শুরু হল উত্তরাখন্ডের গাড়োয়াল হিমালয়ের ওপর ধারাবাহিক ভ্রমণ-কথা। স্মৃতি থেকে কলম ধরলেন সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।
কথা হচ্ছিল লক্ষণ সিং নেগির সাথে। তুঙ্গনাথে তিন দিন এর হাতের রান্নাই চেটেপুটে খেয়েছিলাম। ঠান্ডা শীতের রাতে ওর চিলতে ঝুপড়িটায় বসত আড্ডা। উনুনের ধারে বসে গা সেঁকে নেওয়ার সাথে সাথে। থাকত তুঙ্গনাথের অন্য কিছু ভ্রমণার্থী, মন্দিরের এক পন্ডিতজি, লক্ষণের সহকারী আরও দু'-একজন। সারি-গ্রামের ছেলে লক্ষণ। ছোটভাই আর্মিতে গেছে। এখন অরুণাচলে পোস্টিং। লক্ষণের দু:খ দু'বার পরীক্ষা দিয়েও আর্মিতে সুযোগ হয়নি। কখনো উচ্চতার জন্য, কখনো মেডিকেলে বাদ পড়ে গেছে। উত্তরাখণ্ডের গ্রামের অন্যান্য লোকের মতই হাসিখুশি, সরল হাসিতে মাখা মুখ। অবশ্যই সাহসী। ও বলল- যে ছ'মাস মন্দির খোলা থাকে তখনই আমাদের ইনকাম সাব। বাকি সময় ওই জমানো টাকায় ঘর চালাও। সদ্য বিয়ে করেছে। পরের বার এলে তার বাড়িতে যাওয়ার কথা হয়েছে সারি'তে। ট্রেকিং-এর কথায় এল বিষ্ণু সরোবরের কথা। দেওরিয়া তাল ছাড়িয়ে আরও ওপরে যেতে হয়। ও একবার গেছে। সেখানে নাকি টেহরি গাড়োয়ালের রাজা একবার গেছিলেন অনেক সৈন্য-সামন্ত নিয়ে। রাতের বেলায় তারা বাদ্য, জগঝম্প সহকারে হৈ-হল্লা জুড়ে দেয়। কুপিত হয় এই দেবভূমির পর্বতে-অরণ্যে লুকিয়ে থাকা দেব-দেবীরা। পাথর করে দেয় সেই গোটা বাহিনীকে। আজও নাকি সেখানে সেই সব পাথর দেখা যায়। আর দেখা যায় সেই সেনাদের অস্ত্র-শস্ত্র। লক্ষণ নিজের চোখে দেখে এসেছে। লক্ষণ বলল- এখানে রাত হয়ে গেলে বাইরে নাচ-গান-হই-হল্লা করা মানা সাহাব্। দেব-দেবীরা কুপিত হবেই। সেই মানুষ বিপদে পড়বেই। তাই রাত হলে এখানে কোন ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বনের পথে যাবে না। গেলেও তাকে কিছু জায়গায় সেখানকার অধীষ্ট দেবতাকে প্রণাম জানাতে হবে। না'হলে এমনও হয়েছে যে ড্রাইভার একসাথে দু'টো রাস্তা দেখেছে, যার একটা হয়তো চলে গেছে আসলে খাদে। মনে পড়ে গেছিল কিছুকাল আগে পড়া এক লেখকের কুমায়ুনে সুন্দরডুঙ্গা ট্রেকের কথা। লেখক যাওয়ার কিছুদিন আগেই সে-পথে নাকি একদল তরুণ-তরুণী ক্যাম্প করে ছিল। নদী-পাহাড়ের সে দেশে অনেক রাত অবধি চলেছিল হই-হল্লা, নাচ-গান। অনেকবার বারণ করেছিলেন স্হানীয় গাইডরা। শোনেনি। পরদিন সকালে তাদের সবাইকেই মৃত অবস্হায় পাওয়া যায়। লেখক তাঁর লেখায় ঘটনাটার সত্যাসত্য বিচারের ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেন। মনে পড়ে যায় রুদ্রনাথে গিয়ে শোনা কাহিনী। সেখানে বৈতরণী কুন্ড সহ যে জলের কুন্ডগুলি আছে তার কাছে যেতে হলে অসমান পাথুরে জমি ভেঙ্গে যেতে হয়। কিন্তু যেতে হয় খালি পায়ে। একজন জুতো পড়ে যেতে চাওয়ায় স্হানীয় একজন বলেন-তাহলে আপনার বাড়ি ফেরার গ্যারান্টি দিতে পারবো না!!
লক্ষণ আরও বলল- এখানে চড়া রঙের জামা পড়ে শুটিং কেউ করে না। কিছুদিন আগেই নাকি এক গাড়োয়ালি সিনেমার শুটিং-এ এসব করতে গেছিল নায়ক-নায়িকা তুঙ্গনাথে। কিছু পরেই দু'জনে অসুস্হ হয়ে জ্ঞান হারায়। ওদের কথায় এখানে জীবন মানে সংযম মেনে চলা। প্রকৃতিকে মেনে চলা।প্রকৃতিতেই দেবতার অধিষ্ঠান। চরম ঔদ্ধত্যের খেসারত তো উত্তরাখণ্ড ক'বছর আগেই দিয়েছে। অন্ধকার সেই পাহাড়চূড়ায় , হিমশীতল রাতে কোথায় শহুরে বাস্তবতা হারিয়ে যাচ্ছিল লক্ষণদে'র সোজা চোখে তাকিয়ে বলা কিছু নেহাতই সরল-বিশ্বাসের কথকতার কাছে.....
