top of page

পোষ্যপ্রানী ও বন্যপ্রাণীদের নিয়ে আবেগের মেলবন্ধন ৪র্থ কলকাতা পশু উৎসবে

  • ..
  • Jan 20
  • 4 min read

Updated: Jan 21

বন্যপ্রাণী ও পোষ্য কুকুর বা বিড়ালের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে কি ফারাক রয়েছে? যারা ভালবাসতে জানেন বোধহয় সবার জন্যই ভাবেন। কারণ পৃথিবীটা তো মানুষের একার নয়। প্রতিটি প্রাণীর অধিকার রয়েছে সেখানে তাদের মত করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার। তাই তাদের কথা যৌথভাবে ভেবে কলকাতায় আয়োজিত হচ্ছে কলকাতা পশু উৎসব। ঘুরে এসে জানাচ্ছেন ড: ঐশিমায়া সেন নাগ


ree

গত ২৮ এবং ২৯ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক অনন্য উৎসব, ৪র্থ কলকাতা অ্যানিমাল ফেস্টিভ্যাল। এটি  আমাদের গ্রহের না-মানুষ বাসিন্দাদের এবং তাদের সঙ্গে আমাদের আন্তরিক সম্পর্ক উদযাপনের একটি উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। এই উৎসব কেবল আমাদের সঙ্গে থাকা পোষ্য  প্রাণীদের দ্বারা আমাদের জীবনে বয়ে আনা উষ্ণতা ও আনন্দকে স্বীকৃতি দেয়নি, সাথে সাথে  বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও শিক্ষা দিয়েছে, যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ  কলকাতার অসীম মেমোরিয়াল গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল "ফর দ্য অ্যানিমালস" এবং "কলকাতা অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন" এর  উদ্যোগে আর  "অ্যানিমালস ফার্স্ট এইড" (ইউএসএ) এর সহযোগীতায়।

 


ree

২৮ ডিসেম্বারের বিকেলে, মানুষজন অসীম মেমোরিয়ালের মাঠে জমায়েত হতে শুরু করেন। মাঠের কেন্দ্রস্থলে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, এবং চারপাশে ছিল স্টল ও অন্যান্য স্থাপনাগুলি। উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন প্রাণী কল্যাণ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার সদস্য, পোষা প্রাণীর মালিকরা, এবং প্রকৃতির ও পশুপাখি সম্পর্কে উৎসাহী অন্যান্য ব্যক্তিরা।

 

দিনের প্রথম পর্ব ছিল শিশুদের জন্য 'প্রকৃতি এবং প্রাণী' বিষয়ক একটি বসে আঁকা প্রতিযোগিতা। খুদে অংশগ্রহণকারীরা খুব মনোযোগ সহকারে ছবি আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, এবং তাদের সৃজনশীলতা কাগজে অপূর্বভাবে ফুটে ওঠে। এরপর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন – পশু অধিকার আইন সংক্রান্ত সভা।  প্রায়শই প্রাণী কল্যাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল আইনি সমস্যা দেখা দেয়, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা  কখনও কখনও এই বিষয়গুলোতে প্রযোজ্য আইন সম্পর্কে অবগত থাকেন না। তাই, ৪র্থ কলকাতা অ্যানিমাল ফেস্টিভ্যাল মানুষকে বিশিষ্ট প্রাণী অধিকার আইনজীবী ও কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ করে দিল এইদিন।  তাদের কাছ থেকে প্রাণী কল্যাণ আইন, প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা সম্পর্কিত মামলার সমাধানের উপায় ইত্যাদি সম্পর্কে জানার  সুযোগ পাওয়া গেল ।

 


ree

 এরপর ছিল পোষ্যদের নিয়ে র‍্যাম্প শো। সবার জন্য খুব আনন্দের, মজার একটা পর্ব।  বিভিন্ন আকার এবং আকৃতির, সবার খুব  আদরের পোষা কুকুরগুলো তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে মঞ্চে উঠে র‍্যাম্পে হাঁটল। শেষে তাদের সবার জন্য মেডেল প্রদান করা হয়। সবার মন ছুঁয়ে যাওয়া এই শো-এর পর শুরু হয় “Caregiver Acknowledgement session”, যেখানে গৃহপালিত  ও  বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য সক্রিয় ব্যক্তিদের তাদের মহৎ কাজের জন্য সম্মানিত করা হয়।

