top of page
  • ..

পুরানো দুর্গে মুখোমুখি চিতাবাঘের ছানার : পালামৌর জঙ্গলে

পালামৌ টাইগার রিজার্ভ ভারতের অন্যতম পুরানো টাইগার রিজার্ভ। একসময়ে এখানে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুললেন শ্রী সঙ্গম লাহিড়ী





মে মাসের এক ঘর্মাক্ত দুপুর। আমরা সেদিন বেতলা রেঞ্জের কম্পার্টমেন্ট নং ১ এর থেকে ফিরছিলাম । আমাদের সাথে এক ট্র্যাকার ব্রহ্মদেও সিং এর দেখা পথে। তিনি পাগলের মত হাত নাড়াচ্ছিলেন দূর থেকেই, অর্থাৎ কিছু বার্তা দেবার আছে তার। তিনি খুব হাঁপাচ্ছিলেন, সেই অবস্হাতেই বলতে শুরু করলেন যে, তিনি ও আরো তিন ট্র্যাকার দুটি ছোট বাঘের বাচ্চাকে শুয়ে শুয়ে খেলতে দেখেছেন পালামৌ দুর্গের ধ্বংসাবশেষের এক অংশে সেদিন সকালে। আমি একটু উপহাসই করলাম প্রথমে তার এই গল্পকে কারণ আমি জানি বেতলার বাঘিনী বেগম গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মত বাচ্চা দিয়েছে এবং তাই দ্বিতীয়বার তার বাচ্চা দেওয়া এখন সম্ভব না, কারণ প্রথম বারের বাচ্চাগুলোই এখনও নিজে থেকে শিকার করতে শেখেনি।তবে ট্র্যাকাররা তো আর সাধারণ লোকের মত নয় এবং তাদের জ্ঞানের সামনে অনেক সময়েই অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরাও উপহাসের পাত্র হয়ে যায়।খুবই কৌতুহলজনক বলে মনে হল আমার বিষয়টা তাই।

কোন প্রশ্ন না করে আমি ব্রহ্মদেওকে গাড়িতে তুলে নিলাম বেতলা থেকে ওর বলা জায়গাটার দিকে। বেতলায় আমি আমার আশাহি পেন্টাক্স ক্যামেরাটা নিয়ে নিলাম। আর সময় নষ্ট না করে পাকা সড়কের তিন রাস্তার মোড়ে চলে এলাম যেখান থেকে আমাদের এক কিলোমিটার ট্রেক করতে হবে হালকা জঙ্গল এলাকার মধ্যে দিয়ে। ওই তিন রাস্তার মোড়ে আমি একটু অবাক হলাম রংবেরঙের পোষাক পরা একদল উৎসাহী পর্যটককে দেখে যারা এমন কারুর খোঁজ করছে যে তাদের ওই বাঘের বাচ্চাদের জায়গায় নিয়ে যাবে।অদ্ভুত! এই খবরটা বেতলায় পর্যটকদের কাছে গেল কিভাবে? এ তো এক অদ্ভুত পরিস্হিতি। একদল পর্যটক যারা আমাদের সাথে যাবার জন্য জোর করতে লাগল তাদের সাথে একটা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হয়ে গেল। শেষে আমার বিশ্বস্ত ড্রাইভার চন্দ্রিকা প্রসাদকে নির্দেশ দিতে হল ব্যাপারটার কড়া ভাবে ব্যবস্হা নিতে আইন মোতাবেক। কয়েকজন পর্যটক পরিস্হিতিটা শান্ত করার চেষ্টা করলেন এই বলে যে তারা সবাই নাকি WORLD WILDLIFE FUND OF INDIA-র সদস্য, তাই তাদের সাধারণ পর্যটক হিসাবে দেখা যাবে না। কিন্তু এইসব সত্ত্বেও, চন্দ্রিকা আর আমাদের কিছু বনরক্ষী আর ট্র্যাকার মিলে তাদের বেতলায় ফেরৎ পাঠানো নিশ্চিত করলেন আইনের ভয় দেখিয়ে যে এভাবে বিনা অনুমতিতে সংরক্ষিত এলাকায় নিয়ম ভেঙ্গে প্রবেশ করলে তার ফল কী হতে পারে।

ঠিক ৪ টা নাগাদ আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম একটা সরু পায়ে চলা পথ ব্যবহার করে। ব্রহ্মদেও সিং, নানু মাহাত, রাণাওয়াত সিং, কির্তি সিং আর বনরক্ষী রামপরভিস দুবে আমাকে বিজয়ীর ভঙ্গিমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ওই জায়গায় ১৫ মিনিটের মধ্যে। জায়গাটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ, এমনকি উপস্হিত হনুমান বা বাঁদররাও কোন উৎপাত করছে না। আমরা যখন দুর্গের একটা ভেঙ্গে পড়া দরজায় পৌঁছালাম তখন অন্ধকার হতে শুরু করেছে। ট্র্যাকাররা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যেতে ইচ্ছুক নয় মা বাঘের থেকে চকিতে কোন আক্রমণের আশঙ্কায়, যে হয়ত আশেপাশেই আছে বলে তারা মনে করছেন। এই কারণে আমি একটা ছোট বাঁশের খোঁট নিয়ে দেওয়ালে আওয়াজ করলাম এটা দেখতে যে, সত্যিই মা তার বাচ্চাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে কিনা। পাঁচ মিনিট পর আমরা এই ভাঙ্গা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিলাম, কয়েকজন ট্র্যাকারকে আশেপাশে পাহারায় রেখে যাতে বাঘিনীর কোন আক্রমণ হলে সতর্ক করতে পারবে।

