top of page
  • ..

SHERNI: চিত্র সমালোচনা

বাঘ ও বন্যপ্রাণীকে বিষয় করে সম্প্রতি মুক্তি পেল আমাজন প্রাইমে বিদ্যা বালন অভিনীত 'শেরনি' সিনেমাটি। তারই আলোচনায় শমীক নন্দী




সিনেমা আমি শুধু বিনোদন হিসেবে দেখিনা, বেশ মন দিয়ে, খানিকটা সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই দেখে থাকি। এই প্রথম আমি একটি সিনেমা দেখলাম একটু অন্য চোখ দিয়ে। ঘটনাচক্রেই ক'দিন আগে 'বনে পাহাড়ে' ওয়েবজিনে ভারতের বাঘ সংরক্ষণের বিরাট কর্মকান্ড নিয়ে একটি বেশ তথ্যসমৃদ্ধ ইন্টারেস্টিং ধারাবাহিক রচনা পড়েছিলাম। 'শেরনি' দেখতে বসে প্রায় প্রতিটা ফ্রেমে ওই ধারাবাহিকটার কথা মনে পড়ছিলো।



ভারত সুবিশাল দেশ। কোটি কোটি মানুষের বাস৷ এই বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থান এবং আনুষঙ্গিক প্রয়োজনের হাত ধরে আসা 'উন্নয়নের' ঠেলায় বনজঙ্গল এবং বন্যপ্রাণীরা আজ যারপরনাই বিপর্যস্ত। একেবারে শহুরে বেড়ে ওঠা আর শহুরে দিনাতিপাতের মধ্যে এর বেশি বনের খবর আমরা ক'জন রাখি? না রাখতে পারি? না রাখতে চাই? সেখানে এই 'শেরনি' সিনেমাটি আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার এক দুর্দান্ত প্রচেষ্টা। সিনেমার শেষের দিকে বিদ্যা ভিনসেন্ট যখন তার উর্ধ্বতন অফিসারকে 'প্যাথেটিক' বলে, সেটা কি আমাকে আপনাকেই বলা নয়? একরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে 'শেরনি'-র মৃত্যুর কাহিনী বলে এই সিনেমা, তা কি আসলে একরকম ভাবে আমাদেরই ব্যর্থতা নয়? কোনো দায়ই কি নেই আমাদের? এই প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে জাগাতে সক্ষম হয়েছে অমিত মাসুরকরের এই নতুন প্রয়াস। 'নিউটন'-এর মতো সরকারি ভোট ব্যবস্থার দিকে প্রশ্ন তোলা সিনেমা বানানো পরিচালকের কাছ থেকে তো এটাই পাবার কথা।


সিনেমার শেষের দিকে বিদ্যা ভিনসেন্ট যখন তার উর্ধ্বতন অফিসারকে 'প্যাথেটিক' বলে, সেটা কি আমাকে আপনাকেই বলা নয়? একরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে 'শেরনি'-র মৃত্যুর কাহিনী বলে এই সিনেমা, তা কি আসলে একরকম ভাবে আমাদেরই ব্যর্থতা নয়?


প্রথম দৃশ্যেই দেখতে পাই উর্দিধারি এক ব্যক্তির মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বাঘের চালে হেঁটে চলা। পরে বুঝতে পারি আর কিছুই না, বাঘ ট্র‍্যাকিং-য়ের ক্যামেরা ট্র‍্যাপ পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। প্রথম থেকেই বোঝা যায় যথেষ্ট পড়াশোনা করে বানানো এই সিনেমা, কারণ ঠিক এই ধরনের ক্যামেরা ট্র‍্যাপই ব্যবহার করা হয় বাঘ-সুমারীর কাজে। ঠিক জানা নেই, মনে হলো বেশ কিছু পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রী হয়তো বা আসলেই বন জঙ্গলের মানুষ, এইসব কাজেই হয়তো বা আছেন, তারা অভিনয় করছেন বলে মনেই হয়নি। যে বলিউড এখনো নাকেমুখে নল গুঁজেই ক্রিটিকাল পেশেন্ট বুঝিয়ে দেয় তাদের পক্ষে এ তো বিরাট ব্যাপার। সত্যি বলতে কি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের টেকনিকাল দিকগুলো খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সাথে, কারণ এরকম সিনেমার ক্ষেত্রে সবসময়ই একটা সম্ভাবনা থেকে যায় ডকুমেন্টারি ধাঁচের হয়ে যাওয়ার। বস্তুত এই সিনেমাটিতে ক'দিন আগেই ঘটে যাওয়া নৃশংস T1 বা 'Avni' নামক বাঘিনী হত্যার ঘটনাটিরই যেন ছায়া। শুধু T1 এখানে হয়ে গেছে T12।



