থানেই চিতবনের নাম আসে। আফ্রিকার দ্বিশৃঙ্গি গণ্ডার এমনকি, জাভা সুমাত্রার গণ্ডারের থেকেও আলাদা বিশিষ্ট এই প্রজাতির গণ্ডার বলাবাহুল্য চিতবনের প্রধান আকর্ষণ। বাঘ, লেপার্ড, হরিণ, সাম্বর ইত্যাদির অভাব না থাকলেও দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন, মূলত এই গণ্ডার দেখার আশায়। তাঁদের আসার সময় হল মার্চ থেকে মে’ মাস। এই সময় গাছের পাতা এবং ঝোপ ঝাড় শুকিয়ে যায় বলে জঙ্গলের ভেতরে দৃশ্যমানতা বেড়ে যায়। আর গরমে অধিকাংশ জলধারা শুকিয়ে মাত্র কয়েকটি সজীব থাকে বলে সেই অল্পসংখ্যক জলধারার কাছে বন্যপ্রাণী দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি হয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর এখানে তুমুল বর্ষা। তারপর গেলে অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের জঙ্গল দেখা যেতে পারে প্রাণভরে তবে বন্যপ্রাণী দেখার সম্ভাবনা, মার্চ থেকে মে মাসের তুলনায় কম। আমি চলেছি অক্টোবরের শেষে।
হিমালয়ের পশ্চাৎপটে ন’শো বত্রিশ বর্গ কিলোমিটারের এই অরণ্য নেপালের প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ১৯৮৪ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দুর্লভ সম্মান। কিন্তু এর আগের ইতিহাসে দুর্দিনের অনেক চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। দেশী রাজা থেকে বিদেশী প্রভু সকলেই একসময় সাড়ম্বরে শিকার করেছেন এখানে। বহুমূল্য গাছপালা কেটে ও বন্যপ্রাণী সংহার করে একসময় জনবসতি গড়ে উঠেছিল এইখানে। সেই জনবসতির কিছুটা আবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ম্যালেরিয়ার প্রকোপে। ‘বারাশিঙ্গা’ প্রজাতির হরিণ এবং ‘বন্যমহিষ’ ইতিমধ্যেই এখান থেকে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। গণ্ডারের সংখ্যাও কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এক শো’র কাছাকাছি। তবে রাষ্ট্রীয় উদ্যান ঘোষিত হবার পর বন এবং বন্যপ্রাণীদের সুদিন ফিরে এসেছে। একটি সাম্প্রতিক গণনা অনুযায়ী এখানে এখন গণ্ডারের সংখ্যা প্রায় চার’শো।
পার্কের ঠিক বাইরেই বেশ কয়েকটি টুরিস্ট লজ। বিকেলের আগেই তার মধ্যে একটিতে ঢুকে পড়লাম। চা টা খেয়ে দেখি দিনের অনেকখানি তখনও বাকি। তার মানে একবার পার্কের ভেতর থেকে ঘুরে আসা যায়। শিবালিকের অল্প উচ্চতা থেকে নিচের দিকে ছড়িয়ে আছে চিতবনের অরণ্য। ওপরের দিকটায় অনন্য মহিমায় প্রতিষ্ঠিত শাল। প্রিয় এই গাছটি মহারাষ্ট্রে পাওয়া যায়না বলে আমার মনে একটা চিরস্থায়ী অভাব বোধ আছে। শালের সঙ্গে এখানে আছে সাজ, হলদু, কুসুম।স্থূল শরীর নিয়ে পেঁচিয়ে ওঠা মাহুল। ছায়াচ্ছন্ন বেশ কয়েকটি জায়গায় দেখলাম, গাছের ডাল মস আর অর্কিডে বোঝাই হয়ে আছে। নিচের দিকের অরণ্যে আছে অতিকায় ঘাস, যাকে ‘এ্যলিফ্যান্ট গ্রাস’ বলা হয়। মাঝেমাঝে শিশু, শিমুল আর খয়ের গাছ। পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামা কয়েকটি স্বচ্ছ জলধারা জায়গাটি কে শীতল করে রেখেছে। পার্কে ঘোরার জন্যে অনেকেই জীপ ব্যাবহার করেন। যেখানে প্রকৃতির এমন অকৃপণ সমারোহ, সেখানে এই যান্ত্রিক ব্যবস্থায় মন ওঠেনা। তাই কোনও অসুবিধা না থাকলে, আমার মতে বিকল্প ব্যবস্থাটি বেছে নেওয়া ভালো। বিকল্প ব্যবস্থা হল, হাতির পিঠে বসে ঘোরা।