সৌভাগ্যক্রমে , প্রবেশ করার পরে আমরা দেখলাম দুটি লেপার্ডের বাচ্চা তখনও একটা বড় পাথরের পিছনে শুয়ে, নিজেদের লোকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আমি পাথরটায় একটা লাঠি দিয়ে শব্দ করলাম। আমাদের চমকে দিয়ে বাচ্চাদুটি ফুঁসে উঠল আর আমাদের সামনে রক্ষণাত্মক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে গেল। মিষ্টিভাবে একটা গর্জনও করল আমাদের উপস্হিতিতে যে তারা বিরক্ত সেটা বোঝাতে। আমি আমার ক্যামেরার লেন্স ওদের ওপর ফোকাস করার চেষ্টা করলাম দুর্লভ একটা ছবি পাবার জন্য, কিন্তু ওরা খুবই কাছে ছিল। তাড়াতাড়ি আমার সাধারণ লেন্সটা লাগিয়ে নিলাম আর ফ্ল্যাশটাও লাগালাম যেহেতু আলো একেবারে কমে এসেছিল আশেপাশে। এগুলো যখন করছি, তখন নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে গেল একটা কাঁকড় হরিণের তীব্র চিৎকারে। অ্যালার্ম কল। সেটা একটা জায়গা থেকেই ডেকে চলল যেটা কাছের একটা টিলার ঠিক ওপরে। আমরা ওই জায়গায় ওর ৭ টা কল গুনতে পারলাম যার পরে আওয়াজটা মৃদু হয়ে আসতে লাগল। হরিণটা আমাদের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বোঝার জন্য যথেষ্ট যে শিকার ও শিকারি একে অপরকে চিহ্নিত করতে পেরেছে।কাঁকড় হরিণটি যখন বুঝতে পেরেছে তাদের মধ্যে আর নিরাপদ দূরত্ব নেই বা মা লেপার্ডটি এগোতে শুরু করেছে, তখনই সে সরে যেতে থাকল।

কমে আসা আলোয় এটা কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে বিপজ্জনক পরিস্হিতি। আর অপেক্ষা না করে আমি বাচ্চাগুলির ওপর ফোকাস ঠিক করলাম আর ১২ টা মত ছবি তুলে নিলাম বিভিন্ন অ্যাপারচার আর দূরত্বে।লেন্সে পরিষ্কার বোঝা গেল যে এরা লেপার্ডের বাচ্চাই, বাঘের নয় যেটা ভুল করে আমাদের ট্র্যাকাররা ভেবেছিলেন। তাদের দোষ দেব না কারণ, কাছ থেকে এই বাচ্চাদের পরীক্ষা করে দেখাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অরণ্যের মধ্যে। আমার ধারনা বাচ্চাদুটির বয়স দু'মাসের বেশিই হবে। একটা ব্যাপার মাথায় ঘুরছিল যে- আমরা ওদের এমন কিছু বিরক্ত যেন না করি যাতে ওদের মা ওদের ফেলে চলে যায়। সেটা নিশ্চিত করতে আমরা প্রবেশ পথের মুখে কিছু পায়ের ছাপ বোঝার প্যাড রেখে এলাম যাতে পরের দিন দেখে নিশ্চিত হতে পারি যে মা লেপার্ডটি ওদের কাছে এসেছিল কি আসেনি।

ভাগ্যক্রমে, পরেরদিন আমরা বুঝতে পারলাম যে মা লেপার্ড এসে বাচ্চাদের নিয়ে গেছে ওই ধ্বংস-প্রায় দুর্গ থেকে অন্য কোন নিরাপদ স্হানে। পায়ের ছাপ অনুসরণ করে আমরা ঔরঙ্গা নদীতে চলে এলাম যেখানে নদীর বুকে মা ও তার দুই বাচ্চার পায়ের ছাপ স্পষ্ট। তিনজনেই নদীর বুক ধরে এগিয়ে গেছে আবার বনে উঠে যাবার আগে অবধি এবং নদীর অপর পাড়ে ডালটনগঞ্জ উত্তর বিভাগের ক্ষীয়মাণ জঙ্গলে মিশে গেছে।



লেখক পরিচিতি: শ্রী সঙ্গম লাহিড়ী পালামৌ টাইগার রিজার্ভে দীর্ঘ ৩৮ বছর বন অধিকারিক হিসাবে কর্মরত ছিলেন ও ঝাড়খন্ড বনবিভাগের ডি এফ ও (সোশাল ফরেস্ট্রি) হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। Pugmarks in Palamau বইয়ের লেখক।


রচনাটি লেখকের Pugmarks in Palamau গ্রন্হ থেকে অনুমতিক্রমে অনুদিত ও বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হল।




অনুবাদ: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।






142 views0 comments
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page