গত বছর শেষ হল হিমালয় চর্চার একটি অধ্যায়। দেরাদুনে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন স্বামী সুন্দরানন্দ মহারাজ (১৯২৬-২০২০)। দেশে-বিদেশে হিমালয় প্রেমীদের কাছে যিনি পরিচিত ছিলেন clicking swami নামে। রেখে গেলন পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি দুষ্প্রাপ্য ছবি হিমালয়ের আনাচ-কানাচ, তুঙ্গশিখর থেকে গহীন কন্দরের।সঙ্গে অসংখ্য প্রকাশিত প্রবন্ধ- হিমালয়ের ভূ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য আর জনজীবন নিয়ে।তাঁর সাথে সাক্ষাতের স্মৃতি এবারের পর্বে।ধারাবাহিক লেখায় সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।
হিমালয়ের গল্প মানে তো শুধু পথ বা নিসর্গের বর্ণনা নয়। তার সাথে জুড়ে থাকে ঘটনার ঘনঘটা, কত ইতিহাস, মিথ আর তাদের ভাঙ্গাগড়ার গল্প। যুগ যুগ ধরে তা সঞ্চিত হয়ে এসেছে হিমালয় পথিকদের স্মৃতিকথায়। তেমনি একজন মানুষের সাথে গঙ্গোত্রীতে সাক্ষাতের সুযোগ পেলাম যিনি নিজেই জীবন্ত ইতিহাস হিমালয়-অনুরাগী যাত্রীদের কাছে। স্বামী সুন্দরানন্দ। নবতিপর এই সন্ন্যাসী তো শুধু একজন সাধক নন। একাধারে তিনি পর্বতারোহী, ফটোগ্রাফার, পরিবেশ আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী, সুলেখক, বাগ্মী ও যোগগুরু। তাঁর কথা প্রথম জানতে পারি উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রচনায়। সেই কত্ত বছর আগে বাংলার হিমালয়-পথিক গেছিলেন গোমুখ পেরিয়ে কালিন্দী খাল হয়ে চামোলি জেলার বদ্রিনাথে। গোটা পথে সেই যাত্রাদলের পথ-প্রদর্শক তথা টীম-লিডার হয়ে গেছিলেন তরুণ স্বামী সুন্দরানন্দ। যেমন কর্মঠ, দক্ষ অভিযাত্রী, তেমনি স্নেহ-প্রবণ, সহমর্মী সঙ্গী। তাঁরই লেখায় দেখে নেওয়া যাক- “ চমৎকার মানুষ। ত্রিশের কোঠায় বয়স মনে হয়। দাক্ষিণাত্যের শরীর। শ্যামবর্ণ। একরাশ দাড়িগোঁফ। ঢেউখেলানো কালো চুল। পিঠ ছুঁয়েছে। লম্বা গড়ন। কঠোর যোগাভ্যাসে দেহের দৃঢ় বাঁধন। ‘অ্যাথলেট’ এর মত। কর্মঠ, সজীব, প্রাণবন্ত। মনের উৎসাহ চোখে মুখে, সারা অঙ্গে, চালচলনে যেন ঠিকরে পড়ে। সঙ্গে থাকলে শান্ত ধীর ভাবে স্হির হয়ে বসার কথা মনেই হয় না। যেন, ঝড়ের হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে চলে। মনে হয়, ঘুরে বেড়াই হিমালয়ের গহন বনে, উঠে চলি ঐ উত্তুঙ্গ হিমশিখরে। তাঁর অন্তরের বাসনাও তাই। গাড়োয়ালে- বিশেষত গঙ্গোত্রী, গোমুখ অঞ্চলে বহু অজানা দুর্গম স্হানে ঘুরেছেন, হিমবাহের উপরেও ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। প্রকৃতই হিমালয় প্রেমিক”।
তেমনি তাঁর উচ্ছ্বসিত কাহিনী পড়েছি মরমী লেখক শঙ্কু মহারাজের বইতে। "সুন্দরানন্দ সুদক্ষ ফটোগ্রাফার। প্রিন্টিং ও এনলার্জমেন্ট সহ ফটোগ্রাফির যাবতীয় যন্ত্রপাতি তাঁর আছে। তবে এখন ফটো তোলা ছেড়ে দিয়েছেন।এখন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গী ছোট একটি টাইপ মেশিন। পূজারী ও সাধুদের দরকারী চিঠিপত্র লিখে দিয়েও নিজের অসংখ্য ভক্তদের সঙ্গে পত্রালাপ করে যে সময়টুকু বাঁচে, তা তিনি প্রবন্ধ রচনায় ব্যয় করেন- দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক প্রবন্ধ, সবই ভাগীরথী ও হিমালয়কে কেন্দ্র করে।
কেবল দর্শন নয়, সুন্দরানন্দ বিজ্ঞানও চর্চা করেন। ভাগীরথীর জল ও পলি, এ অঞ্চলের মাটি পাথর গাছপালা ও পশুপক্ষী নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করে তিনি বহু প্রবন্ধ লিখেছেন।..."
