top of page
  • ..

চিতারা কেন ভারত থেকে হারিয়ে গেল?

সম্প্রতি শোরগোল ভারতে আবার চিতাদের আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা নিয়ে। কবে বিলুপ্ত হল তারা ভারতের মাটি থেকে? আর কি তাদের দেখা গেছিল? কবে? কোথায়? কেন হারিয়ে গেল ওরা? নানা তর্ক-বিতর্কের মাঝে বিশ্বের এই দ্রুততম জন্তুর ভারতের মাটি থেকে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পর্যালোচনা করলেন সংরক্ষণবিদ রাজা কাজমি



ছবি: pxfuel


"আমি ছুটিতে ছিলাম মূলতঃ সিংহের পিছনে। যখন আমার প্রাত:রাশ শেষ করলাম, আমার সঙ্গের এদেশি শিকারিটি আমার তাবুতে মুখে একটি প্রসন্ন হাসি নিয়ে এসে বলল- 'সাহেব, আজ অবশেষে তোমার জন্য বড় সিংহটা খুঁজে পেয়েছি বলেই মনে হচ্ছে। চার মাইল দূরে একটা বড় গাছের তলায় একটা বড় জন্তুকে দেখে এসেছি; কী সেটা আমি জানি না..."।

২১ তম হৌসার বিভাগের কর্নেল ই.এ.হার্ডি তাঁর বই Our Horses-এ লিখেছিলেন কথাগুলি ১৮৭৮ সালে। কর্নেল তাঁর শিকারে বার হলেন এবং ৩০ গজ দূরে তিনি যা দেখতে পেলেন তার মনে হল বড় একটা জন্তু ঘুমিয়ে আছে। "আমি গুলি চালালাম। ছিটকে উঠল চারটে চিতা, দারুণ সুন্দর জানোয়ার, একে অপরের ওপর গর্জন আর হুড়োহুড়ি করছে, একটা তার মধ্যে বেশ আহত দেখা গেল। আমি এতটাই অবাক হলাম যে, এক মুহূর্তের জন্য বোকা বনে গেলাম; আমার দ্বিতীয় বন্দুকটা নেব না তীর-ধনুক ভাবার আগেই বৃদ্ধ শিকারী চিৎকার করে উঠল, " তোমার ঘোড়া নিয়ে তাড়াতাড়ি চলো সাহেব, এরা সব চিতা, এদের বর্শায় বিঁধে ফেলা যাবে; আমরা সবক'টাকে মেরে ফেলব!"


এই বইটি প্রকাশের ১০০ বছরের মধ্যে আমরা বস্তুত: সব চিতাকেই মেরে ফেললাম। শেষ এশিয়াটিক চিতা, বিখ্যাত আফ্রিকার চিতার স্বল্প পরিচিত আত্মীয়টিকে গুলি করেন বর্তমান ছত্তিশগড়ের স্বল্পখ্যাত একটি দেশীয় রাজ্যের মহারাজা রামানুজ প্রতাপ সিং দেও ১৯৪৭ সালে।


কিন্তু বাস্তবিক কোন কারণে ভারতের চিতাদের এই পরিণতি হল?


United Nations Convention to Combat Desertification (UNCCD COP 14) এর একটি সাম্প্রতিক সমাবেশে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের এক গবেষক বলেন যে, বাসভূমির মরুগ্রাসে চলে যাওয়াই ভারতের চিতাদের (এবং এখনও টিকে থাকা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের'ও) বিলুপ্তির কারণ।


এই ঘোষণা বেশ বড় বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেয়, কিন্তু বহু মানুষকে এটা জানান দেয় যে, চিতারা ভারতীয় উপমহাদেশে আর নেই, যদিও অনেক ভারতীয় ভাষাতেই চিতার উল্লেখ হয় মূলত: লেপার্ডকে বোঝাতে। ফলত: এই গায়ে ছোপ ছোপ জন্তুদের নিয়ে একটা সংশয় কাজ করে মানুষের মনে।


