রাজস্থানের পালি জেলায় জাওয়াই নদীর উপর নির্মিত জাওয়াই বাঁধের চারিধারে যে আরাবল্লির পাহাড়শ্রেণী আছে, সেখানে নিশ্চিন্তে বাস লেপার্ডদের। তাদের দেখার জন্য সেখানে wildlife safari চলছে বিগত কয়েক বছর ধরে। আর এর ফলে স্থানীয় মানুষদের জন্য অর্থনীতির এক নতুন দিক খুলে গেছে। কলমে ও ছবিতে সুমন্ত ভট্টাচার্য্য।

সন্ধে নামছে তখন দূরের বনজঙ্গল আর পাহাড়শ্রেণীর ওপারে। আকাশটা শেষ সূর্যের আলোয় লাল। কলকল করে বয়ে চলেছে নদীর জল। তার ধারে আধো অন্ধকারে জিপসিতে বসে অপেক্ষা করছি আমরা। দূরে নদীর উপর ব্রিজ দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে মাঝেমাঝে। এতক্ষণে হেডলাইটের আলো জ্বলে উঠেছে তাদের। অপেক্ষা করছি শ্বাপদের। সে জল খেতে যদি নদীতে নামে তবে আবার পাব দর্শন। ছবি কতটা উঠবে জানিনা এই কমে আসা আলোয়। কিন্তু সেটাই তো সব নয়। এই পরিবেশে একটা লেপার্ডকে দেখতে পাওয়া সামনে থেকে সেটাই বা কম কি! এমনকি যদি দেখতে নাও পাই, এই যে নদীর শব্দ করে বয়ে যাওয়া, ভেজা মাটি থেকে উঠে আসা গন্ধ, দূরে নদী পার হয়ে যাওয়া গরু-মহিষের দলের পদচারনার আওয়াজ, তাদের পিছনে আসা স্থানীয় মেষপালক মাথায় লাল পাগড়িয়ালা রাবারি মানুষ- এইসব নিয়ে যে চিত্রনাট্য চোখের সামনে সংঘটিত হচ্ছে তা কোন আর্ট এগজিবিশানের থেকে কম নাকি! প্রকৃতি, আমার দেশের জল-মাটি-হাওয়ায় সেই গ্যালারি জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
যখনই কোন সাফারিতে যাই, বন্যজীবের পিছনে ছোটার মতই এই অনুভূতিগুলো কম রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে না। সে গহীন বনেই হোক বা এই জাওয়াইয়ের মত আধা-বন্য আধা-গ্রাম্য পরিবেশে। এই অপেক্ষা করতে করতে বন্যতাকে শরীর মনে মেখে নেওয়াতেই যেন সম্পূর্ণতা পায় সাফারিগুলি। এমনিতেও সেদিনের মত দর্শন তো পেয়ে গেছি পুরুষ লেপার্ডটির। বিকালের আলোয় বেরার পাথর খাদানের ফাঁক থেকে সে যখন মাথা বার করে দেখা দিয়েছিল। মিলেছে বেশ কিছু ছবিও। তারপরে নদী পার হয়ে নেমে এসে নদীর অন্য পারে অপেক্ষা।
না। সেদিন আর দেখা পাইনি লাজুক সেই পুরুষটির। অন্ধকারে ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁটা ঝোপের ডাল সামলা সামলাতে ফিরে গেছি বেরা গ্রামে থাকার আস্তানায়। লেপার্ডরা আরাবল্লীর খাদ্য শৃঙ্খলের শীর্ষে থাকা প্রাণী। প্রকৃতি তাদেরই দিয়েছে এখানকার রাজপাট। কিন্তু মানুষের সীমাহীন লোভ আর জনসংখ্যার লাগামছাড়া বিস্তারে আরাবল্লী আজ বিপর্যস্ত। বিপন্ন সেখানকার প্রাণীরাও রাজস্থান বা হরিয়ানার মত রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন স্থানে। তবু তার মধ্যে একটু নিশ্চিন্ততার আশ্রয় যেন তারা পেয়েছে রাজস্থানের পালি জেলায় জাওয়াই নদী আর তার বুকে গড়ে ওঠা জাওয়াই বাঁধের আশেপাশে। যদিও এই জায়গা কোন সংরক্ষিত অরণ্য নয়, তবু এখানের পাহাড়ের খাঁজে, গুহায়, পাথরের নীচে তারা পাচ্ছে একটু সুরক্ষার আশ্রয়। এর কারণ তাদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ওয়াইল্ডলাইফ সাফারি। বেরার মতই আরো কিছু কিছু এলাকা যেমন সেনা, বিশালপুর, জীবদা, ধ্রুবোয়ানার মত স্থানে পাহাড়ের অন্দরে-কন্দরে পর্যটকদের নিয়ে যাচ্ছে সাফারির জিপসি লেপার্ড দর্শনে। যে লেপার্ড খুব লাজুক প্রাণী, গহীন বনে যাদের দেখা পাওয়া খুব দুর্লভ এক বিষয়- তারা এখানে রোদের আদর গায়ে মেখে বসে থাকা খোলা পাহাড়ে। কখনও ঘুরে বেড়ায় সপরিবারে।