অন্ধ্রপ্রদেশে জন্মানো সুন্দরানন্দ পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। জীবনে যাকে চেয়েছিলেন, পরিবারের বাধায় তা সম্ভব না হওয়ায় চলে আসেন হিমালয়ে। হিমালয়ের আশ্রম আর পথই হয়ে উঠল নতুন ঠিকানা। অভিভাবকরা এলেন তাঁর দাবি মেনে নিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু জগতের পার্থিব সুখ সম্বন্ধে ধারনায় তখন পরিবর্তন এসেছে তাঁর। উপেক্ষা করলেন একদা কাঙ্ক্ষিত জীবনের হাতছানি। দীর্ঘকাল আর এক কিংবদন্তি স্বামী শিবানন্দের সাথে তপোবনে থেকে সাধনা করলেন [তপোবন মহারাজ।প্রসঙ্গত: তপোবন মহারাজ নিজে একজন উচ্চমার্গের যোগী ও সুলেখক। তাঁর প্রকাশিত বই Wanderings in the Himalayas (Himagiri Vihar) যোগসাধনার দুনিয়ায় একটি ক্লাসিক।। চিন্ময়া মিশনের স্বামী চিন্ময়ানন্দ ছিলেন স্বামী সুন্দরানন্দেরই গুরুভাই]। ১৯৪৮ থেকে রয়েছেন গুরুজির গঙ্গোত্রীর আশ্রমে। ১৯৫৭ সালে গুরু মহারাজের তিরোধানের পর আশ্রমের দায়িত্ব তাঁরই। ফটোগ্রাফি করে তার প্রসেসিং একদিকে, অন্যদিকে হিমালয়ের গাছ-পালা ও পশুপাখির ওপর তথ্যাদি সংগ্রহ, আবার সেসব নিয়ে দেশ-বিদেশের জার্নালে নিয়মিত লিখে যাওয়া। আবার দরদী সন্ন্যাসী-রূপে তীর্থযাত্রী, পর্বতারোহী থেকে স্হানীয় মানুষ-সবার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। এমনটাই প্রাণবন্ত তাঁর জীবন। এক ডজনেরও বেশি পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেছেন। তেনজিং, হিলারির সঙ্গেও অংশ নিয়েছেন অভিযানে। শুনেছি ১৯৬২ তে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাদলের একটি ব্যাটেলিয়নকে হিমালয়ের দুর্গম পথে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছিলেন তিনি। দীর্ঘ সময় ধরে দেখছেন গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের গলে যাওয়া। দেশের নান প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন গঙ্গা বাঁচানোর আর্তি নিয়ে। হিমালয়ের জন্য।
গোমুখ-তপোবনে আসার পথে গঙ্গোত্রীতে এসে দেখলাম হট্টগোলে ভরা এক তীর্থ। কোথায় উমাপ্রসাদবাবুর বইতে পড়া সেই শান্ত তপোবনের মত জায়গা!! এখানে আর কোথায় বা থাকবেন স্বামী কৃষ্ণাশ্রম, সুন্দরানন্দদের মত মহাত্মারা। কোন খোঁজ করার কথা ভাবিনি সে ব্যবসাকেন্দ্রে। কিন্তু, হিমালয়ের দেবতা আমার জন্য অন্যরকম ভেবেছিলেন! স্বামীজির কথা এবার শুনতে পেলাম তপোবনের হিমসন্ধ্যায় দুই মারাঠি ভদ্রমহিলার মুখে। নিয়মিত হিমালয় পথে ঘুরে বেড়ান পঞ্চাশোর্ধ তাঁরা। তপোবনের