top of page
  • ..

বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প গুজরাতের কচ্ছকে পরিণত করছে পাখিদের বধ্যভূমিতে

অপ্রচলিত বা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎসগুলিকে গ্রীণ এনার্জি বলা হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আরো বেশি করে তৈরি হচ্ছে বায়ুচালিত বা সৌরশক্তি নির্ভর এইসব প্রকল্প। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা বা সদিচ্ছার অভাবে গুজরাত বা রাজস্হানে সেগুলি জীববৈচিত্র ও পক্ষীকুলের পক্ষে হয়ে উঠছে সর্বনাশা।বিপুল সংখ্যক পাখিদের মৃত্যু ঘটছে পরিবাহী বৈদ্যুতিক তারের সাথে সংঘর্ষে। কী বলছেন এই নিয়ে বিশেষজ্ঞরা, বিদ্যুৎ সংস্হাগুলি? কী বলছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত? আলোচনায় রোনক গুজ্জর




প্রতি বছর ৩০ হাজার পাখি মারা যাচ্ছে গুজরাতের কচ্ছের আবদাসা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ তারের সাথে সংঘর্ষের ফলে। এমন দুশ্চিন্তাজনক তথ্য উঠে এসেছে দ্য করবেট ফাউন্ডেশান নামক বন্যপ্রাণ সংস্হার সমীক্ষায়। এই পরিবাহী তারের কারণে আরও বিপদে পড়েছে বিপন্ন তালিকাভুক্ত গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডরা। পরিস্হিতির আরও অবনতির আশংকা করা হচ্ছে যেহেতু গুজরাতে আরও বেশি বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা আসতে চলেছে।

বর্তমানে গুজরাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৪৪.১২ গিগাওয়াট, যার মধ্যে ১৭.১ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য বা অপ্রচলিত উৎস থেকে।গুজরাতে এই পুনর্নবীকরণযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বড়সড় পরিকল্পনা আছে যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৬০গিগাওয়াট করার প্রস্তাব রয়েছে। এবং এইসব বিদ্যুৎ প্রকল্পের সিংহভাগই হতে চলেছে কচ্ছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বারে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি এই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও বটে একটি ৩০ গিগাওয়াটের পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির হাইব্রিড এনার্জি পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করেন যা কচ্ছের ৭২হাজার একর জুড়ে বিস্তৃত। এই পার্ক বিশ্বের বৃহত্তম পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র হবে তৈরি হয়ে গেলে।কিন্তু এই পার্ক আসলে এশিয়ার একমাত্র ফ্লেমিংগো প্রজনন কেন্দ্র- কচ্ছ মরুভূমি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের একেবারে কাছে।

পরিবেশ ও বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা দেখছেন, এভাবে চলতে থাকলে পাখিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকা ব্যাপক পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়বে বিপুল আয়তনের বিদ্যুৎ পরিবাহী তার ও মানুষের বেড়ে চলা উপস্হিতির কারণে।


কচ্ছের তৃণভূমিতে পাখিদের আবাসস্হলে বিপদ এই হাইটেনশান বিদ্যুতের তার। ছবি: লেখক।

বিদ্যুতের তারে পাখির মৃত্যু রাজস্হানেও বড় সংকট তৈরি করেছে


ভারতে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদনে গুজরাতের আগে রয়েছে রাজস্হান, যেখানে বিদ্যুৎ পরিবাহী তারে ব্যাপক হারে পাখির মৃত্যুর ঘটনা দেখা যায়। রাজস্হানের থর মরুভূমি অঞ্চলে Wildlife Institute of India এর সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিবছর ১ লাখ পাখির মৃত্যু হচ্ছে এই কারণে।

এইভাবে পরিবাহী তারের সাথে সংঘর্ষে পাখির মৃত্যুর ঘটনা সুপ্রিম কোর্টে চলা একটি মোকদ্দমায় উঠে এসেছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট একটি আদেশে গুজরাত ও রাজস্হানের গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের বাসস্হানে সমস্ত পরিবাহী তারকে ভূ-গর্ভস্হ করার নির্দেশ দেয় এবং শূন্যে থাকা তার থেকে পাখিদের দূরে রাখার জন্য bird diverters এর ব্যবহার করতে বলে সব তারে।

নভীনভাই বাপট গুজরাতের কচ্ছের একজন পক্ষী-বিশারদ ও পরিবেশকর্মী । তিনি জানান যে তাঁরা বাধ্য হয়েই সুপ্রিম কোর্টে যান কারণ গুজরাত সরকার "পাখিদের সংরক্ষণের জন্য কোন উপযোগী ব্যবস্হা গ্রহণ করেনি"।