 


ree

পরদিন রবিবার, ২৯শে ডিসেম্বর, ছিল সকাল থেকেই উজ্জ্বল আর সুন্দর একটা দিন। আবারও, অসীম মেমোরিয়াল গ্রাউন্ড তৈরি হয়েছিল অসংখ্য দু’পেয়ে এবং চার পেয়ে  অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য।

 

দিনের প্রথম পর্ব ছিল একটি বন্যপ্রাণী নিয়ে সচেতনতামূলক সভা, যা কলকাতা এবং এর আশেপাশে শহুরে ও গ্রামীণ  এলাকার বন্যপ্রাণীদের সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছিল। হাওড়ার বাগনানের সুপরিচিত বন্যপ্রাণী উদ্ধারকর্মী এবং সংরক্ষণবিদ চিত্রক প্রামাণিক একটি মনোমুগ্ধকর বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি অনেক বন্যপ্রাণীর কথা বলেন যাদের নিয়ে মানুষ জানে কম। যেমন মেছো বিড়াল, বন বিড়াল, ভাম ইত্যাদি যাদের সঙ্গে আমরা পাশাপাশি থাকি। বিপদ বা সংকটে থাকলে কীভাবে তাদের উদ্ধার করা যেতে পারে সেই নিয়েও চিত্রক বলেন । এছাড়াও, তিনি এই প্রজাতিগুলিকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

 

চিত্রক এবং তার সহকর্মী সুমন্ত দাস, যিনি একজন দক্ষ সাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী উদ্ধারকর্মী-   এখানে  একটি বন্যপ্রাণী সচেতনতা শিবিরও স্থাপন করেন। তারা বিভিন্ন পোস্টার প্রদর্শন করেন যেগুলিতে উল্লেখ  ছিল বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়। চিত্রক এবং সুমন্ত উপস্থিত অনেকের থেকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংক্রান্ত অসংখ্য প্রশ্নের উত্তরও দেন।

 


ree

 এসবের  পাশাপাশি  এই অনুষ্ঠানে  পোষা প্রাণীদের অভিভাবকদের জন্য তাদের পোষ্যদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর সুযোগ ছিল, যা প্রখ্যাত পশু চিকিৎসকরা পরিচালনা করেন। এছাড়াও, পশুদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ পর্বও অনুষ্ঠিত হয়। যারা ভবিষ্যতে পোষা প্রাণীর অভিভাবক হতে চান, তাদের জন্য দেশি কুকুর দত্তক নেওয়ার সুযোগও ছিল এখানে ।

 


ree

দ্বিতীয় দিনেও একটি পশু আইন প্রশিক্ষণ পর্ব অনুষ্ঠিত হয় আবার।  এরপরে দেশি কুকুর শো’ -য়ের পালা ছিল।  এই পর্বে ভারতের নিজস্ব দেশীয় কুকুর প্রজাতিদের উদযাপন করা হয়—যারা দেশের রাস্তায় ঘোরাফেরা করে। যারা তাদের প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারে, সেইসব দয়ালু মানুষজন তাদের দত্তক নেন। শোটির উদ্দেশ্য ছিল রাস্তার কুকুরদের দত্তক নেওয়ার বিষয়ে সচেতন করা ও  প্রচার করা। এই পর্বে শারীরিক প্রতিবন্ধী কুকুররাও অংশগ্রহণ করেছিল এবং তাদের  আদুরে আচরণে সবার  হৃদয় জয় করে নিয়েছিল।

স্মরণীয় দিনটি একটি বই প্রকাশ এবং পুরস্কার বিতরণের মাধ্যমে শেষ হয়। প্রকৃতি ও প্রাণী সম্পর্কিত কাহিনী এবং নিবন্ধের একটি সংকলন হিসেবে প্রকাশিত বইটির শিরোনাম ছিল -"A  Brief Existence and Other Short Writings on Nature and Animals".


