top of page
  • ..

বিদেশি পোষ্যের (exotic pet) বাড়তে থাকা চাহিদায় বিপন্ন জীবজগৎ

বিদেশ থেকে আসা বন্য জীবজন্তুর প্রতি লোভ আছে একটা অংশের মানুষের দেশে দেশে। এর ফলে আইন ভেঙ্গে চলছে এইসব পশুপাখিদের ওপর দুর্বিষহ নির্যাতন,পাচার। বিপন্ন হয়ে পড়ছে তাদের অস্তিত্ব। প্রমাদ গুনছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা। লিখছেন ড: ঐশিমায়া সেন নাগ



ম্যাকাও: বহুল প্রচলিত একটি বিদেশি পাখি

বন্য বা বহিরাগত পশুপাখি পোষা যদি আপনার বড় একটা শখ হয়, তবে বলব আর একবার ভাবুন। এই exotic pet এর গল্প পুরোটাই দু:খ-কষ্ট আর ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায় ভরা যা কোন কোন প্রজাতির অস্তিত্ব সংকটে ঠেলে দেয়। এই জাতীয় পশুপাখির আন্তর্জাতিক ব্যবসা এমনকি মানব সভ্যতার পক্ষেও বিপদের কারণ হতে পারে zoonotic অসুখ ছড়িয়ে। এইসব কুৎসিত দিকের কথা মাথায় রাখলে এই ব্যবসা কমে আসার কথা। অথচ বাস্তব বলছে উল্টো কথা।


এই exotic pet আসলে বন্যজীব যাকে পোষ মানানো যায় না। পোষা প্রাণীরা অন্য প্রকৃতির হয় যা হাজার বছরের বেশি সময়ে পোষ মেনে এসেছে। সাপ, টিয়াপাখি, ম্যাকাও, বাঘ, ভোঁদড়, কুমীর, বাঁদর এসবই বহিরাগত বা exotic পোষ্যর তালিকায় পড়ে। এই বন্যতা বা বিদেশি হওয়াটাই এদের চাহিদার মূল কারণ যার জন্য অনেকেই বিশাল অঙ্কের টাকা দিতেও রাজি। কিন্তু সেই মালিক যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে তার সাধের পোষ্যকে পাবার জন্য, তাকে আদরে ভরিয়ে দেবার জন্য, বন্ধু-বান্ধবকে দেখাবার জন্য , অন্যদিকে সেই সব প্রাণীদের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্দশা।

দেশি বিদেশি যে কোন টিয়া পোষাই বেআইনি


বিদেশি পোষা প্রাণীর যন্ত্রণাময় যাত্রা



মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের এই ব্যবসা বিস্তৃত গোটা বিশ্ব জুড়ে। ব্যবসার প্রয়োজনে এইসব জীবদের হয় বন্য পরিবেশ থেকে ধরা হয় অথবা পালন করা হয় বন্দীদশায়। বিভিন্ন দেশে আইনের ফারাকের কারণে কোন দেশে কোন জীবের বিক্রি নিষিদ্ধ আবার কোথাও বা আইনসম্মত। তাই তাদের অজান্তেই এইসব জীবের মাথার ওপর যে বিপুল দাম নির্ধারণ হয়ে যায়, কোন যথাযথ আইনের অভাবে এইসব জীবরা বহুমূল্য সামগ্রীর ন্যায় ক্রেতার কাছে উপস্থিত হয়।

এইসব বহুমূল্য জীবেদের যে যাত্রা বন্দী হওয়া থেকে পাচার হয়ে বাজারে বিক্রি হতে আসার- তা পুরোটাই রক্তে রঞ্জিত। নিষ্ঠুরতা চরম রূপ নেয় যখন যখন এদের ফাঁদ পেতে ধরা হয়, পঙ্গু করে দেওয়া হয়, বস্তাবন্দী করা হয়, আটকে রাখা হয়, বোতলে ভরা হয় আর এসবই করা হয় লুকিয়ে পাচার করার জন্য। বেশিরভাগ জন্তু বা পাখিই এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। যারা টিকে যায়, তাদের বাকি জীবনটা হয়ে যায় দুর্বিষহ। এই জন্য আবার চাহিদার থেকে বেশি সংখ্যায় ধরা হয় এই জন্তুদের, যা সমস্যাটা আরও বাড়িয়ে দেয়। তথাকথিত এইসব বিদেশি বহুমূল্য পোষ্যদের পাঁচটির মধ্যে চারটিই মারা যায় পাচারের সময়ে বা ধরার এক বছরের মধ্যে। এইসব exotic pet দের না থাকে যথাযথ আশ্রয়, খাদ্য, না থাকে ঘুরে ফিরে চলার স্হান, না পায় শরীরে তাপমাত্রা টিকিয়ে রাখার যথাযথ পরিবেশ।

