top of page
  • ..

পর্যটন যখন বন্যপ্রাণীর শত্রু

দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জনপ্রিয় পর্যটনস্থলে বন্যপ্রাণীদের এমন ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে যা যেমন তাদের সংরক্ষণে বাধা সৃষ্টি করছে , তেমনই পশু নির্যাতনের বিশ্রী উদাহরণ হিসাবে উঠে আসছে। অথচ সচেতনতার অভাবে সাধারণ মানুষদের অনেকেই তাতে অংশ নিয়ে সেই অন্যায়ের ভাগীদার হচ্ছেন। সেই নিয়েই কলম ধরলেন ড:ঐশিমায়া সেন নাগ




বেশ কিছু বছর আগের কথা। কোন চিতার গায়ে হাত বোলানো, বিরাট একটা অজগরকে নিজের গলায় জড়িয়ে ধরা বা রঙোজ্জ্বল কোন ম্যাকাও পাখিকে নিজের হাতে বসিয়ে ছবিতে পোজ্ দেওয়া অনেকটা “স্বপ্ন সত্যি হল” জাতীয় ব্যাপার ছিল আমার কাছে, যখন আমি আফ্রিকা বা উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে সফরে গেছিলাম। সেখানে এমন “animal encounter” অ্যাডভেঞ্চার হয়ে থাকে অনেক স্থানেই। অথচ এখন আমি আতঙ্কিত বোধ করি রীতিমত এমন কিছু কথা ভাবলেই। যদিও সেইসব জায়গায় এই ভাবে পশুদের ব্যবহার আইনসিদ্ধ, কিন্তু তা আসলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও তাদের ভাল থাকার পক্ষে অন্তরায় বই কিছু নয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে জ্ঞান বাড়াতে এখন বুঝতে পারি কতটা সচেতনতার অভাব থেকে মানুষজন এইসবে অংশ নেয়। হয়ত তারা পশুপাখিদের ভালই বাসে, কিন্তু বোঝে না এতে তাদের কতটা ক্ষতি হচ্ছে। গবেষণায় প্রমাণিত যে , প্রতি বছর ২০ থেকে ৪০ লাখ পর্যটক এই ধরনের বন্যপ্রাণী নিয়ে খেলার পিছনে অর্থ ব্যয় করেন যা আদপে ওদের ক্ষতি করে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অন্তরায় সৃষ্টি করে।


বন্দী পশুদের প্রদর্শনী


সোশাল মিডিয়ার অনেক ছবি ও ভিডিওয় আপনারা দেখেছেন হয়ত যে, মানুষ কোন কোন স্থানে বন্দী বাঘেদের গায়ে নিশ্চিন্তে হাত বোলাচ্ছে আর সেইসব ছবি ফলাও করে দেখাচ্ছে সবাইকে। কোথাও বা আবার ছোট বাচ্চারা আদর করছে সিংহের শাবকদের বা বোতলে করে দুধ খাওয়াচ্ছে, হাতি কোথাও বা দর্শকদের সামনে খেলা দেখাচ্ছে, আবার কোথাও গোটা পরিবার খেলছে ধরে রাখা ডলফিনের সাথে। সোশাল মিডিয়ায় এমন সব ছবিতে ছেয়ে গেছে।