হাতির পিঠে বসে জঙ্গলে ঘোরার অভিজ্ঞতা এর আগেও কয়েকবার হয়েছে। সেখানে ব্যবস্থা ছিল একেবারেই অন্যরকম। বসার জন্যে রেলিঙ দেওয়া কাঠের ছোট একটা তক্তাপোষ দড়ি দিয়ে হাতির পিঠের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা ছিল। তক্তাপোষের ওপর ছিল হাল্কা গদি। রেলিঙ ধরে , পাশের দিকে দু’ পা ঝুলিয়ে কিংবা আসনপিঁড়ি হয়ে, মাহুত ছাড়াও অনায়াসেই চারজন বসা যায়। গোটা আট দশ সিঁড়ি বেয়ে কাঠের তৈরি একটা প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাতির পিঠে গিয়ে বসার একটা চমৎকার সুবিধাজনক ব্যবস্থাও ছিল।
আজ কিন্তু আমাদের কপালে জুটলো একেবারে প্রাকৃতিক ‘হস্তি-আরোহণ’। হাতির পিঠে তক্তাপোষ নেই, গুনচট ঢাকা পাতলা বিছানা। ঘাড়ের ওপর বসা মাহুতের ইশারায় হাতি পা মুড়ে মাটিতে বসে পড়ল। পেছন থেকে হাতির পিঠে চড়ে মাহুতের পেছনে দুপাশে দু’পা ছড়িয়ে বসতে হবে, যেমন করে ঘোড়ার পিঠে বসে। এভাবে বসার ফলে মাহুত ছাড়া আর দুজনের বেশি বসার উপায় নেই।
চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটল, এরপর। মাহুতের দ্বিতীয় ইশারায় হাতি উঠে দাঁড়াবার সময় একবার সামনে, একবার পেছনে চকিতে দুলে ওঠার মধ্যে যে অবস্থার সৃষ্টি হল, তাকে অনায়াসেই একটি ছোটখাটো ভূমিকম্পের সঙ্গে তুলনা করা যায়।মাহুত ও আমার মাঝখানে বসেছে আমার বন্ধু কৃষ্ণকুমার। ও দুহাত ওপরে তুলে চিৎকার করল, ‘পড়ে গেলে ধরিস ভাই।‘ আমিও অনুরূপ হাঁক দিয়ে বললাম, ‘অসম্ভব, কারণ তোর আগে আমি পড়ে যাবো।‘ ততক্ষণে হাতি চলতে শুরু করেছে এবং আমাদেরও মনে হচ্ছে, যে যাই বলুক, প্ল্যাটফর্মের পাশে দাঁড়ানো হাতির পিঠে চড়ার মধ্যে কিন্তু এই এডভেঞ্চার নেই।

হাতির পিঠে চিতবনের অরণ্যে ঢুকে পড়ার অনুভূতি, প্রায় রূপকথার মতই। হাতি চলে বেশ দুলকি চালে। অমিত পরাক্রমী, ভ্রুক্ষেপ-হীন অথচ উদাস একধরণের রাজকীয় ভঙ্গিতে। পায়ের নিচে বুনো লতাপাতা পিষে, নুড়ি পাথর মাড়িয়ে, বন্ধুর পথ অবলীলাক্রমে পার হয়ে যায়। আমাদের চারপাশে এখন নয়নাভিরাম চিতবন। চলার পথ সবসময় প্রশস্ত নয়।গাছেরা মাঝেমাঝেই হাত বাড়িয়ে পথরোধ করছে।হাতির পিঠে থাকার ফলে আমরা এখন অনেকটা ওপরে।তাই কোথাও মাথা নিচু করে , কোথাও হাত দিয়ে ডালপালা সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।এই সময় গোটা দশ বারো হরিণের একটা দল ছুটে চলে গেল খুব কাছ দিয়ে।
একটু পরেই জঙ্গলের অন্দর মহলে ঢুকে পড়লাম। দৃষ্টিপথের দুপাশে যেন কয়েকতলা সবুজ বাড়ি। সবুজ, হাল্কা সবুজ, হলদে সবুজ, ঘন সবুজ, কালো সবুজ অন্তহীন সবুজের রাজ্যে দৃষ্টি আবদ্ধ। কোথাও সবুজের সঙ্গে সাদা, কোথাও ধূসর, কোথাও সামান্য হলদে বা লালের ছোঁওয়া বিকেলের আলোয় বিরল সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। বুনো ঘাসের গন্ধে বাতাস ভারি। পাতায় ঘাসে হাতির চলার মৃদু হলেও স্পষ্ট শব্দ। মাঝে মাঝে বাঁদরের হুপহুপ। এছাড়া চারিদিক শান্ত এবং গম্ভীর।