তাহলে মরুভূমির গ্রাসই কি তাদের বিলুপ্তির আসল কারণ? পুরোপুরি তা নয় বোধ হয়।তাদের দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যই তাদের জন্য সংকট তৈরি করে। প্রথমত: এই বড় বিড়ালদের অতি সহজেই পোষ মানানো যেত: এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত শিকারকে তাড়া করতে ও ধরতে- অনেকটা সেই শিকারি কুকুরের মতই যাকে বলা হত কোর্সিং। তাই এদের বড় সংখ্যায় বন থেকে ধরা হত এই কাজের জন্য। দ্বিতীয়ত: চিতারা বন্দী অবস্থায় প্রজননে একেবারেই অক্ষম ছিল। পোষ্য চিতার বাচ্চা হওয়া এতই বিরল ছিল যে, ১৬১৩ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর এর প্রথম ও একমাত্র নিদর্শনটি তুজক-এ -জাহাঙ্গিরি নামক বইতে নথিবদ্ধ করেন।


শিকারের জন্য বন্দী করা


চিতাদের নিয়ে শিকার খেলার সবথেকে পুরানো নিদর্শন পাওয়া যায় দ্বাদশ শতকের পুস্তক মানসোল্লাস-এ। এটা ছিল কল্যাণের রাজা তৃতীয় সোমেশ্বরের রাজদরবারের বিবরণ। ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যযুগে এই শিকার খেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই সময়ের অনেক নথিতেই প্রশিক্ষিত চিতার দলের রাজন্যবর্গ ও সেনার হয়ে শিকারে কৃষ্ণসার হরিণ (ভারতের দ্বিতীয় দ্রুততম স্তন্যপায়ী) মারার উল্লেখ আছে।কিন্তু পোষ মানা অবস্হায় তাদের যেহেতু প্রজননে অক্ষমতা ছিল, ফলে এটা সহজেই বোঝা যায় এই শিকার চালু রাখতে এদের ক্রমাগত বন্য পরিবেশ থেকেই ধরতে হত, মূলত: শিশু অবস্থায়।

চার্লস ই ক্লে, একজন রেলবিভাগের আধিকারিক তার ১৯০১ সালের একটি প্রবন্ধে বলছেন যে তিনি দক্ষিণ কর্ণাটকের এক জঙ্গলি দম্পতির থেকে ১৮৯৬ সালে একটি চিতার বাচ্চা কেনেন। একে তিনি বড় করে তোলেন দক্ষিণ ভারতে শিকারের জন্য।বন থেকে পাওয়া চিতার দাম তখন "দশ টাকা থেকে শুরু করে যা কিছু হতে পারত দরদামের ওপর" , কিন্তু প্রশিক্ষণের সাথে তাদের দামও চড়ত। "একটা ভাল মতন পোষ মানানো (বা প্রশিক্ষিত) চিতার দাম দেড়শো থেকে আড়াইশো টাকা হতে পারত", লিখেছেন মেজর হেনরি শেক্সপীয়ার, যিনি নাগপুর ইরেগুলার ফোর্সের একজন কম্যান্ডান্ট ছিলেন এবং ১৮৪০ এর সময়ে শিকার করতেন।

বন্য পরিবেশ থেকে চিতাদের ধরার মাত্রা এমনই ছিল যে, সম্রাট আকবর তাঁর রাজকীয় পশুশালায় তাঁর ৪৯ বছরের রাজত্বে বিস্ময়কর সংখ্যায় চিতা রেখেছিলেন- ৯,০০০। অবশেষে অষ্টাদশ শতকে চিতাদের, বিশেষতঃ শাবকদের এভাবে বন্য পরিবেশ থেকে বন্দী করার বিষয়টা একটা চরম সংকটের জায়গায় চলে যায়।


শাহজাহানের চিতা নিয়ে কৃষ্ণসার হরিণ শিকার: প্রাচীন মোঘল চিত্র

সুতরাং, তাদের শিকার ও বাসস্হান অনেক দিন অবধি অক্ষুণ্ণ থাকলেও চিতাদের সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছিল তার আগেই যখন ব্রিটিশ শাসন এদেশে দানা বাঁধে শুরু করেছে ও তারা চিতাদের সংখ্যা নথিভুক্ত করতে লেগেছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে আমি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক দিব্যা ভানু সিংহ ১৭৭২ থেকে ১৯৯৭ এর মধ্যে বিভিন্ন নথিতে মাত্র ৪১৪ টি জন্তুর উল্লেখ পেয়েছি।

