top of page
  • ..

যখন মুখোমুখি বাঘ আর বুনো কুকুরের দল: পালামৌর জঙ্গলে

পালামৌ টাইগার রিজার্ভ ভারতের অন্যতম পুরানো টাইগার রিজার্ভ। একসময়ে এখানে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুললেন শ্রী সঙ্গম লাহিড়ী


ছবি: wikimedia commons


নরেশ মাহাতো ছিলেন বাওহারিয়া গ্রামের এক বাসিন্দা। গ্রামটা বেতলার কাছাকাছি। আমি যখন ১৯৮৩ তে গেম ওয়ার্ডেন হিসাবে যোগ দিই, তখন সবথেকে বেশি গবাদি পশু রাখার কৃতিত্ব ছিল ওই এলাকায় তাঁর। বেতলার বাঘিনীর চারটি শাবক বড় হবার সাথে সাথে তারা মাহাতোর গবাদি পশুদের বড় একটা অংশ পেটে চালান করে। এর মধ্যে লেপার্ডরাও তাদের মত করে কাজ সারে বিশেষত: ছোট ছোট পশুগুলোকে খয়ে। শেষে বেচারা মাহাতোর মাত্র এক ডজন গরু ও মহিষে এসে দাঁড়ায়। যদিও আশ্চর্যজনকভাবে, তিনি ব্যাপারটাকে বেশ সহনশীলতার সাথেই গ্রহণ করেন, হতে পারে বন বিভাগ থেকে তাঁকে যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলেই হয়ত। যদিও তাঁর কোঁচকানো মুখ আর শান্ত গলায় বোঝা যেত এগুলো কাটিয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে তখনও সম্ভব হয়নি, যে ঘটনাগুলো তাঁর ভাষায়-'প্রাকৃতিক দুর্বিপাক"!

একটা ন্যাশনাল পার্কের পাশেই থাকায় মাহাতোর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল জন্তু জানোয়ারের গতিবিধি অনুভব করার। হালকা ঘুমের মধ্যেও বাঘের চাপা হুংকার ঠিক শুনে নেন।ঘ্রাণশক্তিও তাঁর প্রবল আর জানোয়ারের আচরণের প্রতি তার সহজাত একটা টান আছে, আছে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা। তাই তিনি যখন এক সন্ধ্যায় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বললেন কিভাবে তাঁর বাড়ির উঠোনের কাছাকাছি এলাকায় বেতলার বাঘিনীটিকে একদল বুনো কুকুর কোণঠাসা করে ফেলেছে, আমি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখলাম। এর আগে অবধি আমি জংলী কুকুরদের বাঘকে তাড়িয়ে তার এলাকার বাইরে বার করে দেবার গল্প শুনেছি। কিন্তু একটা বড়সড় শিকারি জন্তুকে বনের বাইরে বার করে দেবার ব্যাপারটা প্রকৃতির নিয়মের বাইরেই মনে হল। বিষয়টা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক, 'প্রকৃতিতে সবই সম্ভব' আমার মনে হল।

ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে আমি আমার রাজদূত মোটর সাইকেলে বার হলাম পরদিন সকাল সাতটায়, সেই এলাকায় পৌঁছলাম মাহাতোর বর্ণনা মত। জায়গাটা একদম ল্যান্টানার ঝোপে পূর্ণ, মাঝে মাঝে মাঝারি আকৃতির পলাশ গাছ। এমন এলাকায় পা রাখা যে কোন অনভ্যস্ত লোকের পক্ষে বেশ কঠিন, কিন্তু নি:সন্দেহে জায়গাটা বাঘেদের শিকারের জন্য ওৎ পাতার বা বুনো কুকুরের বাচ্চা দেবার জন্য আদর্শ। দুটো হিংস্র প্রাণীই এমন জায়গা ব্যবহার করে, যদিও আলাদা আলাদা কারণে- একজন শিকারের জন্য, একজন নিরাপদে থাকার জন্য। আমি দক্ষ ট্র্যাকার জামির মিঞার সাথে জায়গাটা চষে ফেললাম বাঘের গতিবিধি বোঝার জন্য। ল্যান্টানা ঝোপের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আর এসে পৌঁছলাম রাইফেল জোতে। এটা গ্রামবাসীদের দেওয়া একটা নাম- এক সময়ে ডালটনগঞ্জ শহরের অভিজাত লোকজন এখানে রাইফেল শুটিং অনুশীলন করত বলে।

