top of page
  • ..

কলকাতার কিডনি পূর্ব কলকাতার জলাভূমি আজ বিপন্ন

সম্প্রতি National Green Tribunal (NGT) পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ৩৫০০ কোটি টাকার জরিমানা করেছে আবর্জনা নিষ্কাশনে ব্যর্থতার জন্য। অথচ কলকাতা শহরেই রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বর্জ্য পরিশোধনের পরিকাঠামো যাকে আমরা চিনি পূর্ব কলকাতার জলাভূমি হিসাবেও। যখন একের পর এক শহরে জলাভূমির অভাবে দেখা দিয়েছে বন্যার প্রাদুর্ভাব সেখানে এই জলাভূমির ভূমিকা কলকাতার জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই জলবায়ু পরিবর্তনের সময়। কিভাবে? সেটা নিয়েই আলোচনায় দীপ্তার্ক ঘোষ। আজ দ্বিতীয় পর্ব।


ছবি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ

জলবায়ু পরিবর্তন ও জলাভূমি


পূর্ব কলকাতার এই জলাভূমি আসলে সুন্দরবনেরই এক বিস্তৃত অংশ বটে , যে সুন্দরবন জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন বেড়ে চলা ঝড়ঝঞ্ছাকে প্রতিরোধ করে। যদি এইসব জলাভূমি রক্ষা করা না যায় তবে এই অঞ্চলে জলবায়ু, বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার ওপর তার প্রভাব পড়বে।




২০১০ সালের জাতীয় জলাভূমি মানচিত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পূর্ব কলকাতার জলাভূমির উপর নির্ভর করে সমাজের প্রান্তিকশ্রেণীর ২৭,০০০ পরিবার নির্ভর করে। এইসব মৎস্যজীবীরা ও কৃষকরা শহরের জৈব বর্জ্যের উপর নির্ভর করে যে চাষ করেন তাতে নিজেদের উপায়ই শুধু হয় না, তারা কলকাতা মহানগরের বড় একটা অংশের খাদ্যও জোগান দেয়। এখান থেকে বছরে প্রায় ১৮,০০০ টন মাছ, ১১,০০০ টন ধান আর প্রতিদিন প্রায় ১৫০ টন সব্জি পাওয়া যায়। এদের সাথে সাথে এখানে জীবিকার সন্ধান পান নিলামদার, আড়ৎদার, পাইকার, জাল নির্মাণকারী, মাছের চারা উৎপাদনকারী, খাল বিলের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত মানুষ।

পচনশীল নয় (non-biodegradable) এমন সব আবর্জনাকে পুনরায় কাজে লাগানোর(recycling) জন্য নিয়োজিত রয়েছে যে বিশাল সংখ্যক কাগজ-কুড়ানি তাদের কথা না বললেই নয়। ৫,০০০ এর উপর পরিবার ধাপার এই আবর্জনার স্তূপে এই কাজ করে জীবন চালায়।

“We count the number of millionaires, but not the millions of pickers who are active in our nation’s backyards” – Dr. Dhrubajyoti Ghosh (The Trash Diggers)।


জীববৈচিত্র


‘The salt lakes and marshes east of Calcutta must be protected as a nature reserve for birds, including the migratory cranes, which used to visit the area and are expected to reappear before long’ । লিখেছিলেন জর্জ আর্চিব্যাল্ড একটি চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৬৯ সালে।

এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি একটি ছোটখাটো 'বায়োস্ফিয়ার' তার বিভিন্ন বিপন্ন জীব প্রজাতি নিয়ে। জলজ জীব থেকে শুরু করে উভচর আর পরিযায়ী পাখিদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বাসস্হান এটি।

এখান থেকে সংগ্রহ করা মাটি পরীক্ষা করে এমন অনেক ব্যাক্টেরিয়ার খোঁজ পাওয়া গেছে যারা শুধু পরিবেশগত ভাবেই নয় এমনকি অর্থনৈতিক দিক থেকেও উপযোগী। ১৭ রকমের জুপ্ল্যাঙ্কটন আছে এখানে যা একমাত্র নির্মল জলের (fresh water) জলাশয়তে পাওয়া সম্ভব।

Yellow wagtail ছবি: রিতায়ন রায়

১০৪ রকমের উদ্ভিদ প্রজাতি আমরা পেয়েছি এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমির আশেপাশে। অনেক নারকেল ও সুপারিগাছ আছে এই অঞ্চলে। হয় ফুলকপি থেকে কুমড়ো - নানারকম সব্জির চাষ।