একটি বাঘ কেন হঠাৎ করে মানুষখেকো হয়ে ওঠে, এই সিনেমায় সেটা খুব সূক্ষভাবে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। বন-জঙ্গুলে এলাকায় মানুষ আর বন্যপ্রাণী নিজের নিজের দূরত্ব বজায় রেখেই চলে। নেহাৎই ঘটনাচক্রে মানুষ ঢুকে পড়ে, বা বলা যায় জীবিকার প্রয়োজনে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয় বাঘের এলাকায় এবং তার শিকার হয়। প্রথমে যা ছিলো নেহাৎই দুর্ঘটনা তা-ই হঠাৎ করে হয়ে ওঠে আসন্ন ভোটের ইস্যু। বাঘ মানুষখেকো হয়ে উঠেছে এবং একমাত্র তার কাছেই এর সমাধান আছে, এরকম ভাব করে ভোটের ময়দানে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে দুই যুযুধান রাজনৈতিক পক্ষই। উপুর্যুপরি বাঘটিকে খাঁচায় টোপ দিয়ে ধরার আর ঘুমপাড়ানি গুলি করে ধরার বনবিভাগের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার, বা বলা ভালো ব্যর্থ করে দেওয়ার পরে আসরে নামেন জনৈক সিভিলিয়ান বাঘ-শিকারী, যিনি নিজের পরিচয় দেন একজন 'কনসারভেনিস্ট' হিসেবে যিনি নাকি আজ অবধি কোনো বাঘই জীবিত ধরতে পারেননি! তারপর আর কি, চূড়ান্ত ডামাডোলের মধ্যে একরকম সরকারি শিলমোহর লাগিয়ে হত্যা করা হয় বাঘটিকে! না টিপিকাল বলিউডি ঢঙে বিদ্যা বালন নামক কোনো 'শেরনি'ও পারেননি এই মর্মান্তিক পরিণতি আটকাতে।


সিনেমাটি নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই আসে অভিনয়ের কথা। কাজের জায়গায় একরকম হাত পা বাঁধা কিন্তু আদতে নির্ভীক আপোষহীন ফরেস্ট অফিসার বিদ্যা ভিনসেন্ট-এর রোলে বিদ্যা বালন এক কথায় অনবদ্য । নতুন চাকরির পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা, শহর ছেড়ে একা থাকা, চেয়েও চাকরি ছাড়তে না পারার মতো বিদ্যা ভিনসেন্টের চরিত্রটির ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েনের সাথে সুন্দর ব্যালেন্স রাখে গল্পের বাঘিনীর শেষ পরিনতি। বিশেষ করে বলতে হয় বেসরকারি শিকারী পিন্টু ভাইয়ার রোলে শারদ সাক্সেনার কথা। দর্শকের সবটুকু ঘৃণা থাকবে তার জন্য, এতোটাই নিখুঁত অভিনয়। আর ভালোর দলের হাসান নুরানি হিসেবে বিজয় রাজ বা খারাপের দলের রাজনীতিকদের পা-চাটা সিনিয়র ফরেস্ট অফিসার বনসল হিসেবে ব্রিজেন্দ্র কালা একেবারে যথাযথ। ছোট চরিত্রে জাত চিনিয়েছেন নীরজ কবিও।



সিনেমাটির আরেক সম্পদ এর সিনেম্যাটোগ্রাফি। জঙ্গলের ড্রোন শট, সবুজের সমাহার ইত্যাদি তো আছেই, মনে থেকে যাবে শেষের দিকে গুহার মধ্যে আটকে থাকা ব্যাঘ্র-শাবক দুটির দৃশ্যটিও। আর পরিচালক জাত চিনিয়েছেন প্রথম আর শেষ শটে। প্রথমটির কথা আগেই বলেছি। শেষ সিনে আমরা বিদ্যা ভিনসেন্টকে দেখি তার নতুন কর্মস্থলে, সেখানেও তার চারদিকে অনেক জীবজন্তু, তফাৎ একটাই, তারা সবাই ট্যাক্সিডার্মি করা।



আর অবশ্যই বলতে হয় ভারতের ব্যাঘ্র সংরক্ষণের সমস্যাগুলোর কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরার কথা। Human-wildlife conflict যে সংরক্ষণের কাজে একটা বড় বাধা সেটাই যেন সিনেমাটির মূল উপজীব্য। তার সাথে আছে অযোগ্য আধিকারিক, রাজনীতিক আর মিডিয়ার সুবিধাবাদ। খুব subtly এসেছে 'বিকাশের' সাথে সাথে ক্রমঃহ্রাসমান আন্তরাজ্য জঙ্গল করিডোরের সমস্যার প্রসঙ্গও।



এই সিনেমাও একরকম হ্যাপিলি এভার আফটারের গল্পই বলে। শেষে দেখি বিদ্যা ভিনসেন্টের চেয়ারে এসে বসেন নতুন আধিকারিক, তার সামনে অধস্তনরা সেই একই গল্প ফেঁদে বসেন যা বিদ্যাকেও শুনতে হয়েছিলো! মানে সোজা কথা কিছুই পাল্টায়না। হ্যাপিলি এভার আফটার টিঁকে থাকে সেই একই ঘুণধরা সিস্টেমই। এই সিনেমা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সিস্টেমের লড়াইতে সিস্টেমের জিতে যাওয়ার গল্পই বলে। এমন এক গল্প যা আমাদের চোখ খুলে দিতে চায়। তাই শেষ অবধি জিত সিনেমারই।


লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় চিকিৎসক। নেশায় একজন সিনেফাইল।




314 views2 comments
Royal_Bengal_Tiger_Kanha.JPG
bottom of page