top of page

সংকটে অসমের হুলক গিবনদের বাসভূমি হোলংপার

  • ..
  • Apr 30
  • 4 min read

Updated: May 1

ভারতে বসবাসকারী একমাত্র ape জাতীয় প্রাণী হুলক গিবন। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেলেও তাদের জন্য নির্ধারিত একমাত্র অভয়ারণ্য অসমের জোরহাটের হোলংপাড়। আর খনিজ তেল উত্তোলনের পরিকল্পনার জন্য সেই একমাত্র অভয়ারণ্যেই থাবা বসাতে চলেছে মানুষের উন্নয়ণ প্রকল্পের। কেমন সেই পরিকল্পনা, কিভাবে তা বিপন্ন করবে ভারতের অনন্য এই প্রাণীকূলকে তা নিয়ে আলোচনায়  অসমের বিশিষ্ট গবেষক, অধ্যাপক ও IUCN এর সদস্য ড. সঞ্জীব কুমার বরকাকতি


হুলক গিবন  ছবি: wikimedia commons
হুলক গিবন ছবি: wikimedia commons

ভারতের সরকার ভেদান্ত গ্রুপের অধীনস্থ কেয়ার্ন অয়েল অ্যান্ড গ্যাসের একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে, যাতে তারা অসমের জোরহাট জেলায় অবস্থিত হোলংপাড় গিবন অভয়ারণ্যের পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চলে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে পারবে। কেয়ার্ন অয়েল অ্যান্ড গ্যাস একটি বেসরকারি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন সংস্থা, যা ভারতের অভ্যন্তরীণ অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের এক চতুর্থাংশের যোগান দেয়। তবে অনুসন্ধানমূলক খননের জন্য এই ছাড়পত্রটি অভয়ারণ্যে বসবাসকারী বিপন্ন প্রাইমেটদের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। হোলংপাড়ের হুলক গিবনরা অত্যন্ত সংবেদনশীল, তারা খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে  রয়েছে। তারা ইতিমধ্যেই নানা কারণে তাদের আবাসস্থলের একটি বড় অংশ হারিয়েছে। আবাসস্থলের আরও ক্ষতি তাদের আইইউসিএন রেড লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করার পরিস্থিতি তৈরি করবে। এর ফলে অসম এবং ভারতের সরকারেরই দুর্নাম, কারণ অভয়ারণ্যে খননের অনুমোদনে সরকার নিজেই অংশীদার । গিবনদের টিকে থাকতে একটানা ঘন ছায়াচ্ছন্ন বনভূমির আচ্ছাদন (ক্যানপি) প্রয়োজন, কিন্তু অভয়ারণ্য বা তার আশেপাশের পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চলে (ইএসজেড) খনন কার্যক্রমে বনভূমির খণ্ড-বিখন্ড হবে এবং এর ফলে এই ‘ক্যানপি’র বিভাজন হবে। পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চলে যেকোনো খনন কার্যকলাপ গিবনদের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, কারণ এতে এই  ক্যানপির ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে যাবে।


ছবি: ডা:ধীমান অধিকারী
ছবি: ডা:ধীমান অধিকারী

প্রকল্প স্থলটি হোলংপাড় গিবন অভয়ারণ্য থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি মোট ৪.৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যার মধ্যে রয়েছে ১.৪৪ হেক্টরের একটি ওয়েল প্যাড এবং ৩.০৬ হেক্টরের একটি সংযোগ সড়ক — উভয়ই পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চলের (ইএসজেড) মধ্যে অবস্থিত। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে ভারত সরকারের জাতীয় বন্যপ্রাণী পর্ষদের (NBWL) স্ট্যান্ডিং কমিটি এই প্রস্তাবের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন প্রদান করে। এর আগে অসমের প্রধান বন সংরক্ষক (PCCF, Wildlife) এবং প্রধান বন্যপ্রাণী রক্ষক (chief wildlife warden of Asam)  "জাতীয় স্বার্থ"-এর কথা উল্লেখ করে প্রকল্পটির সুপারিশ করেছিলেন। এছাড়াও, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের অরণ্য সংক্রান্ত  পরামর্শদাতা কমিটিও ২৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রকল্পটিকে অনুমোদন দিয়েছিল।

কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রণালয়, ভারতের বন্যপ্রাণী ইনস্টিটিউট (WII) এবং অসম বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত পরিদর্শন দল জানিয়েছে যে, অনুসন্ধানমূলক খনন খুব সামান্য ক্ষতি ঘটাবে এবং বাণিজ্যিক খনন চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে না। ভেদান্ত গ্রুপ লিখিতভাবে নিশ্চিত করেছে যে, প্রকল্পস্থলে কোনো বাণিজ্যিক খনন চালানো হবে না। প্রতিবেদনটিতে সুপারিশ করা হয়েছে যে, পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চল থেকে, রিজার্ভ আবিষ্কৃত হলেও, কোনো তেল বা গ্যাস উত্তোলন করা যাবে না।


গাছেদের ছাউনি/ ক্যানপি ধরে বনে বিচরন ওদের । ভিডিও: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ।

 

তবে, অনুসন্ধানমূলক খনন অবশ্যই বাণিজ্যিক খননের দিকে নিয়ে যাবে। অন্যথায়, এমন খনন একেবারেই প্রয়োজনীয় ছিল না। তাই, প্রতিবেদনটি যে সুপারিশ করেছে যে, পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চলে, রিজার্ভ আবিষ্কৃত হলেও, কোনো তেল বা গ্যাস উত্তোলন করা যাবে না, তা সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং ভবিষ্যতে এটি সহজেই উপেক্ষা করা হবে। ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর অজুহাত কথাটা  ইতিমধ্যেই এর ইঙ্গিত দেয়। তবে ভারতের অপরিশোধিত তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করার ‘জাতীয় স্বার্থ’ গিবনদের বেঁচে থাকার সামগ্রিক স্বার্থের তুলনায় কখনই বড় হতে পারে না।

ভেদান্ত গ্রুপ জানিয়েছে যে, অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চলাকালীন কোনো বিপজ্জনক পদার্থ ব্যবহার করা হবে না। তবে, অপরিশোধিত তেলের ছড়িয়ে পড়া  পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চলে মাটি দূষণের কারণ হবে। এর আগে অসমের বহু তেল কূপে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ সংযোগ এবং কোনো সম্ভাব্য অগ্নিকাণ্ডও ২০২০ সালের বাঘজন গ্যাস ও তেল লিক ঘটনার মতো কিছু ঘটাতে পারে। খনন স্থানগুলি সবসময় ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির মধ্যে থাকে; যদি তা ঘটে, তবে  দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় প্রায় পুরো আবাসস্থল হারিয়ে যাবে গিবনদের।  এর সাথে সাথেই  অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে একটি রেলপথও বৈদ্যুতিকীকরণের জন্য প্রস্তুত। এই রেলপথটি ইতিমধ্যেই অভয়ারণ্যকে দুটি অসমান ভাগে ভাগ করেছে, যা প্রাণীদের চলাফেরায় সমস্যা সৃষ্টি করেছে এবং গাছের ক্যানপির বিভাজন ঘটিয়েছে। এই রেলপথটি দ্বৈত ট্র্যাকে বাসডাবল লাইনে উন্নীত করার সম্ভাবনাও রয়েছে। এসব কিছুই  এই অভয়ারণ্যের জন্য, বিশেষ করে গিবনদের জন্য ভালো সংকেত বহন করছে না।


গিবনদের পারাপারের জন্য রেলপথের উপর তৈরি সেতু ছবি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ
গিবনদের পারাপারের জন্য রেলপথের উপর তৈরি সেতু ছবি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ

হোলংপাড় গিবন অভয়ারণ্য ভারতের একমাত্র Ape প্রজাতি, হুলক গিবনের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এর আয়তন ২০.৯৮ বর্গ কিলোমিটার, তবে এর পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চল (Eco sensitive zone/ ইএসজেড) ২৬৪.৯২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। বিশাল ইএসজেডের প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে গিবনদের চলাচলের জন্য অবিচ্ছিন্ন ক্যানপির প্রয়োজন।  এই  বনাঞ্চল একটি  বন্য করিডরের কাজ করে, যা দিসোই ভ্যালি রিজার্ভ ফরেস্ট এবং নাগাল্যান্ডের বন্য  আবাসস্থলগুলোকে সংযুক্ত রেখেছে। এটি ছাড়া, অভয়ারণ্যে পাওয়া সাত প্রজাতির প্রাইমেট তাদের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য যে, এই অভয়ারণ্যে ভারতের যে কোনো সুরক্ষিত অঞ্চলের জন্য সর্বোচ্চ প্রাইমেট (primate) প্রজাতির বৈচিত্র্য রয়েছে। এটি এই অভয়ারণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার গুরুত্বকে তুলে ধরে। গিবনরা ছোট ছোট পরিবারে বসবাস করে। এই অভয়ারণ্যে ২৬টি গিবন পরিবার রয়েছে, যার মোট জনসংখ্যা ১০৬। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গিবনদের জীবনকাল প্রায় ৩৫ বছর।