খাঁচায় বন্দী গিরগিটি

এইসব বহুমূল্য বিদেশি পোষ্যর চাহিদা বহুদিনই ছিল, কিন্তু এখন যেন তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। অতীতের রাজা রাজড়ারা যেমন তাদের প্রাসাদ বাঘ, সিংহ, হাতির মত জন্তুতে ভরিয়ে রাখত, এখনকার দিনে আমেরিকা-ইউরোপের বহু ঘরে রয়েছে ৫০০০-১০০০০ বন্দী বাঘ, হাজার হাজার অন্য এমন পোষ্য যেমন ম্যাকাও, শিম্পাঞ্জি, ট্যারান্টুলা, পাইথন প্রভৃতি। বেশি বেশি সংখ্যায় লোকের হাতে যে অতিরিক্ত অর্থ এসে গেছে তা তারা ব্যবহার করছে এইসব পোষ্য রাখতে। এদের কাছে এইধরনের দুর্মূল্য প্রজাতির জীব রাখা একটা ফ্যাশনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন জায়গায় এদের পোষাটা আবার সামাজিক সম্মান ও প্রতিপত্তির সূচক। এই ধরনের ব্যবসা সবসময়েই জীবগুলির বাসস্থান যেসব দেশে তার আইনের পরিপন্থী হয়ে থাকে।

খাঁচায় বন্দী বনের পাখি

ইন্টারনেটকে এখন এই অবৈধ ব্যবসার বাড়বৃদ্ধির পিছনে বড়ভাবে দায়ী করা হচ্ছে। এই মাধ্যমে প্রচার, বিজ্ঞাপন, যোগাযোগ, কেনাবেচা, মূল্য চোকানো এখন সহজ হয়ে গেছে। ফলে আইনরক্ষকদের কাছে এই ব্যবসা রোখাটা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ক্রয়ক্ষমতা বাড়বার সাথে এই ব্যবসাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের সংরক্ষণবিদরা exotic pet এর আকাশছোঁয়া চাহিদা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। Wildlife Conservation Trust (WCT) এর সভাপতি ও বিশিষ্ট প্রকৃতি সংরক্ষণবিদ শ্রী অনীশ আন্ধেরিয়া বললেন, "ভারত যেমন এই অবৈধ ব্যবসার উৎস হিসাবে কাজ করছে, তেমনই এখানে রয়েছে এর বড় বাজার। একদিকে বিদেশি দুর্লভ সব প্রজাতি এদেশে যেমন নিয়ে আসা হচ্ছে, তেমন ভারত থেকে পাচার হচ্ছে বহু জন্তু। আশার কথা এই যে, ভারত সরকার Wild Life (Protection) Act, 1972 এ কিছু পরিবর্তন এনে CITES এর তালিকাভুক্ত যেসব জীবের বেচাকেনা নিষিদ্ধ তাদের আইনি রক্ষাকবচ দেবে। " তাঁরা এখন "Trapped In Trade" নামে একটি প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন এ বিষয়ে দেশব্যাপী সচেতনতা গড়ে তুলতে। ড: আন্ধেরিয়া আরও বললেন, " এই বিদেশি বহুমূল্য জীবের ব্যবসা জীববৈচিত্রের পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকারক। যেসব দেশে এদের পাওয়া যায়, এই ব্যবসার ফলে সেখানে এদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বহিরাগত জীবদের ছেড়ে দিলে পরিবেশেরও স্হায়ী ক্ষতি হয়। এইসব জীবদের থেকে মানুষে ও দেশীয় জীবজন্তুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে zoonotic অসুখ।Covid 19 হয়ত তার একটা বড় উদাহরণ"।

যুক্তরাষ্ট্রে খাঁচায় বন্দী বাঘ

তিনি আরও জানালেন যে এই অবৈধ জীবজন্তুদের ব্যবসা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অবৈধ ব্যবসা এবং অন্য কালোবাজারের সাথে এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ যেমন- মানব পাচার, মাদক, অস্ত্র ও জাল টাকার অবৈধ কারবার।

এইসব কারণে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও সংরক্ষণবিদরা এই ধরনের বিদেশি জীবজন্তু পোষায় আপত্তি জানান। জনগণ ও আইনপ্রনেতাদের কাছে তাদের আবেদন এই বিষয়ে সচেতন হবার, যথাযথ আইন প্রণয়নের জন্য সোচ্চার হবার। CITES (Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Fauna and Flora) হল তেমন একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করতে অঙ্গীকার করেছে।


উত্তরবঙ্গে উদ্ধার হওয়া ক্যাঙ্গারু



আইন প্রণয়নকারী সংস্হাগুলিরও এ বিষয়ে আরও সচেতনতা ও শিক্ষার দরকার যাতে তারা এইসব প্রাণীদের অবৈধ পাচার রোধ করতে পারে ও অপরাধীদের সাজা সুনিশ্চিত করতে পারে। অসহায় জীবেদের এই কান্না আমরা আর কতদিন সহ্য করব!



লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বর্তমানে বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহযোগী সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।



2 e paa_edited.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page