আর একটা বিষয় ওদের বিরুদ্ধে গেছিল- তা হল ওদের বাধ্য স্বভাব। এরা প্রায় কুকুরের মতই নীরিহ ছিল। এরা কখনই বাঘ, সিংহ বা লেপার্ডের মত ভয় জাগাত না। "শিকারি চিতা সহজেই পোষ মানে, ছয় মাস লাগে তাকে সম্পূর্ণরূপে পোষ মানাতে ও প্রশিক্ষিত করতে। এমন অনেক জন্তুই পোষ্য অবস্থায় কুকুরের মতই অনুগত ও বাধ্য, পোষ্য হয়ে যেন আনন্দিত, অতিথিদের সাথেও মার্জিত ভঙ্গী, বিড়ালের মতই গা ঘেঁষে ঘড়ঘড় শব্দ করে। পোষ্য চিতাদের সাধারণতঃ চারপাইয়ের ওপরে দেওয়ালে শেকল বেঁধে রাখা হয়, কখনই খাঁচায় রাখে না।" লিখেছেন ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ ডবলু টি ব্লানফোর্ড তাঁর সম্পাদিত The Fauna of British India, Including Ceylon and Burma-তে ১৮৮৮ সালে।


ছবি: pxfuel

ক্ষতিকারক শ্রেণীভুক্ত হওয়া: vermin


চিতার আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর একটাই ঘটনা জানা যায়। বিশাখাপত্তনমের গভর্নরের এজেন্ট ও বি আরভিনের মৃত্যু ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজের একটি পালিত চিতার হামলায় ১৮৮০ সালে একটি শিকার খেলার সময়ে। তা সত্ত্বেও ব্রিটিশদের এই জন্তুকে "ক্ষতিকারক" শ্রেণীভুক্ত করতে আটকায়না এবং এদের মারা জন্য পুরস্কারের ঘোষণাও ছিল। Journal of the Bombay Natural History Society -র ১৯৯৮ সালের একটি গবেষণাপত্রে পরিবেশ ঐতিহাসিক মহেশ রঙ্গরাজন উল্লেখ করেন যে ১৮৭১ সাল থেকেই পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা চিতা মারা ওপরে পুরস্কার ছিল। এটাই বোধহয় এদেশে এই প্রজাতির কফিনে শেষ পেরেক পোঁতে।

১৯৫১-৫২ সালেই ভারত সরকারের তরফে চিতার অবলুপ্তির কথা মেনে নেওয়া হয়।কিন্তু এরপরেও খুবই বিরল কিন্তু নির্ভরযোগ্য কিছু ঘটনার কথা জানা যায় এদের দেখতে পাবার ১৯৭০ দশকের শুরুর দিকে। ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে দুটি জায়গায়- ছত্তিশগড়ের কোরিয়ার জঙ্গলে ও মধ্যপ্রদেশের সরগুজায়। এরপর ১৯৭৫ সালে ঝাড়খন্ডের হাজারিবাগের কাছে দান্ত কালান নামে একটা গ্রামের উন্মুক্ত বনাঞ্চলে।

পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশে পথভ্রষ্ট এমন কিছু চিতা ১৯৯০ এর দশকেও ছিল, যাদের শেষটিকে গুলি করে মারা হয় ১৯৯৭ সালে চাঘাইতে। এই একই বছরে একটি মেয়ে চিতা ও তার দুই শাবকের দেখা মেলে ওই প্রদেশেরই ওরমারা এলাকায়। আসলে এই 'এশিয়াটিক চিতা' নামটি মান্যতা পায় ভারত থেকে চিতার অবলুপ্তির পর। তার আগে একে 'ভারতীয় চিতা'ই বলা হত।