মহিলা গিবন।  ছবি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ।
মহিলা গিবন। ছবি: ড: ঐশিমায়া সেন নাগ।

 

  এই অভয়ারণ্যটি ৬০টিরও বেশি হাতি, ২১৯টিরও বেশি পাখির প্রজাতি, ২০০টিরও বেশি প্রজাপতির প্রজাতি, বন্য শুকর, ক্যাপড্ ল্যাঙ্গুর, স্টাম্প-টেইলড্ মাকাক, রিসাস মাকাক এবং দুর্লভ প্রজাতির বেঙ্গল স্লো লরিস, বিরল পোকামাকড়, সরীসৃপ ইত্যাদির আবাসস্থল। হোলংগাপার শব্দটি এসেছে এখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া মূল্যবান হোলং (ডিপ্টেরোকার্পাস রেটুসাস) গাছ থেকে।


 সেই সুউচ্চ হোলং বৃক্ষ।  ছবি:  অরিজিৎ নাগ।
সেই সুউচ্চ হোলং বৃক্ষ। ছবি: অরিজিৎ নাগ।

এই উঁচু গাছটি তার বিস্তৃত ছায়া-ছাউনির জন্য পরিচিত এবং গিবনদের চলাচলের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গাছ কেটে ফেলা জৈববৈচিত্র্যের জন্য বড় ক্ষতি হবে, কারণ একটি হোলং গাছ পরিপূর্ণ হতে প্রায় ৫০ বছর সময় নেয়। এটি অসম রাজ্যের রাজ্য বৃক্ষও বটে, ফলে এর একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।


ছবি: ডা: ধীমান অধিকারী
ছবি: ডা: ধীমান অধিকারী

উপরন্তু, যেখানে তেল কূপ খননের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেই এলাকাটি হাতির চলাচলের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই প্রস্তাবিত তেল কূপ খননের কাজ হাতির চলাচলে বাধা সৃষ্টি করবে এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। এর ফলে, এই অঞ্চলে ইতিমধ্যেই বিদ্যমান মানুষ-হাতি সংঘর্ষ আরও বেড়ে যাবে, কারণ হাতিরা মানুষের বসতিতে ঢুকে পড়বে। এখন হাতির পালগুলি তিরুহিল, ডিজোই উপত্যকা এবং ডিজোই বনাঞ্চলের দিকে ঘোরাফেরা করে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম এই চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবে, ফলে পুরোপুরি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। এ কারণে হাতিরা গোলাঘাট ও নগাঁও জেলার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে, যেখানে মানুষ ইতিমধ্যেই হাতির আক্রমণে বহু কষ্ট ভোগ করেছে। সুতরাং, হোলংগাপার গিবন অভয়ারণ্যের পরিবেশ-সংবেদনশীল অঞ্চলে প্রস্তাবিত তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অসমের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।


নিজের ঘরে হুলক গিবন । ভিডিও: অরিজিৎ নাগ।



লেখক পরিচিতি:  অর্থশাস্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সঞ্জীব কুমার বরকাকতি শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নয়নমূলক বিষয়, সাহিত্য সমালোচনা, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে প্রায় পঁয়ষট্টিটি বই রচনা করেছেন। তিনি ‘সোসাইটি ফর শ্রীমন্ত শঙ্করদেব’ নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সভাপতি, যা মধ্যযুগের বহুমুখী প্রতিভা শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের আদর্শ প্রচারের জন্য কাজ করে।

 তিনি আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা IUCN-এর কমিশন অন এডুকেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন-এর সদস্য। এছাড়াও, তিনি ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস (ICOMOS)-এর সঙ্গে যুক্ত এবং এর আন্তর্জাতিক অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কমিটি ও আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক পর্যটন কমিটি-র একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য।


Comentarios


86060474-00b1-415d-8c11-9c4471c9c5e7.png
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG

Editor: Dr. Sumanta Bhattacharya
Co-editor: Dr. Oishimaya Sen Nag

  • Facebook

follow our facebook page to stay updated

© 2021 by Boney Pahare. All rights reserved.

bottom of page