ক্রমশঃ মহাকায় গাছদের অঞ্চল ছেড়ে ঘাসের দিকটায় এসে পড়লাম। এই ঘাসের ইংরেজি ডাকনাম, এ্যলিফ্যান্ট গ্রাস। সার্থকনামা এই ঘাস কোথাও কোথাও হাতির চেয়েও মাথায় উঁচু। অভ্যস্ত ভাবে চলতে চলতে একটি জলধারা অতিক্রম করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল আমাদের হাতি। জলের ওপর ঝুঁকে পড়া একটি ঝোপ থেকে অবলীলায় পাতা সমেত একটি ডাল ভেঙ্গে মুখে পুরলো। তার কানের পেছনে হাত বুলিয়ে মাহুত বলল, ‘এ্যাই, এখুনি এক পেট খেয়েছিস না! আবার কেন?’ হাতির অবশ্য এসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চলা থামিয়ে ডাল চেবালো কিছুক্ষণ। চোঁচোঁ করে জল খেল প্রচুর। এমনকি, পাশে এসে দাঁড়ানো পেছনের হাতিটির গায়ে জলও ছিটিয়ে দিল স্পষ্টতই ইয়ার্কি করে!

নভেম্বরের শেষে ঘাসে ফুল ফোটার সময়, ধরা হয়, ঘাস পরিপক্ব হয়েছে। এই সময়টায় আসে পাশের গ্রাম থেকে কয়েক হাজার মানুষ চিতবনে চলে আসেন। ঘর ছাওয়ার জন্যে বা অন্য কাজের জন্যে বোঝায় বোঝায় ঘাস কেটে নিয়ে যান। পড়ে থাকা শুকনো ঘাসে এবং কেটে নেওয়া ঘাসের গোড়ায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে যান, যাওয়ার সময়। ঘাস ও মাটি পোড়ে। পোড়া মাটিতে বর্ষার জল পড়লেই, সবুজ সতেজ নতুন ঘাস আবার মাথা তোলে নতুন উদ্যমে। প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই প্রথা আজও বলবৎ। কর্তৃপক্ষ মনে করেন, আগুন ভেতরের দিকে যাতে না ছড়িয়ে পড়ে এটুকু সাবধানতা নিলে, এই আগুনে বনের বা বন্যপ্রাণীদের কোনো ক্ষতি হয়না। বরং তৃণভোজীদের খাদ্য ভান্ডার নতুন করে ভরে ওঠে। আর অরণ্য নির্ভর গ্রাম বাসীদের জীবন যাপনেও একটু সুরাহা হয়।
ঘাসের জন্যে এদিকটায় পথ প্রায় অবরুদ্ধ। স্বাভাবিক ভাবেই শুঁড় দিয়ে ঘাস সরিয়ে চলার পথ তৈরি করে চলেছে হাতি, আস্তে আস্তে বেশ সাবধানী পদক্ষেপে। একটু দূরে ঘাসের উচ্চতা কম বলে একটু খোলামেলা ভাব। গতি শ্লথ করতে করতে হাতিও সেদিকটায় এসে একসময় থমকে দাঁড়াল। কেন দাঁড়াল, এদিক ওদিক তাকিয়ে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের মাহুত ফিসফিস করে বলল, ‘সা’ব গেন্ডা’। পাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, প্রায় ৩০/৩৫ ফুট দূরে এক গণ্ডার জননী শাবক সমেত দাঁড়িয়ে আছে।কর্দমাক্ত ধূসর, নিরেট শরীর। মুখ নিচু করে কিছু খুঁজছিল বোধহয়, হাতির উপস্থিতি বুঝতে পেরে সহসা মুখ তুলল। ঘাসের বাধাবিঘ্ন সরিয়ে ভালো ছবি তোলার উপায় নেই। তবু, জলজ্যান্ত গণ্ডার এতো কাছে দাঁড়িয়ে আছে একথা ভাবলে শিহরণ হয়।