বাপট বললেন, "স্হানীয় ও রাজ্যস্তরে অনেকবার অনেক অনুরোধ করা হয়েছে, কিন্তু গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের জন্য কিছু ভাবাই হয়নি। আমরা উন্নয়ন বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরুদ্ধে নয়। গ্রামবাসী ও কৃষকদের বিদ্যুৎ প্রয়োজন। আমরা শুধু বিদ্যুৎ পরিবহন ব্যবস্হার পরিবর্তনের অনুরোধ জানাচ্ছি। জমির নীচ দিয়ে সেটা হলে শেষ ক'টা বেঁচে থাকা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের ও অন্যান্য বিপন্ন প্রাণীদের জন্য তা উপযোগী হত"।

গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড ও তাদের বাসভূমি। ছবি: raju kasambe/ wikimedia commons

২০১২-১৩ সালে কচ্ছের খাদির এলাকায় ফ্লেমিংগোদের বাঁচানোর জন্য গুজরাত বিদ্যুৎ পরিবাহী সংস্হা GETCO ৬৬কিলো ভোল্টের তার ১০ কিলোমিটার ধরে মাটির নীচে পেতেছিল। করবেট ফাউন্ডেশানের ডেপুটি ডিরেক্টার দেবেশ গাদাভি জানালেন, এখন সেই একই সংস্হা কুনাঠিয়া্ গ্রামের কাছে ৬৬ কিলো ভোল্টের বিদ্যুতের তার মাটির নীচে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে। তাই গাদাভি প্রশ্ন তুলছেন, সরকারি সংস্হা ভূ-গর্ভস্হ তার ব্যবহার করতে পারলে বেসরকারি সংস্হা কেন করতে পারছে না! সুপ্রিম কোর্টে চলা মামলায় বেসরকারি সংস্হাগুলি জানিয়েছে মাটির তলা দিয়ে তার নিতে হলে তাদের প্রকল্প নাকি লাভজনক থাকবে না।

বিখ্যাত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ এম কে রজনীতিশ যিনি Wildlife Trust of India -র প্রাক্তন চেয়ারম্যান, তিনিও এই মামলায় একজন আবেদনকারী। তাঁর বক্তব্য, " আমরা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যপূর্ণ স্হান ও সৌধ বাঁচাতে সবরকম চেষ্টা করি। আমরা কোন এমন কাজ সেসব জায়গার আশেপাশে হতে দিইনা যদি তা সেই ঐতিহ্যে আঘাত করে। একইভাবে, তৃণভূমি ও বন আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যপূর্ণ স্হান, একইরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদেরও রক্ষা করতে হবে। আমাদের প্রাকৃতিক আবাসস্হলগুলির একটা ছোট অংশে আমরা এমন সরলরৈখিক পরিকাঠামো (linear infrastructures) কেন হতে দিচ্ছি! উন্নয়নের নামে সবকিছুই কি নষ্ট করে দেব?"

তিনি আরো বলেন, " আমাদের সংবিধান অদ্বিতীয় ও অনুসরণযোগ্য যেখানে জোর দিয়ে বলা আছে, প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা শুধু নাগরিকের কর্তব্যই নয়, তার অধিকারও।গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের বাঁচাতে তো বিদ্যুৎ পরিবহন বন্ধ করার কোন প্রশ্ন নেই। শুধু পরিবাহী তারকে জমির তলা দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। না করলে বুঝতে হবে, আমরা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের অবলুপ্ত করে দিতে চাইছি। এটা তবে ভারতের প্রথম প্রজাতি হবে যাকে জোর করে অবলুপ্ত করে দেওয়া হল তাকে বাঁচানোর বিজ্ঞানসম্মত উপায় থাকা সত্ত্বেও"।




গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের স্হানান্তর করলে কি সমস্যা মিটবে


সুপ্রিম কোর্টে চলা মোকদ্দমায়, গুজরাতের বিদ্যুৎ সংস্হা কচ্ছের চারটি নারী গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের অন্য কোথাও স্হানান্তর করে দিতে সওয়াল করছে।

গুজরাত বন বিভাগের পশ্চিম কচ্ছের ডেপুটি কনজার্ভেটার অব ফরেস্ট যুবরাজ সিং ঝালা জানালেন, সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ সংস্হাগুলির সাথে বৈঠক হয়েছে পাখিদের মৃত্যু নিয়ে এবং উপযুক্ত ব্যবস্হা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, "টিকে থাকা চারটি নারী গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের রক্ষা করা ও তাদের বাসস্হানের সংরক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। গুজরাত বন বিভাগ সংরক্ষিত এলাকায় ক্ষতিকারক কাজকর্ম যাতে না হয় সেদিকে নজর রাখছে আর কর্মীদেরও পাখিদের সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতন করছে"।

