চলছে উত্তরাখন্ডের গাড়োয়াল হিমালয়ের ওপর ধারাবাহিক ভ্রমণ-কথা। স্মৃতি থেকে কলম ধরলেন সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।
ভোজবাসার জি এম ভি এনের ডর্মিটরিতে পৌঁছে শরীরটা ছেড়ে দিলাম বিছানায়। ৮-৯ ঘণ্টা পাথরভাঙ্গা পথের ক্লান্তি। চোখটা একটু লেগে এল। তার মধ্যেই সঙ্গীরা এসে পৌঁছল। পথশ্রমে ধ্বস্ত। তাদের স্বাগত জানাতে উঠলাম। তখন জি এম ভি এন প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল ভাগীরথী শৃঙ্গদের ওপর।সেখানে তখন আঁকা হচ্ছে সোনালী এক সূর্যাস্তের অপরূপ জলছবি। তারপর নেমে এল অন্ধকার। তারাগুলো ফুটে উঠছে আকাশে। আজকের দিন শেষ হবে একটু পরে শীতল রাতে ডিনার টেবিলে খিচুরির ওমে। পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে মনে পড়ল আজ যাত্রার আসল পর্ব। আজ তপোবনের দিকে পা বাড়াব। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে আমরা দু’জন বার হলাম গোমুখের পথে। আজ সঙ্গীদের ভোজবাসাতেই বিশ্রাম। আমাদের সঙ্গে আজ চলেছে কেশব আর মনোজ।
ভোজবাসা থেকে কিছুদূর এগোতেই পথের ডানপাশে মাথা তুলে দাঁড়াল শিবলিঙ্গ চূড়া। আংশিক মেঘে ঢাকা এখন। এখন পথের বামপাশে ভাগীরথী চূড়ারা হাতছানি দিচ্ছে, আর ডানদিকে শিবলিঙ্গ। এর নীচেই আজ পৌঁছাব আমরা। আজকের পথেও বড় বড় পাথর বিস্তর বাধা তৈরি করে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাধার দু:খকে সহ্য করে চলাই তো তীর্থপথের ধর্ম। আর তার আর এক ধর্ম একসময় শেষ হওয়া। তাই দেখতে দেখতে ঘণ্টা আড়াই পর এসে গেল গোমুখ। এখানে নদীর তীব্র জলধারার পাশে অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত এক পাথুরে সমতল।
সেখানে পৌঁছে যাত্রীদের চোখেমুখে সবার অবাক বিস্ময়। এই তো সেই বরফ-গুহা, যা ভারতের প্রাণস্বরূপীনি গঙ্গার জন্মদাতা। জীবনের এ যেন এক মাহেন্দ্রক্ষণ। কয়েকজন তো জলের ধারে রীতিমত ধ্যানস্থ। দক্ষিণ ভারতীয় সেই পরিবারটিকে দেখলাম। পুরুষদের পায়ে নামমাত্র সস্তার চটি। আর মহিলাটি গোটা পথ কাল থেকে এসেছেন একটি পাতলা হাওয়াই চটি পায়ে। কারুর শরীরে নেই কোন শীতবস্ত্র এই কাঁপিয়ে দেওয়া হিমবাহ এলাকায়। এঁরাই হয়ত প্রকৃত তীর্থযাত্রী, কোন পথের বাধাই যাদের কাছে দুরূহ নয় মনের শক্তির কাছে। আমাদের শহুরে সরঞ্জাম, ট্রেকিং শু এইসব এসময়ে সময়ে নেহাৎ আড়ম্বর মনে হয়। আমিও মাথায় একটু্ গঙ্গাজলের স্পর্শ নিলাম।