বিভিন্ন রকমেই এইসব উদ্ভিদ প্রজাতি এখানকার পয়:প্রণালীর জলের শোধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এবং মাছেদের টিকে থাকতে সাহা্য্য করে।

যে বিভিন্ন প্রাণীরা এখানে বাস করে তাদের মধ্যে মাছ ও পাখিদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি গবেষণায় এখানে ১৫ রকমের সরীসৃপ, ৬ ধরনের উভচর, ২২ রকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৭১ রকমের পাখি (স্হানীয় ও পরিযায়ী)খুঁজে পাওয়া গেছে।

বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে সব জলজ প্রাণী পাওয়া গেছে এখানে তার মধ্যে ৫৮ রকমের মাছ, ১১ রকমের চিংড়ি জাতীয় প্রাণী, তিন রকমের কাঁকড়া ও ২০ রকমের শম্বুক জাতীয় প্রাণীও দেখা গেছে। ৫৮ রকমের মাছের মধ্যে ৪৮টি দেশি ও ১০টি বিদেশি প্রজাতির। কলকাতার দৈনিক মাছের চাহিদার এক তৃতীয়াংশ আসে এই নিকাশি নালার শোধিত জলে চাষ হওয়া ভেড়িগুলি থেকেই।

যে জীববৈচিত্র এখানে আছে তার গুরুত পরিবর্তন হচ্ছে জমি ও জলাভূমির ব্যবহারের পরিবর্তনের সাথে সাথে। যে ২৭১ রকম পাখি এখানে থাকার কথা, তাদের মাত্র ১৬২ টিকে গত তিরিশ বছরে কোন না কোন সময়ে দেখা গেছে। এটা বোঝা গেছে যে স্হানীয়ভাবে ১০৯টি প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যাদের বেশিটাই জলচর।


Marsh Mongoose বা জলাভূমির বেজি হল এখানে পাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী জীব।




ছবি: রিতায়ন রায়


সংকটে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি


“The wetlands are real-estate in waiting” – Dr. Dhrubajyoti Ghosh

পরিবেশগত ভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও, এই জলাভূমি জমি হাঙরদের গ্রাসে পড়েছে এবং অপরিকল্পিত, দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পায়নের শিকার। রামসার সম্মেলন একে ২০১০ সালে বিপন্ন বলে ঘোষণা করে এখানে বেআইনি জমিদখল ও ক্ষতিকর দূষণসামগ্রীর উপস্হিতির কথা জানার পরে।

দ্রুত নগরায়নের ফলে পূর্বদিকে শহর বৃদ্ধি পাচ্ছে আর তার জন্য এখানে দ্রুত জমির চরিত্র পাল্টাচ্ছে। ৬০-এর দশকের শুরুতে সল্টলেকের অভিজাত এলাকা গড়ে ওঠার সময় এর একটা বড় অংশ হারিয়ে যায় নগরীর আড়ালে, আর এর পরে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস গড়ে ওঠায় এই জলাভূমি এলাকায় যাতায়াত সুলভ হওয়ার কারণে এখানে জমির চাহিদা আরও বেড়ে যায়। রেকর্ডেই রয়েছে যে ১৯৭২ থেকে ২০১১ - এই চারদশকে এখানকার ৪০০০-৫০০০ বর্গ কিলোমিটার জলাভূমি দখল হয়ে নির্মাণকাজ হয়েছে। এই দখল প্রক্রিয়া চলছেই বিভিন্ন অভিজাত আবাসন নির্মাণে, বড় বড় রাস্তাঘাট ও মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়ীরা নানা বিপজ্জনক উপায়ে এখান থেকে উৎখাত করেছে স্হানীয় কৃষিজীবি ও মৎসজীবি সম্প্রদায়কে যারা এই জলাভূমির উপর নির্ভর করে বেঁচেছিল।

ছবি: বিশ্বরূপ গাঙ্গুলি/ wikimedia commons

এখানে ওখানে যথেচ্ছ প্রমোদ উদ্যান নির্মাণ , ভেড়ির পাড় বাঁধিয়ে দেওয়া বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে। ২০১৬ সালে Society for Creative Opportunities and Participatory Ecosystems (SCOPE) এর করা একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে জলাভূমি ২০০২ সালে ৮৮% থেকে ২০১৬ সালে কমে ১৯% হয়ে গেছে। ২০১৭ সালে হিন্দুস্হান টাইমসে প্রকাশিত একটি সংবাদে বলছে এভাবে জলাজমির ও কৃষিজমির দখল হয়ে যাওয়ায় তা স্হানীয় মানুষের রোজগারের উপর প্রভাব ফেলেছে।