হাতির সঙ্গে গণ্ডারের কোনো প্রাকৃতিক বৈরিতা নেই। তবু আমাদের হাতির দিকে তাকিয়ে একটু যেন চঞ্চল, ব্যস্ত হয়ে উঠল বয়স্কা গণ্ডারটি। বাচ্চাটি তখনও একমনে ঘাস খেয়ে চলেছে। কিভাবে কি ভাব বিনিময় হল বুঝলাম না। আর সময় নষ্ট না করে সতর্ক মা তার ছটফটে বাচ্চাটিকে সঙ্গে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীরতর ঘাসের জগতে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর একটু এগিয়ে পাওয়া গেল তিনটি গণ্ডারের একটি ছোট দল, সেই একই রকম, একটু খোলামেলা জায়গায়। এটা নিঃসন্দেহে বিরল দৃশ্য কারণ গণ্ডাররা সাধারণতই দল বেঁধে থাকেনা। এই দলে একটিও শিশু নেই। বোঝাই যাচ্ছে তিন ‘এডাল্ট’ বেরিয়েছেন, একটু বৈকালিক আড্ডা মারতে! দেখা হল সাম্বরদের দুটি দলের সঙ্গেও। বাঘ বা লেপার্ড প্রত্যাশিত ভাবেই কপালে জুটল না। ঘাসের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে সূর্য্য অস্ত গেল।গাছের মাথায় পাখিদের কোলাহল শুরু হল আর একটু পরে।
ফেরার পথে হাতির সঙ্গে অনর্গল কথা বলছিল আমদের মাহুত। তার এই ভাব বিনিময় যে নেহাত একতরফা নয়, তার প্রমাণ পেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। একটা ভাঙ্গা ডাল পড়েছিল রাস্তা জুড়ে। হাতির কানের পেছনে হাত বুলিয়ে মাহুত বলল, ‘তুলে নে, রাজু ওটা তুলে নে তো’! আমাদের অবাক করে হাতিটিও বাধ্য ছেলের মত শুঁড় দিয়ে ডালটি তুলে নিয়ে পথ হাঁটতে লাগলো। জিজ্ঞাসা করলাম, ডালটা কি কাজে লাগবে? মাহুত বলল, কেটে জ্বালানি করবো, রান্নার কাজে লাগবে। তাছাড়া কাঠের ধোঁওয়া করলে আমার এবং হাতিদের মশাও কম লাগবে।

নয়নাভিরাম এই অরণ্য, তার অধিবাসী ও তাদের নির্ভেজাল সখ্যতা ভালো না লেগে উপায় নেই। ‘চিতবন’ শব্দের উৎপত্তি চিত্ত থেকেই। যে বন কানায় কানায় চিত্ত ভরে দেয়, তা ই চিতবন, এইভাবেই কথাটা এসেছে কি! প্রাচীন হিন্দিতে অবশ্য ‘চিতবন’ শব্দটি দৃষ্টি বা নজর অর্থে ব্যবহৃত হত। নান্দনিক গুণের জন্যে যে বন এক নজরেই ভালো লেগে যায়, তাই চিতবন। আর যদি বাংলা করে বলতে হয়, কি বলা হবে, নন্দন বন? না কি ‘মায়া কানন’? এলোমেলো এই সব ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতি-ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। দিন শেষ, আজকের মত যাত্রাও শেষ। রাত অবশ্যই বাকি। শরীরে ক্লান্তি, মনে পুলক একটা দড়ির খাটিয়ায় বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখলাম কাঁসার বড় থালার মত বড় গোল চাঁদ উঠেছে। অলৌকিক জ্যোৎস্নায় শিবালিকের ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গা এলিয়ে শুয়ে আছে শান্ত সমাহিত চিতবনের অরণ্য। পুরানো একটি কবিতার একটি লাইন হটাতই মনে পড়ে গেল। ‘জানিনা রাত্রি গড়াবে কোথায়, কিসের অন্বেষণে!’
-------------
( মুম্বই সংস্করণ আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবারের ক্রোড়পত্রে এই লেখাটি ২০০৬ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে সামান্য কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।)
লেখক পরিচিতি: লেখক অবসরপ্রাপ্ত আই এফ এস আধিকারিক এবং ঔপন্যাসিক।
Comments