এবার বামদিকের পথ দিয়ে হিমবাহের দিকে চড়া শুরু। এবারের পথ প্রকৃতই দুর্গম, জায়গায় জায়গায় বিপদের হাতছানি। গাইডের দেখানো পথরেখা ধরে উঠছি। বামদিকের পাহাড়টা থেকে হঠাৎ ছোট-বড় পাথর গড়িয়ে নামতে শুরু করল। কেশবরা আমাদের একটু নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়াতে বলল। আসলে একদল ভরাল ওই খাড়া পাহাড়টার গায়ে দৌড়চ্ছিল। তাদের পায়ের আঘাতে এই পাথরবৃষ্টি। এখানে পায়ের নীচ সব আলগা পাথর। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বেশিটাই। গোমুখকে একদম পাশ থেকে দেখতে পাচ্ছি। এত কাছে! স্তরে স্তরে সাজানো জমাট বাধা ধূসর বরফ। কোথাও বা কালো-সাদা রঙের মিশেল। যেন কোন মহাযোগীর জটা! প্রাচীন ঋষিরা কি এ দৃশ্য দেখেই কল্পনা করেছিলেন মহাদেবের জটা হতে গঙ্গার উৎপত্তি? কে জানে....পাথর ভেঙ্গে চলতে চলতে আমার মনে সেইসব প্রশ্নই ঘুরছে। ব্রিটিশরা নতুন করে যখন এইসব অঞ্চল আবিষ্কার করছেন, তখন এইসব অঞ্চলের শিখর বা হিমবাহের নামকরণের সময় প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখিত নামগুলিই ব্যবহার করেছেন। এইসব দুর্গম অঞ্চল তো একসময় সাধকদের লীলাক্ষেত্রই ছিল। তারপর হাজার বছরের ভুলে যাওয়ার বছরগুলোয় এসব পথ থেকে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালেই। আবার গত একশ বছরে যাত্রী চলাচল বেড়েছে!
সম্বিৎ ফেরে হঠাৎ হটাৎ ভেসে আসা গুম গুম আওয়াজে। চারপাশ থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ে এই হিমবাহ এলাকায় অবিরত। পথ বলতে আসলে কিছু নেই। গঙ্গোত্রী হিমবাহের প্রান্তে এই মোরেন বা শিলারাশির উপর দিয়ে সাবধানে পা-ফেল ফেলে এগোতে হবে। প্রতি ঘণ্টায় বরফ গলার সাথে সাথে পথরেখার পরিবর্তন হয়। অভিজ্ঞ গাইডই কেবল সামনের পাথরের দৃঢ়তা অনুমান করে তার ওপর দিয়ে অভিযাত্রীকে নিয়ে যায়। একটু এদিক ওদিক হলে পাথর সহ গড়িয়ে যেতে হতে পারে। চলার পথের পাশেই রয়েছে হিমগহ্বর বা crevasse। দেখতে দেখতে এসে গেলাম গোমুখের ঠিক পিছনে। অদ্ভুত সে দৃশ্য। পার্থিব তবু অলৌকিক। সামনের নীল আকাশ, ধূসর হিমবাহ আর সাদা বরফচূড়ার ঠিক মধ্যমণি হয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। মর্ত্যলোকের দিকে। আশপাশ দিয়ে আরও কিছু অভিযাত্রী আর তাদের পোর্টাররা যাচ্ছেন। কখনও বা পাথরের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটু বিশ্রাম।
এভাবে চলতে চলতে একসময় এই মোরেন এলাকা পার হলাম। কিন্তু, একি! সামনে যে দুস্তর বাধা। খাড়া পাহাড় উঠে গেছে প্রায় ৭৫-৮০ ডিগ্রীতে। এই চড়াই এবার ভাঙ্গতে হবে। তারপরেই নাকি তপোবন! সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছি নেমে আসছে আকাশগঙ্গা ঝর্ণা হয়ে। পাথরের ওপর বসে পড়ে এবার একটু বিরতি আর জলখাবার। আলু পরোটা আর আকাশগঙ্গার ঠান্ডা জল। খেতে খেতে দেখছি সামনের বিস্তৃত ধূসর গঙ্গোত্রী হিমবাহ। মাথার ওপর শিবলিঙ্গ। আর ওই দূরে খরচাকুন্ডের আশ্চর্য সুন্দর শিখর। উল্টোদিকেই ভাগীরথী শিখরের নীচেই কোথাও নন্দনবন। কিছু ছবি নিলাম।