আশ্রমে সন্ধ্যায় লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে হিমালয় নিয়ে আলোচনা চলছিল। তখনই জানতে পারলাম আসার পথে তারা দেখা করে এসেছেন স্বামী সুন্দরানন্দর সাথে। মূল গঙ্গোত্রী বাজার পার হয়ে গঙ্গার ওপারে সুরজকুন্ডের ধারে তাঁর আশ্রম। বয়স ৯০ পার হলেও সতেজ, সবল, সক্ষম সেই যোগীপুরুষ। তখনই ঠিক করে নিলাম এত কাছে এসে এমন একজনের দর্শন না করে ফিরব না। পথের সঙ্গী গাইডকে বললাম-ফেরার পথে অবশ্যই নিয়ে যাবে সেই আশ্রমে। এরপর যেদিন ভোজবাসা থেকে গঙ্গোত্রী ফিরলাম, সঙ্গীরা ধীরে ধীরে ফিরলেও আমি আগে আগে আমাদের পোর্টার দীপককে নিয়ে চলে গেলাম সুরজকুন্ডের ধারে সেই আশ্রমে। ও স্হানীয় ছেলে। স্বামীজীর নাম শুনলেও তার আশ্রম বা তাঁর মাহাত্ম-কোনটাই জানা নেই। আমার উদগ্রীব অবস্হা দেখে একটু অবাক। ওকে আমি যেতে যেতে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম কে এই মহারাজ। খুঁজে-পেতে তাঁর আশ্রম পেলাম। এ সত্যিই এক তপোবন।
সবুজে মোড়া, বিশাল উঁচু পাহাড়ের ঠিক নীচে তার কুটি। পুরানো গঙ্গোত্রী যেন এখনও কিছুটা রয়ে গেছে এদিকে। ওই পাহাড়ের ওপরে পথ চলে গেছে কেদারতালের দিকে। নীচে সুরজকুন্ডে আছড়ে পড়ছে ভাগীরথী সশব্দে। মহারাজকে দেখতে পেলাম। নমস্কার করে বললাম-বাংলা থেকে আসছি। আপনার কথা অনেক পড়েছি। মহারাজ বললেন-“ হ্যাঁ, উমাপ্রসাদকে তো আমিই নিয়ে গেছিলাম কালিন্দি খাল”। বললেন- এখন তো আর সেই গঙ্গোত্রী নেই। সব ব্যবসা হয়ে গেছে। এত বাইরের লোক। ভন্ড সন্ন্যাসীর ভিড়! দীর্ঘশ্বাস.... প্রণাম করলাম তাঁকে।
অনুমতি নিয়ে ছবি তুললাম এই মহান হিমালয় প্রেমিকের। একটু বসতে বললেন- দ্বিপ্রহরিক ভোজনে সময় হয়েছে। ইতিমধ্যে আর একজন আশ্রমবাসী এলেন। পাশেই এক আশ্রমে থাকেন। মহারাজের খোঁজ-খবর রাখেন। তার সাথে আলাপচারিতা চলল। দূর থেকে দেখছি ছোট একটা কাঠের বাটিতে সামান্য আহার করছেন মহারাজ পরিপাটি করে। তারপরে এসে সামনে বসলেন। আশ্রমের সামনের ঘরে তাঁর তোলা কিছু ছবি। সঙ্গী আশ্রমবাসী মহারাজের বিখ্যাত বই- Himalaya: Through the Lens of a Sadhu নিয়ে এনে আমায় দেখালেন। এই বই তাঁকে দেশ-বিদেশের হিমালয় প্রেমিকদের কাছে পরিচয় দিয়েছে নতুন নামে- "the Sadhu Who Clicks"।