শিল্পাঞ্চলের অশোধিত বর্জ্য পদার্থ ঘটাচ্ছে মারাত্মক দূষণ: এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমির কাছাকাছিই রয়েছে কলকাতার কিছু সবথেকে দূষিত এলাকা। এই জলাভূমিতেই চায়না টাউনের ট্যানারির দূষিত পদার্থ এসে পড়ে আর আসে আরও কিছু ছোট ছোট কলকারখানার বর্জ্য। প্রয়াত ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ , যিনি এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বাঁচাতে একাই লড়ে গেছেন তাঁর বই ‘Ecology and Traditional Wetland Practice – Lessons from Wastewater Utilisation in East Calcutta Wetlands’ এ এইসব রাসায়নিক দূষণকে মাছচাষ ও সব্জিচাষের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ৫০টির আশেপাশে প্লাস্টিক ও চামড়ার কারখানা গড়ে উঠছে এই অঞ্চলের সন্নিহিত এলাকায়। এইসব কলকারখানা থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী গ্যাস যেমন বার হয়, তেমনি নির্গত রাসায়নিক ক্ষতি করছে ভেড়িগুলির।

এছাড়া পয়:প্রণালীর বর্জ্য বহনকারী খালগুলি পলিতে জমে যাওয়ায় সেই জল ছড়িয়ে পড়তে পারছেনা জলাভূমিতে যথাযথ ভাবে, ফলে মাছচাষের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া যাচ্ছে না, চাষে প্রভাব পড়ছে। পলি জমে যাওয়া ও জলাজমির দখল হয়ে যাওয়ায় এই অঞ্চলের বন্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে গেছে ৬৫%।

পূর্ব কলকাতার জলাজমির হ্রাস হওয়ার সাথে সাথে যেমন জীববৈচিত্রে প্রভাব পড়ছে তেমনি এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবনে প্রভাব পড়ছে।

এভাবেই দ্রুত নগরায়ন গ্রাস করছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে। ছবি: রাজদীপ দেব।


আইনি সুরক্ষা


এই জলাভূমির গুরুত্ব অনুধাবন করে কলকাতা হাইকোর্ট ১৯৯২ সালে নির্দেশ দেয় "জলাভূমিকে সংরক্ষণ করতে হবে কৃষিকাজ ও মৎসচাষের জন্য।" ২০০৬ তে এটি আইন পাশ করে তৈরি করা হয় East Calcutta Wetlands Management Authority যারা এখানে আইন লঙ্ঘনের বিষয়গুলি দেখে। রামসার সম্মেলন অনুযায়ী, "প্রতিটি স্হানীয় সরকার যথাযথ পরিকল্পনা করবে একটি রামসার তকমাপ্রাপ্ত জলাশয়ের যথাযথ ব্যবহারের জন্য তাকে রামসার জলাশয় ঘোষণার ৬ মাসের মধ্যে"। কিন্তু এত বছর পরেও পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নিয়ে তেমন কোন পরিকল্পনা নেই।কেন্দ্র সরকারের Central Wetlands Regulatory Authority গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে উল্লেখ করেছে যে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি একটি কম খরচে বর্জ্য পরিশোধনের উপযোগী ব্যবস্থা। ২০১৭ সালে রামসার সম্মেলন পুনরায় উল্লেখ করে যে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি পৃথিবীর দুটি সেই বিশেষ জলাশয়ের মধ্যে একটি যারা প্রাকৃতিক উপায়ে বর্জ্য শোধন করে।

ছবি : সুনিষ্ঠা ভট্টাচার্য্য

বেড়ে চলা নগরায়ন জলাভূমিগুলিকে গ্রাস করছে। এর ফলে ভারি বৃষ্টিপাতের পর বন্যা পরিস্হিতি সৃষ্টি হচ্ছে। ই এম বাইপাসও জলাভূমিতে জলের প্রবাহে বাধাস্বরূপ। বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেব, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রের জলের ২০ সেন্টিমিটার উচ্চতাবৃদ্ধি কলকাতাকে বিশ্বের ব্যাপক বন্যায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাযুক্ত শহরগুলির মধ্যে ক্রমতালিকায় তিনে রেখেছে। এই জলাভূমির হারিয়ে যাওয়া এই বিপদকে আরও বাড়াচ্ছে। বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাহিদা ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হবে শহরকে বাঁচাতে হলে। এই ব্যাপারে আরও সচেতনতা ও তথ্যের আদান প্রদান জরুরি কলকাতার কিডনি এই জলাভূমিকে বাঁচাতে যাতে কলকাতার ভবিষ্যৎ রক্ষা পায়।

(শেষ)

Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page