এরপর সেই কষ্টকর পথে চলা শুরু হল। খাড়া পথ। তার ওপর আলগা মাটি, পাথর। কেশবরা কখনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। পার হতে হল আকাশগঙ্গার তীব্র স্রোত। পোষাক, জুতো অনেকটাই ভিজে গেল। এভাবেই একসময় এ পথেরও শেষ হয়। সামনেই তপোবনের প্রান্তর। সোজা তাকালে শিবলিঙ্গ শিখর। অদ্ভুত তার সৌন্দর্য। ২১, ৪৬৬ ফুট উঁচু এই শৃঙ্গকে তুলনা করা হয় আল্পসের ম্যাটারহর্নের সাথে এর দুর্গমতার জন্য। বড়ই কঠিন এর চড়াই। খাড়া দেওয়াল। তার পাশেই মেরু পর্বত। দেবতাদের সভা নাকি ওখানেই বসে! বয়ে আসছে আকাশগঙ্গা কুলকুল রবে। স্বচ্ছ তার জল। সমতল এই উপত্যকায় বরফগলার পর ঘাস জন্মেছে। তার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা রঙের ফুল। দূরে কিছু তাঁবু পড়েছে অভিযাত্রীদের।
আমরা সোজা হাঁটছি মৌনিবাবার আশ্রমের দিকে। আমাদের আজকের আশ্রয়। আকাশগঙ্গার একটা ছোট সাঁকো পার হয়ে একটা টিলার ওপর সেই পাথর আর টিনের তৈরি আশ্রম। বাবা সামনে বসে আছেন তখন। এখানেই ৩৬৫ দিন তাঁর বাস। মুখ দিয়ে কোন কথা বলেন না এই সাধক। ইশারায় থাকার অনুমতি দিলেন চারজনকে। আশ্রমে তখন ইটালি থেকে বড় একটা দল এসে রয়েছে কয়েকদিন। এই দুর্গম প্রকৃতির কোলে ক’দিন সাধন-ভজনের উদ্দেশ্যে তারা নাকি প্রতি বছরই আসেন! ভারতের দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতি তাদের টেনে আনে। আশ্রমে মেঝেতে শয্যার ব্যবস্হা। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তপোবনের প্রান্তরে ঘুরে বেড়ালাম। বিকালের দিকটা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে এল। পিকগুলো ঢাকা পড়ে গেছে। নদীর ধারে চড়ে বেড়াচ্ছে একদল ভরাল। ওপরের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। একটু পরে ডাক এল আশ্রম থেকে। পৌনে ছ’টাতেই নৈশাহার। আরতি, ভজনের পরে পরেই। ভাত, রুটি, পাঁচমিশালি ডাল আর সব্জির আয়োজন। অমন জায়গায় তাই যেন কত বিশাল ব্যাপার! হাসিমুখে বাবা আর তার সঙ্গীরা পরিবেশন করছেন। খাওয়ার পর নিজেদেরই সাফ করতে হয় থালা বাসন। তারপর বাবার সাথে আমরা ও অন্য যাত্রীরা কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলাম নানা বিষয়ে। হিমালয়, আধ্যাত্মিকতা, তাঁর এই নির্জন সাধনা- এসব নিয়ে। বাবা ইশারাতেই বোঝাচ্ছেন। বাইরে নেমে আসা অন্ধকার দেখে এরপর আমাদের ঘরের দিকে চললাম। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠাণ্ডায় কতগুলো যে শীতবস্ত্র, টুপি, গ্লাভস পড়েছি-তার ওপরে টেনে নিলাম লেপ-কম্বল। আমাদের ঘরে আমরা চারজন ছাড়া আছি মারাঠি দুই ভদ্রমহিলা। একসাথে কিছুক্ষণ গল্প চলল। হিমালয়, ভ্রমণ, ট্রেকিং, উত্তরাখণ্ড, সেখানকার মানুষ...এসবই আলোচনার বিষয়। তারপর দীর্ঘ রাত্রি বিছানায়।