অক্সফোর্ড বিশ্বিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে এগুলো সবই আসলে একধরনের পশু নির্যাতন, দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহারের পরিচয়। পশুরা এই সব স্থানে বিকৃত এক পরিবেশে বাস করে, নিষ্ঠুর ভাবে প্রশিক্ষিত করা হয় তাদের, অনেকসময়ই বিশেষ ওষুধের সাহায্যে তাদের দর্শকদের সামনে বাধ্য, সংযত, শান্ত করে দেওয়া হয়। এইসবই তাদের সার্বিক ভাল থাকা ও সুস্থ থাকার পরিপন্থী। পশুদের তাদের শৈশবে মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। দর্শকরা আসে, তাদের আদর করে, খেতে দেয়। এসবের ফলে ওদের স্বাভাবিক বিশ্রাম ও স্বাস্থ্যের ব্যঘাত ঘটে, অপুষ্টির শিকার হয় ওরা। এমন সব জায়গায় পর্যটকরাও যে সম্পূর্ণ নিরাপদে থাকেন তা তো নয়। এইসব পুশদের স্বভাবগত বন্যতা তো থেকেই যায়, যা তাদের আক্রমণাত্মক করে তোলে নির্যাতন বাড়বাড়ি অবস্থায় চলে গেলে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সাথে এসবের কোন সম্পর্ক নেই। এইসব করাই হয় বিনোদনমূলক ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে।



বন্যপ্রানীর খামার ও তার থেকে উৎপন্ন দ্রব্য


আপনারা নিশ্চই এক ধরনের ভাম বিড়াল থেকে পাওয়া বিশেষ এক ধরনের কফি kopi luwak এর নাম শুনেছেন। আর হয়ত কখনও না কখনও ভেবেছেনেই এ জিনিস একবার না একবার চেখে দেখতেই হবে। এই কফি তৈরি হয় Asian palm civet এর মল থেকে পাওয়া পুরোপুরি হজম না হওয়া কফির বীজ থেকে। এই কফির নির্মাতারা ভাম বিড়ালদের খুবই অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে প্রতিপালন করে। জোর করে ওদের কফির দানা খাওয়ায় উৎপাদন বাড়াতে। এইসব পশুখামারে ঘুরতে যাওয়া আর এই কফি খাওয়া মানে তাই বন্যপ্রাণীর উপর নির্যাতনকেই মদত দেওয়া। এইসব চাষের ফলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণও ব্যহত হয়, যেহেতু এই ভামদের বন্য পরিবেশ থেকেই ধরা হয়।



হাতির পিঠে চড়া



২০১২ সালে রাজস্থানের জয়পুরে আমি বেড়াতে গেছিলাম একটি পর্যটন সংস্থার সাথে। ওরা ঐতিহাসিক আমের দুর্গে হাতিতে চড়ে দেখানোর ব্যবস্থা রাখেনি শুনে খুব ক্ষব্ধ হয়েছিলাম মনে আছে। আজ এত বছর পর আমি ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাই যে, ভাগ্যিস সেবার আমি হাতিদের উপরে নির্যাতনের সবথেকে খারাপ ঘটনাগুলোর একটিতে অংশ নেবার থেকে বেঁচে গেছিলাম।

“Refuse to Ride” বলে একটি প্রচার চালানো হয়েছিলে একবার Wildlife SOS নামক একটি এন জি ও –র তরফে। তখন তাদের হয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার সময়ে আমি জানতে পারি আমের দুর্গের হাতিরা সারা জীবন কতটা নির্যাতন ভোগ করে। শৈশবে মায়ের থেকে কেড়ে নিয়ে আসার সময় থেকে যার শুরু হয়। তাদের বাধ্য বানাতে নির্দয় ভাবে প্রহার করা হয়, বদ্ধ নোংরা স্থানে বন্দী করে রাখা হয় দিনের পর দিন আর গরমে তেতে যাওয়া দুর্গের পাথরের উপর দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের হাঁটতে হয় পর্যটকদের কাঁধে নিয়ে। তাদের মধ্যে অনেকেই পায়ের অসুখে ভোগে, অন্ধ হয়ে যায় ও আরো নানারকম শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবু তাদের রেহাই নেই। এই সব ঘটনা জানলে আমি নিশ্চিত যে, যে অনেক সংবেদনশীল পর্যটক আর এভাবে হাতির পিঠে চড়তে চাইবেন না।