সেদিন পড়ন্ত বিকেলে গরম ধোঁয়া ওঠা চা'য়ের কাপ হাতে হাতে সবার। লক্ষণ সিং-এর রান্নাঘরে তখন অনেকেই জড়ো হয়েছে একটু উষ্ণতার জন্য। বেনারস থেকে এসে কয়েকদিন ধরে তুঙ্গনাথে ছুটি কাটাচ্ছেন অধ্যাপক পি কে সিং। প্রতি বছর গরমের এই সময়টা হিমালয়ের কোন না কোন জায়গায় নিরিবিলিতে চলে আসেন তিনি। শুধু ছুটি নয়, নিজের বইয়ে'র লেখালেখির কাজেও মগ্ন থাকেন এসময়। Motivational thoughts-এর ওপর ওনার কাজ। সারা বছর দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান এ নিয়ে স্কুল-কলেজের ছাত্র, কর্পোরেট কর্মীদের লেকচার দিতে। নানা রাজ্যের অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন তিনি। দক্ষিণ ভারতের ছাত্ররা এসব ব্যাপারে কতটা এগিয়ে, কলকাতায় এলে ময়দান এলাকাটা কেমন উপভোগ করেন। লজ্জা পেলেন নিজের রাজ্যের কথা বলতে। সেখানে নাকি ক্লাসে যারা আসে সব পান চিবোতে থাকে, নিজেদের মধ্যে গসিপ চলে আর ঢুলুনি তারপর।
আড্ডায় জমে গেছিলেন তুঙ্গনাথ মন্দিরের একজন পূজারী। মুক্কুমঠে তাঁর বাড়ি। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ বা মদমহেশ্বরে যেমন আদি শঙ্করাচার্যের তৈরি করে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী দক্ষিণ ভারতীয় রাওয়াল সম্প্রদায়ের পূজারীরা পুজো-আচ্চা সামলান, এখানে তা নয়। চোপ্তা ও উখীমঠের মাঝে মুখ্খুমঠের পূজারীরা তুঙ্গনাথজীর পূজা-আচ্চার দায়িত্বে। এই মুখ্খুমঠেই শীতকালে বাবা তুঙ্গনাথের পুজো হয়। দেওয়ালীর পর ডোলিতে করে নিয়ে যাওয়া হয় তুঙ্গনাথের রুপোর মূর্ত্তিকে। মূল শিবলিঙ্গ তখন ঢাকা থাকে ফুল ও ফলে। (এই মুখ্খুমঠ এখন bird watcher'দের ঘাঁটি । অসংখ্য হিমালয় অঞ্চলের পাখির মেলা সেখানে)। পূজারীজি কলকাতা সম্পর্কে যেমন নানা ঘটনা বলছিলেন, তেমনি তাঁর মুখে শুনছিলাম কেদারঘাঁটিতে দু'বছর আগের ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাড় হিম করা বর্ণনা। কেমন করে একটুর জন্য তিনি প্রাণে বেঁচেছিলেন গৌরীকুন্ডে। তেমনি কলকাতায় এসে যজমানের দেখা না পেয়ে কিভাবে একদিনেই ফিরে এসেছিলেন, কলকাতার লোক তাঁকে পথে-ঘাটে কেমন সাহায্য করেছিল তাই বলছিলেন। বাংলার মানুষ যে এখানে প্রতি বছর কত সংখ্যায় আসে, বারবার আসে, কতটা ভালোবাসে এই পাহাড়দেশকে তাও তারা সকলেই বলছিলেন। এ থেকেই অবধারিত এসে গেল বাঙলা, বাঙালীর গল্প। পুজারীজি বললেন-"আপনাদের পশ্চিমবাংগাল তো বুদ্ধিজীবিদে'র জায়গা".....প্রমাদ গুনলাম। বাঙলায় বুদ্ধিজীবি শব্দটা যেমন খোরাকে পর্যবসিত হয়েছে তার বিভীষিকা কি এই সুদূর পাহাড়-জঙ্গলের দেশে এসেও উপস্হিত হয়েছে!!! এখানে এসেও সেইসব ভীষণ বিভূষনদে'র নিয়ে হাবিজাবি কৈফিয়ত দিতে হবে। লজ্জায় মাথা হেঁট হবে। হে তুঙ্গনাথ!!
" সুভাষচন্দ্র, আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ টেগোর......সব তো আপনাদের দেশেরই লোক!! এরাই তো আজকের ভারত তৈরি করেন"। .....যাক বাবা!! এখনও তাহলে ভারতে র কিছু লোক মনে রেখেছে এই বাঙলাকে!! এখনও আজকের কালিমা তার অতীত'কে ভুলিয়ে দিতে পারেনি।
বাইরে তখন একটু একটু করে মেঘ কাটছে, তারা ফুটছে আকাশে।
লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।
ছবি: লেখক
Comments