ঘুম ভাঙ্গল ঘড়ির অ্যালার্মে।সূর্যোদয়ের সময় হল।কাল মেঘে মেঘে সূর্যাস্তের অস্তরাগ দেখার সৌভাগ্য হয়নি।কথায় বলে “মুম্বাই কা ফ্যাশন আউর গাড়োয়াল কা মৌসম।কভি ভি বদল যাতা হ্যায়”।আজ সকাল পরিষ্কার।আশ্রমের সামনেই বিশাল শিবলিঙ্গ তার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।কিছুক্ষণের অপেক্ষা।তারপর তার শীর্ষে এসে পড়ল সোনালী শুভ্র আলোর অদ্ভুত ছটা।এক এক করে সোনা রোদ ছড়িয়ে গেল মেরু পর্বত, ভাগীরথী আর আরও সব নাম না জানা শৃঙ্গের মাথায়।
বেড়িয়ে পড়লাম তপোবনের ভেতর দিকে শিবলিঙ্গের পায়ের অভিমুখে।চারিপাশ জনমানবহীন।সামনে শুধু অদ্ভুত দর্শন সেই শৃঙ্গ আর আমি।এক সময় পথ রোধ করল আকাশগঙ্গার স্রোত।আরও যেতে হলে নদীতে নামতে হবে।থেমে গেলাম।চারপাশের স্বর্গীয় দৃশ্য অনুভব করার চেষ্টা করছি।এ সৌন্দর্য সহ্য করা কঠিন।
আকাশ নীল থেকে আরও নীল হচ্ছে।আলো বাড়ার সাথে সাথে রঙিন হয়ে উঠছে এই চরাচর।চারপাশ দেখতে দেখতে ফিরে এলাম আশ্রমে।কেশবরা বলল, নাস্তা করে নিয়ে এবার ফেরার পথ ধরতে হবে।জলখাবারে ছোলাসেদ্ধ আর এলাচ-দারুচিনি মেশানো অদ্ভুত সুগন্ধি এক চা।
প্রণতি জানালাম শিবলিঙ্গ পর্বতকে, হিমালয়ের এই পবিত্র স্হানকে।বাবার কাছে বিদায় নিয়ে মন্থর পায়ে ফেরার পথ ধরলাম।এবার নামতে হবে সেই খাড়া পথ।উঠতে লাগে বুকের জোর।আর নামতে গিয়ে সব পীড়ন পড়ে হাঁটু আর আঙ্গুলে।ধরে ধরে সাবধানে নামতে হচ্ছে।এক-দু’বার পা হড়কাল।আকাশগঙ্গার জল বেড়ে গেছে আজ।তীব্র স্রোত পার হলাম মনোজের হাত ধরে।ভরসার হাত।বিশ্বাসের সম্পর্ক।কোন কড়ি দিয়ে যার পরিমাপ হয় না।উপর থেকে আবার অবাক হয়ে দেখছি সেই বিশাল হিমবাহ।
তারপরে আবার সেই ধ্বস সঙ্কুল পথে, ক্রিভাসের পাশ দিয়ে ফিরে আসা।দুপুর নাগাদ নেমে এলাম গোমুখের ধারে।চোখে-মুখে জল দিয়ে পথশ্রমের নিবারণ হল।সংগ্রহ করলাম গোমুখের জল।যেন সঞ্জীবনী সুধা।তখন আমাদের সঙ্গীরা গোমুখ দর্শনে পৌঁছেছে।এবার সবাই মিলে ফেরা ভোজবাসার পথে।বহুকালের ঈপ্সিত যাত্রার শেষে ফিরছি তৃপ্ত মন নিয়ে।আজীবনের স্মৃতি।ঘটে ভরে রাখা গঙ্গা জলের মতই যা অমলিন থেকে যাবে।আবার নতুন পথে অভিযানের জন্য ডাক দেবে।
ছবি: লেখক
লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।
Comments