বিশাল সেই বই। ৬০ বছর সময়কাল ধরে হিমালয়ের দুর্গম থেকে দুর্গম অঞ্চলের ছবি আর তথ্যে ভরা। এই বই এখন আউট অব্ প্রিন্ট। মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলাম- এই বই আর বার হবে কিনা! তিনি বললেন-না। আর বার করব না। তবে দেখালেন তাঁর আশ্রমের জমিতে মাথা তুলছে স্টিলের তৈরি সুউচ্চ ফটোগ্রাফি গ্যালারি। তাঁর সারাজীবনের কীর্তি প্রদর্শিত হবে এখানে। দেশ-বিদেশের পর্বতপ্রেমীদের কাছে এক তীর্থস্থান হয়ে উঠবে এই মিউজিয়াম। স্বামীজির কথায় মনে হল, যারা এটা নির্মাণের দায়িত্বে তাঁদের দীর্ঘসূত্রতায় ঈষৎ ক্ষুব্দ্ধ তিনি। কথা বলতে বলতে বইয়ের পাতা উলটচ্ছিলাম। হিমালয়ের পরিবেশ নিয়ে সরকারের কাজকর্মে আশাহত মনে হল তাঁকে। আক্ষেপ ঝড়ে পড়ছিল তাঁর কণ্ঠে। মানুষ বুঝছে না কিসে তাঁর ভালোমন্দ। তাৎক্ষনিক লোভে শেষ করে দিচ্ছে সব। দীপক চলে গেছিল কিছুক্ষণ আগে। মনোজ –আমাদের আর এক পথের সঙ্গী চলে এল আমায় খুঁজতে খুঁজতে। কথায় কথায় কখন ঘন্টাখানেক কেটে গেছে। আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসছে। এবার যেতে হবে। আজ আবার দীর্ঘ যাত্রা গঙ্গোত্রী থেকে বারসুর পথে। বারবার মনে হচ্ছিল এই হিমালয় সাধকের কাছে বসে পাঠ নিই জীবনের। যিনি বলেন- "God does not reside in temples or mosques - he is scattered everywhere in the courtyard of nature."। তবু জীবনের সময় বাঁধা। প্রণাম করে বিদায় নিলাম সেই ঋষির ধ্যানমগ্ন আশ্রম থেকে। ফিরে চলেছি সেই মহান হিমালয়ের পদপ্রান্ত থেকে।
এর একবছর পর আবার সেই বিখ্যাত বই পুন:মুদ্রিত হল। জানতে পেরেই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে হাতে পেলাম মহার্ঘ্য এই সম্পদ। গোটা মহামারীর বছরটা যাওয়া হল না হিমালয়ের পথে। শেষ কয়েক মাস বিছানায় মাথার কাছেই থাকত এই বই। ইচ্ছে হলে উল্টে পাল্টে পড়ে নিতাম, দেখে নিতাম হারিয়ে যাওয়া সময়ের হিমালয়ের ছবি।আমাদের সামনে তিনি রেখেছেন হিমালয়ের সেই সব ছবি, যে দৃশ্য হয়ত আর আমরা দেখতে পাব না গ্লোবাল ওয়ার্মিঙের দাপটে। যে মহাত্মা হিমালয় ও গঙ্গানদী ভারতকে প্রাণদান করেছে, তার বিনাশকালে হারিয়ে যাওয়া কোন এক স্বপ্নলোকের, স্বর্গরাজ্যের ডকুমেন্ট হয়ে থেকে যাবে তাঁর এই কীর্তি। শুনেছি কালান্তক কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার থেকে সেরে উঠলেও নবতিপর শরীরে করোনা হয়ত বিষাক্ত ছাপ রেখে গেছিলেন। ভারতীয় দর্শন মতে আত্মা অবিনশ্বর। তা বোঝা না-বোঝা আমাদের মত মানুষের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু স্বামীজি থেকে যাবেন দেশ-বিদেশের হিমালয় সাধকের মনে, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়- যতদিন বইবে গঙ্গা।
ছবি: লেখক
লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।
Comments