ree

এভাবেই চতুর্থ কলকাতা পশু উৎসব অত্যন্ত সফলভাবে শেষ হয়। এটি শুধুমাত্র মজার আর আনন্দেরই একটি উৎসব ছিল না, বরং শিক্ষামূলক এবং সচেতনতা সৃষ্টির একটি মাধ্যমও হয়ে উঠেছিল।

একজন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপর লেখকের  দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে পারি, এই উৎসবটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ যারা করে এবং অন্যান্য  প্রাণীদের যারা ভালবাসে ও যত্ন করে-তাদের  এক অনন্য মেলবন্ধনের জায়গা হয়ে উঠেছিল। এটি উভয় গোষ্টীকে এক হয়ে সাধারণ সমস্যাগুলির সমাধান খোঁজার জন্য যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছিল।

বর্তমানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংক্রান্ত অনেক সমস্যা, যেমন যত্রতত্র ঘোরাফেরা করা কুকুর ও বিড়ালদের দ্বারা বন্যপ্রাণীর শিকার এবং গৃহপালিত ও বন্য প্রজাতির মধ্যে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি এগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার । রাস্তার পশুদের দত্তক নিয়ে, তাদের ঘরে রেখে, নির্বীজকরণ (স্পে/নিউটার) এবং টিকা প্রদান করে-  পশুপ্রেমীরা সর্বত্র ঘুরে বেড়ানো  কুকুর ও বিড়ালের কারণে বন্যপ্রাণীর ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয় তা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থাগুলি তাদের এইসব  প্রচেষ্টাকে আরও কাজে লাগিয়ে এই প্রক্রিয়াকে আরও বিস্তৃত করতে পারে।

রাস্তার কুকুর ও বিড়ালের যত্ন নেওয়া মানুষরা সব প্রাণীর প্রতিই সহানুভূতিশীল হন। তাই অনেকেই  তারা প্রায়ই বন্যপ্রাণীদেরও বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেন, যেমন ঘুড়ির সুতোয় আটকে পড়া পাখি বা বাজি ফাটার কারণে অসুস্থ প্রাণীদের। তবে, অনেক সময়ই তারা বন্যপ্রাণীদের যত্ন  ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে খুব একটা অভিজ্ঞ নন। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা এমন মানবিক ব্যক্তিদের এইসব বিষয়ে  শিক্ষিত করতে পারেন  ও প্রশিক্ষন দিতে  পারেন, যাতে আরও বেশি বন্যপ্রাণীর জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়।


ree

যত বেশি কণ্ঠ অবলা প্রাণীদের পক্ষে কথা বলবে, তাদের পক্ষ শক্তিশালী হবে। তাই পশুপ্রেমীরা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ যারা করেন তারা    একসঙ্গে একযোগে কাজ করতে পারেন। যখন বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘিত হয় বা প্রকৃতি বিপদের মুখে পড়ে, তখন ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য আরও কণ্ঠস্বর প্রয়োজন একত্রে।  এর জন্য, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তথ্য ও জ্ঞানের  আদানপ্রদান  জরুরি, যাতে উভয়ই এক লক্ষ্যে একত্রিত হতে পারে।

এভাবে, চতুর্থ কলকাতা অ্যানিমাল ফেস্টিভ্যাল আমাদের শিখিয়েছে একটি  সাম্যের পৃথিবী গড়ার গুরুত্ব, যেখানে মানুষ ছাড়াও  প্রতিটি প্রজাতি যেন  একটি ভালো জীবনের সুযোগ পায়।


ছবি: ঐশিমায়া , প্রত্যুষা


লেখক পরিচিতি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট। বর্তমানে বন্যপ্রাণ ও সংরক্ষণের কাজে নিবেদিত। কানাডা থেকে প্রকাশিত শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট worldatlas এর অন্যতম সম্পাদক। বর্তমানে বাংলা ওয়েবজিন 'বনে-পাহাড়ে'র সহযোগী সম্পাদিকার দায়িত্বেও তিনি যুক্ত।

Comments


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page