কচ্ছ জেলা



গুজরাতের মুখ্য বনপাল (Principal Chief Conservator of Forests) ও মুখ্য বন্যপ্রাণী তত্ত্বাবধায়ক (Chief Wildlife Warden) শ্যামল টিকাদার বলেন," গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের অন্যত্র সরিয়ে দেবার কোন প্রশ্ন আসেনা। যদি ওদের আমরা ধরতে যাই, তবে তারা মরে যাবে।যদিও, রাজস্হান থেকে একটি পুরুষ গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডকে নিয়ে আসাই গুজরাতে তাদের টিকিয়ে রাখার একমাত্র উপযুক্ত পদক্ষেপ"।

দেবেশ গাদাভি হলেন IUCN SSC (International Union for Conservation of Nature-Species Survival Commission) এর বাস্টার্ড বিশেষজ্ঞ গ্রুপের সদস্য। গত বারো বছর ধরে তিনি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের সংরক্ষণের কাজে নিযুক্ত। তিনি জানালেন, ২০২০ সালে গুজরাত পরিযায়ী পাখিদের সংরক্ষণে নিযুক্ত সংস্হাগুলির ১৩ তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। এই তাৎপর্যপূর্ণ সম্মেলনে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড ছিল প্রতীক।

তিনি বলেন, "কচ্ছ, বিশেষত: আবদাসা অঞ্চলটি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের জন্যই শুধু নয়, ২৫টিরও বেশি বিপন্ন প্রজাতির পাখির অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যা পরিযায়ী পাখিদের সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও তাৎপর্যের। তাই এই এলাকাকে বাঁচানো দরকার শুধু গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডদের জন্যই নয়, বরং আরও অনেক পরিযায়ী পক্ষীকুলের জন্য যাদের জন্য গুজরাত ও ভারত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ।GETCO মাটির তলা দিয়ে বিদ্যুতের তার নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। এবার অন্য সংস্হাগুলোও এগিয়ে আসুক তারের সাথে সংঘর্ষে পাখির মৃত্যু কমাতে"।


গুজরাত সরকারের শক্তি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা এফিডেবিট অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিলে GETCO টেন্ডারের কাজ শুরু করেছে ১৮ হাজার bird diverters কেনার জন্য যার দাম পড়বে ২৯.২৫ কোটি টাকা। এগুলি লাগানোর কাজ জুন মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবার আশা করা হচ্ছে।

জীববৈচিত্র নিয়ে গবেষণা করা পঙ্কজ যোশী জানালেন, "সরলরৈখিক বা বড় স্হান অবরুদ্ধ করে কোন পরিকাঠামোর দ্রুত নির্মাণ হলে তা অনেক বন্যপ্রাণী প্রজাতির গতিবিধির পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং বাসস্হানের অনেক রকম সমস্যা দেখা দেয় বিপন্ন প্রজাতিগুলির ক্ষেত্রে যেমন, বুনো গাধা, চিংকারা হরিণ, মরুভূমির বিড়াল,শেয়াল, হায়েনা, ক্যারাকাল, নেকড়ে, হনি বেজার্ড, শজারু প্রভৃতির ক্ষেত্রে।কচ্ছের গ্রেটার রান ও লেসার রানের আশেপাশে নির্মিত যাতায়াতের রাস্তাগুলি বড় ও ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীদের যাতায়াতের পক্ষে বড় বাধা, এমনকি পরিযায়ী মরশুমি পাখি যেমন ফ্লেমিংগোদের জন্য। এছাড়া রাস্তায় চাপা পড়ে এদের মারা যাবার সংখ্যা বেড়ে যাবার ব্যাপার তো আছেই।"

এছাড়া ভূমিজ জলের গতিপথে বাধা সৃষ্টির কারণে অনেক রকম ঘাসের বাড়বৃদ্ধিতে সংকট সৃষ্টি হতে পারে যা এখানকার তৃণভোজী প্রাণীদের টিকে থাকতে প্রয়োজন বলেও তিনি জানান।




মূল প্রবন্ধটি Mongabayপত্রিকায় প্রকাশিত। ইংলিশ প্রবন্ধটির অনুমতিক্রমে অনুবাদ করা হল বনেপাহাড়ের পাঠকদের জন্য। মূল প্রবন্ধটির লিঙ্ক: https://india.mongabay.com/2022/05/are-power-lines-turning-kutch-into-a-bird-graveyard-from-a-bird-paradise/

Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page