তেমনই ওদের দেখতে পৌঁছে গেছিলাম সেনার পাহাড়ে দুই বেলা। আবার মোরি বেরার পাহাড়ের নীচ থেকে ওদের দেখা পেয়েছি। আরাবল্লির পাথুরে জমিতে সাফারি গাড়ির ওঠানামা, লেপার্ড দেখার থেকে কম রোমাঞ্চকর নয়। বস্তুত: জাওয়াই হল বিস্তীর্ণ পাথুরে জমি আর ছোট বড় পাহাড়ের সারি। তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট জনপদ। চাষবাস ও পশুপালন এখানকার মানুষদের আদি জীবিকা। একসময় তারা, বিশেষত: রাবারি সম্প্রদায় গবাদি পশুদের বাঁচাতে লেপার্ডদের মেরে ফেলত। কিন্তু বিগত এক- দুই দশকে তাদের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। স্থানীয় বেশ কিছু মানুষের উদ্যোগে যখন থেকে লেপার্ড দেখার জন্য পর্যটন গড়ে উঠেছে। পর্যটনের হাত ধরে এসেছে অর্থ। তা পৌঁছে যাচ্ছে স্থানীয় মানুষের হাতেও। তারা বুঝেছেন লেপার্ডদের থাকার গুরুত্ব। এখন গ্রামের মানুষের সাথে সহাবস্থানে বাস এখানকার লেপার্ডদের। মাঝে মধ্যেই তাদের একটা-দুটো গবাদি পশু বা পোষ্য কুকুর তুলে নিয়ে গেলেও- লেপার্ডদের প্রতি তারা সহনশীল । হলুদ শরীরে চক্রাকার দাগওয়ালা এই রাজকীয় প্রাণীরাও স্বভাবে লাজুক হওয়ায় মানুষের থেকে দূরে থাকে।

সেনার পাহাড়ে লেপার্ড দর্শনের পর রাতের অন্ধকারে ফিরতে ফিরতে ড্রাইভার মুকেশ ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে। গ্রানাইটের জন্য খনন কাজ এখানকার লেপার্ডদের বসতিকে অনেকটাই বিপন্ন করছে। মাঝে এগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও তা আবার শুরু হয়েছে সম্প্রতি। এদিকে হরিণ জাতীয় প্রাণীর অভাবে লেপার্ডদের পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় গ্রামের গবাদি পশু বা কুকুরের উপর। এর ফলে মানুষের সাথে সংঘাতের যেমন ক্ষেত্র তৈরি হয়, তেমনই রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনাও থাকে এই বন্য জীবদের মধ্যে। তাছাড়া জায়গাটি বনদপ্তরের অধীনে না থাকায় লেপার্ডদের বসতি আইনত: সুরক্ষিত নয়। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ঘর বাড়ি বা রিসর্টের কারণে তাদের থাকার জায়গাও কমে আসছে। সংকট এখনও ততটা গভীরে না পৌঁছলেও, ভবিষ্যতে এইগুলি লেপার্ডদের অস্তিত্বে কালো ছায়া ফেলতে পারে।

কথা বলেছি রাজস্থানের বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ধর্মেন্দ্র খান্ডালের সাথে। তাঁর মতে, “ এই স্থানে বনবিভাগের কাজ করা সমস্যার। কারণ ওখানে বেশিরভাগ জমিই ব্যক্তিমালিকানাধীন। তাই ওখানে এই পর্যটনের সাথে যারা জড়িত তাদেরই আপাতত দায়িত্ব নিয়ে বিষয়টা সুরক্ষিত করতে হবে। সাফারির সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা, অন্ধকারেও সাফারি না করা, লেপার্ডদের খুব কাছে না যাওয়া- এইগুলি যেন না হয় ওদেরই দেখতে হবে। কারণ পর্যটন থাকবে যদি লেপার্ড সুরক্ষিত থাকে তবেই। “

লেপার্ড ছাড়াও বিশাল নয়নাভিরাম জাওয়াই বাঁধ শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের বড় প্রিয় জায়গা। ১০০-র উপর পাখি এখানে পাওয়া যায়। শীতে উড়ে আসে সারস ও ফ্ল্যামিংগোর দল। এছাড়া কুমীরদের জন্য জাওয়াই বাঁধ সংরক্ষিত এলাকাও বটে। তাছাড়া স্ট্রাইপড হায়েনা, বনবিড়াল, শিয়াল, নীলগাঈয়েরও বাস এই এলাকায়। পর্যটকরা লেপার্ড ছাড়াও এইসব প্রাণীর জন্য ও পাখির ছবি তোলার জন্যও এখানে আসতে পারেন। করতে পারেন ট্রেকিং বিস্তীর্ণ পাথুরে জমি ও ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে।

পর্যটনকে যদি ভারসাম্যের মধ্যে রেখে এই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়-তবে জাওয়াই অবশ্যই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ও মানুষ-বন্যজীবের সহাবস্থানের ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। দেশ-বিদেশের পর্যটক এলে বদলে যেতে পারে স্থানীয় অর্থনীতি।

সেনার পাহাড়ে লেপার্ড দর্শনে বেড়িয়ে পড়েছিলাম ভোর হবার আগেই। অন্ধকারে কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। গায়ে এসে পড়ছিল বারবার মরু অঞ্চলের ধারালো বাবলার কাঁটা। শেষে ভোরের আলো ফোটার আগেই পাহাড়ের মাথায় তার দর্শন মিলল। জাওয়াইয়ের রাণী অপেক্ষা করছেন নতুন দিনের। আমরাও পাহাড়ের গায়ে অপেক্ষা করতে করতে দেখলাম দিগন্ত লাল করে সূর্যোদয়। সাফারিতে আসা মানে এভাবেই প্রকৃতিকে গায়ে মেখে নেওয়া। শুধুই কিছু ফটোগ্রাফ নয়।

লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। প্রকৃতি ও অরণ্যপ্রেমী। 'বনেপাহাড়ে' ওয়েবজিনের সম্পাদনার দায়িত্বে।
Comments