বন্যপ্রাণীর স্যুভেনির


জ্ঞানই আসল শক্তি। সবক্ষেত্রেই। বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রেও। তা শুধু বিপন্ন প্রজাতিকেই বাঁচায় না, আপনাকে জেলে যাওয়ার থেকেও বাঁচাতে পারে। বন্যপ্রাণী দেহাংশ সঙ্গে রাখা বেআইনি অনেক দেশেই। সেখানকার আইন না জানলে তা কারুকে বিপদে ফেলতে পারে সতর্ক না থাকলে। বন্যপ্রাণীর দেহাংশ থেকে সংগ্রহ করা স্মারকদ্রব্য বা সুভ্যনির যেমন সাপের খোলক, পাখির পালক, সমুদ্র অশ্ব বা সামুদ্রিক কচ্ছপ থেকে তৈরি সব দ্রব্য একেবারেই ব্যবহার করা যাবে না। এমনকি সমুদ্রসৈকতে ঝিনুক বা কোরালের তৈরি যেসব সামগ্রী পাওয়া্ যায় তা হয়ত অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকতে পারে পরিবেশের ক্ষতি করে। আমরা জানি কোরাল বা প্রবালের প্রাচীর কিভাবে সমুদ্র সৈকত রক্ষা করে বড় ঢেউয়ের থেকে , আবার মাছেদের প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। হাজারে হাজারে পর্যটক সমুদ্রসৈকতে গিয়ে প্রবাল নির্মিত স্মারকদ্রব্য কিনলে তা শেষমেশ প্রবাল প্রাচীরের ক্ষতি করে সমুদ্রে। ঝিনুকের খোলক তো অনেকসময় প্রাণীগুলোকে জ্যান্ত সিদ্ধ করেই ভেতরের প্রাণীটিকে মেরে পাওয়া যায়। এ তো সরাসরি নৃশংসতা!



বিদেশি প্রজাতিকে নিয়ে ঘরে আসা


বোটানিক্যাল গার্ডেন, যেখানে নানা দেশি-বিদেশি প্রজাতির উদ্ভিদ থাকে, সেখান থেকে হয়ত কোন সুন্দর বিদেশি প্রজাতির গাছের বীজ এনে আপনার এলাকায় লাগানোর শখ জাগল। কিন্তু স্থানীয় এলাকার না হলে সেই গাছ ওইখানকার পরিবেশের জন্য একটা বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। বংশবিস্তার করে সে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় উদ্ভিদের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তোলে। জন্তুজানোয়ারের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য । এমন একটা উদাহরণ হল দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার বর্মিজ পাইথনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় দাপিয়ে বেড়ানো। কেউ তার পোষ্যকে অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার ফল। এদের আগ্রাসী প্রকৃতির সামনে ওখানকার অনেক স্থানীয় প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে। তাই কোথাও ঘুরতে গেলে সেখানকার বন্যজীবনকে দেখুন, উপভোগ করুন। আর শুধু তাদের দেখার স্মৃতি নিয়েই ফিরে আসুন।

প্রজাতি হিসাবে আমরা মানুষরা চারপাশের পরিবেশের যে বিস্তর ক্ষতিসাধন করছি, আমাদের তাই যথেষ্ট সতর্ক থাকা দরকার যাতে আমাদের কাজের জন্য বাস্তুতন্ত্রে ব্যাঘাত না ঘটে। বন্যপ্রাণীদের এমনভাবে ব্যবহার করব না যা তাদের কষ্টের কারণ হয়, তাদের বিপন্ন করে তোলে। প্রকৃতিকে উপভোগ করার তো অনেক উপায়ই রয়েছে। যেমন বনপথে ট্রেক করে যাওয়া, ন্যাশানাল পার্কে ঘোরা, পাখি দেখা, ক্যাম্পিং করা, নদীতে বা সমুদ্রে সাঁতার কাটা প্রভৃতি। দায়িত্বশীল পর্যটক হন আর অন্যদেরকেও সচেতন করুন।



লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বর্তমানে বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহযোগী সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।

Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page