চিতা নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'চিত্রকা' থেকে, যার অর্থ হল ছাপ।সবথেকে পুরানো চিতা দেখার প্রমাণ মেলে মধ্যপ্রদেশের চম্বল উপত্যকায় খারভাই ও খারিয়াবাদের গুহাচিত্রে যা ২৫০০ থেকে ২৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে করা বলে অনুমান। Journal of Bombay Natural History Society-র ১৯৩৫ সালের একটি ক্রোড়পত্রে চিতাদের বিচরণের ক্ষেত্র বর্ণনা করে: এরা বিচরণ করত বাঙলা থেকে যুক্তপ্রদেশ হয়ে পাঞ্জাব, রাজপুতানা , ওদিকে মধ্য ভারত থেকে দাক্ষিণাত্য অবধি।


এই ক্রোড়পত্রে এটাও বলা ছিল যে, "ভারতের বাইরে চিতা উত্তরাংশে রাশিয়ান তুর্কিস্তান ও কাস্পিয়ান সাগরের অঞ্চলে রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় সিন্ধুপ্রদেশ থেকে ছড়িয়ে গেছে আফগানিস্তান, বালোচিস্তান, পারস্য হয়ে মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনে।" এর সাথে তারা আক্ষেপ জানায় যে, "ভারতে চিতারা আর বন্য পরিবেশে নেই"।


বৈচিত্র্যময় বাসভূমি


বিশাল উন্মুক্ত তৃণভূমির সমতলে আফ্রিকার চিতাদের গতিতে দৌড়ে বেরানোর যে বহুল প্রচলিত চিত্র চোখে ভাসে, ভারতের চিতাকুল তার তুলনায় বিভিন্ন রকমের বাসস্থানে অভ্যস্ত ছিল: ঘাসজমি, কাঁটাঝোপ, শুষ্ক ও আধা শুষ্ক জমিতে ছিল তাদের বাস। কোণঠাসা হতে হতে ওরা ওদের শেষ আশ্রয় খুঁজে পায় পূর্ব-মধ্য ভারতের শালবনের কিনারায়, যতদিন না ওদের শেষ পদচিহ্ন ভারতের মাটি থেকে হারিয়ে যায়।

বর্তমানে এশিয়া থেকে এই প্রাণীটি হারিয়ে যাবার কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে।পৃথিবীর শেষ এশিয়াটিক চিতারা সংখ্যায় এখন মাত্র ৫০ শেষ গণনা অনুযায়ী। মধ্য ইরানের শুষ্ক, পাথীরে, শীতল মরুভূমিতে ওরা ঘুরে বেড়ায়। এমনকি আফ্রিকার শেষ কয়েক হাজার ওদের টিকে থাকা আত্মীয়দের অস্তিত্বও আজ প্রশ্নের সামনে।

ইরানের চিতা। ছবি: Tasnim News Agency/CC BY 4.0

১৯৭০ দশক থেকেই ভারত কথাবার্তা চালাচ্ছে ইরানের সাথে হারিয়ে যাওয়া এই শ্বাপদকে ফিরিয়ে আনার জন্য। ইরানও এর বদলে দুটি প্রাণী চেয়েছে যাদের তারা হারিয়েছে সময়ের সাথে- রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও এশিয়ার সিংহ। যদিও এই প্রকল্প বাস্তবের মুখ দেখেনি। এর কারণ ইরানে চিতার সংখ্যা সংকটজনক রকমের কম এবং তারা বিশাল এক এলাকা জুড়ে রুক্ষ প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়, কেউই বন্দী দশায় নেই। তাই সম্প্রতি এই প্রকল্পের পুনরুজ্জীবনে ভারতকে আফ্রিকার দিকে তাকাতে হয়েছে। যেহেতু আফ্রিকা ও এশিয়ার চিতার মধ্যে জিনগত ফারাক বেশি নেই, তাই তাদের আনাই যেতে পারে। চিতারা ভারতের বিপন্ন তৃণভূমি, যাকে পরিত্যক্ত ভূমি হিসাবে ধরা হয়, তাকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মত ভারত এখন সেই প্রকল্পের দিন গুনছে।



লেখক পরিচিতি: রাজা কাজমি একজন সংরক্ষন বিশেষজ্ঞ, বন্যপ্রাণীর ইতিহাস নিয়ে গবেষক, লেখক।


মূল প্রবন্ধটি The Hinduতে প্রকাশিত। অনুমতিক্রমে বনেপাহাড়ের জন্য অনুবাদ করলেন সুমন্ত ভট্টাচার্য্য










641 views1 comment
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page