জমি বেশ শক্ত। তাই বাঘের পাগমার্ক বা পায়ের ছাপের জন্য আমরা তেমন নজর দিলাম না। তবে ঝোপের মধ্যে সুড়ঙ্গের মত তৈরি হওয়ায় বোঝা গেল কোন জন্তু জোর খাটিয়ে ঝোপের মধ্যে দিয়ে গেছে। একটা ঢালু জমি দিয়ে নামতে আমাদের নজরে এল একটা কুকুরের ডান দিকের পিছন পা। জামির দ্রুত সচেতন হয়ে গেল। এটা একটা বুনো কুকুরের পা আর জামির নিশ্চিত তার রং দেখেই।

ল্যান্টানার ঝোপ। ছবি: wikimedia commons

পড়ুন বুদ্ধদেব গুহকে নিয়ে লেখকের স্মৃতিচারণ: "গান, কবিতা, খাওয়া দাওয়া, আর হাসি-ঠাট্টায় ভরা লালাদা'র স্মৃতি"



এবারে যুদ্ধক্ষেত্রটা বোঝা গেল। মরিয়া হয়ে বাঘটি কুকুরের দলের একটিকে কামড়ে ধরে আর এই ঢাল ধরে গড়িয়ে পড়ে। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য। হতভাগা কুকুরটির শরীরের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশ সব ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক আর রক্তে মাটি ভিজে আছে ছোপ ছোপ হয়ে। লড়াইটা প্রবল ছিল যেহেতু বাঘিনীর সাথে আটটি কি ন'টি কুকুরের সংঘর্ষ হয়েছিল। ভাল করে দেখে বোঝা গেল গোটা মাটি জুড়ে বাঘের লোম ছড়িয়ে আছে। অর্থাৎ, সেও বুনো কুকুরের দলের থেকে ভালই আঁচড়-কামড় খেয়েছে। বলা মুশকিল কে শেষমেশ জিতেছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে বাঘিনীটি জঙ্গলের মধ্যে তার এলাকায় যাওয়ার বদলে , কাছের বাওহারিয়া গ্রামের দিকে আশ্রয় নিয়েছে। তাই মাহাতো গরু চড়িয়ে ফেরার পথে বাঘিনীটিকে তার বাচ্চাদের নিয়ে দেখতে পেয়েছেন।

এই পুরো ব্যাপারটা সেই পুরানো বিশ্বাসকেই আর একবার প্রতিষ্ঠা করল যে, যখন বুনো কুকুররা কোন এলাকায় থাকে , তখন তার চেয়ে বড় শিকারি যেমন বাঘ অবধি সেইখান থেকে সরে যায়। বাঘ অনেক দক্ষ শিকারি হওয়ায় শিকার করার সময় অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে। এই বিশেষ ঘটনাটিতে আমার মনে হয়েছিল, বাঘিনীটি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বুনো কুকুরের দলটার দ্বারা এবং এদের থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে বাওহারিয়া গ্রামের কাছাকাছি আশ্রয় নিয়েছিল।

বুনো কুকুরেরা মনুষ্য বসতির কাছে থাকতে পছন্দ করে না আর এই দলটি বনের সীমানাবর্তী এলাকায় পরের ২৪ ঘণ্টা থেকে সাঈদুপ ২ নং কম্পার্টমেন্ট জঙ্গলের অন্যদিকে চলে যায়। আর আমাদের নিশ্চিন্ত করে সেই বেগম নামক বাঘিনীক আবার বাচ্চাসহ ঘোরাফেরা করতে শুরু করে বেতলা ২ নং কম্পার্টমেন্ট আর ডোরামি সুরক্ষিত বনাঞ্চলে। অর্থাৎ বাঘিনীর শাবকের সুরক্ষিত।


লেখক পরিচিতি: শ্রী সঙ্গম লাহিড়ী পালামৌ টাইগার রিজার্ভে দীর্ঘ ৩৮ বছর বন অধিকারিক হিসাবে কর্মরত ছিলেন ও ঝাড়খন্ড বনবিভাগের ডি এফ ও (সোশাল ফরেস্ট্রি) হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। Pugmarks in Palamau বইয়ের লেখক।

রচনাটি লেখকের Pugmarks in Palamau গ্রন্হ থেকে অনুমতিক্রমে অনুদিত ও বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হল।


অনুবাদ: সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।





















2 e paa_edited.jpg
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page